কাদিয়ানী বয়ানের উপর পালটা কিছু বয়ান
((বয়ান-১))
আপনি যখনি কাদিয়ানীদের সাথে কথা বলবেন তারা তখনি আপনার প্রতি যে বয়ানটি ছুড়ে দেবে সেটি হচ্ছে, কুরআন থেকে ঈসা (আ.)-কে জীবিত প্রমাণ করে দিন। যদি তা প্রমাণ করে দিতে পারেন, তাহলে আর কিছু বুঝাতে হবেনা; আমরা কাদিয়ানীয়ত ছেড়ে দেব। ধারণা করা হয় যে, কাদিয়ানীদের সো-কল্ড চতুর্থ খলীফা মির্যা তাহের আহমদই এ বয়ানের প্রবর্তক। এর আগে কাদিয়ানীদের বয়ান ছিল, ইস্তিখারা করে আল্লাহর কাছ থেকে সমাধান চেয়ে নিন। তিনিই উত্তম সমাধানকারী। বর্তমানেও মাঝেমধ্যে তাদের অনেককে পুরনো এ বয়ানের পেছনে ছুটতে দেখা যায়। আসুন, এবার তাদের উদ্দেশ্যে আমাদের পালটা কিছু বয়ান এখানে উত্থাপন করছি। আমাদের বয়ানগুলো এই যে,
(১) নবুওয়তের দাবীদার গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে শুধুমাত্র একজন ‘সত্যবাদী’ ও ‘আমানতদার’ সাব্যস্ত করে দেখান। তাহলে আর কিছুই করতে হবেনা। আমরা তার সততা আর যোগ্যতার ভিত্তিতেই তার নবুওয়ত দাবীর বৈধতা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) এর শিক্ষার আলোকে যাচাই করে দেখব। যদি সে নবী হিসেবে সাব্যস্ত হয়ে যায় তাহলে সে ঈসা (আ.) সম্পর্কে আরও যা যা দাবী করে লিখে গেছে আমরা তার সবগুলো দাবী বিনাবাক্যে মেনে নেব। আসুন, তার আগে আপনারা গোলাম আহমদ ইবনে চেরাগবিবিকে শুধুমাত্র একজন ‘সত্যবাদী’ ও ‘আমানতদার’ সাব্যস্ত করতে সংলাপে বসুন। আমরা তারই রচনাবলীর আলোকে তাকে চরম মিথ্যাবাদী ও ধোকাবাজ সাব্যস্ত করব আর আপনারা সেগুলোর খন্ডন করে তাকে ন্যূনতম একজন সৎ মানুষ হিসেবে প্রমাণ করে দেখাবেন।
(২) আপনারা কথায় কথায় ঈসা (আ.) এর বাঁচা-মরা প্রসঙ্গ টেনে আনেন, যা আপনাদের শেষনবী গোলাম আহমদ ইবনে চেরাগবিবির শিক্ষারই বিপরীত। কেননা গোলাম আহমদ ইবনে চেরাগবিবি ‘দাফেউল বালা’ বইতে লিখে গেছে, “ঈসা ইবনে মরিয়মের আলোচনা বাদ দাও, তার চাইতে উত্তম গোলাম আহমদ কাদিয়ানী”। দেখুন, সে ঈসা (আ.) এর আলোচনা বাদ দিতে বলছে আর আপনারা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর শিক্ষার বিরুদ্ধে গিয়ে ঈসা (আ.) এর আলোচনা টেনে আনছেন! সুতরাং আপনাদের বয়ান ঠিক নাই, আগে বয়ান ঠিক করুন, তারপর না হয় সো-কল্ড মসিহি জমাতের তাবলীগ করতে আসবেন।
(৩) ঈসা (আ.)-কে কুরআন দ্বারা জীবিত প্রমাণ করতে বলছেন। আরে ভাই, মির্যা গোলাম আহমদ ইবনে চেরাগবিবি তো নিজেই ১৮৮৪ সালে তার ‘বারাহীনে আহমদীয়া’ (৪র্থ খন্ড) গ্রন্থে পবিত্র কুরআনের সূরা তওবাহ, আয়াত নম্বর ৩৩ (هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ) দ্বারা দলীল দিয়ে লিখে গেছে যে, এই আয়াতে ইংগিতে একখানা ভবিষ্যৎবাণী রয়েছে যে, মসীহ (ঈসা) এই পৃথিবীতে সশরীরে (جسمانى) এবং রাজনৈতিক দর্পনেই (سياست ملكى) পুনরায় আসবেন।
বারাহীনে আহমদীয়া গ্রন্থে গোলাম আহমদ ইবনে চেরাগবিবির লিখাটি এইরূপ,
اور فرقانی اشارہ اس آیات میں ہیں : هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ یہ آیات جسمانی اور سیاست ملکی کے طور پر حضرت مسیح کی حق میں پیشگوئی ہیں اور جس غلبہ کاملہ دین اسلام کا وعدہ دیا گیا ہے وہ غلبہ مسیح کے ذریعہ سے ظہور میں آئے گا اور جب حضرت مسیح علیہ السلام دوبارہ اس دنیا میں تشریف لائیں گے تو ان کے ہاتھ سے دین اسلام جمیع آفاق اور اقطار میں پھیل جائے گا لیکن اس عاجز پر ظاہر کیا گیا ہے کہ یہ خاکسار اپنی غربت اور انکسار اور توکل اور ایثار اور آیات اور انوار کے رو سے مسیح کی پہلی زندگی کا نمونہ ہے اور اس عاجز کی فطرت اور مسیح کی فطرت باہم نہایت ہی متشابہ واقع ہوئی ہے گو ایک ہی جوہر کے دو ٹکرے یا ایک ہی درخت کے دو پہل ہیں۔ براہین احمدیہ حصہ چہارم ؛ روحانی خزائن ۱:۵۹۳
(অর্থ-…..) ঐশী ইংগিত এই আয়াতগুলিতে রয়েছে যে, “তিনিই তাঁর রাসূলকে হেদায়েত এবং সত্য ধর্ম সহকারে প্রেরণ করেছেন, যাতে এটিকে সকল ধর্মের উপর প্রকাশ করা যায়, যদিও মুশরিকরা এটিকে অপছন্দ করে।” এই আয়াতগুলি শারীরিক এবং রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই মসীহের পক্ষে একটি ভবিষ্যদ্বাণী। আর ইসলাম ধর্মের পরিপূর্ণ বিজয় প্রতিশ্রুত মসীহের বিজয়ের মাধ্যমেই প্রকাশিত হবে। আর হযরত মসীহ (ঈসা) দুনিয়ার বুকে আবার যখন আসবেন তখন তাঁর হাত ধরেই ইসলাম ধর্ম পৃথিবীর সকল প্রান্তে এবং সকল দেশে ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু এই অধমের নিকট এটা প্রকাশ পেয়েছে যে, এই অধম মানুষটি তার দারিদ্র্য, নম্রতা, আস্থা, ত্যাগ, নিদর্শন এবং নূর সমূহের মাধ্যমে মসীহের প্রথম জীবনেরই একটি নমুনা। আর এই নম্র মানুষের স্বভাব এবং মসীহের স্বভাব খুবই মিল, যেন তারা একই সত্তার দুটি টুকরো অথবা একই গাছের দুটি শাখা। (বারাহীনে আহমদীয়া, ৪র্থ খন্ড, রূহানী খাযায়েন : ৩/৫৯৩)।
এখন কথা হল, আপনারা কুরআন থেকে যে জিনিসটা সাব্যস্ত করতে বলছেন সেটা তো আপনাদের সো-কল্ড মসীহ গোলাম আহমদ ইবনে চেরাগবিবি অনেক আগেই করে দিয়ে গেছেন। তাহলে এখন আবার নতুন করে কী প্রমাণ করার কথা বলছেন? আসুন, যেটা প্রমাণ করতে বলছেন সেটা যখন প্রমাণ হয়েই আছে তখন আমরা আজকে আপনাদের নিকট জানতে চাইব যে, এখন গোলাম আহমদ কাদিয়ানী সাহেব নিজে “ইবনে চেরাগবিবি” থেকে কিভাবে “ঈসা ইবনে মরিয়ম” হয়ে গেলেন?
(৪) আপনি বললেন, ঈসা (আ.)-কে কুরআন থেকে জীবিত প্রমাণ করে দিতে। আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি তর্কের খাতিরে আপনার সাথে একমত হলাম যে, ঈসা (আ.) বেঁচে নেই। এখন আপনি আমাকে বলুন, ঈসা (আ.) বাঁচা-মরার সাথে গোলাম আহমদ ইবনে চেরাগবিবির “ঈসা” দাবী করার কী সম্পর্ক? সে কিভাবে ঈসা ইবনে মরিয়ম হল? ইতিপূর্বে তো বাহাউল্লাহ ইরানীও একই বয়ান দিয়েছে এবং নিজেকে ঈসা বলেও দাবী করেছে। কাজেই কেউ ঈসা দাবী করলেই সে যদি সত্যিকার অর্থে ঈসা হয়ে যেত তাহলে তো গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর জন্মের আগে থেকেই বাহাউল্লাহ ইরানীকে “ঈসা মসীহ” মানতে হবে। আপনি কি তাকেও ঈসা মসীহ মানেন?
(৫) ঈসা (আ.) যদি আপনাদের বিশ্বাসমতে মৃত্যুবরণ করে থাকেন, তাহলে প্রশ্ন হল বর্তমানে ঈসা মসীহ (আ.) এর সমাধি তথা কবর কোথায়? আসুন দেখা যাক গোলাম আহমদ ইবনে চেরাগবিবির রচনাবলীতে ঈসা মসীহ (আ.) এর কবরের সন্ধান কিভাবে দেয়া হয়েছে!
সে এক জায়গায় লিখেছে,
اور کیا تعجب کہ حضرت مسیح کی قبر کشمیر یا اس کے نواح میں ہو
অর্থাৎ কি যে আশ্চর্যের ব্যাপার যে, হযরত মসীহ’র কবর কাশ্মীর অথবা তার আশপাশে (তিব্বতে) অবস্থিত। (রূহানী খাযায়েন খণ্ড ১০ পৃষ্ঠা নং ৩০২)।
এতে বুঝা গেল, সে নিজেও কনফিউশানে ছিল। সে তিব্বতে নাকি কাশ্মীরে, কোনটা বলবে নিজেও ঠিক পায়নি।
সে আরেক জায়গায় লিখেছে,
یہ تو سچ ہے کہ مسیح اپنے وطن گلیل میں جا کر فوت ہو گیا ۔ لیکن یہ ہرگز سچ نہیں کہ وہی جسم جو دفن ہو چکا تھا پھر زندہ ہو گیا۔
‘সত্য তো এটাই যে, মসীহ (ঈসা) আপনা মাতৃভুমি গ্যালীলে (সিরিয়া) গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু তাঁর ঐ দেহ যেটি (সেখানে) দাফন হয়েছিল তা আবার জীবিত হয়ে যাওয়া একদমই সত্য নয়।’ (ইযালায়ে আওহাম ২য় খন্ড, রূহানী খাযায়েন: ৩/৩৫৩; রচনাকাল ১৮৯১ইং)।
সে আরেক জায়গায় লিখেছে,
حضرت عیسی علیہ السلام بیت اللحم میں پیدا ہوئے اور بیت اللحم اور بلدہ قدس میں تین کوس کا فاصلہ ہے اور حضرت عیسی علیہ السلام کے قبر بلدہ قدس میں ہیں اور اپ تک موجود ہیں اور اس پر ایک گرجا بنا ہوا ہے اور وہ گرجا تمام گرجاؤں سے بڑا ہیں اور اس کے اندر حضرت عیسی کی قبر ہے اور اسی گرجا میں حضرت مریم صدیقہ کی قبر ہے اور دونوں قبرین علیحدہ علیحدہ ہیں۔ اتمام الحجہ روحانی خزائن ۸: ۲۹۹
অর্থাৎ…. হযরত ঈসা (আ.) এর কবর ‘ফিলিস্তিন’ এর বায়তুল মোকাদ্দাসের আঙ্গিনায়। (দেখুন, ইতমামুল হুজ্জাত, রূহানী খাযায়েন খণ্ড নং ৮ পৃষ্ঠা নং ২৯৯ [টিকা দ্রষ্টব্য])।
এখন প্রশ্ন হল, ঈসা (আ.) গোলাম আহমদ ইবনে চেরাগবিবির দাবীমতে মৃত্যুবরণ করার বিশ্বাস সঠিক হলে, তখন ঈসা (আ.) এর কবর সম্পর্কে সে যা যা লিখে গেছে সবগুলোকে সঠিক বলতে হবে। এখন আপনারা কি ঈসা (আ.) এর কবর ‘বায়তুল মোকাদ্দাসের আঙ্গিনায়, সিরিয়ার গ্যালিল জনপদে, তিব্বত এলাকায় কিংবা কাশ্মীরের শ্রীনগরে’ অর্থাৎ একসাথে সবখানে মানেন? হাস্যকর!
(৬) আপনারা গোলাম আহমদ ইবনে চেরাগবিবিকে ‘নবী’ মানেন, কিন্তু কিসের ভিত্তিতে তা মানেন সেটা ক্লিয়ার করেন না। কখনো বলেন, শেষ যামানায় ঈসা মসীহ আসবেন আর হাদীসে তাঁকে চার-চার বার نبى الله عيسى (আল্লাহর নবী ঈসা) অর্থাৎ “নবী” শব্দে সম্বোধন করা হয়েছে। গোলাম আহমদ ইবনে চেরাগবিবি নিজেকে ঐ ঈসা মসীহ দাবী করায় নাকি আপনারা তাকে নবী মানেন! আবার কখনো সূরা নিসার ৬৯ নম্বর আয়াতের من النبيين و الصديقين দ্বারাও আনুগত্যরূপে নবী হওয়া যায় বলে তাকে ‘নবী’ আখ্যা দেন। আবার দেখা যায় যে, সূরা জুমা’র وآخرين منهم لما يلحقوبهم দ্বারাও ব্যাখ্যা দেন এ বলে যে, এ আয়াতে শেষ যামানায় মুহাম্মদ (সা.)-কে আল্লাহ নাকি জীবিত করে দুনিয়ায় আরেকবার পাঠানোর কথা বুঝিয়েছেন (নাউজুবিল্লাহ), সে হিসেবে নাকি গোলাম আহমদ ইবনে চেরাগবিবিকে আপনারা ‘নবী’ এমনকি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ-ও মানেন! আমার জানা নেই যে, আসলে এখানে আপনাদের শেষ কথাটা কী!
সে যাইহোক; তাকে যে দিক থেকেই হোক ‘নবী’ মানেন এটি যখন সাব্যস্ত হয়ে গেল, তখন আপনাদের একখানা প্রশ্ন করা উচিত বলে মনে করছি তা হচ্ছে,
আপনারা মৃত্যুর পর কবরের ফেরেশতার و من نبيك অর্থাৎ তোমার নবী কে? প্রশ্নের উত্তরে কার নাম বলবেন? গোলাম আহমদ ইবনে চেরাগবিবির নাম বলবেন? নাকি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম বলবেন? যেহেতু গোলাম আহমদ নিজেকে শেষনবী হওয়ার দাবীও করেছে, (দেখুন, তাযকিরাতুশ শাহাদাতাই-৮২ বাংলা অনূদিত) সেহেতু তাকে ছাড়া আপনারা দ্বিতীয় কারো নাম ফেরেশতার প্রশ্নের উত্তরে উত্থাপন করতে পারেন না।
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক
প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী এম.এ