ইমাম হাসান এবং হুসাইন এর বংশধারা অবশিষ্ট আছে কি?
- জনৈক কাদিয়ানী মির্যা গোলাম আহমদকে ইমাম মাহদী সাব্যস্ত করতে আর কোনো দলিল প্রমাণ খুঁজে না পেয়ে অবশেষে বলল, আরে জনাব! ইমাম মাহদী হযরত হাসান (রা:)-এর বংশে কিভাবে জন্মিবেন, হাসানের বংশধারা কি এখন অবশিষ্ট আছে? এই লিখাটি ঐ কাদিয়ানীর অজ্ঞতা আর গোঁড়ামিপূর্ণ মন্তব্যের জবাবেই লিখলাম। এখানে বলে রাখতে চাই যে, হযরত হাসান (রা:) জীবনে অনেকগুলো বিয়ে করেছিলেন। তবে তিনি কখনো এক সঙ্গে চারের অধিক স্ত্রী রাখেননি। কারো ইন্তেকাল হলে বা তালাক হলে শুধু তখনি বংশধর বাড়াতে পরবর্তীতে আরেকটি বিয়ে করতেন। শেষ যুগে আগমনকারী ইমাম মাহদী উনারই বংশের কোনো সৌভাগ্যবান পুরুষের ঔরসে হবে বলে বহু সহীহ হাদীসে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে। দেখুন, আবুদাউদ কিতাবুল মাহদী। অতএব বর্তমানে হযরত হাসানের বংশধারা অবশিষ্ট আছে কি নেই—এমন প্রশ্ন তোলাটাও সর্বনিম্নের মূর্খতার পরিচয় বৈ নয়।
মির্যা কাদিয়ানী সাহেব নিজেও কোথাও লিখে যাননি যে, আহলে বাইয়েত নির্বংশ ছিল। কাদিয়ানীদের উচিত, মির্যা কাদিয়ানীর কথিত একটি স্বপ্নে নিজেকে আহলে বাইয়েতের অন্তর্ভুক্ত সাব্যস্ত করার দুরভিসন্ধিমূলক প্রচেষ্টাকে স্মরণ করে একটুখানি হলেও লজ্জা পাওয়া! এই যে দেখুন, মির্যা কাদিয়ানী সাহেব কিসব হাস্যকর স্বপ্ন দ্বারা নিজের মাহদী হওয়ার দাবীকে বাস্তব করে দেখাতে চেয়েছিলেন!
- ইমাম হাসান বিন আলী (রা:)-এর বংশ হতে প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদীর আবির্ভাবের ভবিষ্যৎবাণী থাকায় কেয়ামত পর্যন্ত অবশ্যই আল্লাহ এ বংশটিকে রক্ষা করবেন:
প্রথমেই জেনে নিই শেষ যুগে আগমনকারী ইমাম মাহদী কার বংশ হতে হবেন? উত্তর হল, বহু সহীহ হাদীসের আলোকে প্রমাণিত, হযরত ইমাম মাহদী নবী পরিবার থেকে ও হযরত ফাতেমা (রা:) এর সন্তান হযরত হাসান এর বংশে জন্মগ্রহণ করবেন (আবুদাউদ হা/৪২৮৪)।
ইমাম যাহাবী রচিত ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’ (খ-৪/পৃ-৩৪৭) থেকে :
بنو الحَسَنِ هُم : الحَسَنُ ، وَزَيْدٌ ، وَطَلْحَةُ، وَالقَاسِمُ، وَأَبُو بَكْرٍ، وَعَبْدُ اللهِ -فَقُتِلُوا بِكَرْبَلاَءَ مَعَ عَمِّهِمُ الشَّهِيْدِ- وَعَمْرٌو، وَعَبْدُ الرَّحْمَنِ، وَالحُسَيْنُ، وَمُحَمَّدٌ، وَيَعْقُوْبُ، وَإِسْمَاعِيْلُ، فَهَؤُلاَءِ الذُّكُورُ مِنْ أَوْلاَدِ السَّيِّدِ الحَسَنِ. وَلَمْ يُعْقِبْ مِنْهُم سِوَى الرَّجُلَيْنِ الأَوَّلَيْنِ: الحَسَنِ وَزَيْدٍ، فَلِحَسَنٍ خَمْسَةُ أَوْلاَدٍ أَعْقَبُوا، وَلزِيدٍ ابْنٌ، وَهُوَ الحَسَنُ بنُ زَيْدٍ، فَلاَ عَقِبَ لَهُ إلَّا مِنْهُ، وَلِي إِمْرَةَ المَدِيْنَةِ، وَهُوَ وَالِدُ السِّتِّ نَفِيْسَةَ، وَالقَاسِمِ، وَإِسْمَاعِيْلَ، وَعَبْدِ اللهِ، وَإِبْرَاهِيْمَ، وزيد، وإسحاق.
অর্থাৎ হাসান বিন আলী (০৩-৫০হিজরী) এর সন্তানগণ হলেন, হাসান, যায়েদ, তালহা, কাশেম, আবু বকর, আব্দুল্লাহ। তারা তাদের শহীদ চাচা (হুসাইন)’র সাথে কারবালায় নিহত হন। আর আমর, আব্দুর রহমান, হুসাইন, মুহাম্মদ, ইয়াকুব, ইসমাইল প্রমুখ এরা সর্দার হাসান (বিন আলী)’র সন্তানদের পুরুষগণ। এদের মধ্যে হাসান বিন হাসান আর যায়েদ বিন হাসান এ দুজন ছাড়া অন্যদের থেকে বংশ বিস্তার হয়নি। অধিকন্তু হাসান বিন হাসান এর ৫ সন্তান ছিল। আর যায়েদ বিন হাসানের ছিল ১ সন্তান। যার নাম ছিল হাসান বিন যায়েদ বিন হাসান। তার (যায়েদ বিন হাসান) থেকেও বংশ বিস্তার হয়নি। তবে কিন্তু তার মদীনার এক কৃতদাসীর সন্তান থেকে বংশ বিস্তার হয়েছে। যিনি ৬ সন্তানের জনক। তারা হলেন, কাশেম, ইসমাইল, আব্দুল্লাহ, ইবরাহীম, যায়েদ, ইসহাক। (অনুবাদ সমাপ্ত হল)। সুতরাং দৃৃৃঢ়ভাবে বলতে পারি, ইমাম মাহদী হযরত হাসান (রা:)-এর বংশে কিভাবে জন্মিবেন, হাসানের বংশধারা কি এখন অবশিষ্ট আছে—এধরণের যে কোনো কথাবার্তা পুরোই অজ্ঞতার শামিল।
- ইমাম হুসাইন বিন আলী (রা:)-এর বংশধারা:
ইমাম যাহাবী রচিত ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’ (খ-৪/পৃ-৩৭২) থেকে :
أَولاَدُ الحُسَيْنِ هُمْ: عَلِيٌّ الأَكْبَرُ الَّذِي قُتِلَ مَعَ أَبِيْهِ، وَعَلِيٌّ زِينُ العَابِديْنَ، وَذُرِّيَتُهُ عَدَدٌ كَثِيْرٌ، وَجَعْفَرٌ، وَعَبْدُ اللهِ وَلَمْ يُعْقِبَا. অর্থাৎ হুসাইন (০৪-৬১ হিজরী) এর সন্তানগণ হলেন, আলী আকবর (উপাধি, আবুল হাসান [৩৩-৬১হিজরী]) যিনি পিতার সাথে নিহত হন। আর আলী যয়নুল আবেদীন (উপনাম, আস-সাজ্জাদ) এর বংশের সন্তান সন্ততি অনেক রয়েছে। তবে জাফর ইবনে হুসাইন আর আব্দুল্লাহ ইবনে হুসাইন এদের বংশ বিস্তার হয়নি। (আরো দেখুন, তাহযীবুত তাহযীব খ-২/পৃ-৩৪৫; তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত খ-১/পৃ-১৬৩)।
বলে রাখতে চাই যে, ইমাম হুসাইন (রহ:) এর পুত্র সন্তানদের মধ্যে আলী আকবর বিন হুসাইন ২৫ বছর বয়সে ৬১ হিজরীতে কারবালায় শহীদ হন। উনার অপর দুই পুত্র জাফর এবং আব্দুল্লাহ ছোটবেলাতেই ইন্তেকাল করেন। ফলে তাদের থেকেও বংশ বিস্তার হয়নি। কিন্তু আলী যয়নুল আবেদীন (৩৮-৯৫ হিজরী) থেকে বংশ বিস্তার হয় বহুলাংশে। কারবালার যুদ্ধে আলী যয়নুল আবেদীন যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন না। তিনি সস্ত্রীক ও পুত্র মুহাম্মদ আল-বাকের এবং আপনা ফুফু যয়নাব বিনতে আলী সহ তাবুতে ছিলেন । কারণ তিনি তখন প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। শত্রুরা তাঁকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু ফুফু যয়নাব বিনতে আলী (০৫-৬২হিজরী) এর প্রাণপণ প্রচেষ্টায় ও খুব বেশি অসুস্থ থাকায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান!
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন : لما استشهد والده، قال شمر بن ذي الجوشن: اقتلوا هذا الغلام؛ فقال بعض أصحابه: أنقتل فتى حدثاً مريضاً لم يقاتل؟! فتركوه অর্থাৎ যখন তার পিতা হুসাইন বিন আলী শহিদ হয়ে গেলেন তখন শামির বিন যিল যোশন বলল, এই ছেলেটাকেও হত্যা করে ফেল। তখন তার কোনো কোনো সাথী নিষেধ করে বলল, ছেলেটি অসুস্থতায় ভুগছে। এর ফলে তাকে আর হত্যা করা হয়নি, তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। (তথ্যসূত্র : তাবক্বাতুল কোবরা লি-ইবনে সা’আদ ৫/১৬৩; তারীখে তাবারী ১১/৬৩০; তারীখে দামেস্ক লি-ইবনে আসাকীর ২/৩৩৫)।
আলী যয়নুল আবেদীন এর সংসারে প্রায় ১৬জন সন্তান সন্ততি জন্ম গ্রহণ করেন। তন্মধ্যে একজনের নাম ছিল ‘হাসান আসগর’ (১০০-১৫৭ হিজরী)। এই হাসান আসগর থেকেই ৫ জন পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। তারা হলেন, উবায়দুল্লাহ আল-আ’রাজ, আব্দুল্লাহ আল-আকিকি, সুলায়মান, আলী, আল-হাসান। এভাবে অসংখ্য মাত্রায় বংশ বিস্তার হয়।
ইমাম মাহদী হযরত ইমাম হুসাইন (রা:) এর বংশ থেকে হবে কিভাবে?
কোনো কোনো হাদীসে উল্লেখ আছে যে, ইমাম মাহদী ইমাম হুসাইনের বংশ থেকে হবেন। ফলে বাহ্যিকভাবে হাদীসের মধ্যে স্ববিরোধ মনে হয়ে থাকে। এর জবাবে বলব, ইমাম হাসান আর ইমাম হুসাইন দু’জনের সন্তানদের মধ্যকার বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ইতিহাস যাদের ভালোভাবে জানা আছে তারা কখনোই এ জাতীয় বর্ণনা দ্বারা বিভ্রান্ত হবেনা।
ইতিহাস প্রমাণ করে যে, ইমাম হুসাইন বিন আলী (রা:) এর একটি কন্যা ছিলেন ফাতেমা। তার বিয়ে হয়েছিল ইমাম হাসান বিন আলীর পুত্র হাসান আল মুছান্নাহ (৩৭-৯৭ হিজরী) এর সাথে। হাসান আল মুছান্নাহ’র মায়ের নাম ছিল খাওলাহ বিনতে মানযূর। তাদের সংসারে জন্মগ্রহণ করেন, আব্দুল্লাহ আল-মুহায, ইবরাহীম আল-গুমার, হাসান আল-মুছাল্লাছ প্রমুখ। (সূত্র : মুনতাহিল আ-মা-ল ফী তাওরীখিন নাবী ওয়াল আ-ল, ১/৬৫১-৫৩; শায়খ আব্বাস আল-ক্বিম্মী)।
আপনাদেরকে আরও একটি তথ্য দেব। হযরত হাসান বিন আলী (রা:) এর ‘ফাতেমা‘ নামে একজন কন্যা ছিল। তাঁকে বিয়ে দেয়া হয় ইমাম হুসাইন (রা:) এর পুত্র আলী যয়নুল আবেদীন এর সাথে। সে ঘরে প্রায় ষোলজন সন্তান সন্ততি জন্ম লাভ করেন।
ইমাম মাহদী হযরত আব্বাস (রা:) এর বংশ থেকে হবে কিভাবে?
ইমাম মাহদী পিতার দিক থেকে হযরত হাসান এবং হযরত আব্বাস উভয়ের বংশধর হবেন। কেননা হযরত হাসানের সাথে হযরত আব্বাসের পুত্র আল-ফজলের মেয়ে উম্মে কুলছুমের বিয়ে হয়। তাদের সংসারে জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মদ আল-আসগর, জাফর, হামজা এবং ফাতেমা (দেখুন তবক্বাতে ইবনে সা’আদ ৬/৩৫২)। স্ক্রিনশট –
অতএব, বুঝা গেল প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদীর মাতা কিংবা পিতার বংশক্রম ইমাম হাসান এবং ইমাম হুসাইন দুইজনের সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই কোনো কোনো বর্ণনায় ইমাম মাহদীর বংশ হিসেবে ইমাম হুসাইন (রা:)-এরও উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রধানতম কারণ এটাই। গভীরভাবে চিন্তা করলে যে কেউই বুঝতে পারবে যে, হাদীসগুলোর কোনো কোনোটির সনদের মধ্যে কিছুটা দুর্বলতা থাকলেও মূলত মতনের ক্ষেত্রে কোনো বৈপরীত্য নেই।
শিক্ষাবিদ ও গবেষক মুহাম্মদ নূরুন্নবী এম.এ