বিদগ্ধ হাদীস বিশারদদের দৃষ্টিতে “ওয়া লাল মাহদী ইল্লা ঈসা ইবনে মরিয়ম” – খন্ডিত অংশের বর্ণনাটি কিজন্য দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য, জানতে পড়ুন!
সম্প্রতি ব্রাদার রাহুল ভাইয়ের একটি ভিডিও এর জবাবে কাদিয়ানীদের বর্তমান যিম্মাদার (আমীর) জনাব আব্দুল আউয়াল সাহেবের চরম খেয়ানত ও প্রতারণাপূর্ণ বক্তব্যের সংক্ষিপ্ত জবাব এটি। কারণ তিনি উক্ত বর্ণনাটিকে সহীহ প্রমাণ করতে নানা মিথ্যা, খেয়ানত আর হটকারিতাপূর্ণ চতুরতার আশ্রয় নিয়েছেন। যা একজন জ্ঞানপাপীর পক্ষেই সম্ভব!
প্রাসঙ্গিক লিখা দুটি পড়া জরুরি –
(১) ওয়া লাল মাহদী ইল্লা ঈসা ইবনু মরিয়াম – হাদীসের খণ্ডাংশটির সঠিক অর্থ Click
(২) প্রকৃত ইমাম মাহদী আর কাদিয়ানিদের মির্যা গোলাম আহমদ এই দুইয়ের মধ্যকার পার্থক্য গুলো Click
পর্ব ১
ওয়া লাল মাহদী ইল্লা ঈসা ইবনে মরিয়ম – খণ্ডিত অংশের এই বর্ণনাটি সূত্রের বিচারে সমস্ত হাদীস বিশারদের মতে যঈফ তথা দুর্বল । একথা লিখেছেন, বিশিষ্ট যুগ ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ)। (মেরকাত, কিতাবুল ফিতান, বাবু আশরাতিস সা’আহ باب أشراط الساعة, ভলিয়ম নং ১০)।
খেয়াল করুন :
উক্ত বর্ণনাটি যে চেইনে (Chain/সনদ) বর্ণিত হয়েছে সেখানে সূত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা না হওয়ার সমস্যা বিদ্যমান। তেমনি সূত্রের “মুহাম্মদ বিন খালিদ আল জানাদী” একজন অজ্ঞাত ও অপরিচিত ব্যক্তি বলেও অধিকাংশ হাদীস বিশারদ মত ব্যক্ত করেছেন। তাছাড়া ইমাম যাহাবী’র মীযানুল ই’তিদাল কিতাবে পরিষ্কার করে এই দুটি কথাও উল্লেখ আছে যে, (ভিন্ন আরেকটি চেইন হিসেবে – লিখক) সূত্রের “আবান ইবনে সালেহ” এইধরনের কোনো বর্ণনা “হযরত হাসান বসরী” থেকে শ্রবণ করা প্রমাণিত নয়। তেমনি এই সূত্রের “ইউনুস ইবনে আব্দুল আ’লা” নামক রাবীও হযরত ইমাম শাফেয়ী থেকে শ্রবণ করেননি। মজার ব্যাপার হল, ইমাম শাফেয়ীও এধরণের কোনো বর্ণনা “মুহাম্মদ বিন খালিদ আল জানাদী” হতে শ্রবণ করেননি। ইমাম ইয়াহইয়া বিন মাঈন (রহ:) নিজেও একথা বলেছেন বলে ইমাম যাহাবী এবং ইমাম ইবনে ছুলাহ (মৃত. ৬৪৩ হিজরী) দুইজনই লিখে গেছেন। সুতরাং এইরূপ বহু কারণে উক্ত বর্ণনাটি দলিল প্রমাণ হিসেবে অগ্রহযোগ্য। কারো কারো মতে বানোয়াটও। এবার বিস্তারিত।
এবার বর্ণনাটির অন্যতম সমালোচিত বর্ণনাকারী “মুহাম্মদ বিন খালিদ আল জানাদী” (محمد بن خالد الجندى) সম্পর্কে যুগ বিখ্যাত হাদীস বিশারদদের মতামত দেখুন:-
১- ইমাম আবুল ফাতহ আল আযদী > তার বর্ণনার পেছনে পড়া যাবেনা।
২- ইমাম আবু আব্দুল্লাহ হাকেম নিশাপুরী > সে একজন মাজহুল (অজ্ঞাত) বর্ণনাকারী।
৩- ইমাম বায়হাক্বী > সে একজন অজ্ঞাত বর্ণনাকারী।
৪- শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ > তার বর্ণনা দ্বারা দলিল দেয়া যাবেনা। ইমাম শাফেয়ীর কিতাব ‘মুসনাদে শাফেয়ী’-এর মধ্যে এই হাদীস নেই।
৫- সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাকারক ইবনে হাজার আসকালানী > সে একজন অজ্ঞাত বর্ণনাকারী।
৬- ইমাম ইবনে কাসীর > সে মাজহুল নন যেমনটি ইমাম হাকেম (রহ:) মনে করেন। বরং ইবনে মাঈন থেকে বর্ণিত আছে, তিনি তাকে ছিকাহ আখ্যা দিয়েছেন (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)। ইমাম ইবনে কাসীর (রহ.)-এর এই বক্তব্যে সাধারণদের জন্য বিভ্রান্ত হবার কোনো কারণ নেই। কেননা ইবনে মাঈন (রহ.)-এর ঐ বক্তব্যটি ইবনে মাঈনের নামে প্রচার হলেও সেটি প্রকৃতপক্ষে অপ্রমাণিত। যেজন্য স্বয়ং ইমাম যাহাবী (রহ.) নিজেও এটি লিখার সময় والله اعلم বা আল্লাহই ভালো জানেন, বলে লিখে গেছেন। এ সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
এই পর্যায় কাদিয়ানী আমীর জনাব আব্দুল আউয়াল সাহেব যে জঘন্য খেয়ানত আর প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন সেটি হল,
তিনি ইবনে মাঈন (রহ:) এর নাম ভেঙ্গে ইবনে কাসীর (রহ:)-এর উদ্ধৃতিতে ঐ কথাটি খুব জোরালোভাবে উল্লেখ করলেও ইবনে মাঈনের বক্তব্যের পরের অংশটি আস্তে করে এড়িয়ে যান। ইবনে মাঈন থেকে ঐ একই বক্তব্যের শেষাংশে এটিও লিখা আছে و روى عنه ثلاثة رجال سوى الشافعي অর্থাৎ আর তার কাছ থেকে ইমাম শাফেয়ী ব্যতীত তিন ব্যক্তিই বর্ণনা করত। (দেখুন, ইমাম যাহাবী’র মীযানুল ই’তিদাল ৩/৫৩৫ দ্রষ্টব্য)। এতে সুস্পষ্ট প্রমাণিত হল যে, ঐ “লাল মাহদী” – ওয়ালা বর্ণনাটির সূত্র মুনকাতি তথা বিচ্ছিন্ন। কেননা মুহাম্মদ ইবনে খালিদ আল জানাদি থেকে ইমাম শাফেয়ী কিছুই বর্ণনা করেননি বলে খোদ ইবনে মাঈন (রহ:) থেকেও প্রমাণিত। সুতরাং কাদিয়ানীদের জন্য মোটেও উচিত হবেনা যে, ইবনে মাঈন (রহ:)-এর সম্পূর্ণ বক্তব্যের কিছু অংশ বাদ দিয়ে আর কিছু অংশ নেয়া! এটি মস্তবড় খেয়ানত (জালিয়াতি) নয় কি? তাই জনাব আব্দুল আউয়াল তার এই জালিয়াতির জন্য অন্তত স্বজাতির নিকট ক্ষমা চাওয়া উচিত! কেননা তার অনুসারীদের অনেকে এমনও রয়েছেন যারা সরলমনে তার কথা বিনাবাক্যে বিশ্বাস করে ফেলেন!
৭- ইমাম যাহাবী > এই বর্ণনা মুনকার বা অগ্রহণযোগ্য। সনদে উল্লিখিত ইউনুস নামক ব্যক্তি হযরত শাফেয়ী থেকে এই বর্ণনা শুনেনি।
৮- বিশিষ্ট হাদীস বিশারদ ইমাম আব্দুর রহমান ইবনে ইয়াহইয়া আল-মু’আল্লিমী > و لم يثبت هذا عن ابن معين অর্থাৎ হযরত ইয়াহইয়া বিন মাঈন হতে তার ছিকাহ (বিশ্বস্ত) হওয়ার কথাটি প্রমাণিত নয়।
৯- রিজালশাস্ত্রের হেভিওয়েট স্কলার ইমাম ছাগানী > এই বর্ণনা মওদ্বু বা বানোয়াট।
১০- ইমাম নাসাঈ > সে (মুহাম্মদ বিন খালিদ আল জানাদী) একজন মুনকার বা অগ্রহণযোগ্য।
১১- ইমাম আব্দুল বার > তিনি দুর্বল এবং মাতরূক বা পরিত্যাজ্য এবং و لا يثبت هذا الحديث অর্থাৎ এটি হাদীস হিসেবে প্রমাণিত নয়।
১২- ইমাম ত্বীবি (রহ:) খণ্ডিত অংশের অর্থ করেছেন, معناه لا مهدى كاملا معصوما إلا عيسى بن مريم অর্থাৎ এর অর্থ হল, তখন ঈসা ইবনে মরিয়ম-ই একজন নিষ্পাপ ও পরিপূর্ণ সুপথপ্রাপ্ত হবেন (মেরকাত কিতাবুল ফিতান, টীকা দ্রষ্টব্য)। এবার সম্পর্কিত তথ্যের জন্য সংযুক্ত স্ক্রিনশট –
- রেফারেন্স : ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী’র তাহযীবুত তাহযীব ৯/১২৬; আল আ’মালী, ইমাম ইবনে ছুলাহ ৪৮-৫২; ইমাম যাহাবী’র মীযানুল ই’তিদাল ৩/৫৩৫।
➡️ বিস্তারিত ২য় পর্বে আসছে। সবাই লিখাটি প্রচার করে মিথ্যাবাদী আর প্রতারকদের মুখোশ উন্মোচন করে দিন।
(অসমাপ্ত)
লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী