লিখেছেন, প্রখ্যাত গবেষক শায়খ আবু সালমান (হাফি.)
সুদীর্ঘ প্রায় আড়াইশ’ বছর বৃটিশরা এই উপমহাদেশ শাসন করেছে। ইতিহাস সাক্ষী- ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য তারা অনেক মসজিদ-মাদরাসা গুড়িয়ে দিয়েছে। শহীদ করেছে শত শত আলেমে দ্বীনকে । তাদের পাশবিক নির্যাতনের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে মানবতা হয়ে পড়েছিল বিধ্বস্ত, বাকরুদ্ধ এবং চরম অসহায়। মুসলমানদের প্রতি সীমাহীন অত্যাচার ও অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে তারা এ অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান ও সাম্রাজ্যের ভিতকে দৃঢ় ও পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিল। ইতিহাসের পাতায় তাদের সে জুলুমের ইতিহাস ছড়িয়ে আছে।
তবে এ দীর্ঘ সময়ে তাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য প্রতিরোধ আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। কখনও তার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে ‘ফরায়েজী আন্দোলন’ নামে। যার নেতৃত্বে ছিলেন পূর্ববাংলার হাজী শরীয়াতুল্লাহ রহ.। কখনও তাদের বিরূদ্ধে সংগ্রাম করেছেন পশ্চিমবাংলার মাওলানা নেছার আলী ওরফে ‘তিতুমীর’ রহ.। যে তিতুমীরের ‘বাশের কেল্লা’-র কথা আমরা সকলেই জানি। এরূপ আরও অনেক সংগ্রামী সাধক এ পথে নিজের জীবনোৎসর্গ করেছেন। যাদের অবিরাম সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের কারণেই বৃটিশ বেনিয়ারা এ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল।
ইতিহাস সাক্ষী, এই ভূখন্ডে স্বাধীনতা লুট করার জন্য এবং মুসলমানদের প্রতিরোধ-আন্দোলনকে দমন করার জন্য ইংরেজরা মীর জাফর ও মীর সাদেকের ন্যায় অনেক বিশ্বাসঘাতককে ব্যবহার করেছে। যারা নিজ জাতি ও ধর্মের সাথে গাদ্দারী করে ইংরেজ বেনিয়াদের সহোযোগিতা করে। ফলে ভারতবর্ষে তাদের আগ্রাসন ও স্বেচ্ছাচারিতার শিকড় দৃঢ় ও মজবুত হয়ে যায়।
এতকিছুর পরও যখন তাদের বিরূদ্ধে ক্ষণেক্ষণে প্রতিরোধ আন্দোলন চলতেই থাকে, এবং ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের মাধ্যমে মুসলমানদের বুকের ভেতরের দীর্ঘদিনের ছাইচাপা আগুনের সম্মিলিত বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তখন তারা আন্দোলনের এ ধারা চিরতরে বন্ধ করার জন্য নতুন এক জঘন্য কৌশল বেছে নেয়। তারা ভেবে দেখল, ভারতবর্ষের মুসলমানেরা অত্যন্ত ধর্মভীরু। আল্লাহ ও রাসূলের কথার সামনে তারা সব কিছু বিলিয়ে দিতেও প্রস্তুত হয়ে যায়। তারা মানলে শুধু তাদের নবীর কথাই মানে। কারণ, নবীদের মুখের কথা সাধারণ কথা নয়। তা স্বয়ং খোদার তরফ থেকে আগত ওহী। আর ওহীর নির্দেশ পালন মুসলমানদের দৃষ্টিতে সর্বোচ্চ ফরজ বিধান। অতএব, যদি কাউকে ব্যবহার করে ওহীর দোহাই দিয়ে ইংরেজদের পক্ষে কথা বলানো যায় এবং মুসলমানদেরকে বৃটিশ শাসনের আনুগত্যের দীক্ষা দেওয়া যায়, তাহলে জনসাধারণের মনের বৃটিশবিদ্বেষ কিছুটা লঘু করা সম্ভব হতে পারে।
এ নীলনকশা বাস্তবায়নে তারা নির্বাচন করল পাঞ্জাব প্রদেশের গুরুদাশপুর জেলার কাদিয়ান নামক গ্রামের এক ব্যক্তিকে। যার নাম মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী। যে ইংরেজদের ছত্রছায়ায় তাদের হীন স্বার্থ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নবুওতের দাবি করে। অথচ হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই শেষনবী। তার পরে কোনো ব্যক্তি নবুওয়তের আসনে অধিষ্ঠিত হবে না। তার পরে যে কোন ধরনের নবুওতের দাবিদার নিঃসন্দেহে কাফের ও বেঈমান। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আর কোরআন-সুন্নাহর অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে সকল যুগের মুসলিম উম্মাহর আকীদা বিশ্বাস এটাই ।
মির্যা কাদিয়ানীর নবুওয়াত দাবী :
(নিচে উদ্ধৃত সকল রেফারেন্স মির্যা কাদিয়ানীর স্বহস্তে রচিত রচনাবলীর সমষ্টি ২৩ খন্ডে প্রকাশিত ‘রূহানী খাযায়েন‘ সহ তারই অপরাপর রচনা হতে উল্লেখ করা হবে)
মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী স্পষ্টভাষায় নবুওয়াতের দাবী করেছে। কখনও বলেছে,
- “আমার দাবী হলো আমি নবী ও রাসূল” –মালফুযাত-১০/১২৭ পুরাতন সংস্করণ, ৫/৪৪৭ নতুন সংস্করণ
তার স্বহস্তে লিখিত পুস্তিকা ‘দাফেউল বালা’ গ্রন্থে লিখেছে,
- “প্রকৃত সত্য খোদা তিনিই যিনি কাদিয়ানে তার রাসূল প্রেরণ করেছেন।” –দাফেউল বালা ১২, বাংলা অনুবাদ
অন্যত্র বলেছে,
- “আমি ঐ খোদার শপথ করে বলছি যার হাতে আমার জীবন তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন এবং তিনিই আমার নাম নবী রেখেছেন।” -(তাতিম্মা হাকিকাতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/৫০৩)
মির্যা কাদিয়ানীর এ জাতীয় আরও অনেক বক্তব্য আছে, যেখানে সে নিজেকে নবী আখ্যা দিয়েছে। তার দাবিদাওয়ার তালিকা অনেক লম্বা। শুরুতে মুজাদ্দিদ, মামূর মিনাল্লা, মুলহাম, পর্যায়ক্রমে যুগ ইমাম, ইমাম মাহদী ও ঈসা ইবনে মারইয়াম হওয়ার দাবি করেছে। অবশেষে নবুওয়তের দাবি করেছে।
বক্ষমান প্রবন্ধে এটি আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। আমরা এখানে আলোচনা করবো, কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতায় মির্যা কাদিয়ানী দাবিদাওয়া ও স্বতন্ত্র দল গঠনের পয়াস পেয়েছে। আর তাদের হীন স্বার্থ বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই সে আমৃত্যু সাধনা করে গেছে।
মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী তার গোটা জীবন অতিবাহিত করেছে বৃটিশ তোষামোদ, চাটুকারিতা ও গুণকীর্তন করে। তার স্ব-লিখিত এমন কোনো গ্রন্থ নেই যেখানে সে বৃটিশের গুণগান করেনি। সে নিজেই বলেছে,
- “এই সতের বছর ধরে আমি যে পরিমাণ গ্রন্থ রচনা করেছি, তার সবগুলোতেই বৃটিশ সরকারের আনুগত্যের প্রতি মুসলমানদেরকে উৎসাহিত করেছি।” –কিতাবুল বারিয়্যাহ, রূহানী খাযায়েন ১৩/৬-৭
বাস্তবে তা-ই ঘটেছে। সে তার প্রতিটি গ্রন্থেই মুসলমানদেরকে জালেম বৃটিশের আনুগত্যের প্রতি অনুপ্রাণিত করেছে। আমরা এখানে তার কয়েকটি মাত্র বক্তব্য তুলে ধরছি। পাঠকমাত্রই বুঝতে সক্ষম হবেন যে, আসলেই সে ও তার সম্প্রদায় বৃটিশ কর্তৃক সৃষ্ট, তাদের মদদপুষ্ট এবং তাদের উচ্ছিষ্টভোগী।
বৃটিশ আনুগত্যের আহবান
যুগে যুগে যখনই নবীগণ এসেছেন সমকালীন অত্যাচারী শক্তির মোকাবেলা করেছেন। তারা তাগুতের সামনে কখনো মাথা নত করেননি। বাতিলের সামনে হকের কালিমা বলতে বিন্দুমাত্র ভয় পাননি ও বিচলিত হননি। তারা ভয় পেতেন একমাত্র আল্লাহকে। কোনো জালিমশাহীর তোষামোদ ও চাটুকারিতাও তারা করেননি। হযরত মূসা আ. এর সময়কালে বাতিল আত্মপ্রকাশ করেছে খোদাদ্রোহী ফেরাউনের রূপ নিয়ে। ফেরাউনের মুখের উপর আল্লাহর হুকুম শুনাতে মূসা আ. বিন্দুমাত্র ভয় পাননি। হযরত ইবরাহীম আ. এর যামানায় কুফুরী শক্তি ছিল নমরূদ। ইবরাহীম আ. কখনও নমরূদের কোন পরোয়া করেননি।
ভারতবর্ষে বৃটিশ বেনিয়াদের স্বেচ্ছাচার এবং মুসলমানদের উপর তাদের অবর্ণনীয় নির্যাতন ও নিপীড়নের ইতিহাস বলে শেষ করা যাবে না। নবুওয়তের মিথ্যা দাবিদার মির্যা কাদিয়ানী মুসলমানদের চির শত্রæ বৃটিশ বেনিয়াদের চাটুকারিতা ও তোষামোদের জন্য যে ভাষা-শব্দ ব্যবহার করেছে তা যে কোনো ভদ্র ও আত্মমর্যাদার অধিকারী ব্যক্তির মনেই ঘৃনার উদ্রেক করবে।
মির্যা কাদিয়ানী তার অনুসারীদেরকে সাম্রাজজ্যবাদী বৃটিশ সরকারের আনুগত্যের দীক্ষা দিতে গিয়ে বলছে-
- “আমি (আমার অনুসারীদেরকে) অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উপদেশ দিচ্ছি যে, তারা যেন আমার সেই নসীহত ভালোভাবে মনে রাখে, যা প্রায় ২৬ বছর যাবত আমি বক্তৃতা ও লেখনীর মাধ্যমে তাদের অন্তরে বদ্ধমূল করে আসছি। তা হল- তারা পরিপূর্ণরূপে এই ইংরেজ সরকারের আনুগত্য করবে। কেননা তারা আমাদের কল্যাণকামী সরকার। তাদের সাহায্য-ছায়ায় থেকেই আমাদের জামাতে আহমাদিয়া (কাদিয়ানী সম্প্রদায়) মাত্র কয়েক বছরে কয়েক লাখে পৌছে গেছে।” –মাজমুয়ায়ে ইশতেহারাত ২/৭০৮, নতুন সংস্করণ
বৃটিশ সরকারের উপর মির্যা কাদিয়ানীর অবদান:
- “আমার জীবনের সিংহভাগ সময় কেটেছে এই ইংরেজ সরকারের সাহায্য ও তাদের সমর্থন কুড়িয়ে। আমি জিহাদের বিরুদ্ধে ও ইংরেজ সরকারের আনুগত্যের বিষয়ে এত বিপুল গ্রন্থ রচনা করেছি এবং প্রচারপত্র বিতরণ করেছি, যে গ্রন্থ ও প্রচারপত্রগুলো যদি এক স্থানে একত্রিত করা হয় তাহলে তা দ্বারা ৫০ টি আলমারি ভরে যাবে। আর এগুলো আমি সকল আরবদেশে; মিশর, সিরিয়া ও কাবুলে, এবং রোমদেশ পর্যন্ত পৌছে দিয়েছি। সর্বদাই আমার চেষ্টা ছিল যেন মুসলমানেরা এই বৃটিশ সরকারের হিতাকাঙ্খী হয়ে যায়। -তিরয়াকুল কুলুব, রূহানী খাযায়েন-১৫/১৫৫-১৫৬
বৃটিশদের প্রতি আনুগত্য বায়আতের অন্যতম শর্ত:
মির্যা কাদিয়ানীর হাতে কেউ বায়আত হতে চাইলে তার জন্য এই শর্ত জুড়ে দিতো যে, বৃটিশদের প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য করতে হবে। মির্যা কাদিয়ানী লিখেছে,
- “আমি একজন শান্তিপরায়ণ মানুষ। (বৃটিশ) সরকারের আনুগত্য ও আল্লাহর বান্দার প্রতি সহানুভূতি-ই হল আমার নীতি। আর এটা এমনই এক নীতি যা আমার মুরীদদের বায়আতের জন্য পূর্বশর্ত।” –কিতাবুল বারিয়্যাহ, রূহানী খাযায়েন-১৩/১০
বৃটিশ-আনুগত্য মুসলমানদের জন্য ফরজ:
মির্যা কাদিয়ানীর আকীদামতে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ বেনীয়াদের আনুগত্য করা দেশের প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ। মির্যা কাদিয়ানী লিখেছে,
- “আমি এখানে মুসলমানদেরকে নসীহত করছি। তাদের উপর ফরজ, তারা যেন আন্তরিকভাবে (বৃটিশ) সরকারের আনুগত্য করে।” –লেকচার লুধিয়ানা, রূহানী খাযায়েন-২০/২৭২-
বৃটিশদের অবাধ্যতা পাপ:
মির্যা কাদিয়ানীর দাবি, যেহেতু মুসলমানদের জন্য বৃটিশদের আনুগত্য করা ফরজ তাই তাদের অবাধ্যতা গোনাহের কারণ। মুসলমানদের জন্য এই ফরজ অলঙ্ঘনীয়। মির্যা লিখেছে,
- “মুসলমানদের জন্য ফরজ হলো তারা যেন এই বৃটিশ সরকারের একনিষ্ঠ হিতাকাঙ্খী হয়ে যায় এবং তাদের জন্য নিজের জীবনোৎসর্গকারী হয়ে যায়। আর এই ফরজ ত্যাগ করলে তারা গোনাহগার হবে।” –মাজমুয়ায়ে ইশতেহারাত- ২/৩৫৫
ইসলামের দু’টি অংশ:
মির্যা কাদিয়ানী বলেছে, ইসলামের অংশ দুটি। আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য ও বৃটিশদের আনুগত্য। লিখেছে,
- “বারবার আমি আমার যে নীতি প্রকাশ করেছি তা হলো, ইসলামের দু’টি অংশ। এক. আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য করা। দুই. যে সরকার (সমাজে) নিরাপত্তা ও শান্তি স্থাপন করেছে (!!) এবং জালেমদের কবল থেকে রক্ষা করে আমাদেরকে নিজেদের আশ্রয়ে নিয়েছে সে সরকারের আনুগত্য করা। আর তারা হলো বৃটিশ সরকার।” –শাহাদাতুল কুরআন, রূহানী খাযায়েন -৬/৩৮০
বৃটিশ সরকার খোদার রহমত!
বৃটিশ শাসনামলে উপমহাদেশে ইসলাম ও মুসলমানদের যে ক্ষতি হয়েছে তা কারো অজানা নয়। তারা জুলুম অত্যাচারের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা লুন্ঠন করেছে। মসজিদ-মাদরাসা গুড়িয়ে দিয়েছে। মুসলমানদের সন্তানদের ধর্মীয় চেতনা ও মূল্যবোধ নষ্ট করার হীনচেষ্টা করেছে। তাদের ছত্রছায়াতেই পুরো ভারতবর্ষজুড়ে খৃষ্টানমিশনারী ও পাদ্রীদের অপতৎপরতা শুরু হয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এ ভূখণ্ডে তাদের আধিপত্য ছিল মুসলমানদের জন্য আল্লাহর আযাবস্বরূপ। ভারতবর্ষের সবাই জানতো, বৃটিশরা আল্লাহর দুশমন। আল্লাহর রাসূলের দুশমন। ইসলাম ও মুসলমানদের দুশমন। তারা কখনও মুসলমানদের বন্ধু ও কল্যাণকামী হতে পারে না। অপরদিকে মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর বক্তব্য হল, উপমহাদেশে বৃটিশ শাসন মূলত খোদার রহমত, নেয়ামত ও তার পক্ষ থেকে বরকতস্বরূপ। লক্ষ করুন,
- “ইংরেজ সরকার খোদার অসংখ্য নেয়ামতরাজির মধ্যে অন্যতম নেয়ামত। আর মহামর্যাদাপূর্ণ এক রহমত। আর এ সরকার মুসলমানদের জন্য আসমানী বরতকতূল্য।” –শাহাদাতুল কুরআন, রূহানী খাযায়েন ৬/৩৮৮-৩৮৯
- “প্রকৃতপক্ষে বৃটিশ সরকারের অস্তিত্ব খোদার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য এক নেয়ামত ছিল। যা আমরা পেয়েছি দীর্ঘদিনের প্রতিক্ষার পরে। তাই এই নেয়ামতের বারবার আলোচনা করা আমাদের কর্তব্য।” –মাজমু’আয়ে ইশতেহারাত ২/১৯১
বৃটিশ সরকারের ঢাল:
বৃটিশ সরকারকে সে নিজেদের জন্য ঢাল আখ্যা দিয়েছে। যেমনিভাবে ঢাল মানুষকে আপতিত হামলা থেকে রক্ষা করে তেমনি তারাও কাদিয়ানীকে সব ধরণের দুর্যোগ থেকে রক্ষা করবে- এই বিশ্বাস নিয়েই কাদিয়ানী বলেছে,
- “সুতরাং ইংরেজ সরকার তোমাদের জন্য (আল্লাহর) রহমতস্বরূপ। তোমাদের জন্য তা এক বরকত। এবং তা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তোমাদের সুরক্ষার জন্য একটি ঢাল। (যা তোমাদের উপর নিপতিত হামলা থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করবে- সংকলক)। সুতরাং তোমরা মনে প্রাণে এই ঢালের কদর করো।” –মাজমু’আয়ে ইশতেহারাত- ২/৭০৯
- “মহান রাব্বুল আলামীন ইংরেজ সরকারকে তোমাদের কল্যাণে রহমতের বারিধারার ন্যায় প্রেরণ করেছেন।” –শাহাদাতুল কুরআন, রূহানী খাযায়েন ৬/৩৮৯)
মির্যা কাদিয়ানীর আলোচিত বক্তব্যগুলোর কোনো ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। স্পষ্টভাষায় সে বৃটিশ সরকারকে আল্লাহর রহমত, নেয়ামত এবং বরকত আখ্যা দিয়েছে। আর কোন নেয়ামত লাভ করার পরে তার শুকরিয়া জানানোও তো কর্তব্য! তাই ঘোষনা করলো- এই ‘নেয়ামত’-এর শুকরিয়া আদায় করা আবশ্যক।
বৃটিশ সরকারের শুকরিয়া:
- “উপমহাদেশের সকল মুসলমানের জন্য অত্যাবশ্যক হলো- তারা যেন মহান ইংরেজ জাতির শাসনকে খোদার নেয়ামত মনে করে। আর যেমনিভাবে তারা অন্য নেয়ামতরাজির শুকরিয়া আদায় করে, তেমনি (বৃটিশ শাসনের) এই নেয়ামতেরও যেন শুকরিয়া আদায় করে।” –বারাহীনে আহমাদিয়া, রূহানী খাযায়েন- ১/১৪০
বৃটিশদের অকৃতজ্ঞতা নিমকহারামী:
যারা নিজেদের জান বাজি রেখে স্বদেশ প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে বৃটিশ খেদাও আন্দোলন করেছে তাদেরকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। তাদের বীরত্ব উপমা হিসেবে ব্যবহার করে থাকি। অথচ তাদেরকে-ই মির্যা কাদিয়ানী অকৃতজ্ঞ ও নিমকহারাম বলেছে। লিখেছে,
- “পাঞ্জাবের মুসলমানেরা খুবই অকৃতজ্ঞ প্রমাণিত হবে যদি তারা (ইংরেজদের) এই শাসনকে আল্লাহ তায়ালার এক মহা নেয়ামত মনে না করে। বস্তুত তাদের জন্য এটি (খোদার) এক অসীম রহমত।” –বারাহীনে আহমাদিয়া, রূহানী খাযায়েন -১/১৪০
আরও বলেছে,
- “আল্লাহ তায়ালা রহমতের বারিধারার ন্যায় এই (ইংরেজ) সরকারকে আমাদের শান্তির জন্য প্রেরণ করেছেন। এরপরেও যদি আমরা এই নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় না করি তাহলে তা হবে মারাত্মক ধরণের নিমকহারামী। এই নেয়ামতের মহত্ব ও তাৎপর্য তো আমাদের শিরা-উপশিরায় ও মনেপ্রাণে অঙ্কিত হয়ে আছে।” –মাজমু’আয়ে ইশতেহারাত. ২/১৯১
বৃটিশ শাসনের জন্য মির্যার শুকরিয়া জ্ঞাপন!
নিজ দীক্ষা, হিতোপদেশ ও নীতি অনুসারে মির্যা কাদিয়ানী সারা জীবন ইংরেজ শাসনের এই ‘নেয়ামত’ এর ‘শুকরিয়া’ জ্ঞাপন করে গেছে নানাভাবে, নানা ভাষায়। তাদের শুকরিয়া আদায় করতে গিয়েই তাদের পক্ষে ও তাদের হিতাকাঙ্খী হয়ে গ্রন্থ রচনা করেছে। তার নিজের বক্তব্য অনুযায়ী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সেগুলো বিতরণ করেছে। এমনকি তৎকালীন বড় বড় মুসলিম দেশেও বৃটিশ আনুগত্যের প্রতি উৎসাহ দিয়ে গ্রন্থ পাঠিয়েছে। যাতে করে মুসলমানরা বৃটিশদেরকে নিজেদের বন্ধু ও কল্যাণকামী ভাবতে শিখে। যেমন,
- “আর যদিও আমি এই (সরকারের) শুকরিয়া আদায় করার জন্য উর্দূ, আরবী ও ফার্সী ভাষায় অনেক গ্রন্থ রচনা করেছি, যেগুলোতে আমি ভারতবর্ষের মুসলমানদের উপর মাননীয়া মহারাণীর অসংখ্য অনুগ্রহের কথা আলোচনা করেছি এবং তা বিভিন্ন মুসলিমদেশে পাঠিয়ে দিয়েছি। আর প্রত্যেক মুসলমানকে (বৃটিশ সরকারের প্রতি) খাঁটি আনুগত্য ও তাদের বশ্যতা স্বীকার করে নিতে অনুপ্রাণিত করেছি।” –তোহফায়ে কায়সারিয়া, রূহানী খাযায়েন ১২/২৫৫
- “আমার বয়স এখন প্রায় ষাট বছর। শুরুজীবন থেকে আজ পর্যন্ত বক্তৃতা ও লেখনীর মাধ্যমে আমি নিজেকে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে সর্বদা ব্যস্ত রেখেছি যে, কীভাবে মুসলমানদের অন্তরকে বৃটিশ সরকারের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা, তাদের প্রতি কল্যাণকামিতা ও সহমর্মিতার দিকে আকৃষ্ট করতে পারি ।” –মাজমু’আয়ে ইশতেহারাত ২/১৯০ উর্দূ রচনা
খোদার ইলহামে বৃটিশ প্রীতি!
বৃটিশদের তোষণ করতে গিয়ে মির্যা কাদিয়ানী এ মিথ্যারও অবতারণা করেছে, তাকে নাকি এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ইলহাম করা হয়েছে। তার বক্তব্যটি লক্ষ্য করুন.
- “সকল মুসলমানের মধ্যে আমিই হলাম ইংরেজ সরকারের প্রথম সারির হিতাকাঙ্খী। কেননা তিনটি বিষয়ের কারণে আমি তাদের কল্যাণকামিতার প্রতি উৎসাহিত হয়েছি। এক. আমার মরহুম পিতার প্রভাবে। (তিনিও ইংরেজদের একজন একনিষ্ঠ কল্যাণকামী ছিলেন।) দুই. আমার প্রতি এই সরকারের অনুগ্রহ-অনুকম্পা। তিন. আল্লাহ তায়ালার ইলহাম (প্রত্যাদেশ)।” (আল্লাহ তায়ালা ইলহামযোগে আমাকে ইংরেজ সরকারের হিতাকাঙ্খী হওয়ার ইঙ্গিত করেছেন।) –তিরইয়াকুল কুলূব, রূহানী খাযায়েন. ১৫/৪৯১
বৃটিশ সরকারের জন্য আন্তরিক দোয়া
মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী ইংরেজ সরকারের প্র্তি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের পর তাদের জন্য দোয়া করেছে এবং তাদের শত্রুদের পরাজয়ের দোয়া করেছে। লিখেছে,
- “আমরা এই সরকারের এমন এমন অনুগ্রহ দেখেছি যার কৃতজ্ঞতা আদায় করা অত সহজ নয়। তাই আমরা আমাদের মহামান্য সরকারকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, আমরা এই সরকারের প্রতি তেমনই আন্তরিক ও কল্যাণকামী, যেমন ছিলেন আমাদের পূর্বসূরীগণ। আমাদের পক্ষে দোয়া ছাড়া আর কিইবা করার আছে!! সুতরাং আমরা দোয়া করছি, আল্লাহ তায়ালা সব ধরণের ক্ষতি ও অনিষ্ট থেকে এই সরকারকে রক্ষা করুন। আর তার শত্রুদেরকে অপদস্থ ও পরাজিত করুন।” –শাহাদাতুল কুরআন, রূহানী খাযায়েন ৬/৩৮০
রাণী ভিক্টোরিয়া ও মির্যা কাদিয়ানী
যাদের হাত লক্ষ মুসলমানের পবিত্র রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল, যারা ভারতবর্ষের মুসলমানদের পশু ছাড়া অন্য কিছু গণ্য করতো না, সেই বৃটিশ সরকারের মহারাণী ভিক্টোরিয়া, যার নামে পুরান ঢাকার ঐ পার্কটির নামকরণ করা হয় যার গাছে গাছে ১৮৫৭ সালে অগণিত মুসলিম বিপ্লবীর লাশ ঝুলেছিল, সেই রাণীর উদ্দেশ্যে মির্যা কাদিয়ানী যেভাবে কৃতজ্ঞতা,অভিনন্দন,আন্তরিক ভালোবাসা আর আসমানী সাহায্যের প্রার্থনা করে করে মুখে ফেনা তুলেছিল, তা ঈমানদার মুসলমানের হৃদয়ে চরম ঘৃণা ও ধিক্কার সৃষ্টি না করে পারে না।
এ বিষয়ে তার বক্তব্যটি লক্ষ করুন,
- “ঐ খোদার শুকরিয়া যিনি আমাদেরকে আজকের এই মহাখুশীর দিনটি দেখার তৌফিক দিয়েছেন যে, আমরা আমাদের মহান সম্রাজ্ঞী, ইংল্যান্ড ও হিন্দুস্তানের (ভারতের) অধিপতি মহারাণীর শত বার্ষিকী জুবিলি দেখতে পেয়েছি। আজকের এই দিনটি পেয়ে আমাদের অন্তরে যে আনন্দস্রোত বয়ে যাচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। আমাদের কল্যাণকামী বরকতময় সম্রাজ্ঞীকে আমাদের পক্ষ থেকে আনন্দ ও কৃতজ্ঞতাপূর্ণ অভিনন্দন জানাচ্ছি। আল্লাহ সম্রাজ্ঞী মহারাণীকে সর্বদা সুখে শান্তিতে রাখুন। -তোহফায়ে কায়সারিয়া, রূহানী খাযায়েন-১২/২৫৪)
আরও লিখেছে,
- “ভারতবর্ষের অধিপতি হে মহান সম্রাজ্ঞী, আল্লাহ আপনাকে সৌভাগ্য ও আনন্দপূর্ণ দীর্ঘায়ূ দান করুন। আপনার শাসনামল কতই না বরকতময় যে, খোদার আসমানী সাহায্য আপনার মিশনকে শক্তিশালী করছে। প্রজাবর্গের প্রতি আপনার সহানুভূতিশীলতা ও সদিচ্ছার পথকে ফেরেশতাগণ সুগম করছে। আপনার সুবিচারের মেঘমালা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। যাতে গোটা সাম্রাজ্যকে ফুলে ফুলে সুশোভিত করে দেয়। নিকৃষ্ট সে যে আপনার শাসনামলের মুল্যায়ন করে না। আর অসভ্য সে, যে আপনার অনুগ্রহের প্রতি অকৃতজ্ঞ। আর জানা কথা যে, মনের টান শুধু মন দিয়েই অনুভব করা যায়। তাই আপনাকে যে আমি মন দিয়ে ভালবাসি এবং বিশেষভাবে আমার অন্তকরণে আপনার প্রতি রয়েছে যে অগাধ ভক্তি ও শ্রদ্ধা- সেকথা মুখ দিয়ে প্রকাশ করার প্রয়োজনবোধ করি না। আপনার জন্য আমাদের দিনরাতের দোয়া জলশ্রোতের ন্যায় অব্যাহত আছে। আমরা রাজনৈতিক চাপের কারণে আপনার অনুগত হইনি, বরং আপনার বিভিন্ন ধরণের গুণ-বৈশিষ্ট আমাদের অন্তরকে আপনার প্রতি আকর্ষিত করেছে। ভারতবর্ষের অধিপতি হে বরকতময় (?)সম্রাজ্ঞী, আপনার এই সম্মান ও সুখ্যাতি সুদীর্ঘ হোক। খোদার দৃষ্টি ঐ রাজ্যের উপর রয়েছে যার উপর আপনার দৃষ্টি আছে। আর খোদার রহমতের হাত সে প্রজাবর্গের উপর আছে যাদের উপর আপনার হাত রয়েছে। -সিতারায়ে কায়সারিয়া, রূহানী খাযায়েন ১৫/১১৯-১২০)
আরও লিখেছে,
- “আমি আমার সকল সাথীবর্গ নিয়ে দু’হাত তুলে দোয়া করছি- হে আল্লাহ, ভারতবর্ষের এই বরকতময় সম্রাজ্ঞীকে আমাদের মাঝে দীর্ঘদিন নিরাপদের রাখো। আর তার প্রতিটি পদক্ষেপে তোমার সাহায্যছায়া দান করো।” –সিতারায়ে ক্বায়সারিয়া, রূহানী খাযায়েন. ১৫/১১৪
“রহমতের ছায়া”!
মির্যা কাদিয়ানী বৃটিশ সরকারের সহায়তা ও তাদের সহযোগিতাকে রহমতের ছায়া আখ্যায়িত করেছে। এবং এই কারণে নিজের উপর তাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা ওয়াজিব মনে করছে। তবে তার নিম্নোক্ত বক্তব্যে এ কথার সুস্পষ্ট স্বীকারোক্তি বিদ্যমান যে, এই বৃটিশ সরকার ব্যতীত অন্য কোন সরকারের অধীনে মির্যা তার মিশন (??) কখনও বাস্তবায়ন করতে পারতো না। সহজভাষায় বলতে গেলে, বৃটিশের পৃষ্ঠপোষকাতায়-ই মির্যা তার মিশনকে অগ্রসর করার প্রয়াস পেয়েছে। মির্যার বক্তব্য লক্ষ্য করুন,
- “আমি ঐ আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি যিনি আমাদেরকে এমন এক সরকারের রহমতের ছায়াতলে (!!!) আশ্রয় দিয়েছেন, যার আশ্রয়ে থেকে আমি স্বাধীনভাবে নিজের ওয়াজ-নসীহতের কাজ আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছি। যদিও এই অনুগ্রশীল সরকারের শুকরিয়া আদায় করা প্রত্যেক প্রজার জন্য ওয়াজিব, কিন্তু আমি মনে করি আমার উপর বেশী পরিমাণে ওয়াজিব। কেননা আমার এই মহান মিশন যা মহামান্য সম্রাজ্ঞীর ছায়াতলে থেকে বাস্তবায়িত হচ্ছে, তা অন্য কোনো সরকারের অধীনে থেকে কখনও বাস্তবায়িত হতো না। হোক না তা কোন ইসলামী সরকার।” (তোহফায়ে কায়সারিয়া, রূহানী খাযায়েন-১২/২৮৩-২৮৪)।
পাঠকবৃন্দ, মির্যা কাদিয়ানীর বক্তব্যগুলো পড়ুন এবং আপনা বিবেককে প্রশ্ন করুন, কাদিয়ানী সম্প্রদায় কোন জ্ঞানে এমন একজন বিশ্ব বেঈমান, স্বজাতির গাদ্দারকে বিশ্বাস করতে পারে! কিভাবে তাকে ইমাম মাহদী, তথাকথিত বুরুজি মুহাম্মদ কিবা একজন ‘নবী’ হিসেবেও বরণ করতে পারে!! যে লোকটি স্বঘোষিতভাবে বৃটিশদের ‘লাগানো চারাগাছ’ আর সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ সরকারের তোষামোদ ও চাটুকারিতায় নির্লজ্জ রেকর্ড সৃষ্টিকারী, যার বিবরণ শুনলে লজ্জা ও ঘৃণায় যেকোনো মানুষের হৃদয় পর্যন্ত কাঁপিয়ে উঠবে; আল্লাহ কি কোনোভাবেই এমন লোককে ন্যূনতম একজন ‘মুজাদ্দিদ’ (সংস্কারক) হিসেবেও প্রেরণ করবেন? নিশ্চয়ই না।
বাকিয়াংশ পড়তে লিখকের ওয়েবসাইট এর এ লিংকটিতে ক্লিক করুন
সংগৃহিত