কাদিয়ানীদের প্রশ্ন ও আমার জবাব
এখানে তাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পর তাদেরকে পালটা দুটি প্রশ্ন করা হবে!
কাদিয়ানী : হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:) যদি শেষ যুগে আকাশ থেকে নেমে এসে উম্মতে মুহাম্মদীয়ার মধ্যে শামিল হন তাহলে তিনি স্বীয় উম্মতের জন্য শাফায়াতকারী হতে পারেন কিভাবে? যেহেতু তখন তাঁকে একই সঙ্গে উম্মতে মুহাম্মদীয়ার মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে! ফলে তাঁর উম্মত বনী ইসরাইলরা তাদের নিজেদের নবীকে না পেয়ে খুব বিপাকে পড়বেন! অতএব, বনী ইসরাইলী ঈসার পুনঃ আগমন সঠিক নয়!
মুসলমান : প্রথমে বুঝতে হবে, শাফায়াত কী এবং কত প্রকার ও কী কী? শাফায়াত বলতে ইসলামী পরিভাষায় কল্যাণ ও ক্ষমার জন্য আল্লাহ তায়ালার নিকট নবী-রাসূলগণের সুপারিশ করাকে বোঝায়। হাশরের ময়দানে মহান আল্লাহর কাছে নবী-রাসূলরা শাফায়াত করবে। শাফায়াত দুই ধরণের। যথা: ১। শাফায়াতে কুবরা ২। শাফায়াতে সুগরা।
(ক) শাফায়াতে কুবরা : কিয়ামতের দিন যখন মানুষ অসহনীয় দুঃখ-কষ্টে নিপতিত থাকবে তখন হযরত আদম (আ:), হযরত নূহ (আ.), হযরত মূসা (আ:) প্রভৃতি নবীদের নিকট উপস্থিত হয়ে শাফায়াতের অনুরোধ করবে। তারা সকলেই অপারগতা প্রকাশ করবে। এসময় সবাই মহানবী (সা:) এর নিকট উপস্থিত হবে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা:) সেজদাহ করবেন এবং আল্লাহর প্রশংসা ও তার মর্যাদা বর্ণনা করবেন। তারপর তিনি তার প্রভুর নিকট সুপারিশ করার অনুমতি চাইবেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে অনুমতি দিবেন। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা:) তাদের জন্য সুপারিশ করবেন। একে শাফায়াতে কুবরা (সর্বশ্রেষ্ঠ শাফায়াত) বলা হয়। এরূপ শাফায়াতের অধিকার একমাত্র মহানবী (সা:) এর থাকবে। এছাড়াও নবী করীম (সা:) জন্নাতীগণকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালার নিকট সুপারিশ করবেন। এর পরেই জান্নাতীগণ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।
(খ) শাফায়াতে সুগরা : কিয়ামতের দিন পাপীদের ক্ষমা ও পুণ্যবানদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য শাফায়াত করা হবে। এটাই শাফায়াতে সুগরা। নবী-রাসূল, ফেরেশতা, শহীদ, আলিম, হাফেজ এ শাফায়াতের সুযোগ পাবে।
এবার চলুন প্রশ্নের উত্তরে ফিরে যাই।
প্রশ্ন ছিল, ঈসা (আ:) যদি শেষ যুগে আকাশ থেকে নেমে এসে উম্মতে মুহাম্মদীয়ার মধ্যে শামিল হন তাহলে তিনি স্বীয় উম্মতের জন্য শাফায়াতকারী হতে পারেন কিভাবে? যেহেতু তখন তিনি একই সঙ্গে উম্মতে মুহাম্মদীয়ার মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত থাকবেন!
উত্তরে বলব, পবিত্র কুরআন মতে, প্রত্যেক নবীই হবেন তাঁর নিজ উম্মতের জন্য শাফায়াতকারী। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, فَکَیۡفَ اِذَا جِئۡنَا مِنۡ کُلِّ اُمَّۃٍۭ بِشَہِیۡدٍ وَّ جِئۡنَا بِکَ عَلٰی ہٰۤؤُلَآءِ شَہِیۡدًا অর্থাৎ তখন তাদের কি অবস্থা হবে, যখন প্রত্যেক সম্প্রদায় থেকে একজন সাক্ষী (নবী) উপস্থিত করব এবং তোমাকেও তাদের সাক্ষীরূপে উপস্থিত করব? তাফসীরে জালালাইন কিতাবে উল্লেখ আছে, يشهد عليها و هو نبيها অর্থাৎ তাদের ব্যাপারে তাদের নবীই সাক্ষ্য দেবেন (কুরআন/০৪: ৪১)। সুতরাং প্রমাণিত হল, ঈসা (আ:) দুনিয়াতে পুনরায় এসে উম্মতে মুহাম্মদীয়ার অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও কেয়ামতের দিবসে স্বীয় উম্মতের পক্ষে একজন সাক্ষী ও শাফায়াতকারী হিসেবেও উপস্থিত হতে পারবেন। যেটি শাফায়াতে সুগরারই অন্তর্ভুক্ত।
এইপর্যায় কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্যে আমার প্রশ্ন, হযরত ঈসা (আ:) উম্মতে মুহাম্মদীয়ার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে এমন কী অপরাধ করলেন যদ্দরুন তিনি আপনাদের বিচারে নবুওয়তের মাকাম (স্তর) থেকেই বহিষ্কৃত হয়ে যাবেন? কী জবাব? কেননা মুসলিম উম্মাহার বিশ্বাস কখনো এমন নয় যে, তিনি উম্মতি হিসেবে পুনঃ আগমন করবেন বলে তাঁর নবীত্ব বাতিল হয়ে যাবে! বড়জোর তখন তিনি নবুওয়তের দায়িত্বে থাকবেন না। ফলে একজন নবী হিসেবে কেয়ামতের দিন তাঁর শাফায়াত থেকেও তাঁর উম্মত বঞ্চিত হবেনা, ইনশাআল্লাহ। সুতরাং উল্লিখিত প্রশ্নটিই বাতিল।
আচ্ছা আপনারা যারা মনে করেন যে, ঈসা (আ:) কেয়ামতের দিন উম্মতে মুহাম্মদীয়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবেন বলে তিনি একই সঙ্গে আপনা বনী ইসরাইলী উম্মতের পক্ষে শাফায়াতকারী হতে পারেন না তাদের এহেন অপযুক্তির মার-প্যাঁচে কেয়ামত দিবসে আমাদের প্রিয় নবী (সা:)-এর শাফায়াতে কুবরাও কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। কেননা আপনাদের যেই যুক্তিতে ঈসা (আ:) “উম্মতি” এবং “নবী” এই দুইয়ের কারণে কেয়ামতের দিন দোটানায় পড়ে যাবেন, সেই একই যুক্তিতে আপনারা আমাদের প্রিয়নবীকেও “নিজ উম্মত” আর “অন্যান্য উম্মত” এই দুইয়ের কারণেই দোটানায় ফেলে দিচ্ছেন? নাউযুবিল্লাহিমিন যালিক। অতএব বিষয়টি ভাবা উচিত!
তাছাড়া ঈসা (আ:)-এর ব্যাপারে আপনারা যেই যুক্তিটা প্রদর্শন করে থাকেন তার সমর্থনে কুরআন কিবা হাদীস থেকে দলিল কোথায়?
কাদিয়ানীদের নিকট আমার সর্বশেষ ২টি প্রশ্ন!
(১) মির্যা কাদিয়ানীর বইতে লিখা আছে, যেসব হাদীস কসম সহ উল্লেখ হয়েছে সেটিকে বাহ্যিক অর্থেই গ্রহণ করতে হবে, এর রূপক অর্থ করা চলবেনা। (হামামাতুল বুশরা, বাংলা অনূদিত : পৃষ্ঠা নং ২৭)। মজারব্যাপার হল, ঈসা (আ:)-এর নাযিল সম্পর্কিত হাদীসে “কসম” (والذي نفسى بيده) উল্লেখ রয়েছে। দেখুন, সহীহ বুখারী কিতাবুল আম্বিয়া। এমতাবস্থায় হাদীসটির ঐ ঈসা বা ইবনে মরিয়ম হতে মির্যা কাদিয়ানী উদ্দেশ্য হলে তখন কি সেটিকে রূপক অর্থে গ্রহণ করা হচ্ছেনা? এখন এর কী জবাব দেবেন? অতএব, বনী ইসরাইলী ঈসার পুনঃ আগমন সঠিক নয় বলে যে মন্তব্য করা হয়েছে সেটিই বরং সঠিক নয়!
(২) মির্যা কাদিয়ানীর “নবী” দাবীকে আপনারা যারা স্বীকার করে নিয়েছেন তাদেরকে যদি মৃত্যুর পর কবরে ফেরেশতা জিজ্ঞেস করে যে, তোমার নবী কে? (و من نبيك؟)। ইমাম বুখারীর দাদা ওস্তাদ (শায়খ) সংকলিত হাদীসের প্রাচীনতম গ্রন্থ ‘মুসান্নাফে আব্দ রায্যাক‘ কিতাবুল জানায়েজ, বাবু ফিতনাতিল কবরি, হাদীস নং ৬৭৩৭ দ্রষ্টব্য।
- কবরে সুওয়াল জওয়াব হওয়া সম্পর্কে বুখারীর হাদীসেও উল্লেখ আছে, দু’জন ফিরিশতা কবরে মৃত ব্যক্তির কাছে এসে তাকে জিজ্ঞেস করবেন : مَا كُنْتَ تَقُولُ فِي الرَّجُلِ لِمُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلم. অর্থাৎ এ ব্যক্তি তথা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে তুমি কি বলতে? সহীহ বুখারী, কিতাবুল জানায়েজ, হাদিস নম্বরঃ ১২৯১ (ইফা)।
তাহলে আপনারাও বা কী উত্তর দেবেন? তখন আপনারা উত্তরে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীই আপনাদের নবী ছিল বলবেন? সুতরাং, কেয়ামতের দিন ঈসা (আ:)-এর দোটানায় পড়া নিয়ে চিন্তিত না হয়ে বরং নিজেদের অবস্থা নিয়েই চিন্তিত থাকুন! বিচার-বোধ নিজ হাতে হত্যা না করে নিজের আখেরাত নিয়ে পুনরায় ভাবুন!
- বলে রাখতে চাই, কাদিয়ানীদের অন্যতম একটি বিশ্বাস, কবরে কোনো সুওয়াল জওয়াব হবেনা এবং কোনো ধরণের আযাবও হবেনা। তাই তাদের প্রতি ‘কবরের আযাব সম্পর্কে একটি সহীহ হাদীস’ শিরোনামে আমার এই লিখাটি পড়ার অনুরোধ রইল। Click in here
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক