Home Blog

ইলিয়া সম্পর্কে কাদিয়ানী ‘বয়ান’ এর খণ্ডন

ভন্ড ও প্রতারক মসীহ দাবীদারদের ব্যাপারে বাইবেলের ‘মথি’ এর গসপেলে ২৪:৪-৫ ভাষ্যমতে সতর্কবাণী নিম্নরূপ-

যীশু (ঈসা) তার দ্বিতীয় আগমনকালে কী ঘটতে পারে সে সম্পর্কে শিষ্যদের বলতে গিয়ে ভণ্ড প্রবক্তারা যে আসবে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। যেমন, বাইবেলের নতুন নিয়মে লেখা আছে, “যীশু বললেন, শোন, সতর্ক থেকো তোমরা; কেউ যেন তোমাদের মন না ভোলায়। কেননা, আমার নাম নিয়ে অনেকেই তো আসবে আর বলবে, আমিই সেই খ্রিষ্ট এবং তারা অনেকের মনও ভুলাবে।” (মথি : অধ্যায় ২৪, পদ নং ৪-৫)।

এতে একদম পরিষ্কার হয়ে গেল যে, বাইবেলের সাক্ষ্যমতেও আগত ঈসা হতে কোনো নান্নুমিয়া বা চক্কুমিয়াকে রূপকের আদলে বুঝাবেনা, বরং মরিয়ম পুত্র ঈসা (আ.)ই উদ্দেশ্য। মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে যার আবার এসে হজ্জ করার কথা বলা হয়েছে এবং যাঁর সম্পর্কে নবীকরিম (সা.) চার-চার বার নাবীউল্লাহ ঈসা অর্থাৎ আল্লাহর নবী ঈসা বলেছেন।

ঈসা (আ.) আবার এসে হজ্জ করা সম্পর্কে নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন,

وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَيُهِلَّنَّ ابْنُ مَرْيَمَ بِفَجِّ الرَّوْحَاءِ حَاجًّا أَوْ مُعْتَمِرًا أَوْ لَيَثْنِيَنَّهُمَا

অর্থাৎ সে সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! মরিয়ম পুত্র ঈসা (আ.) নিশ্চিত রাওহা উপত্যকায় হজ্জ্ব (হাজ্জ/হজ) অথবা উমরাহ অথবা উভয়ের তালবিয়াহ্ পাঠ করবেন। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২৮৯৬, ইসলামীক সেন্টার ২৮৯৫)। এ সম্পর্কে আরও পড়ুন

যাইহোক,

আজকের প্রসঙ্গ “ইলিয়া” নিয়ে। কাদিয়ানীদের বইগুলো যারাই পড়েছে তারা নিশ্চয়ই এ চরিত্রের সাথে পরিচিত আছেন।

আমি গতকাল তাদের বাংলায় অনূদিত “মালফুযাত” বইটি পড়ে শেষ করলাম। বইটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যতগুলো আলোচনা রয়েছে সেটির কেন্দ্রীয় আগ্রহ সম্পর্কে—আমি যদি একবাক্যে বলি তা হচ্ছে,

“গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজ সত্তার স্বীকৃতির জন্য যেন পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম!”

পৃথিবীর ইতিহাসে আমার জানামতে এমন একজন স্বীকৃত যুগ-ইমাম বা মুজাদ্দিদ অতীত হননি যিনি নিজেকে একবারের জন্যও “মুজাদ্দিদ” অথবা “ইমাম” হওয়ার ন্যূনতম দাবীটুকুও করে গেছেন বা লিখে গেছেন।

শুধু বইটি নয়, তার এভাবে আরও যত বই রয়েছে সবগুলো বইয়ের আবেদন একটাই, মির্যা কাদিয়ানীকে মেনে নেয়ার আহবান, তার সত্তাকে স্বীকৃতি দেয়ার বলিষ্ঠ আহবান। কেন তাকে মেনে নিতে হবে, তাকে মেনে না নিলে কী কী ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি তার লিখনীর ভেতর আরও একটি বিষয় খুব খেয়াল করেছি, সেটি হচ্ছে

পাঠকদের মস্তিষ্ক ধোলাই করতে যত ধরণের ভেল্কিবাজি রয়েছে তিনি তার ষোলকলাই পূর্ণ করে ছেড়েছেন। তিনি হাদীসের আগপাছ কর্তন করে উদ্দেশ্যমূলক ও খণ্ডিত অংশটি উল্লেখ করেছেন। আয়াত এবং হাদীসের “প্রসঙ্গ” এড়িয়ে গিয়ে খেয়ালখুশি মাফিক বয়ানের পর বয়ান দাঁড় করে গেছেন। তিনি তার উদ্দেশ্যমূলক কোনো দাবীকে গ্রহণযোগ্য মানে দাঁড় করতে প্রথমে একটি “বয়ান” দাঁড় করতেন। তার উক্ত বয়ানের সমর্থনে গ্রহণযোগ্য কোনো ভিত্তি থাকুক বা না থাকুক, তাতে তার কিছুই যায় আসেনা। এরপর তার কাঙ্ক্ষিত সেই আনুমানিক সীদ্ধান্তে (যেমন রূপক মসীহ, বুরুজ্জি মুহাম্মদ ইত্যাদি) পৌঁছার জন্য চলত যারপরনাই নির্লজ্জ ব্যর্থ চেষ্টা।

তন্মধ্যে তৌরাতের সেই ইউহান্না বা যোহনের তথাকথিত ইলিয়া এর আধ্যাত্মিকতায় আগমনের বয়ানটি অতিব প্রসিদ্ধ, যার উপর ভিত্তি করে মির্যা কাদিয়ানী তার কথিত “রূপক মসীহ” দাবীকে জায়েজ করতে চেয়েছিল। অথচ পুরো কাহিনীটাই ভিত্তিহীন ও প্রত্যাখ্যাত। কেননা মির্যা কাদিয়ানী নিজেও ইসরাইলী সোর্সগুলো সম্পর্কে লিখে গেছে,

غرض یہ چاروں انجیلیں جو یونانی سے ترجمہ ہو کر اس ملک میں پہیلائی جاتی ہیں ایک ذرہ بہی قابل اعتبار نہیں۔ تریاق القلوب

অর্থাৎ মোটকথা হচ্ছে এই চারো ইঞ্জিল যা ইউনানি (গ্রীস) ভাষায় অনুবাদ হয়ে এই রাজ্যে প্রচারিত হয়েছে এগুলো এক অণু পরিমাণ-ও গ্রহনযোগ্য নয়।

দেখুন রূহানী খাযায়েন ১৫/১৪২।

তিনি আরও লিখেছেন,

بلکہ سچ تو یہ بات ہے کہ وہ کتابیں آنحضرت صلی اللہ علیہ و سلم کے زمانہ تک ردی کی طرح ہو چکی تہیں اور بہت سے جہوٹ ان میں ملائے گئے تہے جیساکہ قرآن شریف فرمایا گیا ہے کہ وہ کتابیں محرف مبدل ہیں اور اپنی اصلیت پر قائم نہیں رہیں۔ چشمہ معرفت

অর্থাৎ বরং সত্যকথা তো এটাই যে, এ সমস্ত কিতাব [আগের ঐশীগ্রন্থ গুলো–অনুবাদক] হুজুর সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ পর্যন্ত নষ্ট বস্তুতে পরিণত ছিল এবং প্রচুর মিথ্যা তাতে মিশ্রিত ছিল। যেমনটা কুরআন শরীফে বলা হয়েছে যে, এ সমস্ত কিতাব বিকৃত ও পরিবর্তিত এবং আপনা মৌলিকত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়।

দেখুন, রূহানী খাযায়েন ২৩/২৬৬।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইউহান্না অর্থাৎ যোহনের ইঞ্জিল এর মধ্যে পরিস্কার উল্লেখ আছে, সে সময়ের জেরুজালেম এর নেতৃস্থানীয় ইহুদীরা ইউহান্না’র নিকট কতিপয় ভবিষ্যদ্বক্তাসহ লোকজন প্রেরণ করেছিলেন এই মর্মে যে, ইউহান্না-ই সেই প্রতিশ্রুত ‘ইলিয়া‘ কিংবা ‘মসীহ‘ কিনা—তা যেন খোদ ইউহান্না’র মুখ থেকেই জেনে আসেন। তাই ইউহান্নাকে যখন প্রশ্ন করা হল তখন তিনি পরিস্কার করে জানিয়ে দিলেন যে ‘আমি (ইউহান্না) সেই প্রতিশ্রুত মসীহ নই’। তারা তাঁকে আরো জিজ্ঞেস করলো, তাহলে আপনি কে? ইলিয়া? ইউহান্না উত্তরে বললেন, না, আমি তা-ও নই

দেখুন, ইউহান্না’র ইঞ্জিল ১ম অধ্যায়, আয়াত ১৯-২১।

এবার কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্যে আমার জিজ্ঞাসা, ইসরাইলী সোর্সগুলোর উপর বিশ্বাস রাখলে হযরত ইয়াহইয়া (যোহন/ইউহান্না) এবং হযরত ঈসা (যীশু/ইসোয়া) আলাইহিমাস সালাম দু’জনের যে কোনো একজনকে ‘মিথ্যাবাদী’ সাব্যস্ত করতে হচ্ছে। নাউজুবিল্লাহ। যেহেতু মথির গসপেল মতে ঈসা যোহনকে ‘ইলিয়া’ আখ্যা দিয়েছেন। পক্ষান্তরে ইউহান্নার গসপেল মতে, যোহন নিজেকে ‘ইলিয়া’ হওয়া অস্বীকার করেছিলেন। সুতরাং ঈমানের তাগিদে আমাদেরকে অবশ্যই মানতে হবে যে, ইসরাইলী রেওয়ায়েতগুলো অথেনটিক নয়, বরং পরিত্যাগযোগ্য।

তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নিই যে, ইউহান্না তিনি নিজেকে “ইলিয়া” হওয়া অস্বীকার করেননি। তা সত্ত্বেও সেটির উপর কিয়াস করে মুহাম্মদে আরাবী (সা.) এর হাদীসকে তাবীল (ব্যাখ্যা) করে ‘ঈসা ইবনে মরিয়ম’ বলতে “রূপক ঈসা” এর ধারণা কোনোমতেই ঠিক হবেনা। কারণ, “ইলিয়া” তথা ইলিয়াস নবী পুনরায় আসা সম্পর্কে ইসরাইলী ভবিষ্যৎবাণীতে “শপথ বাক্য” এর উল্লেখ ছিলনা।

কিন্তু ইসলামী অথেনটিক সোর্সগুলোতে ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) এর আবার আসা সম্পর্কিত ভবিষ্যৎবাণীতে “শপথ বাক্য” এর উল্লেখ রয়েছে। এমনকি ‘তিনি (ঈসা) অচিরেই ফিরে আসবেন’ শব্দচয়নে বর্ণনাও রয়েছে। যাইহোক, এ সম্পর্কে মির্যা কাদিয়ানীর বক্তব্য হচ্ছে,

  • “শপথ (কসম করে কিছু বলা) একথারই প্রমাণ বহন করে যে, নিশ্চয়ই খবর বা হাদীসটি জাহেরি (আক্ষরিক) অর্থই বুঝাবে। সেখানে কোনো তাবীল (ব্যাখ্যা) চলবে না, ব্যতিক্রম মর্মার্থ নেয়াও চলবেনা। নচেৎ শপথ করে লাভ কী হল?”

দেখুন, হামামাতুল বুশরা (বাংলা) পৃষ্ঠা নং ২৭

এবার দেখা যাক, ঈসা (আ.) এর নুযূল হওয়া সম্পর্কে সহীহ বুখারী’র কিতাবুল আম্বিয়া-তে হাদীসটি কেমন শব্দচয়নে এসেছে! রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন,

  • بَابُ نُزُوْلِ عِيْسَى ابْنِ مَرْيَمَ عَلَيْهِمَا السَّلَام حَدَّثَنَا إِسْحَاقُ أَخْبَرَنَا يَعْقُوْبُ بْنُ إِبْرَاهِيْمَ حَدَّثَنَا أَبِيْ عَنْ صَالِحٍ عَنْ ابْنِ شِهَابٍ أَنَّ سَعِيْدَ بْنَ الْمُسَيَّبِ سَمِعَ أَبَا هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ لَيُوْشِكَنَّ أَنْ يَنْزِلَ فِيكُمْ ابْنُ مَرْيَمَ حَكَمًا عَدْلًا فَيَكْسِرَ الصَّلِيْبَ وَيَقْتُلَ الْخِنْزِيْرَ وَيَضَعَ الْجِزْيَةَ وَيَفِيْضَ الْمَالُ حَتَّى لَا يَقْبَلَهُ أَحَدٌ حَتَّى تَكُوْنَ السَّجْدَةُ الْوَاحِدَةُ خَيْرًا مِّنْ الدُّنْيَا وَمَا فِيْهَا ثُمَّ يَقُوْلُ أَبُوْ هُرَيْرَةَ وَاقْرَءُوْآ إِنْ شِئْتُمْ وَإِنْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ إِلَّا لَيُؤْمِنَنَّ بِهٰ قَبْلَ مَوْتِهٰ وَيَوْمَ الْقِيٰمَةِ يَكُوْنُ عَلَيْهِمْ شَهِيْدًا (النساء :159)

গ্রন্থঃ সহীহ বুখারী (তাওহীদ প্রকাশনী) অধ্যায়ঃ ৬০/ আম্বিয়া কিরাম (‘আ.) (كتاب أحاديث الأنبياء) হাদিস নম্বরঃ ৩৪৪৮

৬০/৪৯. মারইয়াম পুত্র ‘ঈসা (আ.)-এর অবতরণ।

৩৪৪৮. আবূ হুরাইরাহ্ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, শপথ সেই সত্তার, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, শীঘ্রই তোমাদের মধ্যে মরিয়ামের পুত্র ‘ঈসা (আ.) শাসক ও ন্যায় বিচারক হিসেবে আগমন করবেন। তিনি ‘ক্রুশ’ ভেঙ্গে ফেলবেন, শূকর হত্যা করবেন এবং তিনি যুদ্ধের সমাপ্তি টানবেন। তখন সম্পদের ঢেউ বয়ে চলবে। এমনকি কেউ তা গ্রহণ করতে চাইবে না। তখন আল্লাহকে একটি সিজ্দা করা তামাম দুনিয়া এবং তার মধ্যকার সমস্ত সম্পদ হতে অধিক মূল্যবান বলে গণ্য হবে। অতঃপর আবূ হুরাইরাহ্ (রা.) বলেন, তোমরা ইচ্ছা করলে এর সমর্থনে এ আয়াতটি পড়তে পারঃ ‘‘কিতাবীদের মধ্যে প্রত্যেকে তাঁর (ঈসা (আ.)-এর) মৃত্যুর পূর্বে তাঁকে বিশ্বাস করবেই এবং কিয়ামতের দিন তিনি তাদের (যারা তাঁকে ইশ্বর পুত্র সাব্যস্ত করেছিলো) বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবেন।’’ (আন-নিসাঃ ১৫৯) (২২২২) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩১৯৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩২০২)

তাহলে এবার চিন্তা করার বিষয় যে, ঈসা (আ.) এর দ্বিতীয়বারের আগমন সম্পর্কিত হাদীসে ‘শপথ’ বাক্যের উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও সেখানে তাবীল করে ‘রূপক ঈসা‘ এর ধারণা নেয়া কতটুকু গ্রহণযোগ্য? এটি খোদ মির্যা কাদিয়ানীর-ও নীতিবিরুদ্ধ নয় কি?

বলে রাখা জরুরি যে, ইলিয়া এর ইসলামি সমার্থক নাম ইলিয়াস (আ.)। হযরত ইলিয়াস (আ.) ইসলামের একজন নবী, যিনি বনী ইসরাইল সম্প্রদায়ে আগমন করেছিলেন। তিনি হযরত মূসার (আ.) ভাই হযরত হারুনের (আ.) বংশধর ছিলেন। তিনি বর্তমান জর্ডান নদীর উত্তর অঞ্চলের জিলীআদ নামক স্থানের “আবেল মাহুলা” নামক জায়গার অধিবাসী ছিলেন। খ্রিস্টান এবং ইহুদিদের কাছে তিনি এলিয় (Elijah) নামে পরিচিত। তিনি খৃষ্টপূর্ব ৮৭৫ থকে ৮৫০ অব্দের মাঝামাঝি সময়ে জন্মগ্রহণ করেন। ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি হিযকিলের পরে আল ইয়াসার পূর্বে নবী হিসাবে প্রেরিত হন।

যাইহোক, সকল কাদিয়ানী মতবাদের অনুসারীদের বলতে চাই, আপনি কাকে কী বলে মেনে নিচ্ছেন সেটি আপনার ব্যাপার। কিন্তু একটু তো নিজের বিবেককে প্রশ্ন করবেন এবং নিরপেক্ষ বিবেকবুদ্ধি খাটিয়ে নিজের বিশ্বাসের পরিপক্কতা যাচাই করে নেবেন। মৃত্যুর পরে কিন্তু সেই সুযোগ কারো থাকবেনা। তাই আসুন, গোঁড়ামি বাদ দিয়ে মির্যা কাদিয়ানীর দাবীগুলো কী কী এবং সেসব দাবী দাওয়ার জন্য তার মত ব্যক্তি কোনোভাবেই উপযুক্ত কিনা, যাচাই-বাছাই করুন। কেননা একজন মিথ্যাবাদী, প্রতারক আর ধোকাবাজ আর যাইহোক, কিছুতেই ইমাম মাহদী বা নবুওয়ত দাবী করার যোগ্য হতে পারেনা। আল্লাহ হাফেজ।

লিখক প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী

হযরত ইমাম মাহদী এর জন্ম কোথায় হবে?

জনৈকা বাংলাদেশী কাদিয়ানী খাতুনের তিনটি প্রশ্নের উপর আমাদের মূল্যায়ন,

কাদিয়ানী ন্যাশনাল আমীর আব্দুল আউয়ালকে উদ্দেশ্য করে কাদিয়ানী খাতুনের প্রশ্নগুলো নিন্মরূপ,

  • প্রশ্ন করা হল যে, ইমাম মাহদী মক্কায় জন্মগ্রহণ না করে তিনি মক্কার বাহিরে অনারবে কিজন্য জন্মগ্রহণ করবেন?
  • প্রশ্ন করা হল যে, হজ্বের সময় মক্কা মদীনায় আহমদীরা তথা কাদিয়ানীরা হারামাইনের ইমামের পেছনে সালাত কেন পড়েন না?
  • প্রশ্ন করা হল যে, ইসলাম ধর্মে তো যাকাত সবার উপর বাধ্যতামূলক নয়, তাহলে কাদিয়ানী জামাতের সবার উপর ‘চান্দা’ বাধ্যতামূলক কেন?

এবার উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর উত্তর আব্দুল আউয়াল সাহেব কীভাবে দিলেন সেটা তো জানবোই, তার আগে প্রশ্নগুলোর মূল্যায়নের উপর সংক্ষেপে লিখব। খাতুন সাহেবার প্রথম প্রশ্ন-

“ইমাম মাহদী মক্কায় জন্মগ্রহণ না করে তিনি মক্কার বাহিরে অনারবে কিজন্য জন্মগ্রহণ করবেন?” প্রশ্নকারী যেন বলতে চাচ্ছেন যে, ইমাম মাহদী দাবীদার মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী মক্কার বাহিরে ভারতের পাঞ্জাবের ‘কাদিয়ান’ গ্রামে জন্মগ্রহণ করার কারণ কী?

খাতুন সাহেবার প্রশ্ন সঠিক। তিনি ঠিকই ধরতে পেরেছেন। ইসলামের সেই ইমাম মাহদী যার আগমনী ভবিষ্যৎবাণীতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিষ্কার বলে গেছেন যে ইমাম মাহদী আরব শাসন করবেন। যেমন,

لاَ تَذْهَبُ أَوْ لاَ تَنْقَضِي الدُّنْيَا حَتَّى يَمْلِكَ الْعَرَبَ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ بَيْتِي يُوَاطِئُ اسْمُهُ اسْمِي

অর্থাৎ দুনিয়া ততক্ষণ ধ্বংস হবে না, যতক্ষণ না আমার বংশ থেকে একজন আরবের শাসনকর্তা নিযুক্ত হবে। যার নাম হবে আমার নামের মত। (হাদীসের মান, হাসান)। হাদীসটি সিয়াহ সিত্তাহ’র অন্যতম কিতাব আবুদাউদ শরীফের ‘মাহদী অধ্যায়’ উল্লেখ রয়েছে। হাদীস নম্বর ৪২৩৩।

সুতরাং প্রমাণিত হল যে, ইমাম মাহদী আরবে জন্মগ্রহণ করবেন বলেই তিনি আরবের শাসনকর্তা হবার সুযোগ লাভ করবেন।

ইবনে কাসীর (রহ.) শেষ যুগে আত্মপ্রকাশকারী প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদীর সম্পূর্ণ নামটি কিরকম হবে তিনি তার ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া (البداية والنهاية)’ কিতাবে নিম্নরূপ উল্লেখ করে গেছেন, তিনি লিখেছেন,

محمد بن عبد الله العلوي الفاطمي الحسني رضي الله عنهم.

অর্থাৎ ইমাম মাহদীর নাম হবে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ যিনি আলী, ফাতেমা এবং হাসানের (আল আলীবিয়্যি আল ফাতেমিয়্যি আল হাসানি) সন্তান হবেন; রাদিআল্লাহু আনহুম।

বিশৃঙ্খলা ও মালহামা অধ্যায় খ-১/পৃ-১৭।

সিয়াহ সিত্তাহ’র অন্যতম উক্ত কিতাবের আরেক বর্ণনায় বিশুদ্ধ সনদে আরও উল্লেখ আছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

الْمَهْدِيُّ مِنِّي أَجْلَى الْجَبْهَةِ أَقْنَى الأَنْفِ يَمْلأُ الأَرْضَ قِسْطًا وَعَدْلاً كَمَا مُلِئَتْ جَوْرًا وَظُلْمًا يَمْلِكُ سَبْعَ سِنِينَ‏

অর্থাৎ মাহদী আমার বংশ থেকে হবে, যার ললাট প্রশস্ত ও নাক উঁচু হবে। যিনি পৃথিবীকে আদ্‌ল-ইনসাফ দ্বারা এরূপ পূর্ণ করবেন, যেরূপ তা অন্যায়-অবিচারে পূর্ণ ছিল। তিনি সাত বছর রাজত্ব করবেন। (হাদীসের মান, হাসান)। হাদীস নম্বর ৪২৩৬।

একটু খেয়াল করুন, আগের হাদীসটির মত এ হাদীসেও ‘ইমাম মাহদী শাসন বা রাজত্ব করবেন’ বলা হয়েছে। যদিও আগের বর্ণনায় পরিষ্কার করে ‘তিনি আরব শাসন করবেন’ বলেই উল্লেখ রয়েছে।

তারপর আরও দেখুন, ইমাম মাহদী সম্পর্কে পরিষ্কার করে এ কথাও ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছে যে, তিনি মদীনা থেকে মক্কায় পালিয়ে যাবেন এবং লোকজন তথা উম্মাহ’র বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ মক্কায় তাঁকে ইমাম মাহদী হিসেবে সনাক্ত করে তার নিকট হাজরে আসওয়াদ ও মাক্বামে ইবরাহীম এর মাঝে বয়’আত নেয়া শুরু করবেন। যেমন,

يَكُونُ اخْتِلاَفٌ عِنْدَ مَوْتِ خَلِيفَةٍ فَيَخْرُجُ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ هَارِبًا إِلَى مَكَّةَ فَيَأْتِيهِ نَاسٌ مِنْ أَهْلِ مَكَّةَ فَيُخْرِجُونَهُ وَهُوَ كَارِهٌ فَيُبَايِعُونَهُ بَيْنَ الرُّكْنِ وَالْمَقَامِ

অর্থাৎ “একজন খলীফার মৃত্যুর সময় মতানৈক্য দেখা দিলে এবং সে সময় মদীনা থেকে এক ব্যক্তি (তথা ইমাম মাহদী) পালিয়ে মক্কায় আসলে, সেখানকার অধিবাসিগণ তার পাশে সমবেত হবে এবং তাঁকে ইমামতি করার জন্য সামনে পাঠাবে। কিন্তু সে ব্যক্তি তা অপছন্দ করবে। এরপর লোকেরা তার হাতে ‘হাজরে-আসওয়াদ’ ও ‘মাকামে-ইব্‌রাহীমের’ মাঝে বয়’আত গ্রহণ করবে। সে সময় শামদেশ থেকে তার বিরুদ্ধে একদল সৈন্য প্রেরিত হবে, যারা মক্কা ও মদীনার মাঝে অবস্থিত ‘বাইদাহ’ নামক স্থানে মাটিতে ধ্বংস প্রাপ্ত হবে।”

আবু দাউদ, মাহদী অধ্যায়, হাদীস নম্বর ৪২৩৭।

বলে রাখা জরুরি যে, হাদীসটি দীর্ঘবাক্যে বর্ণিত হয়েছে, যার শেষের দিকের কথাগুলোর কোনো মুতাবি বা শাহিদ না থাকায় সেগুলোকে আবু দাউদের উক্ত বর্ণনার সনদের দুর্বলতার কারণে যঈফ বলা হয়েছে। কিন্তু বর্ণনার প্রথমোক্ত কথাগুলো অর্থাৎ ইমাম মাহদী মদীনা থেকে মক্কায় এসে বয়’আত গ্রহণ করার কথাগুলো একাধিক বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত। যেমন ইমাম হাকিম (রহ.) ভিন্ন আরেক সনদে তার ‘মুস্তাদরাক’ গ্রন্থে এ কথাগুলো উল্লেখ করে বলেছেন, এর সনদ সহীহ। ইমাম আবুবকর ইবনু আবী শাইবাহ (রহ.)ও নিজ ‘মুসান্নাফ’ কিতাবে এ কথাগুলো বিশুদ্ধ সনদে উল্লেখ করেছেন। যেমন,

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

يبايع لرجل بين الركن والمقام كعدة أهل بدر، فتأتيه عصائب العراق وأبدال الشام، فيغزوهم جيش من أهل الشام، حتى إذا كانوا بالبيداء يخسف بهم.

অর্থাৎ গযওয়ায়ে বদরের সমপরিমাণ লোকজন একব্যক্তির নিকট ‘হাজরে-আসওয়াদ’ এবং ‘মাকামে-ইব্‌রাহীমের’ মধ্যভাগে বয়’আত গ্রহণ করবে। অত:পর শাম ও ইরাকের ওলী-আবদালগণ তাঁর নিকট উপস্থিত হতে থাকবে। (সে সময়) শামদেশ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে একদল সৈন্য যুদ্ধের উদ্দেশ্যে প্রেরিত হবে, মক্কা ও মদীনার মাঝে অবস্থিত ‘বাইদাহ’ নামক স্থানে মাটিতে তারা ধ্বংস প্রাপ্ত হবে….।

মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, খণ্ড নং ১৫, হাদীস নং ১৯০৭০, হাদীসের মান : সহীহ।

সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে পরিষ্কার শব্দে ও বিশুদ্ধ সনদে প্রমাণিত হল যে, আগত ইমাম মাহদীর জন্মস্থান হবে আরব। তিনি যথাসময় আরবেই জন্মগ্রহণ করবেন, সেখানেই বেড়ে উঠবেন এবং মদীনায় আসার পর তিনি খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে ধাবিত হবেন। বিরোধীপক্ষের সাথে সশস্ত্র লড়াই হবে, আল্লাহ তাঁকে সবকয়টি লড়াইয়ে বিজয় দান করবেন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি আল্লাহর ইচ্ছাতেই আরবের বুকে খিলাফত ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন। তাঁর সেই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফরমান ‘ইয়ামলিকুল আরাবা রাজুলুন মিন আহলি বায়তি’ (يَمْلِكَ الْعَرَبَ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ بَيْتِي) “আমার আহলে বায়তের এক ব্যক্তি আরব শাসন করবে” এর পূর্ণতা দান করবেন। ইনশাআল্লাহ।

সুতরাং কাদিয়ানী খাতুন তাদের ন্যাশনাল আমীর আব্দুল আউয়ালকে প্রথম যে প্রশ্নটি করেছেন তা একদমই অর্থবহ ও প্রাসঙ্গিক। যেজন্য আব্দুল আউয়াল সাহেব উক্ত খাতুনকে ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে যে সমস্ত আয়াত ও কল্প-কাহিনীর অবতারণা করেছেন সবই বানোয়াট, অপব্যাখ্যা ও বাস্তবতা বহির্ভূত।

আব্দুল আউয়াল সাহেব উক্ত খাতুনকে সূরা জুম’আ এর ২ এবং ৩ নং আয়াত পড়ে বুঝতে পরামর্শ দিয়ে বলেন যে, আল্লাহতালা পবিত্র কুরআনের ঐ আয়াতের ভেতর চোখে আঙ্গুল দিয়েই বলে দিয়েছেন যে, ইমাম মাহদী আরবের বাহিরে অন্য কোনো জাতির ভেতর থেকেই হবেন। নাউযুবিল্লাহ! লানাতুল্লাহি আলাল কাযেবীন।

সূরা জুম’আ এর ২ এবং ৩ নং আয়াতে তাহলে কী কথা রয়েছে? পড়তে ক্লিক করুন

Click

আব্দুল আউয়াল এবং তার তথাকথিত ”ছায়া-নবী” মির্যা গোলাম কাদিয়ানী মূলত ঐ সমস্ত বয়ান-বক্তৃতার মাধ্যমে শুধু গোমরাহিকেই বৃদ্ধি করেনি, বরং ইসলামের আদিম ও সহজ সরল শিক্ষায় মারাত্মক বিকৃতিই ঘটিয়েছে। যার ফলে সর্বসম্মত মুসলিম স্কলারদের মতে এরা ইসলামের গণ্ডি থেকে পুরোপুরি বহিষ্কৃত ও কাফির।

সূরা জুম’আ এর ২ এবং ৩ নং আয়াতে তাহলে কী বলা হয়েছে? নতুন কারো আগমন সম্পর্কে বলা হয়েছে? নাকি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আরব-অনারব নির্বিশেষে সকলের জন্য একজন প্রেরিত রাসূল বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে?

পাঠকবৃন্দ! আয়াতটির শুরুতেই বা’আছা (بعث) ক্রিয়াপদটি অতীতকাল বাচক, সেসাথে ‘আখারীনা’ শব্দটির সংযোগ (আ’তফ) তার আগের বাক্যের ‘উম্মিয়্যীন’ এর উপর, যেটি যের অবস্থায় বিদ্যমান।

কাজেই যারা নাহু-সরফ (আরবী ব্যকরণ) মুটামুটিও বুঝেন তাদের নিকট অন্তত একথা পরিষ্কার যে, আয়াত এবং সংশ্লিষ্ট রেওয়ায়েত দ্বারা ভবিষ্যতে কারো আসার কথা বলা হয়নি। বড়জোর সালমান ফারসীর বংশের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যই (ফজিলত) বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, “ঈমান বা ইলম বা দ্বীন যদি সুরাইয়া নক্ষত্রের নিকটেও থাকত তবু তার সম্প্রদায়ের লোকেরা তা নিয়ে আসত।”

সহীহ ইবনু হিব্বান, সহীহ মুসলিম এবং বুখারী সহ সবখানে ‘বহুবচনাত্মক’ শব্দে যথাক্রমে উল্লেখ আছে, তারা সালমান ফারসীর বংশধর বা و قوم هذا (ইবনু হিব্বান), ফারস্যের সন্তানেরা বা ابناء الفرس (মুসলিম), সালমান ফারসীর বংশধর কতিপয় ব্যক্তি বা لناله رجال او رجل من هؤلاء (বুখারী)।

বিস্তারিত উল্লিখিত ওয়েবসাইট লিংকটি থেকে দেখার আহবান রইল।

দীর্ঘ আলোচনা হতে বুঝা গেল যে, আয়াত এবং সংশ্লিষ্ট রেওয়ায়েতের আলোকে নতুন কাউকে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ”বুরুজ” বা দ্বিতীয় আধ্যাত্মিক সত্তায় (হিন্দুশাস্ত্রে যাকে ‘অবতার বলা হয়) আসা সম্পর্কে ইংগিতেও বলা হয়নি। বড়জোর আয়াতের وَآخَرِينَ مِنْهُمْ لَمَّا يَلْحَقُوا بِهِمْ এর ভেতর সালমান ফারসী (রা.) এর বংশধর সহ সমগ্র অনারবের জন্য যারা তখনও আরবের উম্মী সাহাবীদের মধ্যে শামিল হননি ; প্রত্যেকের জন্য একজন ‘রাসূল’ হিসেবে প্রেরিত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রেসালতের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সকল তাফসীরকারক আয়াত এবং রেওয়ায়েতগুলোর আলোকে এও বলে গেছেন যে, সেই অনারবদের মধ্যে হযরত সালমান ফারসী (রা.) এর বংশের স্বতন্ত্র ‘ফজিলত’ বর্ণনা দিতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উরুতে হাত রেখে বলেছিলেন,

لو كان الإيمان عند الثريا لناله رجال او رجل من ه‍ؤلاء

অর্থাৎ যদি ঈমান সুরাইয়া নক্ষত্রপুঞ্জের নিকটে থাকত তাহলেও এঁদের (সালমান ফারসীর বংশের দিকে ইংগিত) এক বা কতেক পুরুষ তা অর্জন করত। (বুখারী ৪৮৯৭, সাহাবী আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে)।

কাজেই প্রশ্নকারী কাদিয়ানী খাতুনের প্রথম প্রশ্নের উত্তরে কাদিয়ানী আমীর যে কথাগুলো বলেছেন তা সম্পূর্ণ মনগড়া ও বানোয়াট। যার বিন্দুমাত্র সত্যতার কোনো চাপ না আছে কোনো দুর্বল হাদীসে আর না আছে সূরা জুম’আ এর আয়াত দু’টি এবং তার সংশ্লিষ্ট রেওয়ায়েতগুলোতে, কোথাও নেই।

সুতরাং আব্দুল আউয়াল সাহেব আবারও ভুজুংভাজুং উত্তর দিয়ে ধরা খেয়েছেন। আল্লাহ তাকে সহ তার সমগোত্রীয় সবাইকে ইসলামের সঠিক শিক্ষায় ফিরে এসে ও তাওবা পড়ে শাহাদাহ পাঠ করে ইসলামে শামিল হবার তাওফিক দিন। আমীন।

(বাকি দু’টি প্রশ্নের মূল্যায়ন নিয়ে পরবর্তীতে লিখা হবে, ইনশাআল্লাহ)।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

জারজ সন্তান বলে মির্যা কাদিয়ানীর গালিগালাজ

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজ হাতে রচিত তার পুস্তকে তার বিরোধিতাকারীদের ‘জারজ সন্তান’ বলে গালি দিয়েছে।

দেখুন, রূহানী খাযায়েন খণ্ড ৯ পৃষ্ঠা ৩১।

সম্পূর্ণ লিখাটি এই যে,

উর্দূ/মূল কন্টেন্ট :

اب جو شخص اس صاف فیصلہ کے برخلاف شرارت اور عناد کی راہ سے بکواس کرے گا اور اپنی شرارت سے بار بار کہے گا کہ عیسائیوں کی فتح ہوئی اور کچھ شرم اور حیا کو کام نہیں لائے گا اور بغیر اس کے جو ہمارے اس فیصلہ کا انصاف کے رو سے جواب دے سکے انکار اور زبان درازی سے باز نہیں ائے گا اور ہمارے فتح کا قائل نہیں ہوگا تو صاف سمجھا جائے گا کہ اس کو ولد الحرام بننے کا شوق ہیں اور حلال زادہ نہیں۔

অর্থাৎ “এখন যে কেউ এই স্পষ্ট সিদ্ধান্তের বিপরীতে ধৃষ্টতা ও একগুঁয়েমির মাধ্যমে অর্থহীন কথা বলবে, এবং নিজ ধৃষ্টতার সাথে বারবার বলবে যে খ্রিস্টানরা বিজয়ী হয়েছে এবং কোনো লজ্জা বা বিনয় ব্যবহার করবে না এবং আমাদের সিদ্ধান্তের প্রতি ন্যায়সঙ্গতভাবে সাড়া দেয় এমন কেউ ছাড়া, আর যেই তা অস্বীকার ও বাড়াবাড়ি করা থেকে বিরত না থাকবে, এবং আমাদের বিজয়ের বিষয়ে কায়েল (স্বীকারকারী) হবেনা, তাহলে স্পষ্টই বোঝা যাবে যে সে লোক ওয়ালাদুল হারাম অর্থাৎ জারজ; বরং সে জারজ সন্তান হওয়ারই ইচ্ছা রাখে।”

(মির্যা কাদিয়ানীর রচনা ‘আনওয়ারুল ইসলাম’ পৃষ্ঠা নং ৩০, রচনাসমগ্র রূহানী খাযায়েন ৯/৩১)।

আফসোস! কাদিয়ানীদের কথিত বুরুজি নবী ও কৃষ্ণের অবতার এবং মসীহ ও মাহদী মির্যা কাদিয়ানী ইবনে চেরাগ বিবি এর বিরোধীদের উদ্দেশ্যে এ কেমন অশালীন গালিগালাজ!!

কিন্তু সাধারণ কাদিয়ানীরা এতই ব্রেইন ওয়াশ এবং কাল্ট যে, তাদেরকে এগুলো বিশ্বাস করানোই যায় না। এভাবে মির্যা কাদিয়ানীর নিজ হস্তে লিখিত পুস্তকের ছবি, মূল ট্যাক্টস অনুবাদ সহ তুলে ধরার পরেও তারা তোতাপাখির মত বলবে,

না না, এগুলো সব মিথ্যা আর বানোয়াট!!

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী
অ্যাডমিন- রদ্দে কাদিয়ানী অ্যাপস

ঈসা (আ.)-কে মৃত সাব্যস্ত করলে তখন প্রশ্নগুলোর উত্তর থাকেনা

‘তাহার পূর্বে বহু রাসূল গত হইয়াছে’ – কুরআন ৩/১৪৪, (অনুবাদ-ইসলামিক ফাউন্ডেশন) এ আয়াত দ্বারা কাদিয়ানীদের দাবী হচ্ছে,

ঈসা (আ.) সহ ইতিপূর্বেকার সমস্ত রাসূল মৃত্যুবরণ করিয়াছেন। এখানে তাদের উদ্দেশ্য, ঈসা (আ.)-কে মৃত সাব্যস্ত করা এবং ‘শেষ যুগে আগত ঈসা’ হতে একজন রূপক ঈসা স্বরূপ মির্যা কাদিয়ানীকে তাঁরই জায়গায় প্রতিষ্ঠা করা।

সে যাইহোক, মূলত কাদিয়ানীদের কৃত অনুবাদ “সমস্ত রাসূল” এর জায়গায় “অনেক বা বহু রাসূল” অর্থই সঠিক। নইলে নিচের এ সংক্ষিপ্ত তিনখানা প্রশ্নের আদৌ কোনো উত্তর থাকেনা।

১। আয়াতটির কোথাও মৃত্যু অর্থের জন্য موت বা মাউত শব্দ আল্লাহ ব্যবহার করেননি। আল্লাহ “খালাত” বা “গত হইয়া গিয়াছে” ক্রিয়াপদ ব্যবহার করেছেন। এখন এর কারণ কী?

এর কারণ তো “গত হইয়া গিয়াছে” শব্দটিকে ‘মুশতারিক’ বা ব্যাপক রাখার মধ্য দিয়ে একটি ঊহ্য প্রশ্নের সমাধান দেয়া। অর্থাৎ ইহজগৎ থেকে যাকে সশরীরে উঠে নেয়া হয়েছে এবং যাদেরকে জীবনাবসান ঘটিয়ে পুরোপুরি নিয়ে নেয়া হয়েছে, এ দু ভাবে ‘গত হওয়া’ সত্তাকে ঐ ‘ক্বাদ খালাত’ শব্দের অর্থে অন্তর্ভুক্ত করতে চাওয়া! তাই নয় কি? নতুবা ‘মউত’ শব্দ পরিত্যাগ করার মধ্যে আর কী কারণ থাকতে পারে? আল্লাহ কি কোনো কারণ ছাড়াই ‘মউত’ (মৃত্যুবরণ করা) শব্দটি এ ক্ষেত্রে পরিত্যাগ করেছেন?

উল্লেখ্য, মির্যায়ী প্রধান শিষ্য হেকিম নূর উদ্দিন সাহেবের রচনায় তিনিও পরিষ্কার করে লিখে গেছেন,

پہلے اس سے بہت رسول ہو چکے

অর্থাৎ তাঁহার পূর্বে বহু রাসূল হইয়াছিল। দেখুন, ফসলুল খিতাব (উর্দূ) পৃষ্ঠা নং ২৮।

২। তাফসীরকারকদের প্রধান হযরত ইবনু আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে পরিষ্কার বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ ঈসাকে সশরীরে আকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন। দলিল একটু পরে দিচ্ছি। তো ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-ও কি قد خلت من قبله الرسل এর সঠিক অর্থ বুঝতে পারেননি? নাউযুবিল্লাহ।

তাফসীরে ইবনে কাসীর-ইমাম ইমাদুদ্দীন ইবনে কাসীর (ابن كثير), সূরা নিসা আয়াত নং ১৫৮ এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন ((قال ابن أبي حاتم : حدثنا أحمد بن سنان، حدثنا أبو معاوية، عن الأعمش، عن المنهال بن عمرو، عن سعيد بن جبير، عن ابن عباس قال : لما أراد الله أن يرفع عيسى إلى السماء، خرج على أصحابه – وفي البيت اثنا عشر رجلا من الحواريين ……. فألقي عليه شبه عيسى ورفع عيسى من روزنة في البيت إلى السماء. وهذا إسناد صحيح إلى ابن عباس)) অর্থাৎ ইবনে আব্বাস থেকে, তিনি বলেন, আল্লাহ যখন ঈসাকে আকাশে উঠিয়ে নিতে চাইলেন, তখন তিনি আপনা সাথীদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। তখন তাঁর বাড়ীতে বারোজন হাওয়ারী ছিলেন……..ইত্যবসরে জনৈক ইহুদীকে ঈসার সাদৃশ করে দেয়া হয় এবং ঈসাকে বাড়ীর বাতায়ন পথে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়। ইবনে আব্বাস পর্যন্ত এর সনদ তথা সূত্র সহীহ।

৩। সূরা নিসা আয়াত নং ১৫৯ তে আল্লাহতালা পরিষ্কার বলেছেন, قبل موته অর্থাৎ ঈসার মৃত্যুর আগে আগে সকল আহলে কিতাব তাঁর প্রতি ঈমান আনবে। দলিল একটু পরে দিচ্ছি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি কুরআনের ভেতর আল্লাহ ঈসা (আ.) সম্পর্কে স্ববিরোধী কথা বলেছেন? নাউযুবিল্লাহ। আল্লাহ যদি সূরা আলে ইমরানে قد خلت দ্বারা ঈসাকেও মৃত্যুবরণকারী বুঝাতেন তাহলে সেই ঈসার মৃত্যুর আগে আগে আহলে কিতাবীরা ঈমান আনতে বলার কী অর্থ? ভাবিয়ে তুলে কিনা?

তাফসীরে ইবনে কাসীর-ইমাম ইমাদুদ্দীন ইবনে কাসীর (ابن كثير), সূরা নিসা আয়াত নং ১৫৯ এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন ((وأولى هذه الأقوال بالصحة القول الأول، وهو أنه لا يبقى أحد من أهل الكتاب بعد نزول عيسى، عليه السلام، إلا آمن به قبل موته، أي قبل موت عيسى، عليه السلام، ولا شك أن هذا الذي قاله ابن جرير، رحمه [الله] هو الصحيح)) অর্থাৎ এ বক্তব্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সঠিক হল প্রথম উক্তি। সেটি এই যে, ঈসা (আ.)-এর অবতরণের পর আহলে কিতাবীদের মধ্য হতে যারাই অবশিষ্ট থাকবে প্রত্যেকে ঈসা (আ.)-এর মৃত্যুর আগেই তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবেই। আর নিঃসন্দেহে এটাই বিশুদ্ধ মত, ইবনে জারীর আত তাবারীও এমনটাই বলেছেন।

ফেসবুক থেকে ক্লিক

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

মির্যা কাদিয়ানীর বৃটিশ তোষণ

লিখেছেন, প্রখ্যাত গবেষক শায়খ আবু সালমান (হাফি.)

সুদীর্ঘ প্রায় আড়াইশ’ বছর বৃটিশরা এই উপমহাদেশ শাসন করেছে। ইতিহাস সাক্ষী- ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য তারা অনেক মসজিদ-মাদরাসা গুড়িয়ে দিয়েছে। শহীদ করেছে শত শত আলেমে দ্বীনকে । তাদের পাশবিক নির্যাতনের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে মানবতা হয়ে পড়েছিল বিধ্বস্ত, বাকরুদ্ধ এবং চরম অসহায়।  মুসলমানদের প্রতি সীমাহীন অত্যাচার ও অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে তারা এ অঞ্চলে নিজেদের  অবস্থান ও সাম্রাজ্যের ভিতকে দৃঢ় ও পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিল। ইতিহাসের পাতায় তাদের সে জুলুমের ইতিহাস ছড়িয়ে আছে।

তবে এ দীর্ঘ সময়ে তাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য প্রতিরোধ আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। কখনও তার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে ‘ফরায়েজী আন্দোলন’ নামে। যার নেতৃত্বে ছিলেন পূর্ববাংলার হাজী শরীয়াতুল্লাহ রহ.। কখনও তাদের বিরূদ্ধে সংগ্রাম করেছেন পশ্চিমবাংলার মাওলানা নেছার আলী ওরফে ‘তিতুমীর’ রহ.। যে তিতুমীরের ‘বাশের কেল্লা’-র কথা আমরা সকলেই জানি। এরূপ আরও অনেক সংগ্রামী সাধক এ পথে নিজের জীবনোৎসর্গ করেছেন। যাদের অবিরাম সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের কারণেই বৃটিশ বেনিয়ারা এ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল।

ইতিহাস সাক্ষী, এই ভূখন্ডে স্বাধীনতা লুট করার জন্য এবং মুসলমানদের প্রতিরোধ-আন্দোলনকে দমন করার জন্য ইংরেজরা মীর জাফর ও মীর সাদেকের ন্যায় অনেক বিশ্বাসঘাতককে ব্যবহার করেছে। যারা নিজ জাতি ও ধর্মের সাথে গাদ্দারী করে ইংরেজ বেনিয়াদের সহোযোগিতা করে। ফলে ভারতবর্ষে তাদের আগ্রাসন ও স্বেচ্ছাচারিতার শিকড় দৃঢ় ও মজবুত হয়ে যায়।

এতকিছুর পরও যখন তাদের বিরূদ্ধে ক্ষণেক্ষণে প্রতিরোধ আন্দোলন চলতেই থাকে, এবং ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের মাধ্যমে মুসলমানদের বুকের ভেতরের দীর্ঘদিনের ছাইচাপা আগুনের সম্মিলিত বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তখন তারা আন্দোলনের এ ধারা চিরতরে বন্ধ করার জন্য নতুন এক জঘন্য কৌশল বেছে নেয়। তারা ভেবে দেখল, ভারতবর্ষের মুসলমানেরা অত্যন্ত ধর্মভীরু। আল্লাহ ও রাসূলের কথার সামনে তারা সব কিছু বিলিয়ে দিতেও প্রস্তুত হয়ে যায়। তারা মানলে শুধু তাদের নবীর কথাই মানে। কারণ, নবীদের মুখের কথা সাধারণ কথা নয়। তা স্বয়ং খোদার তরফ থেকে আগত ওহী। আর ওহীর নির্দেশ পালন মুসলমানদের দৃষ্টিতে সর্বোচ্চ ফরজ বিধান। অতএব, যদি কাউকে ব্যবহার করে ওহীর দোহাই দিয়ে ইংরেজদের পক্ষে কথা বলানো যায় এবং মুসলমানদেরকে বৃটিশ শাসনের আনুগত্যের দীক্ষা দেওয়া যায়, তাহলে জনসাধারণের মনের বৃটিশবিদ্বেষ  কিছুটা লঘু করা সম্ভব হতে পারে।

এ নীলনকশা বাস্তবায়নে তারা নির্বাচন করল পাঞ্জাব প্রদেশের গুরুদাশপুর জেলার কাদিয়ান নামক গ্রামের এক ব্যক্তিকে। যার নাম মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী। যে ইংরেজদের ছত্রছায়ায় তাদের হীন স্বার্থ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নবুওতের দাবি করে। অথচ হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই শেষনবী। তার পরে কোনো ব্যক্তি নবুওয়তের আসনে অধিষ্ঠিত হবে না। তার পরে যে কোন ধরনের নবুওতের দাবিদার নিঃসন্দেহে কাফের ও বেঈমান। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আর কোরআন-সুন্নাহর অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে সকল যুগের মুসলিম উম্মাহর আকীদা বিশ্বাস এটাই ।

মির্যা কাদিয়ানীর নবুওয়াত দাবী :

(নিচে উদ্ধৃত সকল রেফারেন্স মির্যা কাদিয়ানীর স্বহস্তে রচিত রচনাবলীর সমষ্টি ২৩ খন্ডে প্রকাশিত ‘রূহানী খাযায়েন‘ সহ তারই অপরাপর রচনা হতে উল্লেখ করা হবে)

মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী স্পষ্টভাষায় নবুওয়াতের দাবী করেছে। কখনও বলেছে, 

  • “আমার দাবী হলো আমি নবী ও রাসূল” –মালফুযাত-১০/১২৭ পুরাতন সংস্করণ, ৫/৪৪৭ নতুন সংস্করণ

তার স্বহস্তে লিখিত পুস্তিকা ‘দাফেউল বালা’ গ্রন্থে লিখেছে,

  • “প্রকৃত সত্য খোদা তিনিই যিনি কাদিয়ানে তার রাসূল প্রেরণ করেছেন।” দাফেউল বালা ১২বাংলা অনুবাদ

অন্যত্র বলেছে,

  • “আমি ঐ খোদার শপথ করে বলছি যার হাতে আমার জীবন তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন এবং তিনিই আমার নাম নবী রেখেছেন।” -(তাতিম্মা হাকিকাতুল ওহীরূহানী খাযায়েন ২২/৫০৩)

মির্যা কাদিয়ানীর এ জাতীয় আরও অনেক বক্তব্য আছে, যেখানে সে নিজেকে নবী আখ্যা দিয়েছে। তার দাবিদাওয়ার তালিকা অনেক লম্বা। শুরুতে মুজাদ্দিদ, মামূর মিনাল্লা, মুলহাম, পর্যায়ক্রমে যুগ ইমাম, ইমাম মাহদী ও ঈসা ইবনে মারইয়াম হওয়ার দাবি করেছে। অবশেষে নবুওয়তের দাবি করেছে।

বক্ষমান প্রবন্ধে এটি আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। আমরা এখানে আলোচনা করবো, কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতায় মির্যা কাদিয়ানী দাবিদাওয়া ও স্বতন্ত্র দল গঠনের পয়াস পেয়েছে। আর তাদের হীন স্বার্থ বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই সে আমৃত্যু সাধনা করে গেছে।

মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী তার গোটা জীবন অতিবাহিত করেছে বৃটিশ তোষামোদ, চাটুকারিতা ও গুণকীর্তন করে। তার স্ব-লিখিত এমন কোনো গ্রন্থ নেই যেখানে সে বৃটিশের গুণগান করেনি। সে নিজেই বলেছে,

  • “এই সতের বছর ধরে আমি যে পরিমাণ গ্রন্থ রচনা করেছি, তার সবগুলোতেই বৃটিশ সরকারের আনুগত্যের প্রতি মুসলমানদেরকে উৎসাহিত করেছি।” কিতাবুল বারিয়্যাহরূহানী খাযায়েন ১৩/৬-

বাস্তবে তা-ই ঘটেছে। সে তার প্রতিটি গ্রন্থেই মুসলমানদেরকে জালেম বৃটিশের আনুগত্যের প্রতি অনুপ্রাণিত করেছে। আমরা এখানে তার কয়েকটি মাত্র বক্তব্য তুলে ধরছি। পাঠকমাত্রই বুঝতে সক্ষম হবেন যে, আসলেই সে ও তার সম্প্রদায় বৃটিশ কর্তৃক সৃষ্ট, তাদের মদদপুষ্ট এবং তাদের উচ্ছিষ্টভোগী।

বৃটিশ আনুগত্যের আহবান

যুগে যুগে যখনই নবীগণ এসেছেন সমকালীন অত্যাচারী শক্তির মোকাবেলা করেছেন। তারা তাগুতের সামনে কখনো মাথা নত করেননি। বাতিলের সামনে হকের কালিমা বলতে বিন্দুমাত্র ভয় পাননি ও বিচলিত হননি। তারা ভয় পেতেন একমাত্র আল্লাহকে। কোনো জালিমশাহীর তোষামোদ ও চাটুকারিতাও তারা করেননি। হযরত মূসা আ. এর সময়কালে বাতিল আত্মপ্রকাশ করেছে খোদাদ্রোহী ফেরাউনের রূপ নিয়ে। ফেরাউনের মুখের উপর আল্লাহর হুকুম শুনাতে মূসা আ. বিন্দুমাত্র ভয় পাননি। হযরত ইবরাহীম আ. এর যামানায় কুফুরী শক্তি ছিল নমরূদ। ইবরাহীম আ. কখনও নমরূদের কোন পরোয়া করেননি।

ভারতবর্ষে বৃটিশ বেনিয়াদের স্বেচ্ছাচার এবং মুসলমানদের উপর তাদের অবর্ণনীয় নির্যাতন ও নিপীড়নের ইতিহাস বলে শেষ করা যাবে না। নবুওয়তের মিথ্যা দাবিদার মির্যা কাদিয়ানী মুসলমানদের চির শত্রæ বৃটিশ বেনিয়াদের চাটুকারিতা ও তোষামোদের জন্য যে ভাষা-শব্দ ব্যবহার করেছে তা যে কোনো ভদ্র ও আত্মমর্যাদার অধিকারী ব্যক্তির মনেই ঘৃনার উদ্রেক করবে। 

মির্যা কাদিয়ানী তার অনুসারীদেরকে সাম্রাজজ্যবাদী বৃটিশ সরকারের আনুগত্যের দীক্ষা দিতে গিয়ে বলছে-

  • “আমি (আমার অনুসারীদেরকে) অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উপদেশ দিচ্ছি যে, তারা যেন আমার সেই নসীহত ভালোভাবে মনে রাখে, যা প্রায় ২৬ বছর যাবত আমি বক্তৃতা ও লেখনীর মাধ্যমে তাদের অন্তরে বদ্ধমূল করে আসছি। তা হল- তারা পরিপূর্ণরূপে এই ইংরেজ সরকারের আনুগত্য করবে। কেননা তারা আমাদের কল্যাণকামী সরকার। তাদের সাহায্য-ছায়ায় থেকেই আমাদের জামাতে আহমাদিয়া (কাদিয়ানী সম্প্রদায়) মাত্র কয়েক বছরে কয়েক লাখে পৌছে গেছে।” মাজমুয়ায়ে ইশতেহারাত ২/৭০৮নতুন সংস্করণ

বৃটিশ সরকারের উপর মির্যা কাদিয়ানীর অবদান:

  • “আমার জীবনের সিংহভাগ সময় কেটেছে এই ইংরেজ সরকারের সাহায্য ও তাদের সমর্থন কুড়িয়ে। আমি জিহাদের বিরুদ্ধে ও ইংরেজ সরকারের আনুগত্যের বিষয়ে এত বিপুল গ্রন্থ রচনা করেছি এবং প্রচারপত্র বিতরণ করেছি, যে গ্রন্থ ও প্রচারপত্রগুলো যদি এক স্থানে একত্রিত করা হয় তাহলে তা দ্বারা ৫০ টি আলমারি ভরে যাবে। আর এগুলো আমি সকল আরবদেশে; মিশর, সিরিয়া ও কাবুলে, এবং রোমদেশ পর্যন্ত পৌছে দিয়েছি। সর্বদাই আমার চেষ্টা ছিল যেন মুসলমানেরা এই বৃটিশ সরকারের হিতাকাঙ্খী হয়ে যায়। -তিরয়াকুল কুলুবরূহানী খাযায়েন-১৫/১৫৫-১৫৬

বৃটিশদের প্রতি আনুগত্য বায়আতের অন্যতম শর্ত:

মির্যা কাদিয়ানীর হাতে কেউ বায়আত হতে চাইলে তার জন্য এই শর্ত জুড়ে দিতো যে, বৃটিশদের প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য করতে হবে। মির্যা কাদিয়ানী লিখেছে,

  •  “আমি একজন শান্তিপরায়ণ মানুষ। (বৃটিশ) সরকারের আনুগত্য ও আল্লাহর বান্দার প্রতি সহানুভূতি-ই হল আমার নীতি। আর এটা এমনই এক নীতি যা আমার মুরীদদের বায়আতের জন্য পূর্বশর্ত।” কিতাবুল বারিয়্যাহরূহানী খাযায়েন-১৩/১০

বৃটিশ-আনুগত্য মুসলমানদের জন্য ফরজ:

মির্যা কাদিয়ানীর আকীদামতে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ বেনীয়াদের আনুগত্য করা দেশের প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ। মির্যা কাদিয়ানী লিখেছে,

  • “আমি এখানে মুসলমানদেরকে নসীহত করছি। তাদের উপর ফরজ, তারা যেন আন্তরিকভাবে (বৃটিশ) সরকারের আনুগত্য করে।” লেকচার লুধিয়ানারূহানী খাযায়েন-২০/২৭২-

বৃটিশদের অবাধ্যতা পাপ:

মির্যা কাদিয়ানীর দাবি, যেহেতু মুসলমানদের জন্য বৃটিশদের আনুগত্য করা ফরজ তাই তাদের অবাধ্যতা গোনাহের কারণ। মুসলমানদের জন্য এই ফরজ অলঙ্ঘনীয়। মির্যা লিখেছে,

  • “মুসলমানদের জন্য ফরজ হলো তারা যেন এই বৃটিশ সরকারের একনিষ্ঠ হিতাকাঙ্খী হয়ে যায় এবং তাদের জন্য নিজের জীবনোৎসর্গকারী হয়ে যায়। আর এই ফরজ ত্যাগ করলে তারা গোনাহগার হবে।” মাজমুয়ায়ে ইশতেহারাত- ২/৩৫৫

ইসলামের দুটি অংশ:

মির্যা কাদিয়ানী বলেছে, ইসলামের অংশ দুটি। আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য ও বৃটিশদের আনুগত্য। লিখেছে,

  • “বারবার আমি আমার যে নীতি প্রকাশ করেছি তা হলো, ইসলামের দু’টি অংশ। এক. আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য করা। দুই. যে সরকার (সমাজে) নিরাপত্তা ও শান্তি স্থাপন করেছে (!!) এবং জালেমদের কবল থেকে রক্ষা করে আমাদেরকে নিজেদের আশ্রয়ে নিয়েছে সে সরকারের আনুগত্য করা। আর তারা হলো বৃটিশ সরকার।” –শাহাদাতুল কুরআনরূহানী খাযায়েন -৬/৩৮০

বৃটিশ সরকার খোদার রহমত!

বৃটিশ শাসনামলে উপমহাদেশে ইসলাম ও মুসলমানদের যে ক্ষতি হয়েছে তা কারো অজানা নয়। তারা জুলুম অত্যাচারের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা লুন্ঠন করেছে। মসজিদ-মাদরাসা গুড়িয়ে দিয়েছে। মুসলমানদের সন্তানদের ধর্মীয় চেতনা ও মূল্যবোধ নষ্ট করার হীনচেষ্টা করেছে। তাদের ছত্রছায়াতেই পুরো ভারতবর্ষজুড়ে খৃষ্টানমিশনারী ও পাদ্রীদের অপতৎপরতা শুরু হয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এ ভূখণ্ডে তাদের আধিপত্য ছিল মুসলমানদের জন্য আল্লাহর আযাবস্বরূপ। ভারতবর্ষের সবাই জানতো, বৃটিশরা আল্লাহর দুশমন। আল্লাহর রাসূলের দুশমন। ইসলাম ও মুসলমানদের দুশমন। তারা কখনও মুসলমানদের বন্ধু ও কল্যাণকামী হতে পারে না। অপরদিকে মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর বক্তব্য হল, উপমহাদেশে বৃটিশ শাসন মূলত খোদার রহমত, নেয়ামত ও  তার পক্ষ থেকে বরকতস্বরূপ। লক্ষ করুন,

  • “ইংরেজ সরকার খোদার অসংখ্য নেয়ামতরাজির মধ্যে অন্যতম নেয়ামত। আর মহামর্যাদাপূর্ণ এক রহমত। আর এ সরকার মুসলমানদের জন্য আসমানী বরতকতূল্য।” শাহাদাতুল কুরআনরূহানী খাযায়েন ৬/৩৮৮-৩৮৯
  • “প্রকৃতপক্ষে বৃটিশ সরকারের অস্তিত্ব খোদার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য এক নেয়ামত ছিল। যা আমরা পেয়েছি দীর্ঘদিনের প্রতিক্ষার পরে। তাই এই নেয়ামতের বারবার আলোচনা করা আমাদের কর্তব্য।” মাজমু’আয়ে ইশতেহারাত ২/১৯১

বৃটিশ সরকারের ঢাল:

বৃটিশ সরকারকে সে নিজেদের জন্য ঢাল আখ্যা দিয়েছে। যেমনিভাবে ঢাল মানুষকে আপতিত হামলা থেকে রক্ষা করে তেমনি তারাও কাদিয়ানীকে সব ধরণের দুর্যোগ থেকে রক্ষা করবে- এই বিশ্বাস নিয়েই কাদিয়ানী বলেছে,

  • “সুতরাং ইংরেজ সরকার তোমাদের জন্য (আল্লাহর) রহমতস্বরূপ। তোমাদের জন্য তা এক বরকত। এবং তা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তোমাদের সুরক্ষার জন্য একটি ঢাল। (যা তোমাদের উপর নিপতিত হামলা থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করবে- সংকলক)। সুতরাং তোমরা মনে প্রাণে এই ঢালের কদর করো।” মাজমু’আয়ে ইশতেহারাত- ২/৭০৯
  • “মহান রাব্বুল আলামীন ইংরেজ সরকারকে তোমাদের কল্যাণে রহমতের বারিধারার ন্যায় প্রেরণ করেছেন।” –শাহাদাতুল কুরআনরূহানী খাযায়েন ৬/৩৮৯)

মির্যা কাদিয়ানীর আলোচিত বক্তব্যগুলোর কোনো ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। স্পষ্টভাষায় সে বৃটিশ সরকারকে আল্লাহর রহমত, নেয়ামত এবং বরকত আখ্যা দিয়েছে। আর কোন নেয়ামত লাভ করার পরে তার শুকরিয়া জানানোও তো কর্তব্য! তাই ঘোষনা করলো- এই ‘নেয়ামত’-এর শুকরিয়া আদায় করা আবশ্যক।

বৃটিশ সরকারের শুকরিয়া:  

  • “উপমহাদেশের সকল মুসলমানের জন্য অত্যাবশ্যক হলো- তারা যেন মহান ইংরেজ জাতির শাসনকে খোদার নেয়ামত মনে করে। আর যেমনিভাবে তারা অন্য নেয়ামতরাজির শুকরিয়া আদায় করে, তেমনি (বৃটিশ শাসনের) এই নেয়ামতেরও যেন শুকরিয়া আদায় করে।” বারাহীনে আহমাদিয়ারূহানী খাযায়েন- ১/১৪০

বৃটিশদের অকৃতজ্ঞতা নিমকহারামী:

যারা নিজেদের জান বাজি রেখে স্বদেশ প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে বৃটিশ খেদাও আন্দোলন করেছে তাদেরকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। তাদের বীরত্ব উপমা হিসেবে ব্যবহার করে থাকি। অথচ তাদেরকে-ই মির্যা কাদিয়ানী অকৃতজ্ঞ ও নিমকহারাম বলেছে। লিখেছে, 

  • “পাঞ্জাবের মুসলমানেরা খুবই অকৃতজ্ঞ প্রমাণিত হবে যদি তারা (ইংরেজদের) এই শাসনকে আল্লাহ তায়ালার এক মহা নেয়ামত মনে না করে। বস্তুত তাদের জন্য এটি (খোদার) এক অসীম রহমত।” বারাহীনে আহমাদিয়ারূহানী খাযায়েন -১/১৪০

আরও বলেছে,

  • “আল্লাহ তায়ালা রহমতের বারিধারার ন্যায় এই (ইংরেজ) সরকারকে আমাদের শান্তির জন্য প্রেরণ করেছেন। এরপরেও যদি আমরা এই নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় না  করি তাহলে তা হবে মারাত্মক ধরণের নিমকহারামী। এই নেয়ামতের মহত্ব ও তাৎপর্য তো আমাদের শিরা-উপশিরায় ও মনেপ্রাণে অঙ্কিত হয়ে আছে।”  –মাজমু’আয়ে ইশতেহারাত. ২/১৯১

বৃটিশ শাসনের জন্য মির্যার শুকরিয়া জ্ঞাপন!

নিজ দীক্ষা, হিতোপদেশ ও নীতি অনুসারে মির্যা কাদিয়ানী সারা জীবন ইংরেজ শাসনের এই ‘নেয়ামত’ এর  ‘শুকরিয়া’ জ্ঞাপন করে গেছে নানাভাবে, নানা ভাষায়। তাদের শুকরিয়া আদায় করতে গিয়েই তাদের পক্ষে ও তাদের হিতাকাঙ্খী হয়ে গ্রন্থ রচনা করেছে। তার নিজের বক্তব্য অনুযায়ী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সেগুলো বিতরণ করেছে। এমনকি তৎকালীন বড় বড় মুসলিম দেশেও বৃটিশ আনুগত্যের প্রতি উৎসাহ দিয়ে গ্রন্থ পাঠিয়েছে। যাতে করে মুসলমানরা বৃটিশদেরকে নিজেদের বন্ধু ও কল্যাণকামী ভাবতে শিখে। যেমন,

  • “আর যদিও আমি এই (সরকারের) শুকরিয়া আদায় করার জন্য উর্দূ, আরবী ও ফার্সী ভাষায় অনেক গ্রন্থ রচনা করেছি, যেগুলোতে আমি ভারতবর্ষের মুসলমানদের উপর মাননীয়া মহারাণীর অসংখ্য অনুগ্রহের কথা আলোচনা করেছি এবং তা বিভিন্ন মুসলিমদেশে পাঠিয়ে দিয়েছি। আর প্রত্যেক মুসলমানকে (বৃটিশ সরকারের প্রতি) খাঁটি আনুগত্য ও তাদের বশ্যতা স্বীকার করে নিতে অনুপ্রাণিত করেছি।”  তোহফায়ে কায়সারিয়ারূহানী খাযায়েন ১২/২৫৫
  • “আমার বয়স এখন প্রায় ষাট বছর। শুরুজীবন থেকে আজ পর্যন্ত বক্তৃতা ও লেখনীর মাধ্যমে আমি নিজেকে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে সর্বদা ব্যস্ত রেখেছি যে, কীভাবে মুসলমানদের অন্তরকে বৃটিশ সরকারের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা, তাদের প্রতি কল্যাণকামিতা ও সহমর্মিতার দিকে আকৃষ্ট করতে পারি ।” –মাজমু’আয়ে ইশতেহারাত ২/১৯০ উর্দূ রচনা

খোদার ইলহামে বৃটিশ প্রীতি!

বৃটিশদের তোষণ করতে গিয়ে মির্যা কাদিয়ানী এ মিথ্যারও অবতারণা করেছে, তাকে নাকি এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ইলহাম করা হয়েছে।  তার বক্তব্যটি লক্ষ্য করুন.

  • “সকল মুসলমানের মধ্যে আমিই হলাম ইংরেজ সরকারের প্রথম সারির হিতাকাঙ্খী। কেননা তিনটি বিষয়ের কারণে আমি তাদের কল্যাণকামিতার প্রতি উৎসাহিত হয়েছি। এক. আমার মরহুম পিতার প্রভাবে। (তিনিও ইংরেজদের একজন একনিষ্ঠ কল্যাণকামী ছিলেন।)  দুই. আমার প্রতি এই সরকারের অনুগ্রহ-অনুকম্পা। তিন. আল্লাহ তায়ালার ইলহাম (প্রত্যাদেশ)।” (আল্লাহ তায়ালা ইলহামযোগে আমাকে ইংরেজ সরকারের হিতাকাঙ্খী হওয়ার ইঙ্গিত করেছেন।)  –তিরইয়াকুল কুলূবরূহানী খাযায়েন. ১৫/৪৯১

বৃটিশ সরকারের জন্য আন্তরিক দোয়া

মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী ইংরেজ সরকারের প্র্তি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের পর তাদের জন্য দোয়া করেছে এবং তাদের শত্রুদের পরাজয়ের দোয়া করেছে। লিখেছে,

  • “আমরা এই সরকারের এমন এমন অনুগ্রহ দেখেছি যার কৃতজ্ঞতা আদায় করা অত সহজ নয়। তাই আমরা আমাদের মহামান্য সরকারকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, আমরা এই সরকারের প্রতি তেমনই আন্তরিক ও কল্যাণকামী, যেমন ছিলেন আমাদের পূর্বসূরীগণ। আমাদের পক্ষে দোয়া ছাড়া আর কিইবা করার আছে!!  সুতরাং আমরা দোয়া করছি, আল্লাহ তায়ালা সব ধরণের ক্ষতি ও অনিষ্ট থেকে এই সরকারকে রক্ষা করুন। আর তার শত্রুদেরকে অপদস্থ ও পরাজিত করুন।” –শাহাদাতুল কুরআনরূহানী খাযায়েন ৬/৩৮০

রাণী ভিক্টোরিয়া ও মির্যা কাদিয়ানী

যাদের হাত লক্ষ মুসলমানের পবিত্র রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল, যারা ভারতবর্ষের মুসলমানদের পশু ছাড়া অন্য কিছু গণ্য করতো না, সেই বৃটিশ সরকারের মহারাণী ভিক্টোরিয়া, যার নামে পুরান ঢাকার ঐ পার্কটির নামকরণ করা হয় যার গাছে গাছে ১৮৫৭ সালে অগণিত মুসলিম বিপ্লবীর লাশ ঝুলেছিল, সেই রাণীর উদ্দেশ্যে মির্যা কাদিয়ানী যেভাবে কৃতজ্ঞতা,অভিনন্দন,আন্তরিক ভালোবাসা আর আসমানী সাহায্যের প্রার্থনা করে করে মুখে ফেনা তুলেছিল, তা ঈমানদার মুসলমানের হৃদয়ে চরম ঘৃণা ও ধিক্কার সৃষ্টি না করে পারে না।

এ বিষয়ে তার বক্তব্যটি লক্ষ করুন,

  •  “ঐ খোদার শুকরিয়া যিনি আমাদেরকে আজকের এই মহাখুশীর দিনটি দেখার তৌফিক দিয়েছেন যে, আমরা আমাদের মহান সম্রাজ্ঞী, ইংল্যান্ড ও হিন্দুস্তানের (ভারতের) অধিপতি মহারাণীর শত বার্ষিকী জুবিলি দেখতে পেয়েছি। আজকের এই দিনটি পেয়ে আমাদের অন্তরে যে আনন্দস্রোত বয়ে যাচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। আমাদের কল্যাণকামী বরকতময় সম্রাজ্ঞীকে আমাদের পক্ষ থেকে আনন্দ ও কৃতজ্ঞতাপূর্ণ অভিনন্দন জানাচ্ছি।  আল্লাহ সম্রাজ্ঞী মহারাণীকে সর্বদা সুখে শান্তিতে রাখুন।  -তোহফায়ে কায়সারিয়ারূহানী খাযায়েন-১২/২৫৪)

আরও লিখেছে,

  • “ভারতবর্ষের অধিপতি হে মহান সম্রাজ্ঞী, আল্লাহ আপনাকে সৌভাগ্য ও আনন্দপূর্ণ দীর্ঘায়ূ দান করুন। আপনার শাসনামল কতই না বরকতময় যে, খোদার আসমানী সাহায্য আপনার মিশনকে শক্তিশালী করছে। প্রজাবর্গের প্রতি আপনার সহানুভূতিশীলতা ও সদিচ্ছার পথকে ফেরেশতাগণ সুগম করছে। আপনার সুবিচারের মেঘমালা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। যাতে গোটা সাম্রাজ্যকে ফুলে ফুলে সুশোভিত করে দেয়। নিকৃষ্ট সে যে আপনার শাসনামলের মুল্যায়ন করে না। আর অসভ্য সে, যে আপনার অনুগ্রহের প্রতি অকৃতজ্ঞ। আর জানা কথা যে, মনের টান শুধু মন দিয়েই অনুভব করা যায়। তাই আপনাকে যে  আমি মন দিয়ে ভালবাসি এবং বিশেষভাবে আমার অন্তকরণে আপনার প্রতি রয়েছে যে অগাধ ভক্তি ও শ্রদ্ধা- সেকথা মুখ দিয়ে প্রকাশ করার প্রয়োজনবোধ করি না। আপনার জন্য আমাদের দিনরাতের দোয়া  জলশ্রোতের ন্যায় অব্যাহত আছে। আমরা রাজনৈতিক চাপের কারণে আপনার অনুগত হইনি, বরং আপনার বিভিন্ন ধরণের গুণ-বৈশিষ্ট আমাদের অন্তরকে আপনার প্রতি আকর্ষিত করেছে। ভারতবর্ষের অধিপতি হে বরকতময় (?)সম্রাজ্ঞী, আপনার এই সম্মান ও সুখ্যাতি সুদীর্ঘ হোক। খোদার দৃষ্টি ঐ রাজ্যের উপর রয়েছে যার উপর আপনার দৃষ্টি আছে। আর খোদার রহমতের হাত সে প্রজাবর্গের উপর আছে যাদের উপর আপনার হাত রয়েছে। -সিতারায়ে কায়সারিয়া, রূহানী খাযায়েন ১৫/১১৯-১২০)

আরও লিখেছে,

  • “আমি আমার সকল সাথীবর্গ নিয়ে দু’হাত তুলে দোয়া করছি- হে আল্লাহ, ভারতবর্ষের এই বরকতময় সম্রাজ্ঞীকে আমাদের মাঝে দীর্ঘদিন নিরাপদের রাখো। আর তার প্রতিটি পদক্ষেপে তোমার সাহায্যছায়া দান করো।” সিতারায়ে ক্বায়সারিয়ারূহানী খাযায়েন. ১৫/১১৪

রহমতের ছায়া”!

মির্যা কাদিয়ানী বৃটিশ সরকারের সহায়তা ও তাদের সহযোগিতাকে রহমতের ছায়া আখ্যায়িত করেছে। এবং এই কারণে নিজের উপর তাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা ওয়াজিব মনে করছে। তবে তার নিম্নোক্ত বক্তব্যে এ কথার সুস্পষ্ট স্বীকারোক্তি বিদ্যমান যে, এই বৃটিশ সরকার ব্যতীত অন্য কোন সরকারের অধীনে মির্যা তার মিশন (??) কখনও বাস্তবায়ন করতে পারতো না। সহজভাষায় বলতে গেলে, বৃটিশের পৃষ্ঠপোষকাতায়-ই মির্যা তার মিশনকে অগ্রসর করার প্রয়াস পেয়েছে। মির্যার বক্তব্য লক্ষ্য করুন,

  • “আমি ঐ আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি যিনি আমাদেরকে এমন এক সরকারের রহমতের ছায়াতলে (!!!) আশ্রয় দিয়েছেন, যার আশ্রয়ে থেকে আমি স্বাধীনভাবে নিজের ওয়াজ-নসীহতের কাজ আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছি। যদিও এই অনুগ্রশীল সরকারের শুকরিয়া আদায় করা প্রত্যেক প্রজার জন্য ওয়াজিব, কিন্তু আমি মনে করি আমার উপর বেশী পরিমাণে ওয়াজিব। কেননা আমার এই মহান মিশন যা মহামান্য সম্রাজ্ঞীর ছায়াতলে থেকে বাস্তবায়িত হচ্ছে, তা অন্য কোনো সরকারের অধীনে থেকে কখনও বাস্তবায়িত হতো না। হোক না তা কোন ইসলামী সরকার।”  (তোহফায়ে কায়সারিয়া, রূহানী খাযায়েন-১২/২৮৩-২৮৪)

পাঠকবৃন্দ, মির্যা কাদিয়ানীর বক্তব্যগুলো পড়ুন এবং আপনা বিবেককে প্রশ্ন করুন, কাদিয়ানী সম্প্রদায় কোন জ্ঞানে এমন একজন বিশ্ব বেঈমান, স্বজাতির গাদ্দারকে বিশ্বাস করতে পারে! কিভাবে তাকে ইমাম মাহদী, তথাকথিত বুরুজি মুহাম্মদ কিবা একজন ‘নবী’ হিসেবেও বরণ করতে পারে!! যে লোকটি স্বঘোষিতভাবে বৃটিশদের ‘লাগানো চারাগাছ’ আর সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ সরকারের তোষামোদ ও চাটুকারিতায় নির্লজ্জ রেকর্ড সৃষ্টিকারী, যার বিবরণ শুনলে লজ্জা ও ঘৃণায় যেকোনো মানুষের হৃদয় পর্যন্ত কাঁপিয়ে উঠবে; আল্লাহ কি কোনোভাবেই এমন লোককে ন্যূনতম একজন ‘মুজাদ্দিদ’ (সংস্কারক) হিসেবেও প্রেরণ করবেন? নিশ্চয়ই না।

বাকিয়াংশ পড়তে লিখকের ওয়েবসাইট এর এ লিংকটিতে ক্লিক করুন

সংগৃহিত

খোদার সাথে সহবাস করার উদ্ভট দাবী

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী সাহেব (মৃত. ১৯০৮ইং) এর উদ্ভট অনেক দাবীর কথা বলা যায়। তন্মধ্যে এটিও একটি যে, তিনি খোদাতায়ালার সাথে ইন্টারকোর্স তথা যৌনমিলন করেছেন। একদম সরল ও ভদ্র ভাষায় বললে, তিনি তার খোদার সহিত সহবাস করেছিলেন। তারই হাতে বয়’আত গ্রহণকারী সিনিয়র সহচর (মুরিদ) কাজী ইয়ার মুহাম্মদ খান সাহেব মির্যা সাহেব থেকে এ ঘটনাটি তার নিজ গ্রন্থ ‘ইসলামী কুরবানী‘-তে লিখে গেছেন।

কাজী ইয়ার মুহাম্মদ খান আহমদীয়া কমিউনিটি জগতে খুবই প্রসিদ্ধ ও মুখলিস ব্যক্তি যাকে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী প্রায় সব সময় কাছাকাছি রাখতেন। মির্যা সাহেবের পরিবারের সদস্যের ন্যায়ই ছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে, মির্যা কাদিয়ানী সাহেব কাজী সাহেব সম্পর্কে একটি ইলহামী বাণীতে বলেছেন آخر سيف الاسلام অর্থাৎ ইসলামের সর্বশেষ তলোয়ার (ইসলামী কুরবানী পৃষ্ঠা নং ৫)। আরও বলা হয় যে, কাজী সাহেব মির্যা সাহেবের স্ত্রী সাইয়েদা নুসরাত জাহান সাহেবার পার্সোনাল সেক্রেটারি ছিলেন।

সে যাইহোক, তিনি ‘ইসলামী কুরবানী’ (اسلامى قربانى) বইটি উর্দূ ভাষাতেই লিখেন। আহমদীয়া কমিউনিটি কাজী ইয়ার মুহাম্মদ খান সাহেবকে প্রথম সারীর কথিত একজন মির্যায়ী ‘সাহাবী’ বলে গণ্য করতেন। দেখুন, নিচের ছবিতে তিনি মির্যা সাহেবের গায়ে হাত রেখে বাম পাশে কিভাবে দাঁড়িয়ে আছেন!

কাজী ইয়ার মুহাম্মদ খান সাহেবের দুর্লভ একটি ছবি

এবার মূল কথায় ফিরে এলাম, মির্যা সাহেব থেকে তারই কথিত সাহাবী কাজী ইয়ার মুহাম্মদ খান সাহেব সরাসরি বর্ণনা করে নিজ হাতে লিখেছেন

جیسا کہ حضرت مسیح موعود علیہ السلام نے ایک موقع پر اپنی حالت یہ ظاہر فرمائی ہے کہ کشف کی حالت آپ پر اس طرح طاری ہوئی کہ گویا آپ عورت ہیں اور اللہ تعالی نے رجولیت کی طاقت کا اظہار فرمایا تھا سمجھنے والے کے لیے اشارہ کافی ہے۔ اسلامی قربانی ؛ قاضی یار محمد خان

  • অর্থ:- “হযরত মসীহে মওঊদ (মির্যা কাদিয়ানী) একবার নিজের অবস্থা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, কাশফ (আধ্যাত্মিক ধ্যাণ)’র অবস্থা এভাবে চেপে বসল যে, নিজেকে স্ত্রীলোক মনে হল। আর আল্লাহ তা’য়ালা পৌরুষত্বের শক্তি আমার উপর প্রকাশ করছেন। জ্ঞানীদের জন্য ইশারাই যথেষ্ট।” নাউযুবিল্লাহ।

দেখুন ‘ইসলামী কুরবানী ট্রাকট নং ৩৪, পৃষ্ঠা নং ১২।

  • ইসলামী কুরবানী বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড লিংক

উল্লেখ্য, আধুনিক ট্রান্সজেন্ডার মতবাদের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক রূপকার যদি মির্যা কাদিয়ানী সাহেবকে ধরা হয় তাহলেও ভুল হবার কথা নয়। বলাবাহুল্য যে, ট্রান্সজেন্ডার মতবাদে বিশ্বাসীরাই সমকামিতা বা প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনকর্মের সমর্থক। নাউযুবিল্লাহ ছুম্মা নাউজুবিল্লাহ।

কিন্তু আহমদীয়া কমিউনিটিকে উক্ত ঘটনা সম্পর্কে যখন জিজ্ঞেস করা হয় তখন তারা ৩ ভাবে এর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে থাকে। এক. প্রথমতঃ ঘটনাটিকেই অস্বীকার করে মুখ লুকানোর চেষ্টা করেন। দুই. কখনো উত্তরটা এভাবেও দেন যে, আরে আরে; এটি একটি কাশফ মাত্র। কাজেই এধরণের কাশফীয় কোনো কথাবার্তায় এত সিরিয়াস হবার কী আছে! তিন. আবার কখনো ঘটনার বিবরণকে ভিন্নদিকে ঘুরিয়ে দিতে ‘রূপক’ বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। আর যখন লজ্জায় মুখ লুকানোর কোনো উপায় থাকেনা তখন বইটির লিখক কাজী সাহেবকেই ‘মাতাল’ আর ‘পাগল’ বলে সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেন। পড়ুন, তাদের ‘হান্ড্রেড অ্যালিগেশন‘ অনলাইন ভার্সন।

আর যখন বর্তমান আহমদীয়া কমিউনিটি কাজী সাহেবকে পাগল আর মাতাল বলে মির্যা সাহেবের কাশফকে বেহুদা সাব্যস্ত করতে চাচ্ছে তখন তারা ভুলে যায় যে, বিগত কাদিয়ানী খলীফাদের কেউই কাজী সাহেবকে পাগল বা মাতাল বলার কোনো প্রমাণ নেই। বরং প্রত্যেকে তাকে মির্যা কাদিয়ানী সাহেবের ঘনিষ্ঠ অনুসারীদের মধ্যেই গণ্য করে আসছেন। উপরের ছবিটিও তা-ই প্রমাণ করে। নইলে মির্যা কাদিয়ানী সাহেব কিজন্য একজন মাতাল বা পাগলকে নিজের শরীরের সাথে মাখামাখি অবস্থায় ক্যামরার সামনে নিয়ে পোজ দেবেন? বিষয়টি জ্ঞানীদের নিশ্চয়ই ভাবিয়ে তুলবে। আর হ্যাঁ, মির্যা কাদিয়ানী সাহেব একজন নবী দাবীদারও ছিলেন। কাজেই আর যাইহোক একজন নবী দাবীদারের ‘কাশফ’কে ‘বেহুদা’ আখ্যা দেয়ার মত এমন দেয়াদব অন্তত নিজেকে তার অনুসারী বলে দাবী করতে পারেনা।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী

মির্যা কাদিয়ানীর দাবী যারা মানেনা তাদের সম্পর্কে

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (১৮৩৯-১৯০৮) একজন ব্রিটিশ ভারতীয় নাগরিক। পুর্বপুরুষ ছিল মোগল। সম্রাট তৈমুরের বংশধর ছিল। তার পরদাদা মির্যা গুল মুহাম্মদ এবং দাদা মির্যা আতা মুহাম্মদ, পিতা মির্যা গোলাম মর্তুজা। প্রত্যেকে শিখদের দ্বারা নিজ জন্মস্থান পাঞ্জাবে অনেক নিপীড়নের সম্মুখীন হয়, জমিজমা হারায়। কিন্তু পাঞ্জাবের মহারাজা রণজিৎ সিং এর রাজত্বের শেষের দিকে ব্রিটিশ সরকার তার পিতা মির্যা গোলাম মর্তুজাকে তাদের হারানো ৫ টি গ্রামের পূর্ণ জমিদারী পুনরায় উদ্ধার করে দেয়।

জাগতিক এ স্বার্থসিদ্ধির শোকরগুজার হিসেবে তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন বংশপরম্পরায় ব্রিটিশ সরকারের একান্ত অনুগত ও জীবন উৎসর্গকারী। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ সরকারের সাহায্যে মির্যা গোলাম মর্তুজা ৫০টি সশস্ত্র ঘোড় সওয়ার পাঠিয়েছিলো। যারা সে সময় ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে জীবন-মরণ যুদ্ধ করেছিলো। মির্যা কাদিয়ানী এ ইতিহাস নিজেই তার রচনা ‘কিতাবুল বারিয়্যাহ’ পুস্তকে লিখে গেছেন। তার রচনাসমগ্র রূহানী খাযায়েন খন্ড নং ১৩ পৃষ্ঠা নং ৪-৬ দেখুন।

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজ পূর্ব পুরুষদের অনুকরণে আজীবন ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যান। নিজেকে স্বঘোষিতভাবে ব্রিটিশ সরকারের রোপিত চারাগাছ বলে পরিচয় দিতেন। জীবনের শুরুতে ইসলামের পক্ষেও বহু লিখালিখির কাজ করেন। তবে পরবর্তীতে নিজেকে কখনো ‘মসীহ‘, কখনো বা ইমাম মাহদী, কখনো বা বুরুজি মুহাম্মদ দাবীতে বাজার গরম করে তুলেন। ১৯০১ সালের পর নিজেকে সরাসরি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আধ্যাত্মিক সত্তা বলে দাবী করেন। দ্বিতীয় মুহাম্মদ বা বুরুজি মুহাম্মদ হবার দাবী সহ জীবনের শেষের দিকে শরীয়তী নবী হওয়ারও দাবী করে বসেন।

মির্যা কাদিয়ানী সাহেবকে যারা মানে না তাদের সম্পর্কে তারই রচনার আলোকে নিচে তুলে ধরছি,

তিনি তার ১৮৯৯ সালের দিককার একটি রচনায় পরিষ্কার লিখেছেন,

میرا یہ مذہب ہے کہ میرے دعوے کے انکار کی وجہ سے کوئی شخص کافر یا دجال نہیں ہو سکتا۔

অর্থাৎ “আমার মত হচ্ছে যে, আমার দাবী অস্বীকার করার কারণে কোনো ব্যক্তি কাফের অথবা দজ্জাল হয়ে যাবেনা।” দেখুন, তার রচনা ‘তিরয়াকুল কুলুব‘ পৃষ্ঠা নং ১৩১ উর্দূ, (রূহানী খাযায়েন খন্ড নং ১৫, পৃষ্ঠা নং ৪৩২)। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি দ্রষ্টব্য –

কিন্তু মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী সাহেব তার আরেক রচনায় ১৯০৬ সালের মার্চের দিকে দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা দিয়ে লিখে গেছেন যে,

خدا تعالی نے میرے پر ظاہر کیا ہے کہ ہر ایک شخص جس کو میرے دعوت پہنچی ہیں اور اس نے مجھے قبول نہیں کیا وہ مسلمان نہیں ہے اور خدا کے نزدیک قابل مؤاخذہ ہے

“খোদাতায়ালা আমার প্রতি প্রকাশ করেছেন যে, যাদের নিকট আমার দাওয়াত পৌঁছা সত্ত্বেও কবুল করেনি তারা মুসলমান নয়, বরং তারা খোদার নিকট ধরপাকড়ের যোগ্য।” দেখুন ‘তাযকিরাহ‘ চতুর্থ এডিশন পৃষ্ঠা নং ৫১৯, উর্দূ ভার্সন। প্রামাণ্য স্ক্যানকপি দ্রষ্টব্য –

শেষকথা– উপরের দীর্ঘ আলোচনা হতে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, মির্যা গোলাম কাদিয়ানী সাহেব সত্যিই একজন মানসিক রোগী ছিলেন। তার স্মৃতিশক্তি খুব বেশি লোপ পেয়েছিল। ফলে তিনি সকালে কী বলতেন তা বিকেল পর্যন্ত মনে রাখতে পারতেন না। যখন যা মনে আসত তখন তা নির্দ্বিধায় লিখে যেতেন। আফসোস! তার অধিকাংশ অন্ধ অনুসারীর জন্য। তাদেরকে বুঝিয়ে কোনো ফায়দা নেই। কারণ তারা ব্রেইন ওয়াশ ও অন্ধ। আল্লাহ তাদেরকে সুবোধ দান করুন।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

মুহাম্মদ নূরুন্নবী এম এ

নবুওয়ত লাভের ভিত্তি ‘ফানা ফির রাসূল’ প্রসঙ্গে

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নবুওয়ত অর্জনের ভিত্তি ছিল “ফানা ফির রাসূল” বা রাসূলের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া। কিন্তু এখানে আমার ২টি প্রশ্ন রয়েছে। যেমন,

১ মির্যা কাদিয়ানী সাহেবের সেই “ফানা ফির রাসূল” ওয়ালা সাধনাগুলো কী ছিল, যা ইতিপূর্বে উম্মতে মুহাম্মদীয়ার দ্বিতীয় কারো মধ্যে কল্পনা করাও অসম্ভব, যার দরুন মির্যা সাহেবকে সত্যিই ‘রাসূলের মধ্যে বিলীন’ হয়ে যাওয়ার কনসেপ্ট বাস্তব বলে প্রতীয়মান হবে?

২ ফানা ফির রাসূল দ্বারা নবুওয়তের মাকাম লাভ করা যায় এ ধরণের কোনো ইংগিত বা ফরমান কি কুরআন বা সুন্নাহতে পাওয়া যায়? উম্মতে মুহাম্মদীয়ার বিগত চৌদ্দশত বছরের ইসলামের অথেনটিক সাহিত্য সমূহ এ সম্পর্কে আদৌ কি কিছু বলেছে?

উল্লেখ্য, পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট শিক্ষা হচ্ছে, আল্লাহকে ভালোবাসতে হলে তাঁর রাসূলের পূর্ণ অনুসরণ করতে হবে। আর তাঁর রাসূলের পূর্ণ অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে বান্দার প্রতি আল্লাহর ভালোবাসা এবং Forgive বা ক্ষমা। (সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ৩১)।

Say: “If you love Allah, then follow me and Allah will love you and forgive your sins.” (Surah Al `Imran: 31)

প্রাসঙ্গিক আলোচনা :-

পবিত্র কুরআনের সূরা জুম’আ আয়াত নং ২ এবং ৩ এর শিক্ষা মতে,

  • ہُوَ الَّذِیۡ بَعَثَ فِی الۡاُمِّیّٖنَ رَسُوۡلًا مِّنۡہُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتِہٖ وَ یُزَکِّیۡہِمۡ وَ یُعَلِّمُہُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ ٭ وَ اِنۡ کَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ لَفِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ

অর্থ- তিনিই নিরক্ষরদের[১] মধ্যে তাদের একজনকে পাঠিয়েছেন রসূলরূপে, যে তাদের নিকট আবৃত্তি করে তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করে এবং শিক্ষা দেয় গ্রন্থ ও প্রজ্ঞা, যদিও ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে।

  • শাব্দিক অনুবাদ– ہُوَ তিনি সেই সত্তা الَّذِیۡ যিনি بَعَثَ প্রেরণ করেছেন فِی মধ্যে/মাঝে الۡاُمِّیّٖنَ নিরক্ষরদের/উম্মীদের رَسُوۡلًا একজনকে রাসূল হিসেবে مِّنۡہُمۡ তাদেরই মধ্য থেকে।……… وَّ এবং তিনি প্রেরণ করেছেন اٰخَرِیۡنَ অন্যান্যদের (অনারবদের) মধ্যেও مِنۡہُمۡ তাদের لَمَّا یَلۡحَقُوۡا যারা এখনো মিলিত হয়নি بِہِمۡ ؕ তাদের (আরবের ঐ উম্মী সাহাবীদের) সাথে وَ আর ہُوَ তিনি (আল্লাহ) الۡعَزِیۡزُ পরাক্রমশালী الۡحَکِیۡمُ প্রজ্ঞাময়।

টিকাঃ [১] أُمِّيِّيْنَ (নিরক্ষর) থেকে এমন আরবদেরকে বুঝানো হয়েছে, যাদের অধিকাংশ লেখাপড়া জানত না। এদেরকে বিশেষ করে উল্লেখ করার অর্থ এই নয় যে, রসূল (সা.)-এর রিসালাত অন্যদের জন্য ছিল না। কিন্তু সর্বপ্রথম যেহেতু সম্বোধন তাদেরকেই করা হয়েছে, তাই তাদের উপর ছিল আল্লাহর বেশী অনুগ্রহ।

  • وَّ اٰخَرِیۡنَ مِنۡہُمۡ لَمَّا یَلۡحَقُوۡا بِہِمۡ ؕ وَ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ

অর্থ- আর তাদের অন্যান্যদের[২] মধ্যেও (রসূল পাঠিয়েছেন), যারা এখনো তাদের সাথে মিলিত হয়নি। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

টিকাঃ [২] আয়াতে اٰخَرِیۡنَ এর আ’তফ বা সংযোগ হল أُمِّيِّيْنَ এর সাথে এবং উভয়ই যের অবস্থায় বিদ্যমান (ফাতহুল বারী, ইবনু হাজার আসকালানী)। অর্থাৎ, بَعَثَ فِي آخَرِيْنَ مِنْهُمْ আর آخَرِيْنَ বলতে পারসীক এবং অন্যান্য অনারব লোক, যারা কিয়ামত পর্যন্ত রসূল (সা.)-এর উপর ঈমান আনয়ন করবে। কেউ কেউ বলেন, আরব ও অনারবদের সেই সমস্ত লোক, যারা সাহাবাদের যামানার পর কিয়ামত পর্যন্ত আসতে থাকবে। এতে পারস্য, রোম, তুর্কিস্তান, মোগল, কুর্দিস্তান এবং চিন ও ভারত ইত্যাদি দেশের সমস্ত বাসিন্দা (বিশ্ববাসী)রা অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ, রসূল (সা.)-এর নবুওয়ত সবার জন্য। তাই এরা সবাই তাঁর উপর ঈমান আনতে থাকবে। আর ইসলাম গ্রহণ করার পর এরা সবাই مِنْهُمْ (তাদের অন্যান্য) এর দলে শামিল হয়ে যাবে। অর্থাৎ, প্রথম প্রথম ইসলাম গ্রহণকারীরা أُمِّيِّيْن এর অন্তর্ভুক্ত। কেননা, সমস্ত মুসলমান হল একই উম্মত। এই (তাদের) সর্বনামের কারণে কেউ কেউ বলেন, ‘অন্যান্য’ বলতে পরে আগমনকারী আরবদেরকে বুঝানো হয়েছে। কেননা, ‘তাদের’ সর্বনাম দ্বারা (আরব) ‘নিরক্ষরদের’ প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। (ফাতহুল ক্বাদীর, ইমাম আল্লামা শাওকানী রহঃ)।

ইমাম তাবারীও (রহ.) তাফসীরে তাবারী গ্রন্থে লিখেছেন যে,

يقول تعالى ذكره: وهو الذي بعث في الأميين رسولا منهم، وفي آخرين منهم لما يلحقوا بهم، فآخرون في موضع خفض عطفًا على الأميين.

অর্থাৎ আল্লাহ তালার বাণী : ‘তিনি সেই সত্তা যিনি উম্মীদের জন্য তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং তাদের অন্যান্যদের জন্যও যারা তাদের সাথে এখনো মিলিত হয়নি’, অতএব آخرين এটি الاميين এর উপর আ’তফ বা সংযোগ হয়ে যের এর স্থলে রয়েছে। (তাফসীরে তাবারী সূরা জুম’আ)।

কিন্তু আহমদী তথা কাদিয়ানীদের এখানে মারাত্মক পর্যায়ের ভ্রান্তিটা হচ্ছে তারা آخَرِيْنَ শব্দকে أُمِّيِّيْنَ এর উপর আ’তফ বা সংযোগ মানেনা। তারা آخرين শব্দকে মাফউল বা কর্ম ধরেই একটি মনগড়া কনসেপ্ট দাঁড় করার চেষ্টা করে থাকে। আর সেই কনসেপ্টটা হচ্ছে, আয়াতটিতে আল্লাহ নাকি و آخَرِيْنَ ‘অন্যান্যদের’ বলে মুহাম্মদ (সা.)-কে বুরুজি রঙে দ্বিতীয়বার পৃথিবীতে প্রেরণ করার সংবাদ দিয়েছেন! নাউযুবিল্লাহ। অথচ آخَرِيْنَ শব্দটি যের এর অবস্থায় রয়েছে এবং সেটি أُمِّيِّيْنَ এর উপর আ’তফ বা সংযোগ। ফলে অর্থ দাঁড়ায় بَعَثَ فِي آخَرِيْنَ مِنْهُمْ তথা আল্লাহ তা’য়ালা উম্মীদের মধ্যে এবং সেই অন্যান্য (অনারব লোক)দের মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছেন, যারা কিয়ামত পর্যন্ত রসূল (সা.)-এর উপর ঈমান আনয়ন করবে। لَمَّا یَلۡحَقُوۡا بِہِمۡ অর্থাৎ যারা এখনো উম্মীদের (আরবদের) সাথে মিলিত হয়নি। সহীহ বুখারী সহ বিভিন্ন বর্ণনায় আয়াতটির ব্যাখ্যায় এসেছে,

  • لو كان الإيمان عند الثريا لناله رجال او رجل من ه‍ؤلاء

অর্থাৎ যদি ঈমান সুরাইয়া নক্ষত্রপুঞ্জের নিকটে থাকত তাহলেও এঁদের (সালমান ফারসীর বংশের দিকে ইংগিত) এক বা কতেক পুরুষ তা অর্জন করত। (বুখারী ৪৮৯৭, সাহাবী আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে)।

সম্পূর্ণ হাদীসটি এইরূপ,

كُنَّا جُلُوسًا عِنْدَ النَّبيِّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم، فَأُنْزِلَتْ عليه سُورَةُ الجُمُعَةِ: {وَآخَرِينَ مِنْهُمْ لَمَّا يَلْحَقُوا بِهِمْ} [الجمعة: 3]، قالَ: قُلتُ: مَن هُمْ يا رَسولَ اللَّهِ؟ فَلَمْ يُرَاجِعْهُ حتَّى سَأَلَ ثَلَاثًا، وفينَا سَلْمَانُ الفَارِسِيُّ، وضَعَ رَسولُ اللَّهِ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم يَدَهُ علَى سَلْمَانَ، ثُمَّ قالَ: لو كانَ الإيمَانُ عِنْدَ الثُّرَيَّا، لَنَالَهُ رِجَالٌ -أوْ رَجُلٌ- مِن هَؤُلَاءِ.

অর্থাৎ আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা নবী করীম (সা.)-এর কাছে বসেছিলাম। এসময় তাঁর উপর সূরা জুম‘আ অবতীর্ণ হল, যার একটি আয়াত হল- ‘এবং তাদের অন্যান্যের জন্যও যারা এখনও তাদের সাথে মিলিত হয়নি’ (৬২/৩)। তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, তারা কারা? তিনবার জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও তিনি কোনো উত্তর দিলেন না। আমাদের মাঝে সালমান ফারেসী উপস্থিত ছিলেন। রাসূল (সা.) সালমানের উপর হাত রেখে বললেন, ঈমান সুরাইয়া নক্ষত্রপুঞ্জের নিকট থাকলেও এদের কতেক লোক বা কোনো এক ব্যক্তি তা অবশ্যই পেয়ে যেতো’ (বুখারী হা/৪৮৯৭)।

মুসলিমের বর্ণনায় রয়েছে, যদি দ্বীন সুরাইয়া নক্ষত্রপুঞ্জের কাছেও থাকত, তবুও পারস্যের একজন ব্যক্তি তা নিয়ে আসত বা পারস্যের সন্তানদের কেউ কেউ তা পেয়ে যেত’ (মুসলিম হা/২৫৪৬)। সহীহ ইবনু হিব্বান এর বর্ণনায় আরো স্পষ্টভাবে এসেছে যে, রাসূল (সা.) এ সময় সালমানের উরুতে হাত মেরে বললেন, এ ব্যক্তি ও তাঁর জাতি (সহীহ ইবনু হিব্বান হা/৭১২৩)।

হাদীসটির ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু কাসীর বলেন, অত্র হাদীস দলীল হল এ বিষয়ে যে, রাসূল (সা.) আরব-আ’জমের সকল মানুষের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন’। ত্বীবী বলেন, জাতি উল্লেখ করে সালমান ফারেসী (রা.)-কে বুঝানো হয়েছে। অথবা এর দ্বারা আরবের বিপরীতে অনারবদের বুঝানো হয়েছে (মিরক্বাত হা/৬২১২-এর ব্যাখ্যা)। যেমন বুখারী, মুসলিম সহ কুতুবে সিত্তাহর মুহাদ্দিসগণ সকলেই অনারব ছিলেন।

অন্যান্য বর্ণনায় এভাবেও এসেছে যে,

وَعَنْهُ قَالَ: كُنَّا عِنْدَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم إِذْ نَزَلَتْ عَلَيْهِ سُورَةُ الْجُمُعَةِ فَلَمَّا قَرَأَ {وَآخَرِينَ مِنْهُمْ لَمَّا يَلْحَقُواْ بِهِمْ} قَالَ رَجُلٌ: مَنْ هؤُلَاءِ الَّذِينَ لَمْ يَلْحَقُوا بِنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ فَلَمْ يُكَلَمْهُ حَتَّى سَأَلَهُ مَرَّتَيْنِ أَوْ ثَلَاثاً. قَالَ: وَفِينَا سَلْمَانُ الْفَارِسِيُّ، فَوَضَعَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَدَهُ عَلَى سَلْمَانَ وَقَالَ: لَوْ كَانَ الْإِيمَانُ عِنْدَ الثُّرَيَّا لَنَالَهُ رِجَالٌ مِنْ هؤُلَاءِ

অর্থাৎ আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা নবী করীম (সা.)-এর কাছে বসেছিলাম। এসময় তাঁর উপর সূরা জুম‘আ অবতীর্ণ হল, যার একটি আয়াত হল- ‘এবং তাদের অন্যান্যের জন্যও যারা এখনও তাদের সাথে মিলিত হয়নি’ (৬২/৩)। জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারা কারা যারা এখনও তাদের সাথে মিলিত হয়নি’? দু’-তিনবার জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও তিনি কোনো উত্তর দিলেন না। বর্ণনাকারী বললেন, আমাদের মাঝে সালমান ফারেসী উপস্থিত ছিলেন। রাসূল (সা.) সালমানের উপর হাত রেখে বললেন, যদি ঈমান সুরাইয়া নক্ষত্রপুঞ্জের নিকটেও থাকত তবু কিছু লোক তা অবশ্যই পেয়ে যেতো’ (মুসলিম, তিরমিজি)।

বুখারীর ব্যাখ্যাকারক ইমাম আ’ঈনী (রহ.) ‘উমদাতুল ক্বারী’ গ্রন্থে رجال من ه‍ؤلاء এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন,

(لَنَالَهُ رِجَالٌ مِنْ هَؤُلَاءِ”)؛ أي: الفرس بقرينة سلمان الفارسيّ، وقال الكرمانيّ: أي: الفرس؛ يعني: العجم، وفيه نَظَر لا يخفى، ثم إنهم اختلفوا في:{وَآخَرِينَ مِنْهُمْ} ، فقيل: هم التابعون، وقيل: هم العجم، وقيل: أبناؤهم، وقيل: كل من كان بعد الصحابة، وقال أبو روق: جميع من أسلم إلى يوم القيامة، وقال القرطبيّ: أحسن ما قيل فيهم: أنهم أبناء فارس، بدليل هذا الحديث:”لناله رجال من هؤلاء”، وقد ظهر ذلك بالعيان، فإنهم ظهر فيهم الدين، وكثر فيهم العلماء، وكان وجودهم كذلك دليلًا من أدلة صدقه صلى الله عليه وسلم، قاله في “العمدة”

অর্থাৎ “’এদের অনেক লোক এটি অর্জন করতো’ এ থেকে সালমান ফারসীর প্রতি ইংগিত থাকার কারণে পারস্যের অনেক লোককে বুঝানো উদ্দেশ্য। শারেহে বুখারী ইমাম কিরমানী (রহ.) এর মতে, পারস্য বলে অনারবদের বুঝানো হয়েছে। অত:পর ‘ওয়া আখারীনা মিনহুম’ এর তাৎপর্য নিয়ে মতভেদ হয়ে যায়। কেউ বলেছেন, এ থেকে তাবেয়ীগণ উদ্দেশ্য। কেউ বলেন, অনারবগণ উদ্দেশ্য। কেউ বলেছেন, পারস্যের সন্তানগণ উদ্দেশ্য। কেউ বলেন, সাহাবীদের পরবর্তী সবাই উদ্দেশ্য। আবু রাওক্ব বলেন, কেয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মুসলমান উদ্দেশ্য। ইমাম কুরতুবী বলেছেন, উত্তম মতটি হল, পারস্যের পুরুষগণ উদ্দেশ্য। হাদীসের দলীল ‘তাদের মধ্য হতে অনেক পুরুষ তা অর্জন করতো’ অনুসারে। বাস্তবতা তেমনই। নিশ্চয়ই তাদের মাধ্যমেই দ্বীনের প্রচারপ্রসার হয়েছে, বহু উলামায়ে কেরাম তাদের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছে। এ বাস্তবতাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর (ভবিষ্যৎবাণীকে) সত্য প্রমাণ করেছে।” (উমদাতুল ক্বারী)।

দীর্ঘ আলোচনা হতে স্পষ্টতই বুঝা গেল যে, এতে ভবিষ্যতে সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির আগমনের ভবিষ্যৎবাণী ইংগিতেও করা হয়নি, কথিত বুরুজি মুহাম্মদ এর আগমন হবার কনসেপ্ট তো বহুত দূর কি বাত। বড়জোর সুরাইয়া নক্ষত্রের নিকটে চলে যাওয়া ঈমান বা দ্বীন বা ইলম অর্জন করার কথা বলা হয়েছে। তাও এক বা একাধিক জনের জন্য। ফলে এটি সাহাবী সালমান ফারসী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র বংশের ফযিলত বর্ণনা করাই হল। নতুবা ইমাম সুয়ূতী (রহ.) সহ বহু যুগ বিখ্যাত ইমাম লিখে যেতেন না যে, সেই পুরুষদের মধ্যে অন্যতম ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)। বলাবাহুল্য যে, রাদ্দুল মুহতারে ইমাম ইবনুল আবেদীন শামী (রহ.), তাবয়িদুস সহীফা গ্রন্থের ’তাবশীরুন নবী’ অধ্যায়ে ইমাম সুয়ূতী (রহ) এবং খায়রাতুল হিসান গ্রন্থে ইমাম ইবনু হাজার আল হায়তামী (রহ.) প্রমুখ এ মর্মে বলে গেছেন যে, এ হাদীস দ্বারা ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর ব্যাপারে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে (রাদ্দুল মুহতার ১/৫৩)।

সে যাইহোক, হুবহু কথাটির ন্যায় কুরআনেও আল্লাহ বলেছেন,

  • لَوْ كَانَ فِيهِمَا آلِهَةٌ إِلَّا اللَّهُ لَفَسَدَتَا فَسُبْحَانَ اللَّهِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا يَصِفُونَ

অর্থাৎ যদি আসমান যমীনে আল্লাহ ব্যতীত বহু ইলাহ থাকত তাহলে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেত। সুতরাং তারা যা বলে আরশের রব তা থেকে পবিত্র। (সূরা আম্বিয়া আয়াত ২২)।

এখন এর মানে আসমান এবং যমীনে সত্যিকারের বহু ইলাহ বিদ্যমান থাকা জরুরি নয়। এটি কথার কথা। জ্ঞানীদের নিশ্চয়ই বুঝার বাকি থাকেনি যে, অনুরূপ সুরাইয়া নক্ষত্রের নিকটে ঈমান প্রকৃতপক্ষে চলেই যাবে, বিষয়টিও জরুরি নয়। বরং সেটিও সূরা আম্বিয়ার ২২ নং আয়াতের ‘যদি আসমান যমীনে বহু ইলাহ থাকত’ এরই ন্যায় কথার কথা মাত্র। আর এগুলো ভাষার অলংকার। যার বাস্তব প্রতিফলন জরুরি নয়। কিন্তু কাদিয়ানীরা তো আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে সূরা জুমার و آخرين منهم (ওয়া আখারীনা মিনহুম) এর অপব্যাখ্যা দিয়ে মুহাম্মদ (সা.) এর দ্বিতীয় আধ্যাত্মিক আগমন অর্থাৎ তথাকথিত বুরুজি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কনসেপ্ট দাঁড় করার চেষ্টায় মরিয়া। মূলত কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা মির্যা গোলাম আহমদ সুরা জুম’আ এর অত্র আয়াতের চরম অপব্যাখ্যা থেকেই নিজের সত্তাকে কথিত বুরুজি মুহাম্মদ বলে দাবী করার প্রয়াস পায়। যা ছিল সম্পূর্ণ উদ্ভট দাবী ও বাতিল দর্শন। সত্যের সাথে যার লেশমাত্র সম্পর্কও নেই। ফলে এ গোষ্ঠীটির পুরো বুরুজি কনসেপ্টটাই ভ্রান্ত ও ব্যাকরণ-বিরুদ্ধ। পবিত্র কুরআনে মারাত্মক বিকৃতি সাধন বৈ নয়।

আল্লাহ! তুমি প্রকৃত সত্যানুসন্ধানীকে সুবোধ দান কর।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক।
প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী

‘ছাহিবুশ শরীয়ত’ কী? মির্যা কাদিয়ানীর বই থেকে

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর রচিত “আরবা’ঈন” বইটি থেকে আজ আরেকটি উদ্ধৃতি এখানে কোড করছি,

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর জন্ম ভারতে। ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের গুরুদাস পুর জেলার ‘কাদিয়ান’ নামক গ্রামে ১৮৩৯ বা ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে। তখন পুরনো ভারত সহ গোটা উপমহাদেশ ছিল সাম্রাজ্যবাদ ব্রিটিশ সরকারের শাসনের অধীনে। মির্যা গোলাম কাদিয়ানী শুরুতেই নবুওয়তের দাবী করেনি। তবে তার প্রথমদিকের দাবীগুলোর ফাঁকে ফাঁকে ভবিষ্যতে তার নবুওয়ত দাবী করতে পারে এমন ইংগিত বেশ জোরেশোরে দেয়া হয়েছিল। তার অন্ধভক্ত কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের লোকেরা যখন শুনেন যে, মির্যা সাহেব মসীহ এবং ইমাম মাহদী, জিল্লি (ছায়া) নবী ইত্যাদি দাবী করেই বসে থাকেনি, বরং নিজেকে বুরুজি মুহাম্মদ, হুবহু মুহাম্মাদূর রাসূলুল্লাহ হবার-ও দাবী করেছিল। তখন বিশাল আকাশটা যেন তাদের মাথার উপর পড়লো, এমন অবস্থা তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে যায়। তারা বিশ্বাসই করতে চায় না যে, সে এধরণের কোনো কিছু দাবী করে লিখে যেতে পারে!

শুধু তাই না, মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজেকে প্রকৃতপক্ষে একজন নতুন শরীয়তবাহক রাসূল বলেও দাবী করে লিখে গেছেন। কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের লোকেরা একথাও বিশ্বাস করতে চায় না। তারা চোখ কপালে তুলে বলে, আরে না না; এসব মোল্লা মুন্সীদের মিথ্যাচার! মির্যা সাহেব কখনোই এমন দাবী করতে পারেন না। আজ তাই তাদেরই প্রকাশিত ও মির্যা সাহেবের রচিত ‘আরবা’ঈন’ গ্রন্থের বাংলায় অনূদিত কপি থেকে এখানে ছোট্ট একটা রেফারেন্স সহ উল্লেখ করতে চাচ্ছি। নিচে প্রামাণ্য স্ক্যানকপিও তুলে দিচ্ছি। যাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের কোনো অবকাশ না থাকে। আসুন, সর্বপ্রথম মির্যা কাদিয়ানী সাহেবের রচনা উর্দূ বইটি থেকেই উর্দূ অংশটি তুলে ধরা যাক,

মির্যা কাদিয়ানী সাহেব নিজকে শরীয়তবাহক রাসূল দাবী করে একদম সুস্পষ্টভাবে লিখেছেন,

ما سوا اس کے یہ بھی تو سمجھو کہ شریعت کیا چیز ہے جس نے اپنی وحی کے ذریعہ سے چند امر اور نہی بیان کیئے اور اپنی امت کے لیے ایک قانون مقرر کیا وہی صاحب الشریعت ہو گیا۔ پس اس تعریف کے رو سے بھی ہمارے مخالف ملزم ہیں کیونکہ میرے وحی میں امر بھی ہیں اور نہی بھی۔

  • উচ্চারণ – মা সেওয়া উস কে ইয়ে ভি তু সমঝো কে শরিয়ত কেয়া চিজ হে জিস নে আফনি ওহি কে জরি’য়া চে চন্দ আমর ওর নাহি বয়ান কিয়ে ওর আফনি উম্মত কে-লিয়ে এক কানুন মুকাররর কিয়া, অ-হি ছাহিবুশ শরিয়ত হো গিয়া। ফস ইস তারিফ কি রো চে ভি হামারে মুখালিফ মুলজিম হেঁ। কিঁউকে হামারে ওহি মে আমর ভি হেঁ ওর নাহি ভি।

অর্থাৎ এ ছাড়া এটিও তো চিন্তা কর শরীয়ত কী বিষয়? যিনি নিজের ওহীর মাধ্যমে কতক আদেশ ও নিষেধ গণনা করেন আর স্বীয় উম্মতের জন্য নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করেন তিনি শরীয়ত বাহকও হয়ে যান। সুতরাং এ সংজ্ঞার দৃষ্টিকোণ থেকেও আমাদের বিরোধীরা অভিযুক্ত, কেননা আমার ওহীতে আদেশ-নিষেধ উভয়ই আছে

তথ্যসূত্রঃ রূহানী খাযায়েন খন্ড ১৭ পৃষ্ঠা ৪৩৫; আরবা’ঈন পৃষ্ঠা নং ১০১ (বাংলা অনূদিত)।

প্রামাণ্য স্ক্যানকপি

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

মুহাম্মদ নূরুন্নবী এম এ