হাদীসের নাম ভেঙ্গে উম্মতিনবীর দলিল ও তার খন্ডন

1
হাদীসের নাম ভেঙ্গে উম্মতিনবীর দলিল ও তার খন্ডন
আর্টিকেল

জনৈক প্রশ্নকর্তা : একটি হাদীসে উল্লেখ আছে “…অতপর মূসা (আ:) আরজ করলেন اِجْعَلْنِىْ نَبِيًّا تِلْكَ الْاُمَّة অর্থাৎ হে আল্লাহ আমাকে সেই উম্মতের নবী বানিয়ে দাও। আল্লাহপাক ইরশাদ করলেন “মিনহা নাবিয়্যুহা” অর্থাৎ তাদের নবী তাদেরই মধ্য থেকে হবে।” ( ইমাম আবু নাঈম আল-ইস্ফাহানী (রহ:)-এর সীরাতগ্রন্থ “হুলিয়া” এবং থানভীর সীরাতগ্রন্থ “নশরুত্তিব” দ্রষ্টব্য)। এই হাদীসে ‘তাদের নবী’ হতে মির্যা কাদিয়ানী সাহেবের কথাই কি বুঝানো হয়েছে?

সূরা নিসা আয়াত নং ৬৯ এর অপব্যাখ্যা খন্ডন Click

উত্তর : শায়খ আলবানী (রহ:) লিখেছেন, এর সূত্র খুবই দুর্বল বরং মওজূ অর্থাৎ বানোয়াট। সনদের একজন রাবী আবু আইয়ুব আল জানাইরি একজন মাতরূক তথা পরিত্যাজ্য এমনকি তার ভেতর দুর্বলতা থাকাও প্রসিদ্ধ, অপর আরেক রাবী সাঈদ ইবনে মূসা একজন মাজহূল অর্থাৎ অজ্ঞাত রাবী। ইমাম ইয়াহ্ইয়া বিন মঈন, ইবনে আদী, ইমাম বুখারী, আবু যুর’আ প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ বর্ণনাটির রাবীগণের কঠোর সমালোচনা করেছেন (ইমাম যাহাবী (রহ:) রচিত ‘মীযানুল ইতিদাল’ ৩/৬৭ দ্রষ্টব্য)। ইমাম ইবনে হাব্বান (রহ:) থেকে উক্ত বর্ণনাটির একজন রাবী সাঈদ ইবনে মূসা আল-উমাবী সম্পর্কে ‘মীযানুল ইতিদাল’ কিতাবে লিখা আছে اتهمه ابن حبان بالوضع. ثم ساق له ثلاثة أحاديث هذا أحدها ، وقال: موضوع অর্থাৎ ইবনে হাব্বান (রহ:) উক্ত বর্ণনাকারীকে জাল হাদীস তৈরিকারী বলে অভিহিত করেছেন। অতপর তিনি ঐ বর্ণনাকারীর তিনখানা হাদীসের অন্যতম এই একখানা হাদীসকে জাল তথা বানোয়াট বলেছেন।

  • কিতাবের ভাষ্যমতে :-

শায়খ নাসির উদ্দীন আল-বানী (রহ:) লিখেছেন, إسناده ضعيف جدا، بل موضوع، ولوائح الوضع عليه ظاهرة ، وآفته أبو أيوب الجنائري واسمه سليمان بن سلمة الحمصي قال أبو حاتم: متروك لا يشتغل به. وقال ابن الجنيد: كان يكذب. وقال الخطيب: سعيد بن موسى مجهول، والجنائزي مشهور بالضعف. অর্থাৎ – এর সনদ (সূত্র) খুবই দুর্বল, বরং বানোয়াট। বানোয়াট হওয়ার লক্ষণসমূহ এতে সুস্পষ্ট। আর এখানে সমস্যা হল, আবু আইয়ুব আল জানাইরি। তার নাম সুলেমান ইবনে সালামাহ আল হেমসি। তার সম্পর্কে ইমাম আবু হাতেম বলেছেন, সে মাতরূক বা পরিত্যাজ্য, তাকে নিয়ে হাদীসের কাজ করা যাবেনা। ইবনুল জুনাইদ বলেছেন, সে মিথ্যা বলত। ইমাম খতিব আল-বাগদাদী বলেছেন, সাঈদ ইবনে মূসা একজন মাজহূল তথা অজ্ঞাত রাবী। আর আবু আইয়ুব আল-জানায়িরি দুর্বলতার জন্য প্রসিদ্ধ।

(সূত্র : জিলালুল জুন্নাহ ফী তাখরীজিস সুন্নাহ লি-ইবনে আবী আ’ছেম- শায়খ আলবানী রহ. খ-১, পৃ-২২২; বর্ণনা নং ৬৯৬)। এবার কবি সত্যি নিরব! স্ক্রিনশট এই :-

জিলালুল জুন্নাহ ফী তাখরীজিস সুন্নাহ লি-ইবনে আবী আ’ছেম- শায়খ আলবানী রহ: খ-১, পৃ-২২২; বর্ণনা নং ৬৯৬
  • সতর্কতা :

এখানে যে কথাটি বলে রাখা জরুরি সেটি হচ্ছে, এটি সহীহ হলেও এর দ্বারা কখনোই কথিত উম্মতিনবীর কনসেপ্ট প্রমাণিত হয় না। তার কারণ এখানে মূলত মূসা (আ:)-এর নিবেদনের প্রতিউত্তরে আল্লাহর যেই কথাটি উল্লেখ আছে অর্থাৎ قال نبيها منهم তথা তাদের নবী তাদেরই মধ্য থেকে হবেন। এ থেকে উদ্দেশ্য হল, মুহাম্মদে আরাবী (সা:)-এর আবির্ভাবের সংবাদ দেয়া। তার কারণ এর একটু উপরেই লিখা আছে, قال موسى و من امة احمد؟ (উচ্চারণ, ক্বালা মূসা ওয়া মান উম্মাতু আহমদ?) অর্থাৎ মূসা (আ:) জিজ্ঞেস করলেন, আহমদ এর উম্মত কারা (তথা মুহাম্মদ সাঃ এর উম্মতের বৈশিষ্ট্য কেমন হবে?)। এতেই সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, মূসা (আ:) যেই উম্মতের নবী হতে চেয়ে নিবেদন করার কথা রয়েছে সেই উম্মত মূলত উম্মতে মুহাম্মদীই। সুতরাং এই থেকে কাদিয়ানীদের কথিত উম্মতিনবীর কনসেপ্ট পুরোই অপ্রাসঙ্গিক, বানোয়াট ও বাস্তবতা বিবর্জিত বলে প্রমাণ পাওয়া গেল। এরপরেও যারা এটিকে সাত অন্ধের হাতি দেখা উল্লু কা পাঠাদের ন্যায় উম্মতিনবীর দলিল মনে করবে তাদেরকে বুঝানোর সাধ্য কারো নেই! আল্লাহর নিকট তাদের সোপর্দ করছি।

লিখকের পেইজ থেকে পড়ুন Click

  • কাদিয়ানীদের তথাকথিত “উম্মতিনবী”র দলিলটি সম্পূর্ণরূপে ও হাদীসের নাম ভেঙ্গে নিম্নরূপ:-

তাদের বইতে উল্লেখ আছে যে, হাদীসে কুদসীতে এসেছে : “আল্লাহতায়ালা একবার মূসা (আ:)-কে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করেছেন তুমি বনী ইসরাঈলদের জানিয়ে দাও, যে ব্যক্তি আহমদ (সা:) এর প্রতি অবিশ্বাসী অবস্থায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করবে সে যেই হোক আমি তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাব। হযরত মূসা (আ:) আরজ করলেন, আহমদ কে? আল্লাহপাক ইরশাদ করলেন : হে মূসা! আমার ইজ্জত ও গৌরবের শপথ। আমি সমস্ত সৃষ্টি জগতের মধ্যে তাঁর চেয়ে অধিক সম্মানিত কাউকেই সৃষ্টি করিনি। আমি তাঁর নাম আরশের মধ্যে আমার নামের সাথে আসমান ও জমিন এবং চন্দ্র ও সূর্য সৃষ্টির বিশ লক্ষ বছর পূর্বে লিপিবদ্ধ করেছি। আমার ইজ্জত ও গৌরবের শপথ! আমার সমস্ত মাখলূকের জন্য জান্নাত হারাম যতক্ষণ মুহাম্মদ (সা:) এবং তাঁর উম্মত জান্নাতে প্রবেশ না করবে। অতপর মূসা (আ:) আরজ করলেন : “ইজ’আলনী নাবিয়্যা তিলকাল উম্মাতি” অর্থাৎ হে আল্লাহ আমাকে সেই উম্মতের নবী বানিয়ে দাও। আল্লাহপাক ইরশাদ করলেন “মিনহা নাবিয়্যুহা” অর্থাৎ তাদের নবী তাদেরই মধ্য থেকে হবে। মূসা (আ:) পুনরায় আরজ করলেন : তবে আমাকে সেই নবীর একজন ‘উম্মত’ বানিয়ে দাও। আল্লাহপাক ইরশাদ করলেন, তুমি তাঁর পূর্বেই নবীরূপে আবির্ভূত হয়েছ আর সেই নবী তোমার পরে প্রেরিত হবেন। তবে জান্নাতে তাঁর সাথে তোমাকে একত্রিত করে দেব।”

  • কাদিয়ানীদের বিশ্বাস:

কাদিয়ানীদের বিশ্বাস অনুযায়ী এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, মূসা (আ:)-এর নিবেদনের প্রতিউত্তরে আল্লাহর বাণী : ‘তাদের নবী তাদেরই মধ্য থেকে হবে।’ অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা:) এর উম্মতের মধ্য হতে একজন ‘নবী’ হবেন। অতএব, মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীই ছিলেন সেই উম্মতিনবী! (নাউযুবিল্লাহ)।

  • আরেকটি জবাব:

‘তাফসীরে আবী হাতিম’ (৫/১৫৮৭) এর মধ্যে এই ধরণের আরেকটি দুর্বল বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে, আল্লাহপাক মূসা (আ:)-কে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করলেন : تلك الامة تكون بعدك امة احمد (উচ্চারণ) ‘তিলকাল উম্মাতু তাকূনু বা’দাকা উম্মাতু আহমাদ’ অর্থাৎ ঐ উম্মত তোমার পর আহমদের উম্মত হবে। এতে কিন্তু পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, মূসা (আ:) যেই উম্মতের নবী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলিয়া কথিত আছে তার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহও যে বলেছেন ‘তাদের নবী তাদেরই মধ্য থেকে হবে’—এই সমস্ত কথাবার্তায় ভবিষ্যতে একজন ‘উম্মতিনবী’ হবে—বুঝায় না, বরং ঐ সমস্ত কথাবার্তায় মুহাম্মদ (সা:)-এরই আগমনী সংবাদ দেয়া উদ্দেশ্য। নচেৎ ‘তাকূনু বা’দাকা উম্মাতু আহমাদ’—একথার কী মানে?

এছাড়াও উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা:) হতে একটি বর্ণনায় উল্লেখ আছে, “যে রাতে প্রিয়নবী (সা:) জন্মগ্রহণ করলেন সেই রাতে একজন [জ্যোতিষী] ইহুদী পন্ডিত মক্কার দিকে আগমন করছিল। সে কুরাইশদের সম্বোধন করে বলল, হে কুরাইশ সকল! আজ রাতে তোমাদের কি কোনো পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে? তারা জবাব দিলো, আমরা জানিনা। তখন সেই ইহুদী বলল : অনুসন্ধান করো! কেননা, আজ রাতে এই উম্মতের নবী জন্মগ্রহণ করেছেন যার দুই কাঁধের মাঝখানে একটা চি‎‎‎‎‎হ্ন রয়েছে। অতপর কুরাইশরা অনুসন্ধান করার পর জানতে পারল যে, জনাব আব্দুল্লাহ’র এক পুত্র [মুহাম্মদ সা:] সন্তান জন্মগ্রহণ করেছেন।” (ফাতহুল বারী’র সুত্রে নশরুত্তিব’ [বাংলা] অধ্যায় ষষ্ঠ হাদীস নং ৭ দ্রষ্টব্য)।

অতএব বর্ণনাটি সহীহ হোক কিংবা জাল হোক, যাই হোক; কোনো অবস্থাতেই এর ‘তাদের নবী তাদেরই মধ্য থেকে হবে’ খন্ডিত অংশকে আশ্রয় করে তথাকথিত উম্মতিনবী’র অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না। এটি পূর্বেকার আরো সে সকল সীরাতগ্রন্থকার স্ব স্ব কিতাবে উম্মতে মুহাম্মদীয়ার ফজিলত বর্ণনা করতে উল্লেখ করেছেন তাদের কারো থেকে কাদিয়ানীদের কথিত উম্মতিনবীর কনসেপ্ট প্রমাণিত হয়না! উল্লেখ্য, ফজিলত বর্ণনার ক্ষেত্রে যদিও বা সহীহ হাদীস নয় এমন হাদীসও প্রাসঙ্গিকক্রমে উল্লেখ করা কারো কারো মতে বৈধ, কিন্তু আকীদার প্রমাণে একমাত্র সহীহ হাদীসই অথেনটিক, এটি উম্মাহার সর্বসম্মত মুহাদ্দিসীনের মত। আল্লাহ তুমি তাদের হিদায়াত দান কর।

একই বিষয়ে আরও একটি লিখা হাদীসে কথিত ‘উম্মতিনবী’র দলিল থাকার দাবী সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here