হযরত ঈসা ইবনু মরিয়ম (আ.) ছিলেন আল্লাহর একজন সম্মানিত নবী ও রাসূল। আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন স্বরূপ তিনি পিতা বিহীন জন্মগ্রহণ করেন। এ সম্পর্কে জানতে পবিত্র কুরআনের সূরা আলে ইমরান, আয়াত নম্বর ৪৭ পড়া যেতে পারে।
ঈসা ইবনু মরিয়ম ফিলিস্তিনের বেথেলহাম শহরে কুমারী মাতা বিবি মরিয়ম বিনতে ইমরানের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। আল্লাহতালা তাঁকে ৩৩ বছর বয়সসীমার মধ্যেই রূহুল কুদস জিবরাইল (আ.) এর মাধ্যমে উঠিয়ে নেন। সূরা নিসা, আয়াত নং ১৫৭ দ্রষ্টব্য। ইহুদীরা তাঁর বাড়ী ঘেরাও করে তাঁকে পাকড়াও করার যে পরিকল্পনা নিয়ে আসছিল, তাতে তারা ব্যর্থ হয়। আল্লাহ তাঁকে সে মুহূর্তে রূহুল কুদস জিবরাইল এর মাধ্যমে সাহায্য করেন (সূরা মায়েদা, আয়াত নম্বর ১১০, তাফসীরে জালালাইন-ইমাম সূয়ুতী রহ. দ্রষ্টব্য)। ইহুদীরা বহু চেষ্টা করে তাঁকে পাকড়াও করতে কিন্তু তারা তাঁর নাগাল পেতেও ব্যর্থ হয়, আল্লাহতালা তাঁকে তাদের ধরপাকড় থেকে নিবৃত রাখেন (সূরা মায়েদা, আয়াত ১১০)। পবিত্র কুরআনের বেশ কিছু আয়াতে আল্লাহতালা ইংগিতে সংবাদ দিয়েছেন যে, শেষ যামানায় তিনি তাঁকে পৃথিবীতে আবার পাঠাবেন। এ ধরনের ইংগিত পাওয়া যায় সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং ৪৬ এবং ৮১ এর মধ্যে। তাছাড়া সূরা যুখরূফ, আয়াত নম্বর ৬১ আমাদের ডেকে ডেকে বলছে, নিশ্চয়ই ঈসা মসীহ কেয়ামতের একটি নিদর্শন। আয়াতটির ব্যাখ্যায় হাদীসসমূহে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, আল্লাহতালা শেষ যামানায় ঈসা ইবনু মরিয়মকে পৃথিবীতে আবার পাঠাবেন, তিনি এসে শরীয়তে মুহাম্মদীয়ার আদলে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবেন এবং একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক ও ন্যায়নিষ্ঠ ইমামের ভূমিকায় থাকবেন। চল্লিশ-পয়তাল্লিশ বছরের মধ্যে তিনি ইন্তেকাল করবেন। ইমাম মাহদী এবং ঈসা ইবনু মরিয়ম দু’জন একই সময় হবেন।
হযরত ঈসা ইবনু মরিয়ম (আ.) শেষ যামানায় আবার ফিরে আসবেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণী-
হাদীস : সহীহ বুখারী ৩৪৪৮- وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ لَيُوْشِكَنَّ أَنْ يَنْزِلَ فِيكُمْ ابْنُ مَرْيَمَ حَكَمًا عَدْلًا فَيَكْسِرَ الصَّلِيْبَ وَيَقْتُلَ الْخِنْزِيْرَ وَيَضَعَ الْجِزْيَةَ وَيَفِيْضَ الْمَالُ حَتَّى لَا يَقْبَلَهُ أَحَدٌ حَتَّى تَكُوْنَ السَّجْدَةُ الْوَاحِدَةُ خَيْرًا مِّنْ الدُّنْيَا وَمَا فِيْهَا ثُمَّ يَقُوْلُ أَبُوْ هُرَيْرَةَ وَاقْرَءُوْآ إِنْ شِئْتُمْ وَإِنْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ إِلَّا لَيُؤْمِنَنَّ بِهٰ قَبْلَ مَوْتِهٰ وَيَوْمَ الْقِيٰمَةِ يَكُوْنُ عَلَيْهِمْ شَهِيْدًا (النساء :159)
অর্থ- আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, শপথ সেই সত্তার, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, শীঘ্রই তোমাদের মধ্যে মরিয়মের পুত্র ‘ঈসা (আঃ) শাসক ও ন্যায় বিচারক হিসেবে আগমন করবেন। তিনি ‘ক্রুশ’ ভেঙ্গে ফেলবেন, শূকর হত্যা করবেন এবং তিনি জিজিয়া উঠিয়ে দেবেন। তখন সম্পদের ঢেউ বয়ে চলবে। এমনকি কেউ তা গ্রহণ করতে চাইবে না। তখন আল্লাহকে একটি সিজ্দা করা তামাম দুনিয়া এবং তার মধ্যকার সমস্ত সম্পদ হতে অধিক মূল্যবান বলে গণ্য হবে। অতঃপর আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) বলেন, তোমরা ইচ্ছা করলে এর সমর্থনে এ আয়াতটি পড়তে পারঃ ‘‘কিতাবীদের মধ্যে প্রত্যেকে তাঁর (ঈসা (আঃ)-এর) মৃত্যুর পূর্বে তাঁকে বিশ্বাস করবেই এবং কিয়ামতের দিন তিনি তাদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিবেন।’’ (আন-নিসাঃ ১৫৯) – বুখারী ৩৪৪৮।
হযরত ঈসা (আ.) দ্বিতীয়বার ফিরে আসা সম্পর্কে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার একটি বর্ণনা নিম্নরূপ,
সনদ সহ সম্পূর্ণ বর্ণনাটি : “الرَّبِيعُ بْنُ صُبَيْحٍ ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ سِيرِينَ ، عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ : لا تَقُولُوا : لا نَبِيَّ بَعْدَ مُحَمَّدٍ ، وَقُولُوا : خَاتَمُ النَّبِيِّينَ ، فَإِنَّهُ يَنْزِلُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ حَكَمًا عَدْلا وَإِمَامًا مُقْسِطًا ، فَيَقْتُلُ الدَّجَّالَ ، وَيَكْسِرُ الصَّلِيبَ ، وَيَقْتُلُ الْخِنْزِيرَ ، وَيَضَعُ الْجِزْيَةَ ، وَتَضَعُ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا“. (519، تفسير يحيى بن سلام، سُورَةُ الأَحْزَابِ، تَفْسِيرُ سُورَةِ الأَحْزَابِ)
অর্থাৎ…. তোমরা বলোনা মুহাম্মদ (সা.) এর পর কোনো নবী নেই, (তবে) তোমরা বলবে ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’। কেননা নিশ্চয়ই মরিয়ম পুত্র ঈসা (অচিরেই) একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক এবং ন্যায়নিষ্ঠ ইমাম রূপে নাযিল হবেন, তিনি দাজ্জালকে কতল করবেন, ক্রুস ভেঙ্গে ফেলবেন, শুয়োর হত্যা করবেন, রাষ্ট্রীয় ট্যাক্স (জিজিয়া) উঠিয়ে দেবেন, তখন যুদ্ধ আপনা সমস্ত সরঞ্জামাদি গুটিয়ে নেবে। – (তাফসীরে ইয়াহইয়া ইবনু সাল্লাম ৫১৯, সূরা আহযাব ৪০)।
অপ্রিয় হলেও সত্য কথা যে, কাদিয়ানীরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের এ সুস্পষ্ট বাণীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে! নির্বোধরা জানেনা যে, ভারতের চেরাগ বিবির পুত্র মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী আগত সেই “মসীহ” দাবীতে জঘন্য একজন মিথ্যাবাদী। তার ব্রেইন ওয়াশ অনুসারীরা হয়ত ভুলে গেছে যে, মুহাম্মদী বেগম সম্পর্কে আল্লাহ’র নাম ভেঙ্গে তার একের পর এক প্রকাশিত তথাকথিত ওহী ইলহাম যেভাবে মিথ্যা প্রমাণিত হল, তার ব্যক্তিত্ব মরে যাওয়ার জন্য আদতে সেসব ঘটনা-ই যথেষ্ট বলা চলে।
আমরা জানি যে, হযরত আবূ হুরাইরাহ (রা.) সহ সকল সাহাবী এবং উম্মতে মুহাম্মদীয়ার সকল সদস্য অকপটে বিশ্বাস করতেন যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) যে মসীহ তথা মরিয়ম পুত্র ঈসা (আ.) এর আগমনী সংবাদ দিয়েছেন তিনি অবশ্যই শেষ যামানায় যথাসময় ফিরে আসবেন, তাঁর অনুসারী খ্রিস্টান দুনিয়া সে সময়টিতে তাঁর প্রতি ঈমান এনে মুসলিম উম্মাহার দলভুক্ত হয়ে যাবেন। হযরত আবূ হুরাইরাহ (রা.) সূরা নিসা, আয়াত নম্বর ১৫৯ তিলাওয়াত করে পরিষ্কার ঘোষণা দিয়ে গেছেন যে, এ আয়াত আগত ঈসা ইবনু মরিয়ম (আ.) শেষ যামানায় ফিরে আসবেন, এ বিশ্বাসের পক্ষে অকাট্য মজবুত দলিল। ফলে ঈসা ইবনু মরিয়ম (আ.) এর মৃত্যু হয়ে গেছে বলা কিংবা এ ধরনের মতের সমর্থন পবিত্র কুরআনে থাকার দাবী করা নিতান্তই অন্যায় ও সত্য পরিত্যাগের শামিল। এমনকি তাদের ঐ ধরণের দাবী পবিত্র কুরআনকে স্ববিরোধিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করার নামান্তর।
- শায়খ ইবনু তাইমিয়াহ (রহ.) হযরত ঈসা ইবনু মরিয়ম (আ.)-কে আকাশে উঠিয়ে নেয়া বিষয়ে মুসলিম উম্মাহার ইজমা বা সর্বসম্মত মত উল্লেখ করে লিখে গেছেন,
وإجمعت الامة على ان الله رفع عيسى الى السماء
অর্থাৎ উম্মতে মুহাম্মদিয়া এ কথার উপর ইজমা বা একমত হয়েছেন যে, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা ঈসা আলাইহিস সাল্লামকে আকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন। (বয়ানু তালবীসিল জাহমিয়্যাহ ২/৪১৯, রচিতা শায়খ ইবনু তাইমিয়াহ রহঃ)।
যাইহোক, সাধারণ কাদিয়ানীদের মনে প্রশ্ন জাগা দরকার যে, আগত যে মসীহ সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সংবাদ দিয়েছেন তা হতে কোনো “রূপক মসীহ” কিভাবে উদ্দেশ্য হতে পারে? আল্লাহর রাসূল (সা.) শপথ বাক্য দ্বারা যে মসীহ এর ভবিষ্যৎবাণী দিবেন তা হতে যদি “রূপক মসীহ” উদ্দেশ্য হত তাহলে এ ধরনের ভবিষ্যৎবাণীর ক্ষেত্রে শপথ করে কী লাভ হল?
সব চে মজার ব্যাপার হচ্ছে, আগত মসীহ হতে “রূপক” উদ্দেশ্য হলে আল্লাহর রাসূল (সা.) শুধুই “মসীহ” শব্দ বলতেন, তিনি কোনোভাবেই “মরিয়ম পুত্র” বলতেন না। তাছাড়া সাহাবায়ে কেরামগণ-ও আগত মসীহ হতে “রূপক মসীহ” ই বুঝতেন। কিন্তু হয়েছে তার উল্টো। সমস্ত সাহাবী আগত মসীহ হতে “ইবনু মরিয়ম” ই বুঝেছিলেন এবং তাঁরা সেই বুঝ এর সমর্থনে কুরআন থেকে সূরা নিসা আয়াত নম্বর ১৫৯কে উদ্ধৃত করেছেন, সুবহানাল্লাহ।
শেষকথা হল, যাদের নিকট আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং সাহাবায়ে কেরামগণের শিক্ষাই একমাত্র শিক্ষা হিসেবেই চূড়ান্ত, তারা কখনো চাঁদাখোর ধোকাবাজ কাদিয়ানী মুরুব্বিদের কথায় কান দেবেনা। মুসলিম উম্মাহার সর্বসম্মত আকীদাই তাদের আকীদা হিসেবে গ্রাহ্য হবে। আল্লাহ আমাদেরকে নিরপেক্ষ ভাবে বিষয়টিকে বুঝার তাওফিক দিন।
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক