প্রশ্নকর্তা : “তাওয়াফফা” শব্দটি কুরআনের অসংখ্য স্থানে “মৃত্যু” অর্থের জন্য ব্যবহৃত হলে তবে সেটি শুধু মাত্র কুরআনের দুটি স্থানে (০৩:৫৫;০৫:১১৭) কিজন্য ‘মৃত্যু-ভিন্ন’ অর্থের জন্য ব্যবহৃত হবে?
উত্তরদাতা :
(ক) প্রশ্নকর্তার প্রশ্নে উত্থাপিত দাবীটা পুরোপুরি সঠিক নয়। কেননা পবিত্র কুরআনের (০৩:১৫; ০৬:৬০) আয়াত সহ প্রায় স্থানে উল্লিখিত “তাওয়াফফা” শব্দ “মৃত্যু” অর্থে ব্যবহার হয়নি।
(খ)
প্রশ্নকর্তার উল্লিখিত দাবী সম্পূর্ণ মনগড়া ও তাফসীর শাস্ত্রীয় নীতি-বিরুদ্ধ একটি অর্বাচীন দাবী। তর্কের খাতিরে তার উক্ত দাবী মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য যদি মেনেও নিই তখন তার নিকট নিচের প্রশ্নটির আদৌ কোনো জবাব থাকেনা। প্রশ্নটি হল, পবিত্র কুরআনের অসংখ্য জায়গায় ‘আসহাবুন নার’ (আরবী : أَصْحَابَ النَّارِ) শব্দ ব্যবহার হয়েছে। তন্মধ্যে বাকারা/০২:৩৯,৮১,২১৭,২৫৭; আলে ইমরান/০৩:১১৬; আ’রাফ/০৭:৪৪,৫০; রা’আদ/১৩:০৫; যুমার/৩৯:০৮; মুমিন/৪০:০৬,৪৩; তাগাবুন/৬৪:১০; মুদ্দাচ্ছির/৭৪:৩১ অন্যতম। এখানে মাত্র ১৩টি স্থানের উল্লেখ করা হল। এছাড়া আরো বহু উদাহরণ দেয়া যাবে। কিন্তু পবিত্র কুরআনের ১১৪টি সূরার মধ্যে শুধুমাত্র সূরা মুদ্দাচ্ছির আয়াত নং ৩১ ছাড়া অন্য সবকয়টি স্থানে শব্দটির অর্থ হল “জাহান্নামীগণ“। সূরা মুদ্দাচ্ছির এর ৩১নং আয়াতে উল্লিখিত “আসহাবুন নার” (আরবী : أَصْحَابَ النَّارِ) অর্থ “জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক বা ফেরেশতাগণ” (রেফারেন্স, তাফসীরে ইবনে কাসীর দ্রষ্টব্য)। এখন এর কী জবাব?
নিচে সংশ্লিষ্ট আয়াতটি অর্থসহ তুলে ধরছি।
- মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, وَمَا جَعَلْنَا أَصْحَابَ النَّارِ إِلَّا مَلائِكَةً وَمَا جَعَلْنَا عِدَّتَهُمْ إِلَّا فِتْنَةً لِلَّذِينَ كَفَرُوا ۙ لِیَسۡتَیۡقِنَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ وَ یَزۡدَادَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِیۡمَانًا وَّ لَا یَرۡتَابَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ وَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ ۙ وَ لِیَقُوۡلَ الَّذِیۡنَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ مَّرَضٌ وَّ الۡکٰفِرُوۡنَ مَاذَاۤ اَرَادَ اللّٰہُ بِہٰذَا مَثَلًا ؕ کَذٰلِکَ یُضِلُّ اللّٰہُ مَنۡ یَّشَآءُ وَ یَہۡدِیۡ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ مَا یَعۡلَمُ جُنُوۡدَ رَبِّکَ اِلَّا ہُوَ ؕ وَ مَا ہِیَ اِلَّا ذِکۡرٰی لِلۡبَشَرِ
অর্থ : আর আমি ফেরেশতাদেরকেই জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক বানিয়েছি। আর কাফিরদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ আমি তাদের সংখ্যা নির্ধারণ করেছি। যাতে কিতাবপ্রাপ্তরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে; আর মুমিনদের ঈমান বেড়ে যায় এবং কিতাবপ্রাপ্তরা ও মুমিনরা সন্দেহ পোষণ না করে। আর যেন যাদের অন্তরে রোগ আছে তারা এবং অবশিষ্টরা বলে, এরূপ উপমা দ্বারা আল্লাহ কী ইচ্ছা করেছেন? এভাবেই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন আর যাকে ইচ্ছা সঠিক পথে পরিচালিত করেন। আর তোমার রবের বাহিনী সম্পর্কে তিনি ছাড়া কেউ জানেন না। আর এ হচ্ছে মানুষের জন্য উপদেশমাত্র। (আল-কুরআন/৭৪:৩১)।
(গ)
মির্যা কাদিয়ানী খোদ্ নিজেও আপনা বইতে ‘তাওয়াফ্ফা’ শব্দের ভিন্ন ভিন্ন ৫ ধরণের অর্থ নিয়েছেন। তার লেখিত ৮৩টি বইয়ের সমষ্টি ২৩ খন্ডে প্রকাশিত রূহানী খাযায়েন থেকে সেই অর্থগুলো হচ্ছে ‘পূর্ণ নেয়ামত দানকরা’ [১:৬২০]; ‘পরিপূর্ণ পুরষ্কার দেয়া’ [১:৬৬৪-৬৫]; ‘অপমানকর ও অভিশপ্ত মৃত্যু হতে রক্ষাকরা’ [১২:২৩]; ‘জন্মগ্রহণকরা’ [১৯:৪৯]। তার কৃত অনুবাদের পাঁচ স্থানের মাত্র একটিতেই ‘তাওয়াফফা’ অর্থ মৃত্যু উল্লেখ রয়েছে। অথচ পাঁচ জায়গাতেই তারই কৃত ঊসূল-মতে ‘কর্তা আল্লাহ্ আর কর্ম প্রাণী’ই রয়েছে। তো এবার এখানে কী জবাব দেবেন?
পরিশেষে বলতে পারি, পবিত্র কুরআনের শব্দসমূহের অর্থ-প্রয়োগ সম্পর্কে দাবী করে এভাবে বলা সঠিক নয় যে, অমুক শব্দটি কুরআনের যতস্থানেই এসেছে সেটি সবখানে অমুক অর্থে ব্যবহার হলে তখন অমুক স্থানে তমুক ব্যতিক্রম অর্থে কিজন্য ব্যবহার হতে যাবে!? তার কারণ পবিত্র কুরআনের কোন শব্দটি কোন অর্থে ব্যবহৃত হল সে সম্পর্কে সব চেয়ে ভালো জানতেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তারপর সাহাবায়ে কেরাম। তারপর সাহাবায়ে কেরামের শিষ্যরা তথা বিজ্ঞ তাবেয়ীগণ। তারপর তাবেয়ীদের শিষ্যরা তথা বিজ্ঞ আইম্মায়ে কেরাম ও তাফসীরকারকগণ। তাঁরা পবিত্র কুরআনকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস এবং সাহাবায়ে কেরামের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দ্বারা প্রতি যুগে সব ধরনের বিকৃতি থেকে রক্ষা করেছেন। ফলে তাঁদের ব্যাখ্যা ও বুঝের বিপরীতে যে কোনো ব্যাখ্যা ও বুঝ পুরোপুরি বাতিল এবং পরিত্যাজ্য।
লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী।
লিখক ও গবেষক