Home Blog

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে কাদিয়ানীরা লজ্জিত কেন?

0

কাদিয়ানী সম্প্রদায় দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এতটা লজ্জিত কেন?

কাদিয়ানীদের অন্যতম শুভাকাঙ্ক্ষী শেখ হাসিনা সরকারের পতন হল। তিনি দেশ ছেড়েও পালিয়েছেন। তার পালিয়ে যাওয়ার পরপরই, একে একে তাদের অন্যান্য প্রায় সকলেই এখন নিয়মিত কট খাচ্ছেন। কাদিয়ানীদের অন্যতম সহযোগী জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু, রাশেদখান মেনন আর এখন সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক-ও। ডক্টর কামাল হোসেন এবং তার কন্যা বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের ব্যারিষ্টার সারা হোসেন-ও কাদিয়ানীদের অন্যতম সহযোগী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রুবাইয়াত ফেরদৌস সহ কাদিয়ানীদের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয়া অসংখ্য কথিত সুশীল বুদ্ধিজীবীর চেহারাগুলোও কারো অচেনা নয়। গাদানিক প্রধান শাহরিয়ার কবির, সুলতানা কামাল, খুশি কবিরদের কথা আর না হয় না-ই বললাম। খুবই আশ্চর্য ব্যাপার, আল্লাহর রাসূলের খতমে নবুওয়তের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহকারী কাদিয়ানীদের সহযোগীরা হঠাৎ যেন বাতাসে মিশে গেছে!

কাদিয়ানীরা স্বৈরাচারী আ’লীগ সরকারের প্রভাব এবং ক্ষমতা খাটিয়ে বহু ফায়দা নেয়। সেই ইতিহাস আজ আর কারো অজানা নয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে গত ১৫ বছর ধরে “মসজিদ” নাম দিয়ে যে পরিমাণে “কাদিয়ানী উপাসনালয়” তারা নির্মাণ করেছে, কল্পনারই বাহিরে। গাজীপুরে (রাজবাড়ী মাঠ সংলগ্ন গাজীপুর মহিলা কলেজের পূর্ব পাশ হয়ে সাফা টাওয়ারের দক্ষিণে) ইতিমধ্যে তারা ৫ কাঠা জমির উপর মসজিদ নামে তাদের বিশালাকৃতির ৫ তলা কমপ্লেক্স ও মিশনারী হেড কোয়ার্টার করার উদ্যোগও নিয়েছে। কিন্তু এ খবর কয়জনই বা রাখে! তাদের প্রতি আ’লীগ সরকার নাগরিক অধিকারের নামে এত অন্ধ ছিল, স্থানীয় মুসলমানদের কোনো যৌক্তিক দাবী কিংবা প্রতিবাদের সামান্যতমই তোয়াক্কা করেনি। বরং স্থানীয় মুসলমানদের নির্বিচারে গুলিতে আহত এবং নিহত করা হয়। গত ২০২৩ সালের ৫ ই মার্চ এবং ২৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে পঞ্চগড়ের (সদর) আহমদনগরের স্থানীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে ও কাদিয়ানীদের পক্ষে সেই সময়কার স্বৈরাচারী প্রশাসনিক মনোভাব আর রক্তক্ষয়ী সংঘাতের চিত্রগুলো ইন্টারনেটে আজো ভাসছে।

এদেশের কথিত সুশীল বুদ্ধিজীবীরা কি জানে যে, কাদিয়ানী সম্প্রদায় নিজেদের বাহিরে কোনো মুসলমানকেই “মুসলমান” মানেনা! বরং পরিষ্কার করে কাদিয়ানী লিটারেচার গুলোতে অ-কাদিয়ানী মুসলমানদের “অমুসলিম” এবং “কাট্টা কাফের” বলে লিখে রাখা হয়েছে, এমনকি মুসলমানদের নাবালক শিশুদের জানাযাতেও অংশগ্রহণ করতে কড়া নিষেধ করা হয়েছে। আর কারণ হিসেবে তাদেরই দ্বিতীয় খলীফা মির্যা বশির উদ্দীন মাহমুদ (মৃত. ১৯৬৪ ইং) লিখেছে,

“আমাদের জন্য ফরজ হচ্ছে, আমরা যেন গয়ের আহমদীদেরকে (অ-কাদিয়ানীদেরকে) মুসলমান মনে না করি এবং তাদের পেছনে সালাত না পড়ি। কেননা আমাদের দৃষ্টিতে তারা খোদাতালার একজন নবীকে অস্বীকারকারী। এটি ধর্মীয় মু’আমালা, এতে কিছু করার মত কারো কোনো এখতিয়ার বা সুযোগ নেই।” (আনওয়ারে খিলাফাত ৯৩ নতুন এডিশন, আনওয়ারুল উলূম ৩/১৪৮, মির্যা বশির উদ্দীন মাহমুদ)।

উক্ত উদ্ধৃতিটির প্রামাণ্য স্ক্যানকপি নিচে দেখুন

উল্লেখ্য, মির্যা বশির উদ্দীন মাহমুদ ছিল ভন্ডনবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর পুত্র ও তার জামাতের দ্বিতীয় খলীফা এবং কথিত ‘মুসলেহ মওউদ’ উপাধিপ্রাপ্ত। নিচে তার একটি ছবিও প্রদর্শন করা হল।

স্বৈরাচারী আ’লীগ দুঃশাসনের পতন হবার আগে কাদিয়ানী ন্যাশনাল আমীর আব্দুল আউয়াল খান সাহেব নিজেকে শেখ পরিবারের অন্যতম হিতাকাঙ্ক্ষী ও আত্মীয় বলেও পরিচয় দিতেন এবং জায়গামত মুসলমানদের বিরুদ্ধে তৎকালীন সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার করতেন। এর ভুরি ভুরি প্রমাণ আমাদের নিকট রেকর্ড রয়েছে। আজ আর সেই আত্মীয়ের আত্মীয়রা দেশ-ছাড়া। আখের আস্তে আস্তে ঝুঁকতে শুরু করেছেন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ডক্টর আসিফ নজরুল স্যার সহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়জন উর্ধতন ব্যক্তিবর্গের দিকে। আফসোস! ক্ষমতা পালাবদলের সাথে সাথেই এদের ডিগবাজীও শুরু। কিন্তু নতুন জেনারেশনের কি এদের নিয়ে কোনো খোঁজখবর আছে??

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের কাদিয়ানীদের বর্তমান ন্যাশনাল আমীর আব্দুল আউয়াল খান সাহেবও ইতিপূর্বে “জাসদ” এর রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। আ’লীগ দুঃশাসনকে আজীবনের জন্য বাংলাদেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠা করার মনোবাসনা থেকেই তাদের পেয়ারে হুজুর (কাদিয়ানী পঞ্চম খলীফা) মির্যা মাসরূর আহমেদকে দিয়েও ইংল্যান্ডের টিলফোর্ড শহরে অনেক দোয়া করিয়েছেন, যার তথ্য প্রমাণ আমাদের নিকট রয়েছে।

এ পর্যায় জনৈক কাদিয়ানী মিশনারীকে উদ্দেশ্য করে মুসলমান যুবকের প্রশ্নোত্তর নিচে তুলে ধরছি,

আপনাদের শিক্ষার আলোকে নবুওয়তের ধারণাটা কেমন?

যিল্লি নবী হতে পারে, এ ছাড়া আর কোনো ধরনের নবী হবেনা।

যিল্লি নবী হতে পারে কি পারেনা, এ টপিকে পরে আসছি। আগে “যিল্লি নবী” বলতে কী বুঝায় আর “যিল্লি” শব্দটা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের কোন কথায় উল্লেখ আছে দেখান!

…..কোনো উত্তর নেই।

যেহেতু “যিল্লি নবী” এর কোনো কনসেপশনই আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের কোনো কথায় উল্লেখ নেই, সেহেতু এর ধারণাটাই বাতিল। সুতরাং কাদিয়ানীদের “যিল্লি নবী” এর তাবৎ শিক্ষাটাই ভ্রান্ত ও প্রত্যাখ্যাত। ফলে এ শিক্ষাকে ব্যাজ করে যে বা যারা নিজেদের মুসলমান দাবী করবে তারা ভন্ড এবং ইসলামের অবমাননাকারী বলেই সাব্যস্ত হবে।

সূরা নিসার ৭০ নং (মুসলমানদের হিসেবে ৬৯ নং) আয়াত অনুযায়ী আনুগত্যরূপে নবী হতে পারে বলে উল্লেখ আছে!

যদি তাই হবে তাহলে তো মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীই উক্ত আয়াত নিজ দাবীর পক্ষে সবার আগে উল্লেখ করে যেতেন! অথচ আমরা তার রচনায় এমন কোনো আয়াতই উল্লেখ করেছেন, এমনটা দেখিনা!

….. কোনো উত্তর নেই।

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুক্ত অর্থে শেষনবী নন, তার পরেও নবী আছে। নইলে ঈসা আলাইহিস সালাম পুনরায় আসতে পারেন না।

ঈসা আলাইহিস সালামের পুনরায় আসার কারণে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম “শেষনবী” হবার বিশ্বাসে কোনো ধাক্কা লাগবে না। কারণ, ঈসা আলাইহিস সালামের প্রতি পুনরায় আসার পর নবুওয়ত দ্বিতীয়বার অর্পিত হবেনা। তিনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের পূর্বেই জেরুজালেমে অবস্থানকালে যেই নবুওয়ত প্রাপ্ত হয়েছিলেন সেই নবুওয়তের ক্রমধারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে চিরতরে খতম বা শেষ হয়ে গেছে। এ জন্যই পবিত্র কুরআনের সূরা আহযাব, আয়াত নম্বর ৪০ বলছে, ((و لكن رسول الله و خاتم النبيين)) অর্থাৎ কিন্তু তিনি (মুহাম্মদ) আল্লাহর একজন রাসূল এবং নবীগণের ক্রমধারা সমাপ্তকারী।

পবিত্র কুরআনের সূরা বাক্বারা, আয়াত নম্বর ৪ উক্ত বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট করে দিয়েছে। যেমন আল্লাহ তালা বলছেন, ((وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۚ وَ بِالۡاٰخِرَۃِ ہُمۡ یُوۡقِنُوۡنَ)) অর্থাৎ “আর (প্রকৃত মুমিন তো তারাই) যারা ঈমান আনে সেসব বিষয়ে, যা তোমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং যা তোমার পূর্বে নাযিল করা হয়েছে। আর আখিরাতের প্রতি তারা বিশ্বাস রাখে।” খুব খেয়াল করুন, উল্লিখিত আয়াতে শুধুমাত্র মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আর তাঁর পূর্বে গত হয়ে যাওয়া নবী রাসূলগণের প্রতিই নাযিলকৃত বিষয়ের উপর ঈমান আনার কথা রয়েছে। এতে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, নতুন করে আর কারো প্রতি আল্লাহর পক্ষ হতে কিছুই নাযিল হবেনা। যেজন্য নতুন করে কেউ এখন নবুওয়তের দাবী করা কুফুরী এবং এমন ব্যক্তি ও তার মান্যকারী সবাই ভন্ড এবং অমুসলিম হিসেবেই সাব্যস্ত। মূলত একই কারণে নবুওয়তের দাবীকারী ভারতের পাঞ্জাবের অধিবাসী মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী আর তার অনুসারী সমস্ত আহমদীয়া তথা কাদিয়ানী সম্প্রদায় অমুসলিম। যারা তাদের অমুসলিম মানতে নারাজ, বা তাদের পক্ষে বুঝেশুনেই সাফাই গেয়ে যাচ্ছে তাদের প্রত্যেকের উপর তাকফীরী ফাতাওয়া আরোপিত হবে।

…. কোনো উত্তর নেই।

চলবে

লিখক শিক্ষাবিদ ও গবেষক
প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী

ঈমান কি বাড়ে কমে? আমল কি ঈমানের অন্তর্ভুক্ত?

0

ঈমান কি বাড়ে কমে?

ইমাম আবু হানিফা (রহিমাহুল্লাহ)-এর সময় খারিজিদের খুব উৎপাত ছিল। তারা কবিরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তিদের কাফের মনে করতো এবং তাদের সাথে যুদ্ধ করা এবং তাদের জান মালকে হালাল মনে করত। কারণ, তাদের মতে ঈমান আমলের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং আমল পরিত্যাগ করা মানে ঈমান পরিত্যাগ করা। এজন্য আমল যে ঈমানের মূল বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত নয় এবং আমল ত্যাগের কারণে যে কেউ কাফের হয় না, তাকে হত্যা করা তার মাল ছিনিয়ে নেয়া যে বৈধ নয়, তা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া ওলামায়ে কেরামের উপর আবশ্যক হয়ে পড়ে। সে দায়িত্ব‌ই পালন করেছিলেন ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ)। তিনি ফাতাওয়া দিলেন, ঈমান আর আ’মল সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। আ’মল দ্বারা ঈমানে শক্তি বৃদ্ধি হয়, তবে সেটি ঈমানের অংশবিশেষ নয়। তিনি এ ফাতাওয়ার সমর্থনে দলিল এবং যুক্তি দুটোই পেশ করেন।

ঈমান শব্দের মূল অর্থ হলো বিশ্বাস করা, সত্যায়ন করা। খারেজিদের নিকট ঈমানের মূল রুকন বা ভিত্তি তিনটি। যথা-

১. ঈমানের বিষয়গুলোকে অন্তরে বিশ্বাস করা,
২. মুখে স্বীকার করা,
৩. শরীয়ত মোতাবেক আমল করা।

তাদের নিকট এগুলোর একটি বাদ গেলেও ঈমান থাকবে না, তাই কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি কাফের, যেহেতু সে আমল পরিত্যাগ করেছে আর আমল ঈমানের তিন রুকনের এক রুকন। উল্লেখ্য, প্রসিদ্ধ মাযহাব চতুষ্টয়ের তিনটি-ই আ’মলকে ঈমানের বাহিরের জিনিস বলে মত দিয়েছে।

বলাবাহুল্য, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের কতিপয় বিশেষজ্ঞ ঐ তিনটির সমষ্টিকে ঈমানের মূল রুকন বা ভিত্তি বললেও তাঁরা আমল পরিত্যাগকারীকে খারেজীদের মত ‘কাফের’ বলেন না। কিন্তু এটা তাঁদের এক ধরনের স্ববিরোধিতা বৈ নয়।

কারণ, বাকি দুই রুকনের মধ্যে সামান্য পরিমাণ ঘাটতি হলেও ঈমান বাতিল হয়, যেমন- কেউ বলল, আমি ফেরেশতায় বিশ্বাস করি না, তবে ঈমানের বাকি সব বিশ্বাস করি। এখানে ফেরেশতার প্রতি বিশ্বাসের কমতি হওয়ায় তার পুরো ঈমানই বাতিল হয়ে যাবে। তদ্রূপ কেউ বলল, আমি যাবুরকে আসমানী কিতাব হিসেবে স্বীকার করি না, কিন্তু ইসলামের বাকি সব মান্য করি। এ ব্যক্তি বাকি সব মানা সত্তেও কাফের বলে গণ্য হবে। তদ্রুপ কেউ যদি বলে, আমি পুরো কোরআন মানি তবে অমুক আয়াত মানি না। এই ব্যক্তি ও কাফের বলে গণ্য হবে। তদ্রূপ বাড়তি করলেও কাফের হবে। যেমন কেউ নিশ্চিতভাবে বলল শ্রীকৃষ্ণ নবী ছিল। অথচ এর স্বপক্ষে কোরআন হাদিসের কোন দলিল নেই। অথবা বলল বর্তমানে ও নবী আসা সম্ভব, তাহলে সে কাফের হবে। সুতরাং বুঝা গেল ঈমানের এই মৌলিক দুটি রুকনে বাড়তি কমতির কোনো সুযোগ নেই।

যেহেতু ঈমানের বিষয়বস্তুগুলোতে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বাড়তি কিংবা কমতির সুযোগ নেই এ দৃষ্টিকোণ থেকেই ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ঈমান বাড়েও না কমেও না। এ মাসআলাটিকে ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ “আল আলিমু ওয়াল মুতাআল্লিম”-এ অত্যন্ত সুন্দর ও চমকপ্রদভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আগ্রহীরা সেখানে দেখে নিতে পারেন।

যাইহোক, তাহলে মুহাদ্দিসদের কথা অনুযায়ী তৃতীয় রুকনে তথা আমলের ক্ষেত্রেও সামান্য পরিমাণ ছুটে গেলে পুরো ঈমান বাতিল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু খারেজীদের মতো সেটা তারা বলছেন না, সুতরাং এটা প্রকৃতপক্ষে ঈমানের রুকন নয়। হ্যাঁ, যদি এটাকে ঈমানের পূর্ণতাদানকারী রুকন বলি, ঈমানের অস্তিত্ব আনয়নকারী রুকন না বলে তাহলে অসুবিধা নেই।যেমন- হাসান নামক ব্যক্তির মাথার সুন্দর চুল না থাকলেও ব্যক্তি হাসান অস্তিত্বে থাকে। তদ্রুপ তার নাক, কান, চোখ, হাত ও পা না থাকলেও ব্যক্তি হাসান আছে বলে গণ্য হবে। কিন্তু এগুলো থাকলে ব্যক্তির দৈহিক সৌন্দর্যও গঠন পূর্ণতা লাভ করে।

তদ্রুপ ঈমানের বিষয়বস্তুগুলোর প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস এবং মৌখিক স্বীকৃতি থাকা অবস্থায় ব্যক্তি আমল পরিত্যাগ করলেও তার ঈমান বিদ্যমান থাকে কিন্তু ঈমানের সৌন্দর্যবর্ধক জিনিস বিদ্যমান থাকে না। আর যখনি ঈমানের বিষয়বস্তুগুলোর কোন একটিতে অবিশ্বাস করার মাধ্যমে কমতি সাব্যস্ত হবে, তখনি কুফর আবশ্যক হবে।

সুতরাং আমরা বুঝলাম ইমাম আবু হানিফা রহ. ঈমান বাড়েও না কমেও না বলে বুঝিয়ে থাকেন ঈমানের বিষয়বস্তুতে কমতি বাড়তি হয় না। আর কোরআন হাদিসের যত জায়গায় ঈমান বাড়া এবং কমার কথা বলা হয়েছে সেগুলো দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, ঈমানের সৌন্দর্য বাড়া, নূর বৃদ্ধি পাওয়া, ঈমানের বিষয়বস্তুতে বাড়তি কমতি উদ্দেশ্য নয়।

কারণ শত শত আমল থাকা সত্ত্বেও ঈমানের বিষয়বস্তুগুলোর কোন একটিতে সামান্য পরিমাণ অবিশ্বাস করলে সে কাফের বলে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে ঈমানের বিষয়বস্তুগুলোর প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস ও মৌখিক স্বীকৃতি থাকাবস্থায় সকল আমল বর্জন করলেও সে কাফের বলে গণ্য হবে না।

আবার কোন হালালকে হারাম মনে করলে কিংবা হারামকে হালাল মনে করলে সাথে সাথে কাফের হয়ে যাবে। অকাট্য দলিলে প্রমাণিত কোন গুনাহে লিপ্ত হ‌ওয়াকে হালাল মনে করলেও কাফের হয়ে যায়।‌ এসকল বিষয়ে মুহাদ্দিসদের সাথে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মুতাকাল্লিমদের কোন বিরোধ নেই।

সুতরাং বোঝা গেল ঈমান হলো অন্তরের বিষয় আমল ঈমানের অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে ঈমান আনার কারণে আমল আবশ্যক হয়, আমলের কারণে ইমান আবশ্যক হয় না।

আমল যে মূল ঈমানের অন্তর্ভুক্ত নয় এ ব্যাপারে ইমাম আবু হানিফার বহু দলিল রয়েছে। ইনশাআল্লাহ ধীরে ধীরে আমরা সেগুলো আলোচনা করব।

লিখক, অ্যাডমিন ফিকহ মিডিয়া

ফতুল্লায় বিগত ১০ বছরেও কেউ কাদিয়ানী হয়েছে বলে আমি শুনিনি

0

নারায়নগঞ্জের ফতুল্লা স্থানীয় জনাব মজিবুর রহমান শেখ, একজন কাদিয়ানী-আহমদীয়া ধর্মের অনুসারী। জনাব মজিবুর রহমান শেখ গত ২৮ বছর ধরে একজন কনভার্টেট কাদিয়ানী মুবাল্লিগ (ফতুল্লা, নারায়নগঞ্জ ঢাকা)। সম্প্রতি তিনি স্যোসাল মিডিয়ায় মন্তব্য করেছেনঃ “আমার জানামতে আহমদীয়া মুসলিম জামাত ফতুল্লাহ গত ১০ বছরে একজনও বয়াত করেনি।” তিনি তার ঐ মন্তব্যে কাদিয়ানীদের চাপাবাজীর মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছেন। স্যোসাল মিডিয়ায় শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিকট নিজের অবিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করতে শুরু করেছেন। তিনি কোনো এক কারণে কাদিয়ানী জামাতের প্রতি ভীষণ বিরক্ত। সম্ভবতঃ কাদিয়ানী জামাতের অনুসারী ও নিজেদের মধ্যকার যে কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। যার ফলে তিনি জুলুম বা নিপীড়নের শিকার হন। যার জন্য বকশিবাজারস্থ তাদের কেন্দ্রে তিনি বিচার চেয়েও বিচার পাননি। অথচ বিচারের আশায় তিনি প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত ঢাকার বকশিবাজারে তাদের হেড কোয়ার্টার বা কেন্দ্রের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। নিচে তারই মন্তব্য গুলোর স্ক্রিনশট তুলে ধরছি, যাতে কাদিয়ানী জামাতের লোকদের মুখে মধু এবং অন্তরে বিষ থাকার বিষয়টি আরও খুব চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।

জনাব মজিবুর রহমান শেখ সাহেবের এফ.বি একাউন্ট এর লিংক – মজিবুর রহমান শেখ

লিখক, মুহাম্মদ নূরুন্নবী এম.এ

তোমরা তা কামড়ে ধরো, হাদীসের এ খণ্ডিতাংশের কী তাৎপর্য ও একটি আপত্তির উত্তর,

0

ইমাম বুখারীর ‘আল আদাবুল মুফরাদ’ হাদীস নং ৯৬৩ হতে, (সনদ সহ) নিম্নরূপ,

حَدَّثَنَا عُثْمَانُ الْمُؤَذِّنُ، قَالَ‏:‏ حَدَّثَنَا عَوْفٌ، عَنِ الْحَسَنِ، عَنْ عُتَيِّ بْنِ ضَمْرَةَ قَالَ‏:‏ رَأَيْتُ عِنْدَ أُبَيٍّ رَجُلاً تَعَزَّى بِعَزَاءِ الْجَاهِلِيَّةِ، فَأَعَضَّهُ أُبَيٌّ وَلَمْ يُكْنِهِ، فَنَظَرَ إِلَيْهِ أَصْحَابُهُ، قَالَ‏:‏ كَأَنَّكُمْ أَنْكَرْتُمُوهُ‏؟‏ فَقَالَ‏:‏ إِنِّي لاَ أَهَابُ فِي هَذَا أَحَدًا أَبَدًا، إِنِّي سَمِعْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ‏:‏ مَنْ تَعَزَّى بِعَزَاءِ الْجَاهِلِيَّةِ فَأَعِضُّوهُ وَلا تَكْنُوهُ‏.‏

وفي رواية: إذا الرجل تعزى بعزاء الجاهلية، فأعضوه بهن أبيه، ولا تكنوا .

অর্থ- আমি উবাই ইবনে কা’ব (রা.)-এর নিকট এক ব্যক্তিকে দেখেছি, যে নিজেকে (বংশের গৌরবগাঁথা বর্ণনায়) জাহিলিয়াতের গুণে গুণান্বিত করলে, উবাই তাকে মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরতে বলেন। তিনি তা ইংগিতে বলেননি (অর্থাৎ তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন)। তাই তার সঙ্গীরা তার দিকে তাকাল। তিনি বললেন, ‘মনে হচ্ছে তোমরা এ কথা অপছন্দ করলে!’ তারপর তিনি বললেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কখনোই কাউকে শঙ্কা প্রকাশ করব না। আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, যে নিজেকে (বংশের গৌরবগাঁথা বর্ণনায়) জাহিলিয়াতের গুণে গুণান্বিত করে, সে যেন তা শক্তভাবে কামড় দেয় এবং তোমরা (এ কথা) অস্পষ্ট করে বলবেনা। (আল আদাবুল মুফরাত)।

মুসনাদে আহমদ এবং নাসাঈ এর আস-সুনানুল কোবরা গ্রন্থে অন্য বর্ণনায় আ’উফ ইবনে আবী জামীলাহ আল আ’রাবীর সূত্রে হাসান বছরী থেকে একটু পরিবর্তিত মতনে বর্ণিত আছে, “যে নিজেকে (বংশের গৌরবগাঁথা বর্ণনায়) জাহিলিয়াতের গুণে গুণান্বিত করে, সে যেন তার পিতার প্রজননতন্ত্র কামড় দেয় (অর্থাৎ নিজেকে পুর্বপুরুষের বংশীয় গরিমা থেকে সমূলে উপড়ে ফেলে) এবং তোমরা (এ কথা) অস্পষ্ট করে বলবেনা।”

সনদের তাহকিকঃ হাদীসটির সনদে উ’তাই ইবনু দ্বমরাহ (মৃত. ১৪৭ হি.) সম্পর্কে ইমাম আলী ইবনুল মদনী (রহ.) বলেছেন, ((مجهول، سمع من أبى كعب، لا نحفظها إلا من طريق الحسن، و حديثه يشبه حديث أهل الصدق وإن كان لا يعرف)) অর্থাৎ “সে অপরিচিত। সে উবাই ইবনু কা’ব থেকে শ্রবণ করেছে। তবে আমরা সেগুলো হাসান বছরীর সূত্রে ছাড়া সুরক্ষিত পাই না। আর তার বর্ণিত হাদীসগুলো সত্যবাদীদের হাদীসের ন্যায়, যদিও সে অপরিচিত।” (শরহে মেশকাত, ইমাম ত্বীবী ৯/১৬৭ দ্রষ্টব্য)। হ্যাঁ, ইমামগণের বেশিরভাগই তাকে তাওসীক্ব করেছেন। শায়খ আলবানী বলেছেন, এর সনদ সহীহ। যাইহোক, হাসান বছরীর সূত্রে আরেক সনদে হাদীসটির “মতন” এইরূপ, ((من سمعتموه يدعو بدعوى الجاهلية فأعضوه بهن أبيه ولا تكنوا)) অর্থাৎ, তোমাদের যে ব্যক্তি জাহিলিয়াত যুগের কৃষ্টি-কালচারের দিকে আহবান করবে সে যেন তার পিতার প্রজননতন্ত্র কামড় দেয় (অর্থাৎ নিজেকে পুর্বপুরুষের বংশীয় গরিমা থেকে সমূলে উপড়ে ফেলে) এবং তোমরা (এ কথা) অস্পষ্ট করে বলবেনা।”

বিশ্লেষণঃ মোল্লা আলী ক্বারী (রহ.) হাদীসটির মর্মবাণী বুঝিয়ে দিয়েছেন এভাবে যে,

مَعْناهُ مَنِ انتَسَبَ وانْتَمَى إلى الجاهِليَّةِ بإحْياءِ سُنَّةِ أهْلِها، وابْتِداعِ سُنَّتِهِم في الشَّتْمِ واللَّعْنِ والتَّعْييرِ، ومُواجَهَتِكُم بالفَحْشاءِ والتَّكبُّرِ، فاذْكُروا له قَبائِحَهُ أو قَبائِحَ أبيهِ من عِبادةِ الأصْنامِ، والزِّنا، وشُربِ الخَمْرِ، ونَحوِ ذلك ممَّا كان يُعيَّرُ به مِن لُؤمٍ ورَذالةٍ صَريحًا لا كِنايةً؛ كي يَرتَدِعَ عن التَّعرُّضِ لأعْراضِ النَّاسِ. اهـ. من مرقاة المفاتيح.

এর অর্থ হল, এমন কেউ যিনি (বংশের গৌরবগাঁথা বর্ণনায়) জাহিলিয়াতের যুগের লোকদের কৃষ্টি-কালচারকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং অভিশাপ করা, গালমন্দ, অন্যকে তিরস্কার, অশ্লীলতা ও অহংকার প্রদর্শনের নিয়ম পদ্ধতি উদ্ভাবন করে…. তাহলে তোমরা সেই ব্যক্তিকে মদ্যপান, জেনা-ব্যভিচার এবং মূর্তিপূজা ইত্যাদি বিষয়ে পূর্বপুরুষের কুৎসিত কার্যকলাপগুলো স্মরণ করিয়ে দাও। (মেরকাত শরহে মেশকাত, মোল্লা ক্বারী)।

উল্লেখ্য, আরবী ভাষায় أَعِضُّو (তোমরা কামড়ে ধরো), এক ধরনের ভাষা অলংকার; যেটি বাগধারারই অংশ। এর তাৎপর্য হচ্ছে, তোমরা বংশীয় গৌরব সমূলে উপড়ে ফেলো। ইসলামে বংশীয় গৌরব নিন্দনীয়, পূর্বপুরুষদের নিয়ে অহংকার করা আরও জঘন্য। পূর্বপুরুষদের নিয়ে অহংকারীদের সতর্ক করতেই এভাবে বলা হয়ে থাকে।

সহীহ মুসলিম গ্রন্থে এ ধরনের আরও একটি আরবীয় বাগধারা رغم انف (রাগিমা আনফু অর্থাৎ নাক ধূলোয় ধূসরিত হয়ে যাক) উল্লেখ রয়েছে, যার রূপক অর্থ- ‘সে ক্ষতিগ্রস্ত’। হাদীসটি এই যে,

رغم أنف، ثم رغم أنف، ثم رغم أنف من أدرك أبويه عند الكبر أحدُهما أو كلاهما فلم يدخل الجنة

অর্থাৎ সে ক্ষতিগ্রস্ত অত:পর সে ক্ষতিগ্রস্ত অত:পর সে ক্ষতিগ্রস্ত যে তার পিতামাতা দুজনকেই বা কোনো একজনকে বৃদ্ধ বয়সে জীবিত পেল তবু সে (তাদের সেবা করে) জান্নাতে প্রবেশ করতে পারেনি। – মুসলিম।

অবশ্যই এন্টি ইসলাম নাস্তিক(!)দের নিকট আরবী শব্দগুচ্ছ গুলোয় আপত্তি থাকা অস্বাভাবিক নয়। যেহেতু তারা জাহিলিয়াত যুগ সম্পর্কে যেমন অজ্ঞ, ঠিক তেমনি আরবী ভাষার অলংকার বা বাগধারায়ও গণ্ডমূর্খ।

যাইহোক, এ জাতীয় শব্দগুচ্ছ যে আরবী ভাষায় প্রচলিত বাগধারারই অংশ তা অনুধাবন করতে হলে হুদায়বিয়ার সন্ধি মুহূর্তে কোরাইশের পক্ষ হতে আগত বার্তাবাহককে উদ্দেশ্য করে হযরত আবূবকর (রা.)-এর ঐতিহাসিক উক্তিটি মনে রাখতে হবে। তিনি কোরাইশের পক্ষ থেকে আসা বার্তাবাহককে বলেছিলেন أمضض بظر اللات (আমদ্বিদ বাঝারাল লাত) অর্থাৎ তুমি লাত এর প্রজননতন্ত্র কামড় দাও অর্থাৎ গায়রুল্লার প্রভাব প্রতিপত্তিকে এবার বিদায় জানাও।

রাসূল (সা.) অত্যাধিক লাজুক বলেই শুধুমাত্র أَعِضُّو (তোমরা কামড়ে ধরো) এটুকু বলে বিষয়টা বুঝিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সাধারণ শিক্ষিতদের জন্য বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে দিতে বর্ণনাকারীদের কোনো একজন এটিকে পূর্ণবাক্যে فَأَعِضُّوهُ بِهنِ أبِيهِ রেওয়ায়েত করে দিয়েছেন, উসূলে হাদীসের পরিভাষায় এধরণের অতিরঞ্জনকে ذيادة بالراوى (যিয়াদাত বির-রাবী) বলা হয়। সুতরাং যারা ভাষাবিদ ও পড়াশোনা জানা ব্যক্তি, তাদের নিকট এখন পুরো বিষয়টি পরিষ্কার, আলহামদুলিল্লাহ।

শেষকথা– রাসূল (সা.)-এর أَعِضُّو সংক্ষিপ্ত উক্তির দীর্ঘ বাক্যে প্রকাশ হচ্ছে فأعضوه بهن أبيه (ফা-আ’ইদ্দূহু বিহানি আবীহি)। আর সেটি আরবীয় ভাষা অলংকার। তাই একে গালি বা অশ্লীলতা বলা মূর্খতা। যদি এটি গালি বা অশ্লীলতা হত, তাহলে আরবীয় নাস্তিক বা ইসলাম বিদ্বেষীরাই সবার আগে আপত্তি তুলতো। আল্লাহ আমাদেরকে সহীহ বুঝ দান করুন।

লিখক, মুহাম্মদ নূরুন্নবী এম.এ

হযরত ফাতিমা (রা.)-এর প্রতি প্রথম দুই খলীফা কি অন্যায় করেছিলেন?

0

প্রশ্ন : বিভিন্ন বই পুস্তকে পাওয়া যায় যে, হযরত ফাতিমা (রা.) এর প্রতি দুই খলীফা নাকি খুব অন্যায় করেছিলেন? এর কি কোনো বাস্তবতা রয়েছে?

উত্তর : শীয়া রাফেজি সম্প্রদায়ের সোর্সগুলোয় এ ধরনের কিছু গল্প অবশ্যই বর্ণিত আছে। আহলুস সুন্নাহ’র বিশুদ্ধ কোনো হাদীস গ্রন্থে এ ধরনের কোনো গল্পের উল্লেখ নেই। তবে বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থের বাহিরে কিছু কিছু পুস্তকে এ সম্পর্কে উল্লেখ থাকলেও তার সনদ প্রমাণিত নয়। আবার কোনো কোনোটির বিবরণও একেক রকম।

দুই খলীফার প্রতি জঘন্য অপবাদ :

সব চেয়ে জঘন্য অপবাদটি হচ্ছে, ‘হযরত উমর (রা.) হযরত ফাতিমার পেটে আঘাত করেন, ফলে ফাতিমার গর্ভপাত ঘটে। পেট থেকে মুহসিনের প্রসব হয়ে যায়।’ নাউযুবিল্লাহ। এ জাতীয় বিভিন্ন গল্প কাহিনী শীয়াদের বইপুস্তক গুলোয় ভুরি ভুরি পাওয়া যায়। সত্যি বলতে, এধরণের ইতিহাস সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং অবাস্তব। সত্যের সাথে যার লেশমাত্র সম্পর্কও নেই।

তার কারণ, বর্ণনাগুলোর সিংহভাগই ভিত্তিহীন ও সনদ বিহীন। কিছু কিছু বর্ণনার সনদে ইনক্বিতাহ বা বিচ্ছিন্নতা বিদ্যমান, আবার কিছু কিছু সনদের রাবী বা বর্ণনাকারী জিন্দিক ও অবিশ্বস্ত হিসেবে অভিযুক্ত। আবার কোনো কোনো বর্ণনার মান শাজ পর্যায়ের।

আমি বর্ণনাগুলোর অনুবাদ সহ একটু পরেই উল্লেখ করব, ইনশাআল্লাহ। তার আগে উক্ত দুই খলীফা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) এর সাথে প্রাসঙ্গিক ঘটনাটির পটভূমি উল্লেখ করছি।

১১ হিজরীর ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার রাসূল (সা.) এর ইন্তেকাল হয়ে গেলে সাহাবীরা সকলে তাদের পরবর্তী অভিভাবক বা প্রতিনিধি কে হবেন তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান। রাসূল (সা.)-এর দাফন কার্য সম্পন্ন হওয়ার পরপরই সাহাবীগণ সাকিফা বনু সাইদাহ (سقيفة بنى ساعدة) এর মহল্লায় একত্রিত হন এবং আবূবকর (রা.)-এর নিকট দলে দলে খিলাফতের বয়’আত নিতে শুরু করেন। কিন্তু কয়েকজন সাহাবী তখনো বয়’আত নেননি, তারা বয়’আত নিতে দেরি করেন। তাদের মধ্যে হযরত আব্বাস, হযরত ফজল ইবনে আব্বাস, হযরত আলী, হযরত যোবায়ের ইবনুল আ’ওয়াম, হযরত মিক্বদাদ প্রমুখ অন্যতম। হতে পারে তারা রাসূল (সা.)-এর দাফন কার্য থেকে তখনও পুরোপুরি অবসর হতে পারেননি। তাই বয়’আত নিতে দেরি হচ্ছিল। হযরত আবুবকর (রা.) তাদেরকে অনুপস্থিত দেখে খবর নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেন এবং বেশকয়জন সাহাবীকে সহ হযরত উমর (রা.)-কে তাদের নিকট প্রেরণ করেন।

হযরত উমর (রা.) খবর নিয়ে জানতে পারলেন যে, তারা হযরত ফাতিমা (রা.)-এর বাড়ীতে অবস্থান করছেন। হযরত উমর (রা.) সহ সাহাবীগণ ফাতিমার বাড়ী গিয়ে পৌঁছেন। তাদেরকে খলীফা নির্বাচন সম্পর্কে অবিহিত করলেন। অত:পর বাড়ীর ভেতরে যারা অবস্থান করছিলেন তারা সবাই বের হয়ে আসেন এবং আবূবকর (রা.)-এর হাতে বয়’আতে প্রবেশ করেন। এ ছিল আসল ঘটনা। ঘটনাটি এভাবেই বিশুদ্ধ সূত্রে মুসনাদে আহমদ, মুস্তাদরাক লিল হাকিম গ্রন্থদ্বয়ে বর্ণিত হয়েছে।

হযরত উমর (রা.) কি ফাতিমা (রা.) এর পেটে আঘাত করেছিলেন?

উত্তরে বলা হয় যে, এ ধরনের কোনো ইতিহাস প্রমাণিত নয়, বরং এ কথাটি প্রথম যে ব্যক্তিটি বলেছিল তার নাম ইবরাহীম আন নাজ্জাম আল মু’তাজিলি। তার দাবী হচ্ছে, ((إن عمر ضرب بطن فاطمة يوم البيعة، حتى ألقت المحسن من بطنها)) “নিশ্চয়ই উমর বয়’আতের দিন ফাতিমার পেটে আঘাত করেন, ফলে তাঁর পেট থেকে মুহসিনের গর্ভপাত হয়ে যায়।” – টাটকা জাল ও ভিত্তিহীন।

রেফারেন্স- আল ওয়াফী বিল ওয়াফিয়াত ৬/১৭, সালাহ উদ্দীন আছ-ছফদী আদ দিমাস্কী আশ-শাফেয়ী (মৃত. ৬৯৬ হি.)।

সম্পর্কিত তথ্যঃ উপরের বক্তব্যটি সম্পূর্ণ সনদ বিহীন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থে এটি শীয়া দর্শনে প্রভাবিত ইবরাহীম আন নাজ্জামের নিজেস্ব উক্তি হিসেবে উল্লেখ পাওয়া যায়। নিচে ইবরাহীম আন নাজ্জাম এর বৃত্তান্ত উল্লেখ করছি,

ইমাম যাহাবী তাঁর ‘সিয়ার’ গ্রন্থে তার সম্পর্কে লিখেছেন ((كَانَ النَّظَّامُ عَلَى دِيْنِ البَرَاهِمَةِ المُنْكِرِيْنَ لِلنُبُوَّةِ وَالبَعْثِ وَيُخْفِي ذَلِكَ)) অর্থাৎ ইবরাহীম আন নাজ্জাম এমন একজন, যে পুনরুত্থান এবং নবুওয়তের অস্বীকারকারী ব্রাহ্মণ্য মতবাদের অনুসারী ছিল, অথচ সে তা গোপন রাখত। – (সিয়ারু আলামিন নুবালা, যাহাবী ১০/৫৪২)।

ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী (রহ.) ‘লিসানুল মীযান’ গ্রন্থে তার পুরো নাম এভাবে উল্লেখ করেছেন, ((إبراهيم بن سيار بن هانئ النظام أبو إسحاق البصري)) অর্থাৎ ‘ইবরাহীম ইবনে সাইয়ার ইবনে হানী আন নাজ্জাম আবূ ইসহাক্ব আল বছরী।’ ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী (রহ.) তার সম্পর্কে আরও লিখেছেন, ((من رؤوس المعتزلة متهم بالزندقة وكان شاعرا أديبا بليغا وله كتب كثيرة في الاعتزال والفلسفة ذكرها النديم. قال ابن قتيبة في “اختلاف الحديث” له: كان شاطرا من الشطار مشهورا بالفسق. ثم ذكر من مفرداته: أنه كان يزعم أن الله يحدث الدنيا وما فيها في كل حين من غير أن يفنيها , وجوز أن يجتمع المسلمون على الخطأ)) অর্থাৎ ‘সে ছিল মু’তাজিলি সম্প্রদায়ের অন্যতম নেতা। জিন্দিক বা ধর্মত্যাগী হিসেবেও অভিযুক্ত। তবে সে একজন কবি এবং সাহিত্যিক। তার বহু রচনা ছিল মু’তাজিলি মতবাদ এবং ফিলোসোফি দর্শনের উপর, শায়খ নাদীম তার লিখায় এ সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। ইমাম ইবনু ক্বদামাহ তার ‘ইখতিলাফুল হাদীস’ গ্রন্থে তার সম্পর্কে লিখেছেন, সে একজন ধূর্ত এবং অন্যায় ও অনৈতিকতার জন্য ছিল বিখ্যাত। ইবনু কুদামা ‘মুফরাদাত’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সে দাবী করত যে, সমগ্র পৃথিবী এবং এর মধ্যে আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন, এর কিছুই বিনাশ হবেনা। সে আরও বলত, মুসলিমদের জন্য ভুলের উপর ঐক্যমত হওয়া বৈধ।’

ইবনু হাজার আসকালানী (রহ.) তার মৃত্যু সন লিখেছেন ((مات في خلافة المعتصم سنة بضع وعشرين ومئتين وهو سكران)) অর্থাৎ সে খলীফা মু’তাসিম এর শাসনামলে বছরা শহরে ২২০ হিজরীতে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মারা যায়। (লিসানুল মীযান ১/২৯৫)।

বিশুদ্ধ সনদে এতদ সংক্রান্ত ঐতিহাসিক বর্ণনাটি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) সহ আহলুস সুন্নাহ’র ইমামগণের কিতাবে যেভাবে উল্লেখ আছে,

হাদীসের আরবী ইবারত ও অনুবাদঃ

أسلم القرشي مولى عمر بن الخطاب رضي الله عنه، قال: حين بُويع لأبي بكر بعد رسول الله صلى الله عليه وسلم، كان علي والزبير يدخلان على فاطمة بنت رسول الله صلى الله عليه وسلم فيشاورونها ويرتجعون في أمرهم ، فلما بلغ ذلك عمر بن الخطاب خرج حتى دخل على فاطمة فقال: يا بنت رسول الله صلى الله عليه وسلم ! والله ما من أحد أحب إلينا من أبيك، وما من أحد أحب إلينا بعد أبيك منك، وايم الله ما ذاك بمانعي إن اجتمع هؤلاء النفر عندك إن أمرتهم أن يحرق عليهم البيت. قال: فلما خرج عمر جاؤوها فقالت: تعلمون أن عمر قد جاءني، وقد حلف بالله لئن عدتم ليحرقن عليكم البيت، وايم الله ليمضين لما حلف عليه، فانصرِفوا راشدين، فَرُوا رأيَكم ولا ترجعوا إلّيَّ ، فانصرفوا عنها ، فلم يرجعوا إليها حتى بايعوا لأبي بكر.

অর্থাৎ হযরত উমর ইবনু খাত্তাব (রা.) এর একজন কৃতদাস আসলাম আল কারশী, তিনি বলেন, যখন আল্লাহ’র রসূলের ইন্তেকালের পর আবু বকর (রা.)-এর নিকট বয়’আত নেয়া হচ্ছিল, তখন যোবায়ের এবং আলী দু’জনই আল্লাহ’র রসূলের কন্যা ফাতিমার বাড়ী যান এবং নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করতে থাকেন এবং কাজে বেপরোয়া ছিলেন। যখন এ সংবাদটি উমর ইবনু খাত্তাব (রা.)-এর নিকট পৌঁছল, তখন তিনি ফাতিমা (রা.)-এর নিকট যাওয়ার জন্য বের হন। তিনি বললেনঃ হে আল্লাহ’র রসূলের কন্যা! খোদার কসম, আমাদের কাছে আপনার পিতার চেয়ে প্রিয় আর কেউ নেই এবং আপনার পিতার পর আমাদের কাছে আপনার চেয়ে প্রিয় আর কেউ নেই। খোদার কসম, যদি এ দলটি আপনার নিকট সংঘবদ্ধ থাকে তাহলে তা আমাকে তাদের ঘর পুড়িয়ে দিতে রুখবেনা, যদি আপনি নির্দেশ দিন।

বর্ণনাকারী বলেন, যখন উমর চলে গেলেন, তখন তারা ফাতিমার নিকট আসলেন। ফাতিমা বললেন, তোমরা জানো যে, উমর আমার নিকট এসেছিলেন এবং তিনি আল্লাহর শপথ করেছিলেন যে, আপনারা যদি বয়’আত থেকে বিরত থাকেন তাহলে তিনি আপনাদের ঘর জ্বালিয়ে দেবেন। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি যে, তারা যা করার শপথ করেছেন তা তারা পূরণ করবে। সুতরাং আপনারা মনস্থির করুন আর আমার কাছে ফিরে আসবেন না। তারপর তারা তাঁর নিকট চলে গেলেন এবং আবু বকরের নিকট বয়’আত না করা পর্যন্ত ফিরে যাননি।

রেফারেন্সঃ মুসনাদে আহমদ, ফাজায়েলুস সাহাবা অধ্যায় ১/৩৬৪, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ ৭/৪৩২, আল মুযাক্কার ওয়াত তাযকীর ১/৯১ ইবনু আবী আছিম, ইমাম বাজ্জারের সূত্রে আল ইস্তঈ’আব ৩/৯৭৫ ইবনু আব্দিল বার, তারীখে বাগদাদ ৬/৭৫ খতীবে বাগদাদ। প্রত্যেকের অভিন্ন সনদটি এইরূপ- محمد بن بشر ثنا عبيد الله بن عمر عن زيد بن أسلم عن أبيه به. শায়খ মুহাম্মদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ (হাফি.) বলেছেন, وهذا إسناد صحيح এ সনদটি সহীহ

এবার ব্যতিক্রমী ও দুর্বল বর্ণনাগুলো নিম্নরূপ যেগুলোর মতন বা মূলপাঠ সূত্রের বিচারে অপ্রমাণিত,

. يقول البَلَاذُري (أحمد بن يحيى بن جابر البَلَاذُري البغدادي)ـ بعد لحادثة السقيفة المريرة ـ : إنّ أبا بكر أرسل إلى علي يريد البيعة، فلم يبايع، فجاء عمر و معه فتيلة، فتلقته فاطمة على الباب، فقالت فاطمة : يا ابن الخطاب أتراك محرقاً عليَّ بابي؟ قال : نعم، و ذلك أقوى فيما جاء به أبوك وجاء علي فبايع وقال : كنت عزمت أن لا أخرج من منزلي حتى أجمع يعني أحفظ القرآن

অর্থ- আহমদ ইবনে ইয়াহইয়া ইবনে জাবের আল বালাজুরী আল-বাগদাদী বলেন, সাক্বীফায় সংঘটিত ঘটনার পর :- নিশ্চয়ই আবূবকর (রা.) বয়’আত গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে আলীর নিকট দূত প্রেরণ করেন। যেহেতু সে বয়’আত নেয়নি। ফলে উমর (রা.) একটি প্রদীপ সাথে নিয়ে (ফাতিমার বাড়ীর উদ্দেশ্যে) যাত্রা করেন। ফাতিমা তার সাথে বাড়ীর দরজায় দেখা করেন। তখন ফাতিমা জিজ্ঞেস করলেন, হে উমর! আপনি কি আমার দরজায় আগুল দিতে চাচ্ছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, এটি আপনার পিতা যা নিয়ে এসেছেন তার চেয়েও ভারি। অত:পর হযরত আলী (রা.) বেরিয়ে আসেন এবং বয়’আত গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, আমি (মূলত) গৃহ থেকে বের না হবারই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যতক্ষণ না আমি কুরআন হিফয সম্পন্ন করছি। – আনসাবুল আশরাফ ২/১২, আল বালাজুরী। – দুর্বল

সম্পর্কিত তথ্যঃ ইমাম বালাজুরী (২৭০ হি.) এটি ‘আনসাবুল আশরাফ’ ২/১২-তে বর্ণনা করেছেন। বর্ণনার সনদের অভ্যন্তরীণ ক্রুটি হচ্ছে, সূত্র বিচ্ছিন্নতা। বর্ণনাকারীদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হওয়া প্রমাণিত নয়। কেননা, এর সনদ হচ্ছে المدائني عن مسلمة بن محارب عن سليمان التيمي وعن ابن عون প্রথমতঃ এখানে মাসলামাহ বিন মাহারিব আয যিয়াদী আল কুফী সম্পর্কে রিজালশাস্ত্রের কিতাবগুলোয় জরাহ বা তা’দীল কোনো কথারই উল্লেখ নেই। তবে ইবনু হিব্বান তাকে সিকাহ’র অন্তর্ভুক্ত করেছেন। দ্বিতীয়তঃ সুলাইমান ইবনু তুরখান আত তাঈমী (سليمان ابن طرخان التيمي) এর মৃত্যু সন ১৪৩ হিজরী। কিন্তু সনদে উপরের দু’জনের মধ্যখানে ইনক্বিতা বা বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। অধিকন্তু মাসলামাহ বিন মাহারিব শুধুই হিজাজের রাবীগণ থেকে এবং উমর বিন আব্দুল আযীয থেকেই বর্ণনা করতেন (-আস সিক্বাত, ইবনু হিব্বান)। আর আব্দুল্লাহ ইবনু আ’ওন আল বছরী (وعبد الله بن عون أبو عون البصري) এর মৃত্যু সন বিশুদ্ধ মতে ১৫০ হিজরী। সুলাইমান এবং আব্দুল্লাহ কেউই ঘটনাটি সুনিশ্চিতভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি, যদিও দু’জনই বিশ্বস্ত ছিলেন। ইমাম ইয়াহইয়া বিন সা’ঈদ আল কাত্তান বলেন, সুলাইমান ইবনু তুরখানের মুরসাল সন্দেহযুক্ত ও গুরুত্বহীন। আর তার শায়খ আল মাদাইনী যার পূর্ণ নাম-أبو الحسن علي بن محمد بن عبد الله الإخباري ; মৃত্যু সন ২২৪ হিজরী, তিনি হাদীস বর্ণনায় শক্তিশালী নন (ইবনু আদীর আল কামিল ৫/২১৩ দেখুন)। তবে লিসানুল মীযান গ্রন্থে ইবনু মা’ঈন থেকে তার তাওসীক্ব উল্লেখ আছে। ইমাম যাহাবীও তার বৃত্তান্ত তুলে ধরেছেন। যাইহোক, সর্বসাকুল্যে কথা হচ্ছে, বিশুদ্ধ বর্ণনার বিপরীতে ইমাম বালাজুরীর মুনকাতি সনদের এ বর্ণনার অতিরিক্ত অন্যান্য ঘটনা নির্ভরযোগ্য সনদে উত্তীর্ণ নয় বলে গ্রহণযোগ্য নয়।

এ ধরনের আরও কিছু দুর্বল বর্ণনা শব্দের কিছু পরিবর্তন সহ উল্লেখ রয়েছে, যেমন-

তারীখে তাবারী ৩/২০২।

‘আল ই’কদুল ফারীদ, ইবনু আব্দি রাব্বিহি আল উন্দুলুসী ৫/৩১। সংক্ষেপে।

সম্পূর্ণ লিখাটির সোর্স শায়খ মুহাম্মদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ (হাফি.) এর Islamqa.info এ সাইট থেকে সংগৃহীত

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

কাদিয়ানীর নবুওয়ত একটি ব্রিটিশ পরিকল্পনা,

0

কাদিয়ানীর লেখিত বিভিন্ন বই পুস্তক থেকে হুবহু অনুবাদ সহ তার উত্থানের ঐতিহাসিক বিবরণ,

উনিশ শতকে যখন ব্রিটিশ শক্তি ভারত দখল করে নেয়, তখন স্বাধীনতা সংগ্রামের ইমাম হযরত শাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী ফতোয়া দিয়েছিলেন, ভারত দারুল হরব এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ ফরজ। যার ফলশ্রুতিতে পুরো ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের লেলিহান শিখা জ্বলে ওঠে। এ জাতির আলেমসমাজ এবং স্বদেশের মুজাহিদগণ জীবন মুঠোয় নিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রতিটি মোড়ে প্রতিটি রণক্ষেত্রে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী ভল্লুকদের সাহসিকতার সঙ্গে তারা রুখে দাঁড়ান। এটা সত্য, ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুসলমান মুজাহিদগণ হেরে গেছেন। এ কারণে তারাই সাম্রাজ্যবাদী অমানবিক পৈশাচিক নির্যাতনের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। তবে তাঁদের জিহাদি প্রেরণা কমে যায়নি কখনো। ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলেছে অহর্নিশ।

ইংরেজদের বাজদৃষ্টি মুজাহিদগণের আত্মায় পোষিত এই অগ্নিবিপ্লবের কথা সচেতনভাবেই জানতো।  মুসলমান বিপ্লবীদের হৃদয় মৃত্তিকায় চাপাপড়া জিহাদের লেলিহানের কথা তারা জানত। এও জানত, যেকোনো সময় তা অগ্নিলাভার রূপ নিতে পারে এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সাজানো মঞ্চকে খাক করে দিতে পারে। এ ভয় থেকেই তারা ‘দলাদলি সৃষ্টি করো এবং শাসন করো’- এর ফর্মুলা জন্ম দেয়। মুসলিম জাতির জিহাদি জোশ, বিশ্বাসিক শক্তি, ঈমানি পূর্ণতা, কুরআন  ও সুন্নতের প্রতি আকুল ভালবাসাকে চিরতরে ধ্বংস করে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদকে চির প্রতিষ্ঠিত করার তাগিদে একজন ‘সরকারী নবী’ সৃষ্টির প্রকল্প হাতে নেয়। বিষয়টি পরে ব্রিটিশ কমিশনের একটি প্রতিবেদন থেকে প্রতিভাত হয়ে ওঠে।

১৮৬৯ সালে স্যার উইলিয়াম হান্টারের নেতৃত্বে ইংরেজগোষ্ঠী ভারতবর্ষে একটি কমিশন দল প্রেরণ করেন। ইংরেজদের সম্পর্কে মুসলমানদের মনোভাব যাচাই এবং ভবিষ্যতে মুসলমানদের কিভাবে শেষ করে দেয়া যায়, তার একটা বাস্তব পরিকল্পনা তৈরিই ছিল এই কমিশনের লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে তারা এক বছর ধরে এখানে থেকে মুসলমানদের বিভিন্ন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। ১৮৭০ সালে লন্ডনের ভয়েন্ট হাউজে একটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। তাতে কমিশনের প্রতিনিধিগণ ছাড়াও বিশেষভাবে ভারতবর্ষে নিযুক্ত মিশনারী পাদ্রিগণও অংশগ্রহণ করেন। উভয় দল ভিন্ন ভিন্নভাবে রিপোর্ট পেশ করেন। এ রিপোর্টটি পরে ‘দি এরাইভল অফ ব্রিটিশ অ্যাম্পায়ার ইন ইন্ডিয়া’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। স্যার উইলিয়াম হান্টার তার প্রতিবেদনে লিখেছেন, “মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস হলো, কোনো বিদেশি শাসনের অধীনে বেঁচে থাকার সুযোগ নেই। তাই বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে জিহাদ করা অত্যাবশ্যক। জিহাদের এই মর্মবাণীর প্রতি তাদের অন্তরে রয়েছে উত্তাল আকুলতা। তারা জিহাদের জন্য সদা প্রস্তুত থাকে। তাদের এই মনোভাব যে কোনো সময় তাদেরকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে।”

এ দিকে পাদ্রী সম্প্রদায় তাদের রিপোর্টে বলছে,

  • Report of missionary fathers.
  • majority of the population of the country blindly follow their press their Spritual leaders at this stage. we succeed in finding out would be ready to daclare himself a Zilli Nabi (apostolic prophet). then the large number of people will relly round him. but for this puopose, it is very difficult to persuade someone from the Muslim masses. if this problems solved, the prophethood of such a pesson can flourish under the patronage of the government. we have already over powered the native government mainly persuing policy of seeking help from the traitors. that is a deffitary point of view, now when we have sway over every nook of the country and there is peace and order everywhere, we ought to undertake measure which might create internal unrest among the country. [Extact from the printed report India office library, London]
  • “রাষ্ট্রের অধিবাসীদের অধিকাংশই ধর্মীয় নেতাদের অন্ধ অনুসরণ করে। এক্ষেত্রে যদি আমরা এমন কাউকে খুঁজে বের করতে পারি, যে এই কাজের জন্য প্রস্তুত হবে; নিজেকে ‘ছায়ানবী‘ হিসেবে ঘোষণা করবে। তাহলে একটি বিরাট জনগোষ্ঠী তার পাশে জড়ো হবে। কিন্তু এই লক্ষ্য সাধনের জন্য সাধারণ মুসলমানদের কাউকে উৎসাহিত করা কঠিন। যদি এই সমস্যা সমাধান হয়, তাহলে এই ব্যক্তির নবুওয়াতের বিষয়টিকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এগিয়ে নেয়া যায়। আমরা ইতিপূর্বে গাদ্দারদের সহযোগিতায় ভারতের শাসকদের প্রজা বানিয়েছি। কিন্তু সে ছিল ভিন্ন বিষয়। তখন সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে গাদ্দারদের প্রয়োজন ছিল। এখন যখন রাষ্ট্রের সকল প্রান্তে আমাদের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বহমান; তখন আমাদের এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যাতে রাষ্ট্রে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সৃষ্টি হয়।” [প্রিন্টেড রিপোর্ট, ইন্ডিয়া অফিস লাইবেরি, লন্ডন ]

এই রিপোর্টের আলোকে আমরা ব্রিটিশ পরিকল্পনাটি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি। মূলত এই পরিকল্পনার অধীনেই ব্রিটিশ প্রশাসন শীয়াদের মধ্য থেকে মির্যা হুসাইন আলী নূরীকে (যিনি বাহাউল্লাহ নামে প্রসিদ্ধ) আর সুন্নীদের মধ্য থেকে মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে স্বপ্রণীত নবুয়তের স্টেজে দাঁড় করিয়ে দেয়। মির্যা কাদিয়ানীর তৎপরতাগুলো সামান্য খুঁটিয়ে দেখলেই আমরা সহজে এই বিশ্বাসে উপনীত হতে পারব যে, কাদিয়ানীর নবুওয়াত ব্রিটিশদের তৈরি, তাদের হাতেই লালিত হয়েছে এবং বেড়ে উঠেছে তাদেরই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। আর এ কথা স্বয়ং কাদিয়ানীও তার বিভিন্ন রচনায় স্বীকার করেছে। যেমন, লক্ষ করুন!

বৃটিশ রাণী ভিক্টোরিয়াকে এক চিঠিতে লিখেছেন,

“হে মহামহিম ভারত সম্রাজ্ঞী! আপনার মহিমা এবং সুনাম মুবারক হোক! খোদার দৃষ্টি (তথা করুণা) সে দেশের উপরই রয়েছে, যে দেশের উপর রয়েছে আপনার দৃষ্টি, খোদার রহমত (তথা সাহায্য) সে জনতার উপরই রয়েছে যে জনতার উপর রয়েছে আপনার হাত (তথা হুকুমত)। আপনার পবিত্র নিয়ত (আকাঙ্খা) এর ফলশ্রুতিতেই আল্লাহ আমাকে (রূপক ‘মসীহ’ বানিয়ে) প্রেরণ করেছেন।” (সেতারায়ে কায়সারিয়া, রূহানী খাযায়েন ১৫/১২০, মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী)।

কাদিয়ানী তার এ লিখায় অকপটে বলেই দিয়েছে যে, আল্লাহ নাকি তাকে বৃটিশ রাণীর পবিত্র নিয়ত (আকাঙ্খা) এর ফলশ্রুতিতেই দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন।” প্রামাণ্য স্ক্যানকপি দ্রষ্টব্য।

পাঞ্জাবের লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে এক আর্জিতে লিখেছেন,

“নিজেদের হাতে রোপিত এই চারাগাছটির ব্যাপারে খুব সতর্কতা ও অনুসন্ধানের সাথে অগ্রসর হবেন এবং আপনার অধীনস্তদের বলবেন তারা যেন এই পরিবারের ত্যাগ ও নিষ্ঠার কথা মনে করে আমার দলের প্রতি সদয় দৃষ্টি জ্ঞাপন করেন। আমাদের পরিবার ইংরেজ সরকারের কল্যাণে নিজেদের খুন বইয়ে দিতে ও জীবন দিতেও দ্বিধা করেনি আর না এখনো দ্বিধা করছে।” (মাজমু’আয়ে ইশতিহারাত ৩/২১-২২; নতুন এডিশন)।

আরেকটি রচনায় লিখেছেন,

“আমার (ধর্ম)মত এটাই যা আমি প্রতিবার প্রকাশ করে থাকি তা হল, ইসলামের দুটি অংশ। একটি হল খোদাতালার আনুগত্য করা আর দ্বিতীয়টি হল, এই (ব্রিটিশ) সরকারের আনুগত্য করা যে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করেছে এবং জালেমদের হাত থেকে আপনা ছায়ার নিচে আশ্রয় দিয়েছে। সেটি হল ব্রিটিশ সরকার।” (রূহানী খাযায়েন ৬/৩৮০)।

আরেক জায়গায় লিখেছেন,

“আমার জীবনের অধিকাংশই এই ইংরেজ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা আর সহযোগিতার মধ্যেই অতিবাহিত হয়েছে। আমি জিহাদ নিষিদ্ধ করে ইংরেজ সরকারের আনুগত্যের উপর এই পরিমাণ কিতাব (পুস্তক) রচনা করেছি এবং (এত অধিক পরিমাণ) প্রচারপত্র প্রকাশ করেছি যদি ঐ পত্রাবলী এবং পুস্তকগুলি একত্রিত করা হয় তাহলে তা দ্বারা ৫০টি আলমারি ভর্তি হয়ে যাবে। আমি এই সমস্ত কিতাব তামাম আরব, মিশর, সিরিয়া, কাবুল এবং রোম (ইউরোপ-ইতালি) দেশেও পৌঁছে দিয়েছি। আমার সদাসর্বদা প্রচেষ্টা এটাই থাকে যে, মুসলমানরা যেন এই (ইংরেজ) সরকারের প্রকৃত খয়েরখাঁ হয়ে যায় এবং খুনি মাহদী এবং খুনি মসীহ সংক্রান্ত ভিত্তিহীন বর্ণনাসমূহ এবং জিহাদের প্রতি উদ্বুদ্ধকারী সমস্ত মাসয়ালা তাদের অন্তরসমূহ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় যেগুলো আহাম্মকদের অন্তরসমূহ খারাপ করে দিয়েছে।” (রূহানী খাযায়েন ১৫/১৫৫-৫৬)।

তিনি অন্য একটি রচনায় লিখেছেন,

“আমি বিশ বছর পর্যন্ত ইংরেজ সরকারের প্রতি আনুগত্যের শিক্ষাই দিয়ে যাচ্ছি। আমি আমার মুরিদদের মাঝে এই হিদায়াতই (নির্দেশনা) জারি রেখেছি। তাহলে কিভাবে সম্ভব হতে পারে যে, আমি এই সমস্ত হিদায়াতের বিপরীতে কোনো প্রকারের সরকার-দ্রোহী অভিসন্ধির শিক্ষা দিচ্ছি! অথচ আমি জানি যে, আল্লাহতালা স্বীয় খাস অনুগ্রহে এই সরকারকেই আমার এবং আমার জামাতের আশ্রয়স্থল বানিয়েছেন। এই সরকারের ছায়াতলে আমাদের জন্য যে নিরাপত্তা অর্জিত সেটি না মক্কা শরীফে রয়েছে আর না মদীনায় আর না রোম সম্রাটের কনস্টানটিনোপলের সিংহাসনেও।” (রূহানী খাযায়েন ১৫/১৫৬)।

আরেকটি রচনায় লিখেছেন,

“আমি ইংরেজ সরকারের যে সেবা করেছি তা হলো, এ দেশে এবং অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রে প্রায় পঞ্চাশ হাজার বই পুস্তক এবং প্রচারপত্র ছাপিয়ে বিতরণ করেছি। এ সব রচনায় আমি বলেছি, ইংরেজ সরকার আমাদের মুসলমানদের কল্যাণকামী বন্ধু। তাই ইংরেজ সরকারের নিষ্ঠাপূর্ণ আনুগত্য প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজ।” (সেতারায়ে কায়সারিয়া-৪, রূহানী খাযায়েন ১৫/১১৪, মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী)।

সুতরাং নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে, কাদিয়ানীর কথিত নবুওয়ত ব্রিটিশ সরকারেরই একটি পরিকল্পিত প্রজেক্ট। ব্রিটিশরাই নিজেদের ক্ষমতা টিকানোর উদ্দেশ্যে তাকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে দাঁড় করিয়েছিল। একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিকের পক্ষেও কখনো সম্ভব নয় যে, দখলদার বিদেশীদের দখলদারিত্বের পক্ষে জীবন উৎসর্গ করা, পঞ্চাশটি আলমারি ভর্তি লিখনী দিয়ে সাহায্য করা। কাজেই তার মাহদী, মসীহ কিংবা ‘ছায়ানবী’ ইত্যাদি দাবীসমূহ বাতুলতা আর ভেল্কিবাজি ছাড়া আর কিছুই না।

মির্যা গোলাম আহমদের নবুওয়ত দাবী প্রকৃত অর্থেই, রূপক বা ভিন্ন অর্থে ছিলনা

0

মির্যায়ী রচনাবলী থেকে তথ্যপ্রমাণ সহ নিম্নরূপ,

নবী ও রাসূল দাবী

আমার দাবী, আমি নবী এবং রাসূল। (দৈনিক আল হাকাম ৫ই মার্চ ১৯০৭ইং, মালফুযাত ১০/১২৭ পুরাতন এডিশন, ৫/৪৪৭ নতুন এডিশন)।

শোনো! প্রত্যেক আহমদী এ বিশ্বাসে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, সেই পবিত্র, মহৎ ও ধর্মভীরু ব্যক্তিত্ব যাকে অনেকে মির্যা কাদিয়ানী বলে থাকে, তিনি আল্লাহর মনোনীত একজন নবী। (নবুওয়ত ও খেলাফত ১৭, আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত, বকশিবাজার ঢাকা)।

আল্লাহর আদেশ মোতাবেক আমি একজন নবী। আমি এই দাবী অস্বীকার করলে আমার পাপ হবে। (আখবারে আ’ম ২৬ মে ১৯০৮ ইং, নবুওয়ত ও খেলাফত ৭৬)।

তিনিই সত্য খোদা যিনি কাদিয়ানে তার রাসূল প্রেরণ করেছেন। (দাফেউল বালা ১২, রূহানী খাযায়েন ১৮/২৩১ মির্যায়ী রচনাসমগ্র যা ২৩ খণ্ডে প্রকাশিত)।

আমি একজন রাসূলও এবং নবীও অর্থাৎ আমি প্রেরিত হয়েছি এবং খোদার পক্ষ থেকে আমি গায়েবের সংবাদ প্রাপ্তও। (একটি ভুল সংশোধন, রূহানী খাযায়েন ১৮/২১১)।

যারা একজন সম্মানিত রাসূলকে গ্রহণ করল না, তারা ধ্বংস হয়ে গেছে। ভাগ্যবান সে যে আমাকে চিনতে পেরেছে। আমি খোদার সকল পথের শেষ পথ। আমি তার সকল নূরের শেষ নূর। দুর্ভাগা সে যে আমাকে প্রত্যাখ্যান করল। কারণ, আমি ছাড়া সব অন্ধকার। (কিশতিয়ে নূহ, রূহানী খাযায়েন ১৯/৬১)।

আমি সে খোদার নামে কসম করে বলছি যার হাতে আমার প্রাণ, তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন এবং তিনিই আমার নাম নবী রেখেছেন। (হাকীকাতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/৫০৩)।

এতে কি সন্দেহ যে, আমার ভবিষ্যৎবাণীগুলোর পর দুনিয়াতে ভূমিকম্প ও অন্যান্য আপদ-বিপদ একের পর এক শুরু হওয়া আমার সত্যতার একটি নিদর্শন। মনে করা উচিত, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে আল্লাহর রাসূলকে অস্বীকার করলে তখন অন্য অপরাধীদেরও পাকড়াও করা হয়। (হাকীকাতুল ওহী উর্দূ ১৬১)।

খোদাতালা কাদিয়ানে এই ধ্বংসাত্মক মহামারী থেকে রক্ষা করবেন। কেননা এটা তাঁর রাসূলের রাজধানী। (দাফেউল বালা ১০)।

তিনি (অর্থাৎ গোলাম আহমদ) নবী। আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সেই সকল শব্দে নবী বলেছেন, যে সকল শব্দ দ্বারা কুরআন ও হাদীসে পূর্ববর্তী নবীদের আখ্যায়িত করা হয়েছে। (হাকীকাতুন নবুওয়ত ৭০, মির্যা বশির উদ্দীন মাহমুদ)।

মির্যা কাদিয়ানীর পুত্র এবং কাদিয়ানীদের দ্বিতীয় খলীফা মির্যা বশির উদ্দীন মাহমুদ (মৃত. ৭ই নভেম্বর ১৯৬৫ ইং) লিখেছেন,

  • اگر میرے گردن کے دونوں طرف تلوار بھی رکھ دی جائے اور مجھے کہا جائے کہ تو یہ کہو کہ آنحضرت صلی اللہ علیہ وسلم کی بعد کوئی نبی نہیں آئےگا تو میں اس سے کہوں گا کہ تو جھوٹا ہے اور کذاب ہے آپ کے بعد نبی آسکتے ہیں اور ضرور آسکتے ہیں

অর্থ-“যদি আমার গর্দানের দুই পাশে তলোয়ারও ধরে রাখা হয় আর আমাকে বলতে বলা হয় যে, তুমি বল, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর আর কোনো নবী আসতে পারেনা! তাহলে আমি অবশ্যই বলব যে, তুমি মিথ্যাবাদী ও মহা মিথ্যুক। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর নবী আসতে পারে, অবশ্যই আসতে পারে।” (আনওয়ারে খিলাফাত পৃষ্ঠা ৬৭, উর্দূ অনলাইন এডিশন, মির্যা বশির উদ্দীন মাহমুদ)।

মির্যা বশির উদ্দীন একই গ্রন্থের আরেক জায়গায় পরিষ্কার লিখেছেন,

  • اور (انہیں) یہ سمجھ لیا جائے کہ خدا کے خزانے ختم ہوگی اس لئے کسی کو کچھ نہیں دے سکتا اسی طرح یہ کہتے ہیں کہ خواہ کتنا ہی زہد اور اتقاء میں بڑھ جائے پرہیزگاری اور تقوی میں کئی نبیوں سے اگے گزر جائے معرفت الہی کتنی ہی حاصل کر لے لیکن خدا اس کو کبھی نبی نہیں بنائے گا اور کبھی نہیں بنائے گا ان کا یہ سمجھنا خدا تعالی کی قدر کو ہی نہ سمجھنے کی وجہ سے ہیں ورنہ ایک نبی کیا میں تو کہتا ہوں ہزاروں نبی ہوں گے

অর্থ-“তারা মনে করছে যে, আল্লাহতালার ভাণ্ডার শেষ হয়ে গেছে, তাই তিনি (এখন) কাউকে কিছুই দেন না। তেমনিভাবে এও বলে যে, কোনো কেউ দুনিয়াবিরাগী এবং খোদাভীরুতায় ও তাকওয়া আর পরহেজগারীতে কতেক নবী অপেক্ষায় যতই অগ্রে পৌঁছে যায় না কেন, সে যত বেশিই খোদার মা’রেফত (দর্শন) লাভ করেনা কেন; কিন্তু খোদা তাকে কখনোই নবী বানাবেন না। তাদের এইরূপ মনে করার কারণ হচ্ছে খোদাতালার মর্যাদা বুঝতে না পারা। অন্যথা নবী শুধুই একজন কেন! আমি তো বলি, হাজার হাজার নবী হবেন।” (আনওয়ারে খিলাফাত পৃষ্ঠা ৬৪, উর্দূ অনলাইন এডিশন, মির্যা বশির উদ্দীন মাহমুদ)।

কাদিয়ানীদের তথাকথিত দ্বিতীয় খলীফা মির্যা বশির উদ্দীন মাহমুদ তাঁর পিতার “নবী” দাবীর বিষয়টিকে মূল্যায়ন করে লিখেছেন,

جب حضرت مسیح موعود نبی ثابت ہوگئے، ایسے ہی نبی جیسے دوسرے انبیاء علیہم السلام تو پھر ان کے بھی وہی حقوق ہیں جو دوسرے انبیاء کے ہیں-

অর্থাৎ হযরত মসীহ মওউদ (মির্যা সাহেব) যখন একজন নবী বলে সাব্যস্ত হয়ে গেল, ঠিক তেমনি একজন নবী; যেমন অন্যান্য নবীগণ, তখন তো উনার-ও অনুরূপ অধিকার থাকবে যেভাবে অন্যান্য নবীগণের রয়েছে। (কাদিয়ানীদের অফিসিয়াল উর্দূ পত্রিকা দৈনিক আল ফজল পৃ-১০ কলাম ৩, তারিখ ৩০-১২-১৯১৬ ইং)।

  • মির্যা বশির উদ্দীন মাহমুদের এ কথা থেকে প্রমাণিত হয়ে গেল যে, মির্যা কাদিয়ানী প্রকৃতপক্ষেই একজন “নবী” দাবীদার ছিল। অতএব, তার অনুসারীদের বিভিন্ন রচনা কিবা বক্তৃতায় সেটিকে “উম্মতি-বুরুজী-জিল্লি” শব্দে ব্যাখ্যা দিতে চাওয়া সুস্পষ্ট একটা ধোকা ও প্রতারণা। সাধারণ মানুষের ক্ষোভ এবং প্রশ্নবাণে আত্মরক্ষার হীন-কৌশল ছাড়া আর কিছুই না।

সুতরাং এতে কী সন্দেহ যে, প্রতিশ্রুত মসীহ কুরআন কারীমের অর্থ বিচারেও নবী এবং অভিধানের অর্থ বিচারেও নবী। (হাকীকাতুন নবুওয়ত ১১৬, মির্যা বশির উদ্দীন মাহমুদ)।

অতএব ইসলামি শরীয়ত নবী শব্দের যে ব্যাখ্যা দেয় সে ব্যাখ্যা হিসেবে হযরত মির্যা সাহেব কিছুতেই রূপক নবী নন, বরং প্রকৃত অর্থেই নবী। (হাকীকাতুন নবুওয়াত ১৭৪, মির্যা বশির উদ্দীন মাহমুদ)।

নবী হওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে আমরাও মির্যা গোলাম আহমদকে পূর্ববর্তী নবীগণের মতোই নবী মনে করি। (হাকীকাতুন নবুওয়াত ২৯২, মির্যা বশির উদ্দীন মাহমুদ)।

১৯০১ সাল পর্যন্ত মির্যা সাহেবের ধারণা ছিল যে, আমার নবুওয়ত অপূর্ণাঙ্গ ও খণ্ডিত, যেন তিনি ছায়ানবী। কিন্তু ১৯০১ সালে আল্লাহর ওহী তাকে মনোযোগী করে যে, তার নবুওয়ত অপূর্ণাঙ্গ কিংবা খণ্ডিত নয়, বরং তার নবুওয়ত ঠিক সেই রকম যেমন ছিল পূর্ববর্তী সকল নবীর। এই ওহীর পর তার আকীদা পরিবর্তন হয়ে যায়। পরে তিনি আর নিজের নবুওয়তকে অপূর্ণাঙ্গ ও খণ্ডিত বলেননি। (হাকীকাতুন নবুওয়াত ১২০, মির্যা বশির উদ্দীন মাহমুদ)।

১৯০১ সালের পূর্বের যেসব উদ্ধৃতিতে তিনি নবী হওয়াকে অস্বীকার করেছেন, এখন তা রহিত হয়ে গেছে এবং সেগুলো থেকে প্রমাণ উপস্থাপন করা এখন ভুল। (হাকীকাতুন নবুওয়াত ১২১, মির্যা বশির উদ্দীন মাহমুদ)।

পূর্বেও তাকে নবী নামে ডাকা হতো। কিন্তু তিনি তার ব্যাখ্যা করতেন। এরপর আল্লাহ তায়ালা যখন বারবার ইলহামের মাধ্যমে তাকে নবী বলে ডাকছিলেন, তখন তিনি উপলব্ধি করলেন যে, আসলে তিনি নবীই, অন্য কিছু নন। যেমনটি পূর্বে মনে করতেন। নবী শব্দটি যা তার ইলহামে ব্যবহৃত হত তা একেবারেই দ্ব্যর্থহীন ও স্পষ্ট, ব্যাখ্যার সুযোগ নেই। (হাকীকাতুন নবুওয়ত ১২৪, মির্যা বশির উদ্দীন মাহমুদ)।

  • লিখক, মুহাম্মদ নূরুন্নবী এম.এ
  • কাদিয়ানী মতবাদ বিশেষজ্ঞ

কওমী মাদরাসার চাঁদা ও চামড়া কালেকশনে সিস্টেমেটিক সংস্কার সময়ের দাবী

0

বর্তমানে ক্বওমী মাদরাসাগুলো জনগণের সাহায্য সহযোগিতায় চলার যে পদ্ধতিটা দেখা যাচ্ছে এটা মূলত আমাদের আকাবিরদের তরীকার বিপরীত। দেওবন্দে কালেকশনের জন্য আলাদা মুহাসসিল আছে। এটা উস্তাদ ছাত্রের কাজ নয়।

আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে উস্তাদ ছাত্ররা এটা আঞ্জাম দেয়। কোরবানির সময় ছাত্রদের দিয়ে চামড়া কালেকশন করার বিষয়টা সব সময় আমাদের বিবেকে বাঁধে, আমাদেরকে পীড়া দেয়। একই বাড়ির সামনে ছাত্র-উস্তাদ দাঁড়িয়ে আছেন চামড়ার জন্য, ভিক্ষুক দাঁড়িয়ে আছে গোশতের জন্য। বাড়িওয়ালা ভিক্ষুকদেরও ধমকাচ্ছে, ছাত্র-শিক্ষকদেরও ধমকাচ্ছে। বাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়ার ঘটনাও তো আমাদের সামনেই ঘটেছে। এমন দৃশ্যগুলো আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। এছাড়াও আরও কত লাঞ্ছনাকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। তা তো আমরা নিজ চোখেই দেখেছি। আবার অল্প সময়ে ভালো পরিমাণ অর্থ আয় হওয়াতে কমিটির লোকেরা এটা কোনোভাবেই বন্ধ করতে সম্মত হয় না। তাছাড়া রমজান মাসে কালেকশনের জন্য শিক্ষকদের বাধ্য করাও আমাদের মাদরাসাগুলোতে বিচিত্র নয়। সে কালেকশন করতে গিয়ে তাদের মান-মর্যাদা ঠিক থাকবে কিনা তা দেখার যেন কেউ নেই।

হযরত থানবী (রহ.) এর বক্তব্য ছিল, কোনো ছাত্র তো নয়; কোনো শিক্ষকও কালেকশন করতে যাবে না। এমনকি যদি এর জন্য মাদরাসার সংখ্যা কমে যায়, তাও দীনের জন্য ভালো। তাই আমরা আমাদের এখানে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি যেন ছাত্র-শিক্ষক সকলেরই ইজ্জত সুরক্ষিত থাকে। কালেকশনের জন্য তারা মানুষের বাড়ি-বাড়ি যাবে না। চামড়ার কালেকশন করবে না। এমনিভাবে উস্তাদরাও রমজানে যাকাত কালেকশনের জন্য রশিদ বই নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করবে না।

হ্যাঁ, নিজের ইজ্জত রক্ষা করে যতটুকু করা যায় তা করবে। পারলে করবে, না পারলে না করবে। কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। অর্থনৈতিক বিষয়টা আমরা সামনে রেখে তা’লীম গ্রহণে আসলাফ ও আকাবিরের যে চেতনা ও পদ্ধতি ছিল তা আবার ফিরিয়ে আনার চিন্তা করেছি। অর্থাৎ ইলম হাসিলের পথে ছাত্র তার সাধ্যমত খরচ করবে। যেমন সালাফের যামানায় ইলম হাসিলের যাবতীয় খরচ শিক্ষার্থী নিজে বহন করত। কারও কারও জীবনীতে পাওয়া যায়, বাবার রেখে যাওয়া বিপুল সম্পদের পুরোটাই ইলমের পথে ব্যয় করে দিয়েছেন।

তাই আমাদের চিন্তা হল প্রতিষ্ঠান নয়; শিক্ষার্থী নিজেই নিজের খরচ বহন করবে। সাধারণত আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ম হল, নির্ধারিত নম্বর পেলে মাসিক প্রদেয় মওকুফ হয়ে যায়। কিন্তু এই ফিকির সামনে রেখে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, মাসিক প্রদেয় ফ্রি হওয়ার সম্পর্ক থাকবে সামর্থ্যের সাথে, নম্বরের সাথে নয়। নম্বর বিবেচ্য হবে কেবল ভর্তির ক্ষেত্রে। নম্বর পেলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবে, না হয় না।

এর অর্থ এই নয় যে, এখানে কেবল ধনীরাই সুযোগ পাবে। ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবার জন্য অবারিত সুযোগ থাকবে। তবে প্রত্যেকেই সাধ্য অনুযায়ী ব্যয় করবে; স্বচ্ছলতা নেই বলে সে কিছুই দিবে না- এমন যেন না হয়। যে যতটুকু পারে ততটুকুই দিবে, বাকিটুকু প্রতিষ্ঠান বহন করবে। খরচ করতে অভ্যস্ত হওয়া ইলমের জন্য যেমন দরকার তেমনি দরকার নিজের ব্যক্তিত্ব গঠনের জন্য। এই অভ্যাস না থাকলে ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। একজন লোক যত বড়ই হোক যদি অন্যকে দেওয়ার অভ্যাস তার মাঝে গড়ে না উঠে, কেবল গ্রহণ করেই সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে কোনদিন তার মানসিকতা বড় হয় না। তার প্রতি মানুষের ভক্তি-শ্রদ্ধা জন্মায় না। মানুষ তাকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে না। তাই সমাজে সে কোনো প্রভাবও রাখতে পারেনা, সে গলে যায় অর্থবিত্তের সামনে। এজন্য কেবল যোগ্যতাই যথেষ্ট নয়, যোগ্যতার ব্যবহারের জন্য এই ব্যক্তিত্বকেও ধরে রাখা অত্যন্ত জরুরি।

  • আল্লামা আবুল বাশার সাইফুল ইসলাম হাফিজাহুল্লাহ।
  • শাইখুল হাদীস : জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া৷
  • মুহাম্মাদপুর, ঢাকা৷

জাওনিয়া রাজকুমারীর সাথে বাসর হবার আগেই তালাক্ব দিয়ে দেয়ার কারণ

0

প্রশ্নঃ নবী করীম (সা.)-এর স্ত্রী ‘জাওনিয়া’কে বাসরের আগেই তালাক প্রদান করার কারণ কী ছিল?

উত্তরঃ আল্লামা খায়রুদ্দীন আয যিরিকলী আদ দামেস্কী (মৃত.১৩৯৬ হি.) এর সংকলন ‘আল আ’লাম’ (الأعلام للزِّرِكْلي) এর মধ্যে লিখা আছে, ((أسماء بنت النعمان بن أبي الجون الكندي: من شهيرات نساء العرب شرفا وجمالا. يرتفع نسبها إلى آكل المرار ملك كندة. كان مقام أهلها بنجد، وقدمت مع أبيها على النبي صلّى الله عليه وسلم وهو في المدينة، فعرضها أبوها على النبي صلّى الله عليه وسلم فارتضاها وأمهرها، ولم يتزوج بها لصلف كانت موصوفة به، فأقامت في المدينة إلى أن توفيت في خلافة عثمان)) অর্থাৎ তিনি আসমা বিনতে নুমান ইবনে আবী জাওন আল কিন্দী (মৃত. ৩০ হি.)। একজন অভিজাত ও সুন্দরী আরব রমনী। তিনি কিন্দী বংশীয় রাজকুমারী ছিলেন। নজদের বাসিন্দা। তিনি নবী করীম (সা.)-এর নিকট স্বীয় পিতার সাথে মদীনায় আসেন। অত:পর তার পিতা তাকে নবী করীম (সা.)-এর নিকট সমর্পণ করলে তিনি তাকে গ্রহণ করেন এবং মোহর প্রদান করেন। কিন্তু তিনি তার অহংকারী স্বভাবের কারণে তার সাথে সহবাস করেননি (পরবর্তীতে তালাক্ব দিয়ে দেন-অনুবাদক)। তিনি মদীনায় বসবাস করেন এবং উসমান (রা.)-এর খিলাফত যুগ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।

এবার বিস্তারিতঃ

জাওনিয়া সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। মুহাদ্দিসগণ এ সম্পর্কিত রেওয়ায়েত গুলোর মতন বা মূলপাঠ’কে মুযতারিব তথা উলোটপালোট বর্ণনা বলে অভিহিত করেছেন। ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী (রহ.) নিজেও এ সংক্রান্ত বর্ণনাগুলোর মতনকে ‘মুযতারিব’ আখ্যা দিয়েছেন (ফাতহুল বারী ৯/৩৫৮)। যেমন তিনি লিখেছেন ((وإن كانت القصة متعددة ولا مانع من ذلك فلعل هذه المرأة هي الكلابية التي وقع فيها الاضطراب)) অর্থাৎ গল্পটি যদিও একাধিক এবং তাতে কোনো আপত্তি নেই কিন্তু এই মহিলাটি-ই গল্পের নায়িকা, যার গল্পে ইযতিরাব বা উলোটপালোট রয়েছে।

উসূলে হাদীসের একটি নিয়ম হচ্ছে, সনদ বা সূত্র সহীহ হলেও যখন ‘মতন’ মুযতারিব হিসেবে সাব্যস্ত হবে তখন আর ঐ মতনের উপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবেনা। জাওনিয়া সম্পর্কে ঐতিহাসিক বিবরণটিও অনুরূপ। একটু পরেই এ সম্পর্কে লিখব, ইনশাআল্লাহ।

সম্পূর্ণ লিখাটির উপসংহার যদি ছোট্ট পরিসরে বলতে চাই তাহলে বলব, নবী করীম (সা.)-এর সাথে বিয়ে হওয়ার পরে ‘জাওনিয়া’ নামক ঐ রাজকুমারী সংসার করার প্রস্তাবে অমত পোষণ করেন। যার ফলে রাসূল (সা.) তাকে বিদায় করে দেন। এটা বুঝা যায় এক রেওয়ায়েত অনুসারে।

আরেক রেওয়ায়েত অনুসারে বিয়ের প্রস্তাব দিতে আসলে তিনি তা ফিরিয়ে দেন নিজেকে রাজকুমারী ভেবে। সে তখন রাসূল (সা.)-এর প্রতি অপ্রীতিকর উক্তিও করে বসে। কিন্তু তাকে পরবর্তীতে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, সে নাকি তখন রাসূল (সা.)-কে চিনতে পারেনি। আসল কথা হচ্ছে, রেওয়ায়েতগুলোর মতনে অসঙ্গতি খুব বেশি। ফলে মতনগুলোকে “মুযতারিব” (উলোটপালোট) আখ্যা দিয়ে এর উপর স্কলারগণ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। কিন্তু অল্প বিদ্যা ভয়ংকর টাইপের আনাড়ি কতিপয় এন্টি-ইসলাম নাস্তিকদের এগুলো বুঝানোই অসম্ভব!

জাওনিয়ার পরিচয়ঃ

জাওনিয়া’র পরিচয় হিসেবে উঠে এসেছে যে, তিনি নুমান ইবনে জাওন আশ শারাহীল এর কন্যা। কেউ বলেছেন, নুমান ইবনে আসওয়াদ আল হারিছের কন্যা। কেউ বলেছেন, তিনি বনু হারিস গোত্রের নুমানের কন্যা আসমা, আবার কারো কারো মতে, তিনি বনু সুলাইম গোত্রের মেয়ে। যাইহোক, সহীহ বুখারীর বর্ণনায় তার নাম উমায়মাহ উল্লেখ থাকলেও অন্যান্য বর্ণনায় তাঁর বিভিন্ন নাম উল্লেখ থাকা প্রমাণিত। ইমাম ইবনু আব্দিল বার মালেকী (রহ.) বলেছেন, ((أجمعوا أن رسول الله تزوجها واختلفوا في قصة فراقها)) অর্থাৎ সবাই একমত যে, রাসূল (সা.) তাকে বিয়ে করেছেন। তবে তার বিচ্ছেদ সংক্রান্ত ঘটনায় ঐতিহাসিকগণ মতবিরোধ করেছেন।

হুসাইন ইবনু ওয়ালীদ নিশাপুরী (রহ.) … সাহল ইবনু সা’দ ও আবূ উসায়দ (রা.) থেকে বর্ননা করেন। তারা বলেন যে, ((تَزَوَّجَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم أُمَيْمَةَ بِنْتَ شَرَاحِيلَ ، فَلَمَّا أُدْخِلَتْ عَلَيْهِ بَسَطَ يَدَهُ إِلَيْهَا ، فَكَأَنَّهَا كَرِهَتْ ذَلِكَ ، فَأَمَرَ أَبَا أُسَيْدٍ أَنْ يُجَهِّزَهَا وَيَكْسُوَهَا ثَوْبَيْنِ رَازِقِيَّيْنِ)) অর্থাৎ নবী করীম (সা.) উমায়মাহ বিনত শারাহীলকে বিবাহ করেন। পরে তাকে তাঁর কাছে আনা হলে তিনি তার দিকে হাত প্রসারিত করেন। সে এটি অপছন্দ করল। এরপর তিনি আবূ উসায়দকে নির্দেশ দিলেন, তার জিনিস গুটিয়ে এবং দু-খানা কাতান বস্ত্র পরিয়ে তাকে তার পরিবারে পৌঁছে দিতে। (বুখারী-৫২৫৬ আন্তর্জাতিক নম্বর)।

তবক্বাতে ইবনে সা’দ (৮/১৪৫) গ্রন্থে একটি বর্ণনায় এসেছে, জাওনিয়া ছিলেন আরবের এক সুন্দরী ও অভিজাত রমনী। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) তাকে বিয়ে করেন। তিনি আরও বলেছেন ((فلما رآها نساء النبي صلى الله عليه وسلم حسدنها ، فقلن لها : إن أردت أن تحظي عنده فتعوذي بالله منه إذا دخل عليك . فلما دخل وألقى الستر مد يده إليها ، فقالت : أعوذ بالله منك . فقال: أمن عائذ الله ! الحقي بأهلك)) অর্থাৎ যখন নবী করীম (সা.)-এর স্ত্রীরা তাকে দেখলেন তখন তারা তার সৌন্দর্যের কারণে তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হন। স্ত্রীরা জাওনিয়াকে শিখিয়ে দিলেন যে, যদি তুমি তার সাথে মজা করতে চাও, তাহলে তিনি তোমার কাছে প্রবেশ করলে তার কাছ থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে অর্থাৎ তাঁকে বলবে ‘আউযুবিল্লাহহি মিনকা’। তারপর তিনি যখন প্রবেশ করে পর্দা সরিয়ে তার দিকে হাত প্রসারিত করলেন তখন তিনি বললেন, আউযুবিল্লাহহি মিনকা। অত:পর তিনি বললেন, তুমি আল্লাহর আশ্রয়ে নিরাপদ থেকো। তুমি তোমার পরিবারের সাথে গিয়ে মিলিত হয়ে যাও (অর্থাৎ নবী করীম সা. তাকে বিয়ে থেকে অব্যাহতি দিয়ে দেন)।

জাওনিয়ার সাথে নবী করীম (সা.)-এর সাক্ষাৎ ও দু পক্ষের আলাপচারিতা,

সহীহ বুখারীর ৫২৫৫ নং হাদীস হতে বুঝা যায় যে, নবী করীম (সা.) হযরত আবূ উসায়েদ (রা.)-এর কাছ থেকে জাওনিয়া সম্পর্কে প্রথম সংবাদ পান। কিন্তু জাওনিয়ার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কারণে তিনি তার সাথে বাসর করা থেকে বিরত থাকেন। হাদীসটির বাংলা অনুবাদ এই,

আবূ উসায়দ (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেনঃ আমরা নবী করীম (সা.) এর সাথে বের হয়ে শাওত নামক বাগানের নিকট দিয়ে চলতে চলতে দু’টি বাগান পর্যন্ত পৌঁছলাম এবং এ দু’টির মাঝে বসলাম। তখন নবী করীম (সা.) বললেনঃ তোমরা এখানে বসে থাক। তিনি (বাগানের ভেতরে) প্রবেশ করলেন। তখন নুমান ইবনে শারাহীলের কন্যা উমায়মাহ’র খেজুর বাগানস্থিত ঘরে তাকে আনা হয়। আর তাঁর খিদমতের জন্য ধাত্রীও ছিল। নবী করীম (সা.) যখন তার কাছে গিয়ে বললেন, তুমি নিজেকে আমার কাছে সমর্পণ কর। তখন সে বললঃ কোনো রাজকুমারী কি কোনো বাজারি (অ-রাজকুমার) মানুষের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে?

বর্ণনাকারী বলেনঃ এরপর তিনি তাঁর হাত প্রসারিত করলেন তার শরীরে রাখার জন্য, যাতে সে শান্ত হয়। সে বললঃ আমি আপনার থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চাই। তিনি বললেনঃ তুমি উপযুক্ত সত্তারই আশ্রয় নিয়েছ। এরপর তিনি (সা.) আমাদের নিকট বেরিয়ে আসলেন এবং বললেনঃ হে আবূ উসায়দ! তাকে দু’খানা কাতান কাপড় পরিয়ে দাও এবং তাকে তার পরিবারের নিকট পৌঁছিয়ে দাও। (বুখারী-৫২৫৫)।

যারা আরবী ভাষার অলংকার সম্পর্কে ভালো দখল রাখেন এবং বাগধারা বুঝেন তাদের নিকট এটা পরিষ্কার যে, হাদীসটির এই শেষাংশ যেন ডেকে ডেকে বলছে যে, জাওনিয়ার সাথে নবী করীম (সা.)-এর বিবাহ আগ থেকেই সম্পন্ন ছিল, যা অন্যান্য বিশুদ্ধ বর্ণনামতেও প্রমাণিত। অন্যথা তিনি আবূ উসায়দকে কেন নির্দেশ দিলেন যে, যেন তিনি জাওনিয়াকে দু’খানা কাতান কাপড় প্রদান করেন!? ফলে বলা যেতে পারে যে, জাওনিয়াকে উদ্দেশ্য করে ‘তুমি নিজেকে আমার কাছে সমর্পণ কর’-কথাটি নবী করীম (সা.) বাসর অর্থেই বুঝিয়েছেন। ইমাম বুখারী (রহ.) হাদীসটির অধ্যায় দাঁড় করেছেন এইরূপ, ((بَاب مَنْ طَلَّقَ وَهَلْ يُوَاجِهُ الرَّجُلُ امْرَأَتَه“ بِالطَّلاَقِ)) অর্থাৎ তালাক্ব দেয়ার সময় স্বামী কি তার স্ত্রীর সম্মুখে তালাক্ব দেবে? সুতরাং এতেও বুঝা যাচ্ছে যে, বিয়ে পূর্ব থেকেই সম্পন্ন ছিল, কিন্তু জাওনিয়া সংসার করতে অসম্মতি প্রকাশ করায় নবী করীম (সা.) তার সম্মুখেই তাকে বিবাহ-বন্ধন থেকে অব্যহতি (তালাক্ব) দিয়ে দেন।

বলে রাখা দরকার, সহীহ বুখারীর হাদীস নং ৫২৫৪ দ্বারা পরিষ্কার বুঝা যায় যে, জাওনিয়া নবী করীম (সা.)-এর স্ত্রীদের মধ্যে শামিল ছিলেন। কারণ ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে ইমাম আওযা’ঈ এর সনদে ইমাম যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ((سَأَلْتُ الزُّهْرِي أَي أَزْوَاجِ النَّبِي صلى الله عليه وسلم اسْتَعَاذَتْ مِنْهُ ؟)) অর্থাৎ আমি যুহরীকে জিজ্ঞেস করলাম, নবী করীম (সা.)-এর কোন স্ত্রী তাঁর কাছ থেকে ‘ইয়াজ’ (অব্যাহতি) চেয়েছিলেন? এর উত্তরে হযরত উরওয়াহ স্বীয় খালা আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, ((قَالَ : أَخْبَرَنِي عُرْوَةُ ، عَنْ عَائِشَةَ رضي الله عنها : أَنَّ ابْنَةَ الْجَوْنِ لَمَّا أُدْخِلَتْ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَدَنَا مِنْهَا قَالَتْ : أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْكَ . فَقَالَ لَهَا : لَقَدْ عُذْتِ بِعَظِيمٍ ، الْحَقِى بِأَهْلِكِ)) “তিনি বলেছেন, জাওন কন্যাকে নবী করীম (সা.)-এর নিকট যখন আনা হল এবং তিনি যখন তার নিকটবর্তী হলেন তখন সে বলল, আউযুবিল্লাহি মিনকা অর্থাৎ আমি আল্লাহর জন্য আপনার কাছ থেকে অব্যাহতি চাচ্ছি।”

প্রতিউত্তরে নবী করীম (সা.) তাকে সাফ জানিয়ে দিলেন যে, লাক্বাদ উ’যতি বি’আজিম অর্থাৎ তুমি মহান সত্তার নামে অব্যাহতি কামনা করলে। কাজেই তুমি তোমার পরিবারের সাথে (এখুনি) গিয়ে মিলিত হয়ে যাও (অর্থাৎ আমি তোমাকে অব্যাহতি দিয়ে দিলাম)। নাস্তিকরা সম্পূর্ণ বিষয়টিকে এক পাশে রেখে মাঝখান থেকে খণ্ডিত অংশ উঠিয়ে নেয় এবং নবী করীম (সা.)-এর প্রতি মানহানিকর প্রোপাগাণ্ডা ছড়ায়। নাস্তিকদের প্রোপাগাণ্ডার মূল ইস্যুটি হচ্ছে, নবী করীম (সা.) পর নারীর দিকে হাত বাড়িয়েছেন কিজন্য? জাওনিয়া মূলত সেজন্যই উনাকে السوقة তথা বাজারি (অ-রাজকুমার) পুরুষ আখ্যা দিয়েছিলেন! নাউযুবিল্লাহ।

কিন্তু নাস্তিকদের জন্য দুঃসংবাদ হচ্ছে, সহীহ বুখারীতে (হাদীস-৫২৩৫ ইফা) হযরত সাহাল ইবনে সা’আদ এর অন্য আরেকটি বর্ণনায় পরিষ্কার এসেছে যে, ((أَتَدْرِينَ مَنْ هَذَا ؟ قَالَتْ : لاَ . قَالُوا هَذَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم جَاءَ لِيَخْطُبَكِ . قَالَتْ : كُنْتُ أَنَا أَشْقَى مِنْ ذَلِكَ)) অর্থাৎ জাওনিয়াকে যখন জিজ্ঞেস করা হল, তুমি কি জানো যে, তুমি কাকে ‘বাজারি’ বললে? তখন জাওনিয়া উত্তরে বলেন, না আমি জানতাম না। তখন লোকেরা বলল, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন, তোমাকে প্রস্তাব দিতে এসেছিলেন। জাওনিয়া তখন (বিনয়ের সাথে) বলেছিল, আমি তো উনার থেকে বঞ্চিতা। সুতরাং বুঝা গেল, জাওনিয়া তখন নবী করীম (সা.)-কে চিনতেন না। কিন্তু পরে যখন জানতে পারলেন যে, তিনি স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন, তখন খুবই অনুতপ্ত হন। একই হাদীসের শুরুতে সুস্পষ্ট লিখা আছে, আবূ উসায়দ আস সা’দী নবী করীম (সা.)-এর নিকট সর্বপ্রথম আরবের একজন রাজকুমারীর নাম প্রস্তাব করেন। নবী করীম (সা.) আবূ উসায়দকে নির্দেশ দেন, যাতে তিনি ঐ রাজকুমারীর নিকট দূত প্রেরণ করেন।

উল্লেখ্য, ফাতহুল বারী (৯/৩৫৮) গ্রন্থে লিখা আছে, ভাষাবিদ ইবনুল মুনির বলেছেন ((والسوقة عندهم من ليس بملك كائنا من كان)) “আরবের সাহিত্য পরিভাষায় ‘আসসূক্বাতু’ (السوقة) বলতে বুঝায় এমন ব্যক্তিকে যে রাজকুমার নন।” পক্ষান্তরে নুমান ইবনে জাওন আশ শারাহীল এর কন্যা জাওনিয়া ছিলেন নজদ অঞ্চলের বনু হারিস গোত্রীয় একজন অভিজাত রাজকুমারী। ফলে সে রাজকুমারের সাথেই সংসার করার মনোবাসনা লালন করত এবং অহংকারী ছিল। যে কারণে নবী করীম (সা.) তার সাথে বাসর না করেই তাকে তালাক্ব দিয়ে দেন । কিন্তু ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলো অনেক বেশি অসঙ্গতিপূর্ণ। যেজন্য নির্দিষ্ট কোনো বর্ণনার উপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া থেকে প্রধান প্রধান স্কলারগণ (ইমামগণ) প্রথম থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করে আসছেন। কিন্তু অল্প বিদ্যা ভয়ংকর টাইপের বঙ্গীয় এন্টি-ইসলাম ছুপা নাস্তিকদের বুঝানোর সাধ্য কার?

যেসব বর্ণনা হতে জাওনিয়াকে রাসূল (সা.)-এর স্ত্রী বলেই বুঝা যাচ্ছে আমি এখন সেসব বর্ণনার আলোকেই জাওনিয়ার ‘আউযুবিল্লাহি মিনকা’ কথাটির উত্তর দেব, ইনশাআল্লাহ। পাঠকবৃন্দ! বর্ণনাগুলোর মতনে যথেষ্ট ইযতিরাব রয়েছে, যা আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি।

জ্ঞানীদের নিকট পরিষ্কার আছে যে, বিবাহিত স্ত্রী তার স্বামীকে যখন বলবে যে, আমি আল্লাহর জন্য তোমার কাছ থেকে অব্যাহতি বা ‘ফানাহ’ চাচ্ছি, তখন এ জাতীয় শব্দ রূপকার্থে ‘তালাক্ব’-কেই বুঝায়। অর্থাৎ সে যেন স্বামীর কাছ থেকে তালাক্ব চাচ্ছে! যাইহোক, আগেই বলে আসছি যে, বর্ণনাগুলোর সনদ সহীহ হলেও মতনে ইযতিরাব (উলোটপালোট) রয়েছে। ফলে এ জাতীয় ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া আইনসিদ্ধ হবেনা। যার দরুন ইসলামের ইতিহাসে প্রধান প্রধান স্কলারগণ সর্বসম্মতিক্রমে জাওনিয়াকে নবী করীম (সা.)-এর সহধর্মিণীদের মধ্যে শুমার করেননি।

আমি আমার দীর্ঘ স্টাডি এবং গবেষণা থেকে যতটুকু বুঝেছি এবং প্রমাণ সংগ্রহ করতে পেরেছি, ততটুকুই লিখার চেষ্টা করেছি। এখানে যদি কোনো ভুল ভ্রান্তি হয়ে থাকে তজ্জন্য আমি অধম একাই দায়ী থাকবো। আমি অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাচ্ছি। – লিখক

লিখক, মুহাম্মদ নূরুন্নবী এম.এ, তাং ১৭-০৬-২০২৪ ইং যোগাযোগ-

কাদিয়ানী মতবাদের পোস্টমর্টেম

0

কাদিয়ানীবন্ধুর ইসলাম সম্পর্কে সীমাহীন অজ্ঞতা, জিহালাত, জাল জঈফ ও বিকৃত শিক্ষার খণ্ডনমূলক সরল উত্তর,

(জনৈক কাদিয়ানীবন্ধুর জিহালাত ও তার সরল উত্তর)

কাদিয়ানীবন্ধুঃ

ঈসা এবং মাহদী কি একই ব্যক্তি হবেন, নাকি ভিন্ন ব্যক্তি হবেন?

এর উত্তর হচ্ছে, যদি কুরআন থেকে প্রমাণিত হয় হযরত ঈসা (আ.) মারা গিয়েছেন, তার মানে হচ্ছে সেই বনী ইসরাইলী ঈসা (আ.) আর কখনো পৃথিবীতে আসবেন না। কুরআন থেকে প্রমাণিত যে, বনী ইসরাঈলী ঈসা মারা গেছেন। তাই তাঁর দ্বিতীয়বার আগমনের কোনো সুযোগ নাই (কাদিয়ানীদের বক্তব্য)।

সরল উত্তরঃ

পবিত্র কুরআনের নামে এগুলো কাদিয়ানীদের জঘন্য মিথ্যাচার। কারণ ইসলামের গত চৌদ্দশত বছরেও এধরণের দাবী কোনো বরেণ্য যুগ ইমাম, ফকীহ, মুফাসসির, মুহাদ্দিস কেউই করেননি। সুতরাং এধরণের দাবী ও মতবাদ সম্পূর্ণ বাতিল ও বিদয়াতি মতবাদ। সত্যের সাথে যার লেশমাত্র সম্পর্কও নেই। বরং অসংখ্য আয়াতে ঈসা (আ.)-এর পুনরায় আগমনী ইংগিত থাকা প্রমাণিত, উম্মতে মুহাম্মদীয়ার ইজমাও এর উপর বিদ্যমান যে, মরিয়ম পুত্র হযরত ঈসা (আ.)-এর পুনঃআগমন অকাট্য সত্য এবং এ বিশ্বাস ইসলামে তাওয়াতূর স্তরীয় বিশ্বাস।

এখন কাদিয়ানীদের মতে, কুরআন দ্বারা বনী ইসরাঈলী ঈসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা গেছেন বলে প্রমাণিত হলে, তখন পবিত্র কুরআন থেকে এ কথাও প্রমাণ করে আমাদেরকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, কুরআনে ঈসা (আ.)-এর আসার যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা হতে কাদিয়ানের চেরাগ বিবির পুত্র মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীই উদ্দেশ্য। কেননা মির্যা গোলাম আহমদ নিজেই তার আরেক রচনায় স্বীকার করে লিখেছেন,

اب ثبوت اس بات کا کہ وہ مسیح موعود جس کے آنے کا قران کریم میں وعدہ دیا گیا ہے یہ عاجز ہی ہے

অর্থ-“এখন একথা সাব্যস্ত হয়ে গেল যে, পবিত্র কুরআনে যেই মসীহ মওউদের আসার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে সে এই অধমই।” (রূহানী খাযায়েন ৩/৪৬৮)।

স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য

উল্লেখ্য, মির্যা কাদিয়ানীর ৮৩টি রচনার সমষ্টি ২৩ খণ্ডে প্রকাশিত রূহানী খাযায়েন, যার বাংলা অর্থ- আধ্যাত্মিক ভাণ্ডার।

কাদিয়ানীবন্ধুঃ

হযরত রসূল করীম (সা.) ঈসা (আ.) এর অবতরণের কথা বলেছেন। এর মানে হল, শেষ যুগে যিনি আগমন করবেন তিনি ঈসা (আ.)-এর সদৃশ হবেন। এর সমাধান তিনি নিজেই বলে গেছেন। হাদিসে উল্লেখ আছে,

((لاَ يَزْدَادُ الأَمْرُ إِلاَّ شِدَّةً وَلاَ الدُّنْيَا إِلاَّ إِدْبَارًا وَلاَ النَّاسُ إِلاَّ شُحًّا وَلاَ تَقُومُ السَّاعَةُ إِلاَّ عَلَى شِرَارِ النَّاسِ وَلاَ الْمَهْدِيُّ إِلاَّ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ))

অর্থাৎ, দিনে দিনে বিপদাপদ বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। দুনিয়াতে অভাব অনটন ও দুর্ভিক্ষ বাড়তেই থাকবে। কৃপণতা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে। নিকৃষ্ট লোকদের উপর কিয়ামত সংঘটিত হবে। মাহদী ঈসা ইবনে মরিয়ম ব্যতিরেকে অপর কেউ নন। (ইবনে মাজাহ, বাবু শিদ্দাতিয্যামান, হাদীস নং-৪০৩৯)। অতএব, যিনি ঈসা তিনিই মাহদী।

সরল উত্তরঃ

বর্ণনাটি সহীহ নয়। সর্বসম্মত ইমামগণের মতে এর সনদ বা সূত্র খুবই দুর্বল ও মুনকার (মেরকাত শরহে মেশকাত, কিতাবুল ফিতান ১০/১০১, মোল্লা আলী ক্বারী)। ইমাম মিজ্জি (রহ.) এর সনদে উল্লিখিত ‘মুহাম্মদ বিন খালিদ আল জানাদী’ (محمد ابن خالد الجندى) নামক বর্ণনাকারী সম্পর্কে লিখেছেন, সে অপরিচিত এবং মাতরূক তথা পরিত্যাজ্য। দেখুন, তাহযীবুল কামাল : খণ্ড নং ২৫ পৃষ্ঠা নং ১৪৬; রাবী নং ৫১৮১)। ইমাম শাওক্বানী (রহ.) বলেন, ইমাম সাগানী আল হিন্দী-الصغانى (মৃত. ৬৫০ হি.) ‘তাযকিরাতুল মওযূ’আত’ কিতাবে (১/২২৩) লিখেছেন, এ হাদীস জাল তথা বানোয়াট (আল ফাওয়ায়েদুল মাজমু’আহ-الفوائد المجموعة ১/৫১০)।

মজার ব্যাপার হল, মির্যা কাদিয়ানী নিজেও তার রচনায় স্বীকার করে লিখে গেছেন যে, এর সনদ খুবই দুর্বল, ফলে এর উপর নির্ভর করা যাবেনা। দেখুন, হামামাতুল বুশরা (বাংলা অনূদিত) পৃষ্ঠা নং ১৬১। তাছাড়া যুগ ইমামগণ বর্ণনাটির “ওয়া লাল মাহদী ইল্লা ঈসা”-((وَلَا الْمَهْدِىْ اِلَّا عِيْسَى بْنُ مَرْيَمَ)) উপবাক্যটির অর্থ করেছেন ((مَعْنَاهُ وَ لَا مَهْدِىٌّ كَامِلُ اَوْ مَعْصُوْمُ اِلَّا عِيْسَى ابْنُ مَرْيَمَ)) ‘তখন ঈসা ইবনে মরিয়ম ব্যতীত নিষ্পাপ বা পরিপূর্ণ সুপথপ্রাপ্ত আর কেউ নন1।’ এ অনুবাদ করেছেন, ইমাম কুরতুবি, ইমাম ইবনুল কাইয়ুম এবং ইবনে কাসীর প্রমুখ। দেখুন, আল আহাদীসুয য’ঈফাহ ১/৮৯, শায়খ আলবানী।

মজার ব্যাপার হল, মির্যা গোলাম কাদিয়ানী তার রচনার এক জায়গায় লিখেছেন, ((آنحضرت صلی اللہ علیہ وسلم بھی مہدی تہے)) অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ (সা.)ও ‘মাহদী’ ছিলেন। দেখুন, রূহানী খাযায়েন খণ্ড নং ১৪, পৃষ্ঠা নং ৩৯৪। সুতরাং বুঝা গেল, আক্ষরিক অর্থে শুধু ঈসা (আ.) কেন, বরং যে কোনো সুপথপ্রাপ্ত পুরুষকেও ‘মাহদী’ শব্দে সম্বোধন করা যেতে পারে। তাতে সবাইকে একই ব্যক্তি বুঝাবেনা। যাইহোক, সর্বশেষ কথা হচ্ছে, বর্ণনাটি ‘সহীহ’ মানলেও কাদিয়ানীদের যে শিক্ষা ও মতবাদ সে ধরনের কোনো কিছুই এর দ্বারা ইংগিতেও প্রমাণিত হয় না।

কাদিয়ানীবন্ধুঃ

রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ((يُوْشِكُ مَنْ عَاشَ مِنْكُمَ اَنْ يَلْقَى عِيْسَى بْنَ مَرْيَمَ إِمَامًا مَهْدِيًّا وَحَكَمًا عَدَلًا فَيَكْسِرُ الصَّلِيْبَ وَيَقْتُلُ الْخِنْزِيْرَ وَيَضَعُ الْجِزْيَةَ وَتَضَعُ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا))

অর্থঃ “তোমাদের মধ্যে তখন যারা জীবিত থাকবে তারা ঈসা ইবনে মরিয়মকে ইমাম মাহদী হিসেবে পাবে যিনি শাসক ও ন্যায় বিচারক হিসেবে আগমন করবেন। এরপর তিনি ক্রুশ ধ্বংস করবেন, শূকর হত্যা করবেন এবং জিযিয়া বা যুদ্ধকর বন্ধ করবেন আর তখন অস্ত্রযুদ্ধ রহিত হবে।” (মুসনাদ আহমদ বিন হাম্বল, হাদীস নং ৯০৬৮, প্রকাশনা: দারূল আহহীয়াউত্তুরাস আল আরাবী, বৈরুত, লেবানন)।

সরল উত্তরঃ

হাদীসটি সহীহ, তবে এটিও কাদিয়ানীদের শিক্ষা ও মতবাদকে ইংগিতেও সমর্থন করেনা। কেননা, হাদীসটিতে পরিষ্কার শব্দে وَيَضَعُ الْجِزْيَةَ অর্থাৎ ঈসা (আলাইহিস সালাম) এসে ‘যুদ্ধকর’ রহিত করবেন, উল্লেখ আছে। জ্ঞানীদের জানা আছে যে, যুদ্ধকর রহিত করার এ সক্ষমতা বেসামরিক কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নেই। বরং এ ধরনের সক্ষমতা শুধুই রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী প্রশাসনিক ব্যক্তির-ই রয়েছে। কাজেই এ হাদীসটিও অকাট্য ইংগিত দিচ্ছে যে, আগমনকারী ঈসা হতে প্রকৃত ঈসা ইবনে মরিয়মই উদ্দেশ্য, যিনি আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত হবেন এবং যথাসময়ে উম্মাহার নেতৃত্বে থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ করবেন এবং রাসূল (সা.)-এর ফরমান অনুযায়ী তিনি রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি করে “যুদ্ধকর” স্থগিত করবেন।

বলে রাখা জরুরি যে, মির্যা গোলাম আহমদ সারা জীবনে মেম্বার চেয়ারম্যান হতে পারা তো দূরের কথা, তিনি কোনোদিন সর্বনিম্ন “গ্রাম সরকার” বা চকিদার-ও ছিলেন না। সুতরাং এ হাদীস জীবন গেলেও তার সাথে খাপ খাবেনা।

এবার হাদীসটির সঠিক অনুবাদ জেনে নিইঃ

রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন,

((يُوْشِكُ مَنْ عَاشَ مِنْكُمَ اَنْ يَلْقَى عِيْسَى بْنَ مَرْيَمَ إِمَامًا مَهْدِيًّا وَحَكَمًا عَدَلًا فَيَكْسِرُ الصَّلِيْبَ وَيَقْتُلُ الْخِنْزِيْرَ وَيَضَعُ الْجِزْيَةَ وَتَضَعُ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا))

অনুবাদঃ “তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে তারা অবশ্যই অচিরেই মরিয়ম পুত্র ঈসার সাথে মিলিত হবে, যিনি একজন ন্যায়বিচারক এবং সুপথপ্রাপ্ত নেতা হবেন, তিনি ক্রুশ চূর্ণ করবেন, শুয়োর হত্যা করবেন, যুদ্ধকর রহিত করবেন, এবং ধর্মযুদ্ধ তার সমস্ত যুদ্ধ-সরাঞ্জাম ভারমুক্ত করবে।”

এখানে হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে বিশেষণমূলক (মুরাক্কাবে তাওসীফী) যৌগিক উপবাক্য ((إِمَامًا مَهْدِيًّا)) অর্থ- “একজন সুপথপ্রাপ্ত ইমাম”। কাদিয়ানীরা এর ব্যকরণ-বিরুদ্ধ অনুবাদ তো করেই, তার উপর অপব্যাখ্যা দিয়ে বলে যে, এতে নাকি এটাই বুঝানো উদ্দেশ্য যে, ঈসা আর ইমাম মাহদী দু’জন মূলত একই। নাউযুবিল্লাহ। মূর্খতারও একটা সীমা থাকা দরকার। আফসোস! এ নির্বোধরা এতই বেপরোয়া যে, একই ধরণের আরো যত বিশেষণমূলক হাদীস রয়েছে তারা সেগুলোর উদ্দেশ্য নিয়ে একদমই চিন্তা করেনা।

যেমন, হযরত জারির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন ((ﻭَإجْعَلْهُ هَادِيًا مَهْدِيًّا)) অর্থাৎ হে আল্লাহ আপনি তাকে “একজন সুপথপ্রাপ্ত হিদায়াতকারী” বানিয়ে দিন (বুখারী কিতাবুল জিহাদ ওয়াস সিয়ার)।

তারপর হযরত মু’আবিয়া (রা.) সম্পর্কেও বলা হয়েছে যে, ((اَللَّهُمَّ إجْعَلْهُ هَادِيًا مَهْدِيًّا وَ إهْدِ بِهِ)) অর্থাৎ হে আল্লাহ আপনি তাঁকে “একজন সুপথপ্রাপ্ত হিদায়াতকারী” বানিয়ে দিন আর তার মাধ্যমে [মানুষকে] হিদায়াত দান করুন। (তিরমিযী কিতাবুল মানাকিব)।

তদ্রুপ হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে আরেকটি হাদীসে এসেছে ((إِمَامًا عَادِلاً وَ قَاضِيًاً)) “তিনি একজন ন্যায়পরায়ণ ও বিচারক ইমাম…”। দেখুন, ইমাম আবু বকর আশ-শাফেয়ী (মৃত ৩৫৪ হিজরী) সংকলিত, আল ফাওয়ায়িদুশ শাহীর বিল গাইলানিয়াত : হাদীস নং ৭৯৩ ও ৮২৪।

এখন প্রশ্ন হল, তবে কি রাসূল (সা.) জারির ইবনে আব্দুল্লাহ আর হযরত মু’আবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) তাঁদের দু’জনকেও প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী বুঝালেন?

হাদীসটিকে অপরাপর সহীহ হাদীসগুলোর সাথে মিলিয়ে পড়ার পর পাঠকের নিকট পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, হাদীসটিতে ঈসা (আ.)-কে শুধু আক্ষরিক অর্থেই ‘মাহদী’ আখ্যা দেয়া হয়েছে। যার দরুন হযরত ফাতেমা (রা.)-এর বংশ থেকে আসন্ন শেষ যুগের প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদীর ধারণা বাতিল হয়ে যাবেনা। কারণ, আক্ষরিক অর্থে আবুবকর, উমর, উসমান এবং আলীকেও রাসূল (সা.) একত্রে ‘আল-মাহদিয়্যীন’ ((فعليكم بسُنَّتي وسُنَّةِ الخُلَفاءِ الرَّاشِدينَ المَهْدِيِّينَ)) বলেছেন। দেখুন, তিরমিযী শরীফ, কিতাবুল ইলম হা/২৬৭৬, সনদ সহীহ। আর সে হিসেবে তথা আক্ষরিক অর্থে শুধু ঈসা (আ.) নয়, বরং সকল নবী-ই ছিলেন ‘মাহদী’ তথা সুপথপ্রাপ্ত। আশাকরি, উত্তর পেয়েছেন।

কাদিয়ানীবন্ধুঃ

রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন,

كَيْفَ أَنْتُمْ إِذَا نَزَلَ ابْنُ مَرْيَمَ فِيكُمْ وَإِمَامُكُمْ مِنْكُمْ

অর্থ “তোমাদের অবস্থা তখন কেমন হবে, যখন ইবনে মরিয়ম তোমাদের মধ্যে আবির্ভূত হবেন এবং (তিনি) তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের ইমাম হবেন (কাদিয়ানী অনুবাদ)।” (বুখারী-৩৪৪৯, মুসলিম, কিতাবুল ঈমান-২৮৩)।

সরল উত্তরঃ

কাদিয়ানীদের অনুবাদে নিকৃষ্ট তাহরিফ (বিকৃতি) রয়েছে। অথচ সঠিক অনুবাদ হচ্ছে,

“তোমাদের অবস্থা তখন কেমন (আনন্দের) হবে, যখন ইবনে মরিয়ম তোমাদের মধ্যে নাযিল হবেন আর তোমাদের ইমাম (মাহদী) তোমাদেরই মধ্য থেকে হবেন (ফাতহুল বারী, ইবনু হাজার আসকালানী রহ.)।” (বুখারী-৩৪৪৯, মুসলিম, কিতাবুল ঈমান-২৮৩)।

সরল উত্তরঃ

এ হাদীসটি বরং কাদিয়ানীদের শিক্ষা ও মতবাদেরই সম্পূর্ণ বিরোধী। প্রথমতঃ তার কারণ, হাদীসটিতে “ইবনু মরিয়ম” বলা হয়েছে। যার অর্থ- মরিয়মের পুত্র। কিন্তু মির্যা গোলাম আহমদের মায়ের নাম ছিল চেরাগ বিবি। সুতরাং মিললো না।

দ্বিতীয়তঃ এ হাদীসের ((ابْنُ مَرْيَمَ فِيكُمْ وَإِمَامُكُمْ مِنْكُمْ)) উপবাক্যটি পরিষ্কার বলছে যে, ইমাম মাহদী এবং ঈসা ইবনে মরিয়ম দু’জনই শেষযুগে পৃথিবীতে সমসাময়িক হবেন। সহীহে বুখারীর উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) ফাতহুল বারী গ্রন্থে বিভিন্ন হাদীসবিদগণের উদ্ধৃতির পরিপ্রেক্ষিতে জোরালো যে মতটিকে সুস্পষ্ট করে গেছেন তা হচ্ছে, হাদীসটির ((وَإِمَامُكُمْ مِنْكُمْ)) “আর তোমাদের ইমাম তোমাদেরই মধ্য হতে হবেন” এর দ্বারা ইমাম মাহদীকেই বুঝানো উদ্দেশ্য। (ফাতহুল বারী, কিতাবু আহাদীসিল আম্বিয়া হাদীস নং ৩৪৪৯)।

ইবনে মাজাহ’র দাজ্জাল সম্পর্কিত আবূ উমামাহ’র দীর্ঘ হাদীসে এসেছে,

((كُلُّهُمْ أَىْ الْمُسْلِمُوْنَ بِبِيْتِ الْمُقَدَّسِ وَ اِمَامُهُمْ رَجُلٌ صَالِحٌ قَدْ تَقَدَّمَ لِيُصَلِّى بِهِمْ, اِذْ نَزَلَ عِيْسَى فَرَجَعَ الْاَمامُ يَنْكُصُ لِيَتَقَدَّمَ عِيْسَى, فَيَقِفُ عِيْسَى بَيْنَ كَتِفَيْهِ ثُمَّ يَقُوْلُ: تَقَدَّمْ فَاِنَّهَا لَكَ اُقِمَتْ))

অর্থ- “মুসলমানগণ বায়তুল মুকাদ্দাসে (সালাতের জন্য অপেক্ষা রত) থাকবে। তখন তাদের ইমাম থাকবেন জনৈক নেককার ব্যক্তি। তিনি তাদের সালাত পড়ানোর জন্য সামনে অগ্রসর হবেন। এমতাবস্থায় হঠাৎ (তারা দেখতে পাবে) ঈসা অবতরণ করছেন। ফলে ইমাম সাহেব পেছনে সরে আসবেন যাতে ঈসা সামনে অগ্রসর হন। হযরত ঈসা তাঁর কাঁধের মাঝখান বরাবর এসে দাঁড়াবেন, তারপর (ইমামকে) বলবেন ‘আপনিই অগ্রসর হোন, ইক্বামত আপনার জন্যই দেয়া হয়েছে’। ইমাম আবুল হাসান আল খাস’ঈ আল আবিদী ‘মানাকিবে শাফেয়ী’ গ্রন্থে বলেন, মুতাওয়াতির ভাবে বহু হাদীস বর্ণিত আছে যে, নিশ্চয়ই ঈসা (আ.) এই উম্মতের (ইমাম) মাহদীর পেছনেই সালাত আদায় করবেন। তিনি এটি ইবনে মাজাহ’র হাদীসে আনাস থেকে বর্ণিত [মুনকার রেওয়ায়েত] ((وَلَا مَهْدِيّ إِلَّا عِيسَى)) “ঈসা ব্যতীত আর কোনো মাহদী নেই” (কাদিয়ানী অনুবাদ)-এরই রদ করার উদ্দেশ্যে উল্লেখ করেছেন।

ইমাম আবূ ঝার আল হারাভী বলেন, ইমাম আল যাওযাকী কোনো কোনো মুতাকাদ্দিমীনের কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ((وَإِمَامكُمْ مِنْكُمْ)) “তখন তোমাদের ইমাম তোমাদেরই মধ্য থেকে হবেন” এ কথার অর্থ হচ্ছে, তিনি (ঈসা) পবিত্র কুরআন দিয়েই রাষ্ট্রপরিচালনা করবেন, ইঞ্জিল কিতাব দিয়ে নয়। ইমাম ইবনে তীন বলেন, ((وَإِمَامكُمْ مِنْكُمْ)) এর অর্থ ((أَنَّ الشَّرِيعَةَ الْمُحَمَّدِيَّةَ مُتَّصِلَةٌ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامِ وَ أَنَّ كُلَّ قَرْنٍ طَائِفَةٌ مِنْ أَهْلِ الْعِلْمِ فِي الخ)) “নিশ্চয়ই শরীয়তে মুহাম্মদীয়া কেয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে এবং প্রতি শতাব্দীতে আহলে ইলমগণ থেকে একটি দল (তার সেবায়) বিদ্যমান থাকবে”। ফাতহুল বারী শরহে সহীহ বুখারী। (অনুবাদ সমাপ্ত হল)।

এখন হয়ত কাদিয়ানীবন্ধু বলবে যে, আগত ঈসা একজন “রূপক ঈসা”। কাজেই, হাদীসটির “ইবনু মরিয়ম” বলতেও “রূপক মরিয়ম পুত্র” উদ্দেশ্য! কিন্তু কাদিয়ানীবন্ধুরা হয়ত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর বইগুলো খেয়াল করে পড়লে জানার কথা যে, তিনি নিজেই তার একটি রচনায় লিখেছেন,

“রাসূল (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর ভিত্তিতে কসম খেয়ে যা বলেছেন তার ব্যতিক্রম কীভাবে হতে পারে? এই ক্ষেত্রে এই কসমটি সাব্যস্ত করছে প্রদত্ত সংবাদটি বাহ্যিক অর্থেই পূর্ণ হবে এর রূপক অর্থ করা যাবেনা আর কোনো ব্যতিক্রমও হবেনা। আর যদি তাই হয় তাহলে কসম খেয়ে কী লাভ? অতএব অনুসন্ধিৎসু ও গবেষকের ন্যায় চিন্তা করে দেখ।” দেখুন, হামামাতুল বুশরা (বাংলা অনূদিত) পৃষ্ঠা নং ২৭।

কি বুঝলেন?…. কসমটি সাব্যস্ত করছে প্রদত্ত সংবাদটি বাহ্যিক অর্থেই পূর্ণ হবে এর “রূপক” অর্থ করা যাবেনা!

এখন যিনি নিজেই “রূপক” অর্থ করা যাবেনা বলছেন তাকেই আপনারা কসম সম্বলিত হাদীসের আলোকে আপনারা “রূপক” মসীহ বলে চিৎকার করতেছেন! এটা কি নিজের আক্বল ও বিবেকের সাথে ঠাট্টা মশকরা করা নয়?

এ দেখুন, কসম বা শপথ বাক্য সহকারে বর্ণিত সহীহ বুখারীর হাদীসটি অর্থ সহ,

সহীহ বুখারী (ইফা), অধ্যায়ঃ ৫০/ আম্বিয়া কিরাম (আ.) (كتاب أحاديث الأنبياء), হাদীস নম্বরঃ ৩২০৫, ((حَدَّثَنَا إِسْحَاقُ، أَخْبَرَنَا يَعْقُوبُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، حَدَّثَنَا أَبِي، عَنْ صَالِحٍ، عَنِ ابْنِ شِهَابٍ، أَنَّ سَعِيدَ بْنَ الْمُسَيَّبِ، سَمِعَ أَبَا هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏’‏ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَيُوشِكَنَّ أَنْ يَنْزِلَ فِيكُمُ ابْنُ مَرْيَمَ حَكَمًا عَدْلاً، فَيَكْسِرَ الصَّلِيبَ، وَيَقْتُلَ الْخِنْزِيرَ، وَيَضَعَ الْجِزْيَةَ، وَيَفِيضَ الْمَالُ حَتَّى لاَ يَقْبَلَهُ أَحَدٌ، حَتَّى تَكُونَ السَّجْدَةُ الْوَاحِدَةُ خَيْرًا مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا ‏’.‏ ثُمَّ يَقُولُ أَبُو هُرَيْرَةَ وَاقْرَءُوا إِنْ شِئْتُمْ ‏(‏وَإِنْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ إِلاَّ لَيُؤْمِنَنَّ بِهِ قَبْلَ مَوْتِهِ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكُونُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا‏)‏‏.‏))

অনুবাদঃ ‘ইসহাক (রহ.) … আবূ হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, কসম সেই সত্তার, যার হাতে আমার প্রাণ, অচিরেই তোমাদের মাঝে মরিয়মপুত্র ঈসা (আ.) শাসক ও ন্যায় বিচারক হিসেবে অবতরণ করবেন। তিনি ‘ক্রুশ’ ভেঙ্গে ফেলবেন, শুয়োর মেরে ফেলবেন এবং তিনি জিজিয়া (রাষ্ট্রীয় কর) পরিসমাপ্তি ঘটাবেন। তখন সম্পদের স্রোতে বয়ে চলবে। এমনকি কেউ তা গ্রহণ করতে চাইবে না। তখন আল্লাহকে একটি সিজদা করা সমগ্র দুনিয়া এবং তার মধ্যকার সমস্ত সম্পদ থেকে বেশী মূল্যবান বলে গণ্য হবে। এরপর আবূ হুরায়রা (রা.) বলেন, তোমরা ইচ্ছা করলে এর সমর্থনে এ আয়াতটি পড়তে পারঃ কিতাবীদের মধ্যে প্রত্যেকে তাঁর [ঈসা (আ.) এর] মৃত্যুর পূর্বে তাঁকে বিশ্বাস করবেই এবং কিয়ামতের দিন তিনি তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবেন। (সহীহ বুখারী, হা/৩২০৫; ঈসা ইবনে মরিয়ম নাযিল হওয়া শীর্ষক পরিচ্ছেদ)।

হাদীসটির শুরুতেই কসম বা শপথ বাক্যটি আরেকবার দেখুন,

“রাসূল (সা.) বলেছেন, কসম সেই সত্তার, যার হাতে আমার প্রাণ, অচিরেই তোমাদের মাঝে মরিয়মপুত্র ঈসা (আ.) শাসক ও ন্যায় বিচারক হিসেবে অবতরণ করবেন।”

এখন এর কী উত্তর?

(লিখাটির উপর কারো কোনো মন্তব্য থাকলে তা মন্তব্যের জায়গায় লিখুন)

  1. আহাদীসুয যু’ঈফাহ শায়খ আলবানী রহ. খ ১ পৃ ৮৯, আল কওলুল মুখতাসার, ইবনু হাজার আল হাইতামী পৃ-৩২ ↩︎

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক
প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী
Principal NurunNabi
তাং ১৫/০৬/২৪