আহলে কিতাবীদের মাঝে কেয়ামত পর্যন্ত শত্রুতা সঞ্চারিত থাকা

0
আহলে কিতাবীদের মাঝে কেয়ামত পর্যন্ত শত্রুতা সঞ্চারিত থাকা

আহলে কিতাবীদের মাঝে কেয়ামত পর্যন্ত শত্রুতা সঞ্চারিত থাকা ও একটি প্রশ্নের উত্তর

এধরণের প্রশ্ন সাধারণত কাদিয়ানীরাই উত্থাপন করে থাকে। তাদের এ ধরনের প্রশ্নের অন্তরালে একটা মতলব থাকে। সেটি হচ্ছে, কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে ও শেষ যুগে আগমনকারী ঈসা (আ.)-এর মৃত্যুর আগে আগেই সমস্ত আহলে কিতাবী মুসলমান হয়ে যাওয়া’র বিষয়টিকে কুযুক্তির আড়ালে অস্বীকার করতে চাওয়া। যেহেতু সূরা নিসা আয়াত নং ১৫৯ বলছে, ঈসা (আ.)-এর মৃত্যুর আগে আগেই তারা প্রত্যেকে ঈমান গ্রহণ করবে। এখন পবিত্র কুরআনের এ ভবিষ্যৎবাণী সরাসরি অস্বীকার করার সাধ্য কার? মূলত এ জন্যই ওরা কুযুক্তির আশ্রয় নেয় এবং উল্লিখিত শিক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে থাকে।

কিন্তু প্রশ্ন হল, তাদের এ ধরনের মতলবসিদ্ধ বিশ্বাস ধারণ ও অনুরূপ কুযুক্তির পেছনে দৌড়ানোর কারণ কী?

উত্তর হচ্ছে, মির্যা কাদিয়ানী (জন্ম-মৃত্যু ১৮৩৯-১৯০৮ইং) কুরআন ও হাদীসের আলোকে নিজেকে প্রতিশ্রুত মসীহ তথা হযরত ঈসা (আ.) বলে দাবী করেছে আর কাদিয়ানী তথা কথিত আহমদীয়া সম্প্রদায় তাকে সেভাবেই মেনে আসছে। কাজেই এখন সহজেই প্রশ্ন উঠবে, মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজ দাবীতে যদি সত্যিকারের সেই মসীহ তথা ইবনে মরিয়ম হন তাহলে তো পবিত্র কুরআনের (৪:১৫৯/নিসা) উল্লিখিত শিক্ষা অনুসারে বর্তমান দুনিয়ায় আর কোনো আহলে কিতাবী (ইহুদী খ্রিস্টান) না থাকারই কথা, সকলে ঈমান গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে যাওয়ারই কথা! কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ এ সমস্ত যৌক্তিক যে কোনো প্রশ্নের সম্মুখে সম্পূর্ণ কোনঠাসা। এমতাবস্থায় তাদের জন্য আয়াতটির উল্লিখিত শিক্ষায় অপব্যাখ্যার আশ্রয় নেয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় থাকেনা। মজার ব্যাপার হল, তাদের ন্যায় অনুরূপ কোনো ব্যাখ্যা ইসলামের বিগত চৌদ্দশত বছরেও নির্ভরযোগ্য কোনো সোর্স দ্বারা প্রমাণিত নয়।

তাদের সেই কুযুক্তি ও অপব্যাখ্যাটা কী?

তাদের সেই কুযুক্তি ও অপব্যাখ্যাটি হচ্ছে এ রকম, তারা যুক্তি দেয় যে, হযরত মসীহ তথা ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:)-এর যুগে এবং তাঁরই মৃত্যুর আগে সমস্ত আহলে কিতাবী (ইহুদ-খ্রিস্টান) মুমিন হয়ে গেলে তখন পবিত্র কুরআনের (০৫:৬৪/মায়েদা) আয়াত অনুসারে আহলে কিতাবীদের মাঝে إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ তথা ‘কেয়ামত পর্যন্ত’ শত্রুতা সঞ্চারিত থাকে কিভাবে? সুতরাং বুঝা গেল, ঈসা (আ.)-এর মৃত্যুর আগে আগেই সমস্ত আহলে কিতাবী ঈমান গ্রহণের শিক্ষাটি একটি রূপক, বাস্তব নয়। (এ ছিল তাদের কুযুক্তি ও কুরআন বিরোধী চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ ধর্মবিশ্বাস)।

  • আল্লাহতালা ইরশাদ করেছেন : وَإِن مِّنۡ أَهۡلِ ٱلۡكِتَٰبِ إِلَّا لَيُؤۡمِنَنَّ بِهِۦ قَبۡلَ مَوۡتِهِۦۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يَكُونُ عَلَيۡهِمۡ شَهِيدٗا 

অনুবাদঃ কিতাবীদের যত দল আছে তারা অবশ্যই ঈসার প্রতি তাঁর মৃত্যুর পূর্বে ঈমান আনবে। আর কেয়ামতের দিন তিনি ওদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হবেন (অর্থাৎ তিনি ওদের অবস্থা ও আমল প্রকাশ করে বলবেন যে, ইহুদীরা আমাকে মিথ্যাবাদী বলেছিল আর খ্রিস্টানরা আমাকে আল্লাহর পুত্র বলেছিল)। (তাফসীরে উসমানী, আল্লামা জাস্টিস মুফতি তকি উসমানী হতে অনুবাদ চয়িত)। (সূরা নিসা ১৫৯)।

  • আল্লাহতালা ইরশাদ করেছেন : وَقَالَتِ ٱلۡيَهُودُ يَدُ ٱللَّهِ مَغۡلُولَةٌۚ غُلَّتۡ أَيۡدِيهِمۡ وَلُعِنُواْ بِمَا قَالُواْۘ بَلۡ يَدَاهُ مَبۡسُوطَتَانِ يُنفِقُ كَيۡفَ يَشَآءُۚ وَلَيَزِيدَنَّ كَثِيرٗا مِّنۡهُم مَّآ أُنزِلَ إِلَيۡكَ مِن رَّبِّكَ طُغۡيَٰنٗا وَكُفۡرٗاۚ وَأَلۡقَيۡنَا بَيۡنَهُمُ ٱلۡعَدَٰوَةَ وَٱلۡبَغۡضَآءَ إِلَىٰ يَوۡمِ ٱلۡقِيَٰمَةِۚ كُلَّمَآ أَوۡقَدُواْ نَارٗا لِّلۡحَرۡبِ أَطۡفَأَهَا ٱللَّهُۚ وَيَسۡعَوۡنَ فِي ٱلۡأَرۡضِ فَسَادٗاۚ وَٱللَّهُ لَا يُحِبُّ ٱلۡمُفۡسِدِينَ

অনুবাদঃ ইহুদীরা বলে আল্লাহর হাত রুদ্ধ। ওদেরই হাত রুদ্ধ হয়ে যাক এবং ওরা যা বলেছে তার কারণে ওদের প্রতি লা’নত বর্ষিত হোক। বরং আল্লাহর উভয় হাত প্রসারিত, তিনি যেভাবে ইচ্ছে ব্যয় করেন। আর আপনার রবের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে নিশ্চয়ই তা অনেকের অবাধ্যতা ও কুফুর বাড়িয়ে দেবে এবং আমি কেয়ামত দিবস পর্যন্ত ওদের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করে দিয়েছি। যখনি তারা যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলিত করে আল্লাহ তা নিবিয়ে দেন। আর ওরা যমীনে ফাসাদ করার উদ্দেশ্যে দৌড়ঝাঁপ করে। অথচ আল্লাহ ফাসাদকারীদের পছন্দ করেন না। (তাফসীরে উসমানী, আল্লামা জাস্টিস মুফতি তকি উসমানী হতে অনুবাদ চয়িত)। (সূরা মায়েদা ৬৪)।

যাইহোক, এখন কাদিয়ানীদের উল্লিখিত কুযুক্তির উত্তর দেয়া হবে। তাদের প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, পবিত্র কুরআনের ০৫:৬৪ আয়াত অনুসারে ‘কেয়ামত পর্যন্ত’ বলে মূলত ‘সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত’ সময়ের বিশালতাকেই বুঝানো উদ্দেশ্য। যেহেতু সময়ের বিশালতাকে বুঝাতে ‘কেয়ামত পর্যন্ত’ কথাটি একধরণের বাগধারা ও একটি বালাগাত তথা অলংকারপূর্ণ বাণী। যেমন, সাজেদ তার পরম বন্ধু মাজেদকে বলল, তুই ‘কেয়ামত পর্যন্ত’ চেষ্টা করলেও চেয়ারম্যান নির্বাচনে জয়ী হতে পারবিনা।

খেয়াল করুন, ‘কেয়ামত পর্যন্ত’ বলতে সাজেদ মোটেও এটা বুঝাতে চায়নি যে, সে প্রকৃতপক্ষে কেয়ামতের শিঙ্গাফুঁক দেয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকবে! কারণ বাগধারাকে সাধারণ অর্থে বিচার করা যায়না।

এবার আরেকটু খোলাসা করছি! হাদীসে আসছে, বিশিষ্ট সাহাবী হযরত জাবির ইবনু আব্দিল্লাহ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ((لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ)) অর্থাৎ আমার উম্মতের একটি জামাত সর্বদাই সত্যের স্বপক্ষে ক্বিতাল করে কিয়ামত পর্যন্ত বিজয় হতে থাকবে। (সহীহ মুসলিম ৪৮০১ ইফা)। এখানেও ‘কেয়ামত পর্যন্ত’ শব্দ চয়িত হয়েছে। পক্ষান্তরে অপর আরেকটি হাদীসের শেষাংশে উল্লেখ আছে যে, যখন ঈসা (আ.) দ্বিতীয়বার আসবেন তখন ((و تَضَع الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا)) অর্থাৎ যুদ্ধ আপনা সমস্ত সমরাস্ত্র গুটিয়ে নেবে (মুসনাদে আহমদ হা/৯১১৭)। এবার তাহলে ক্বিতাল (সশস্ত্র ধর্মযুদ্ধ) ‘কেয়ামত পর্যন্ত’ চলবে, এর কী অর্থ দাঁড়াল? যে ক্বিতাল কেয়ামত পর্যন্ত অবিরাম চলতে থাকবে বলা হল, সেই ক্বিতাল হযরত ঈসা (আ:)-এর যুগে কোনো কাফের বাহিনী না থাকায় আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যাবে; এইরূপ উল্লেখ থাকাটাই কি প্রমাণ করে না যে ‘কেয়ামত পর্যন্ত’ বলে মূলত ‘সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত’ সময়ের বিশালতাই উদ্দেশ্য!

শেষকথাঃ পবিত্র কুরআন আর অসংখ্য সহীহ হাদীসের বিরুদ্ধে গিয়ে কারো জন্য এমন কোনো যুক্তি দাঁড় করা ঠিক হবেনা যা ইজমায়ে উম্মতের সুপ্রতিষ্ঠিত ও তাওয়াতূর পর্যায়ের আকীদার পরিপন্থী। আসল কথা হল, যারা কুরআনকে নিজের মনগড়া যুক্তি দিয়ে বুঝতে চায় তারাই পথভ্রষ্ট হয়। কেননা কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক ছিলেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে কুরআন যেভাবে শিক্ষা দিয়ে গেছেন, তারপর সাহাবীরা পরবর্তী প্রজন্মকে তথা তাবেয়ীদের যা শিক্ষা দিয়ে গেছেন, অনুরূপ তাবেয়ীগণ তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে তথা তাবে-তাবেয়ীগণকে যা শিক্ষা দিয়ে গেছেন সেসব শিক্ষা-দীক্ষাকে বিশুদ্ধ সনদ ও ধারাবাহিক বর্ণনাসূত্রে নির্ভরযোগ্য তাফসীরকারকগণ স্ব স্ব তাফসীর গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। কাজেই বর্তমানে কোনো ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর এমন কোনো ব্যাখ্যা বা শিক্ষা গ্রহণযোগ্য হবেনা যেটির কোনো সনদ নেই কিংবা নির্ভরযোগ্য তাফসীর হতে বিশুদ্ধসূত্রে প্রমাণিত নয়। কাদিয়ানী সহ তাবৎ পথভ্রষ্ট গোষ্ঠীর সমুদয় ধর্মমত ও শিক্ষা-দীক্ষা মূলত এ সমস্ত কারণেই বাতিল ও প্রত্যাখ্যাত।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here