নবী এবং রাসূল কি একই? কুরআন হাদীস এবং যুগ ইমামরা কী বলেছেন?
যারা মনে করেন যে, নবী আর রাসূল মূলতই অভিন্ন তাদের নিকট নিচের প্রশ্নগুলোর জবাব চাচ্ছি!
[১] পবিত্র কুরআনঃ সূরা হাজ্জ এর ৫২ নং আয়াতে আল্লাহতালা ইরশাদ করেন, وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ وَلَا نَبِيٍّ إِلَّا إِذَا تَمَنَّى أَلْقَى الشَّيْطَانُ فِي أُمْنِيَّتِهِ فَيَنسَخُ اللَّهُ مَا يُلْقِي الشَّيْطَانُ ثُمَّ يُحْكِمُ اللَّهُ آيَاتِهِ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ অর্থাৎ আমি তোমার পূর্বে যে সমস্ত রাসূল এবং নবী প্রেরণ করিয়াছি, তাহাদের কেহ যখনই কিছু আকাঙ্ক্ষা করিয়াছে, তখনই শয়তান তাহার আকাঙ্ক্ষায় কিছু প্রক্ষিপ্ত করিয়াছে, কিন্তু শয়তান যাহা প্রক্ষিপ্ত করে আল্লাহ তাহা বিদূরিত করেন। অতপর আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহকে সু-প্রতিষ্ঠিত করেন এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (অনুবাদ, ইফা হতে প্রকাশিত)।
আমার প্রশ্ন হল, নবী আর রাসূল যদি একই হত তাহলে আল্লাহতায়ালা কেন বললেন “রাসুল ওয়া লা নবী”? মানে তিনি “রাসূল” বলেই তো থেমে যেতে পারতেন! তারপর আবার “নবী” শব্দ কেন আনলেন? অথচ পবিত্র কুরআন সব ধরণের অনর্থক বর্ণনা ও দ্বিরুক্তি হতে পবিত্র!
[২] হাদীস শরীফঃ বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন [হাশরের কঠিন মুহূর্তে শাফায়াতের উদ্দেশ্যে সমস্ত হাশরবাসী হযরত নূহ (আঃ)-এর নিকট শাফায়াতের জন্য যখন আসবেন তখনকার ঘটনা] হাদীসের খন্ডাংশ : فيأتون نوحا فيقولون يا نوح انت اول الرسل الى اهل الارض و سماك الله عبدا شكورا (উচ্চারণ) ফা ইয়া’তূনা নূহান ফা ইয়াকূলূনা ইয়া নূহুন আন্তা আউয়ালুর রুসুলি ইলা আহলিল আরদ্বি ওয়া সাম্মা-কাল্লাহু আব্দান শাকূরা।” অর্থাৎ… অতপর সমস্ত হাশরবাসী হযরত নূহ (আঃ)-এর নিকট ছুটে আসবে। তারা এসে বলবে, হে নূহ! আপনি হলেন পৃথিবীতে প্রথম রাসূল। আল্লাহতায়ালা আপনার নাম রেখেছিলেন ‘একজন শুকরগুজার বান্দা’। (সহীহ বুখারীঃ কিতাবুল আম্বিয়া, হাদীস নং ৩৩৪০)।
আমার প্রশ্ন হল, যদি নবী আর রাসূল একই হত তাহলে হযরত নূহ (আঃ)-কে হাশরবাসীরা কেন বলবেন انت اول الرسل (You are first messenger) অর্থাৎ আপনি প্রথম রাসূল! এর মানে কি তাহলে নূহ (আঃ)-ই প্রথম নবী? আপনারাও কি এটাই বুঝাতে চান? যদি তাই হয় তাহলে নূহ (আঃ)-এর পূর্বে গত হয়ে যাওয়া হযরত আদম (আঃ) এবং হযরত শীষ (আঃ) প্রমুখ এঁরা কি নবী ছিলেন না? অর্থাৎ আমার প্রশ্নটি হল, নূহ (আঃ)-ই প্রথম রাসূল মানে তিনিই প্রথম নবী—এই অর্থ হলে তখন আদম আর শীষ এঁদের কী হবে? ভাবিয়ে তুলে কিনা?
[৩] যুগশ্রেষ্ঠ ইমামঃ নবুওয়তের মিথ্যা দাবিদার মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীও ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ)-কে হিজরী ৬ষ্ঠ শতাব্দীর একজন যুগ ইমাম ও মুজাদ্দিদ হিসেবেই মানতেন। (রেফারেন্স, আছলে মুছাফফা, উর্দু এশিশন ১/১৬২-৬৫ দ্রষ্টব্য, মির্যা খোদাবক্স কাদিয়ানী রচিত; প্রথম প্রকাশ ১৯০১ ইং; মহাসুসংবাদ পৃষ্ঠা নং ৪৪)। এবার শায়খ ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) কী বলেছেন শুনুন :
“রাসূল হলেন তিনি, যাঁকে অবিশ্বাসী কাফের সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করা হয়ে থাকে। আর নবী হলেন তিনি যাঁকে এমন কোনো সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করা হয় যারা পূর্বেকার রাসূলের শরীয়তে বিশ্বাসী। ফলে প্রেরিত এই পয়গম্বর তিনি তাদেরকে দ্বীন শিক্ষা দেন এবং তাদের মধ্যকার সংঘটিত বিভেদগুলোর মীমাংসা করেন।” শায়খ ইবনে তাইমিয়াহ (রহঃ) এর বক্তব্যের বঙ্গানুবাদ সমাপ্ত হল। (মাজমু’আয়ে ফাতাওয়া লি-ইবনে তাইমিয়াহ)।
একটি প্রশ্ন ও তার জবাবঃ
আল্লাহতালা হযরত ইসমাইল (আঃ) সম্পর্কে ‘ওয়া কা-না রাসূলান নাবিয়্যা’ (আরবী: وَكَانَ رَسُولًا نَّبِيًّا ) বলে তাঁকে ‘রাসূল’ আখ্যা দিয়েছেন। অথচ তিনি নতুন কোনো শরিয়তি ওহীর বাহক ছিলেন না! তারপরেও তাকে ‘রাসুল’ বলল কেন?
উত্তর : উক্ত প্রশ্নের উত্তরে বলা হবে যে, হযরত ইসমাঈল (আঃ) কর্তৃক প্রচারিত শরীয়ত যদিও নতুন কোনো শরীয়ত ছিলনা, বরং এটি ইবরাহিমী শরীয়ত ছিল; কিন্তু তিনি যেই বনু জুরহাম সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরিত হয়েছিলেন তাদের দিক থেকে তাঁর প্রচারিত শরীয়তে ইবরাহিমী নতুন ছিল; এমনকি তারা ইসমাইল (আঃ) এর মাধ্যমেই শরীয়তে ইবরাহিমী সম্পর্কে নতুনভাবে জ্ঞান লাভ করতে পেরেছিলো। তাই প্রত্যক্ষভাবে যদিও ঈসমাইল (আঃ) নতুন কোনো শরিয়তি ওহীর বাহক ছিলেন না কিন্তু পরোক্ষভাবে তিনি বনু জুরহামের নিকট একজন শরিয়তি ওহীর প্রচারকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। এ সম্পর্কে হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত শাহ আশরাফ আলী থানভী-ও লিখেছেন,
“আল্লাহ’র যেই প্রেরিত পুরুষ তাঁর অনুসারীদের নিকট নতুন শরীয়ত পৌঁছান তাঁকে ‘রাসূল’ বলে। চাইত উক্ত শরীয়ত রাসূলের দিক থেকে নতুন হোক, যেমন তাওরাত ইঞ্জিল যবূর ইত্যাদি; অথবা যাদের নিকট তিনি প্রেরিত হলেন তাদের দিক থেকে নতুন হোক, যেমন হযরত ইসমাইল (আঃ) এর প্রচারিত শরীয়তে ইবরাহিমী। কেননা ইসমাইল (আঃ) কর্তৃক প্রচারিত শরীয়ত নতুন কোনো শরীয়ত ছিলনা বরং এটি ইবরাহিমী শরীয়তই ছিল। কিন্তু বনু জুরহাম সম্প্রদায় হযরত ইসমাইল (আঃ) এর মাধ্যমেই শরীয়তে ইবরাহিমী সম্পর্কে নতুনভাবে জ্ঞান লাভ করেছিলো। (রেফারেন্স, ইমদাদুল ফাতাওয়া, খন্ড নং ৫ পৃষ্ঠা নং ৪৫৩)।
[৪] মির্যা কাদিয়ানীঃ মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী কর্তৃক ১৮৮৪ সালে রচিত ‘বারাহীনে আহমদিয়া’ নামক কথিত ইলহামি বইয়ের ৩নং খন্ডের ২৪৬ নং পৃষ্ঠাতে তিনি “সকল নবী এবং সকল রাসূল” এইরূপ শব্দচয়নে নবী এবং রাসূলকে ভিন্ন ভিন্ন মর্মার্থে উল্লেখ করেছেন। এবার তার বই থেকে ‘রাসূল’-এর পরিচয় কিভাবে আছে দেখা যাক!
মির্যা কাদিয়ানী রচিত ‘ইযালায়ে আওহাম‘ কিতাবের ৩ নং খন্ডের ২৪৬ নং পাতায় লেখা আছে حسب تصريح قرآن کریم رسول اسی کو کہتے ہیں جس نے احکام و عقائد دین جبرائیل کے ذریعہ حاصل کئی ہوں لیکن وحی نبوت پر تو تیرہ سو برس سے مہر لگ گئی ہے. کیا یہ مہر اس وقت ٹوٹ جائے گی؟ অর্থাৎ কুরআনের সুস্পষ্ট বিবরণ মতে রাসূল তাঁকেই বলে যিনি জিবরাইল (আঃ)-এর মাধ্যমে দ্বীনী-বিধিমালা ও আকিদাসমূহ লাভ করে থাকেন। পরন্তু নবুওয়াতি-ওহীর উপর তো তেরশত বছর হতে মোহর (সীল) লেগে আছে! তো এই মোহর কি বর্তমানে ভেঙ্গে পড়বে? (রূহানী খাযায়েন ৩/৩৮৭ দ্রষ্টব্য)। উল্লেখ্য এখানে তার (মির্যা) “রাসূল” -এর সংজ্ঞায় পরিষ্কার শব্দে ‘আহকাম” (আরবী : احکام) শব্দটি উল্লেখ রয়েছে। যেটি ‘শরীয়ত’ শব্দের সমার্থক।
এখানে আমার প্রশ্ন হল, “রাসূল” -এর সংজ্ঞায় মির্যা কাদিয়ানী থেকেও “রাসুল যিনি তিনি একজন শরীয়তি ওহীর বাহক” এইরূপই প্রমাণ পাওয়া গেল কিনা? একইভাবে অত্র পৃষ্ঠায় মির্যা সাহেব “নবী” এর পরিচয়টাও “গত তেরশত বছর হতে নবুওয়াতি-ওহীর উপর যেই মোহর (সীল) লেগে আছে তা বর্তমানে ভাঙ্গতে পারে এমন সাধ্য কার”-মর্মে সুস্পষ্ট করে দিলেন কিনা? আপনাদের মতে নবী আর রাসূল দুটো যখন একই তাহলে দুটোর সংজ্ঞায় বা পরিচয়ের ক্ষেত্রে বৈপরীত্য কেন?
সুতরাং বলতে পারি, কাদিয়ানীরা যেটি মনে করে বসে আছে সেটি ভুল এবং পুরোপুরি বাতিল। বরং নবী এবং রাসূল দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। এখানে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক রাসূল একই সাথে নবীও কিন্তু প্রত্যেক নবী একই সাথে রাসূল নন! কথা সংক্ষেপ রাখতে আজকের মত এই পর্যন্তই। আল্লাহ হাফেজ।
লেখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক