মুহাম্মদ ইবনে খালিদ আল জানাদীকে ইবনে মাঈন (রহ.) সিকাহ আখ্যা দেয়া কি প্রমাণিত? মুহাদ্দিসীনদের অভিমত :
ইমাম ইবনে মাঈন (রহ.) মুহাম্মদ ইবনে খালিদ আল জানাদীকে “সিকাহ” (বিশ্বস্ত) বলার নেপথ্য গল্পের একটু গভীরে চলুন। তাহলেই পরিষ্কার হতে পারবেন যে, ইবনে মাঈন (রহ.) এর নামে এই কথা ভিত্তিহীন। ইমাম আবু সা’আদ আস সাম’আনী أبو سعد السمعاني (৫০৬-৫৬২) রচিত কিতাবুল আনসাব (كتاب الأنساب) এর তৃতীয় খণ্ডের ৩৫১ নং পৃষ্ঠায় (রাবী নং ৯৫৫, অধ্যায় নং ৯৪১) পরিষ্কার করে লিখা আছে, لم يثبت هذا عن ابن معين অর্থাৎ ইমাম ইবনে মাঈন (রহ.) সম্পর্কে এই দাবীর ভিত্তি নেই। বিশিষ্ট হাদীস বিশারদ ইমাম আব্দুর রহমান ইবনে ইয়াহইয়া আল-মু’আল্লিমী [الامام المعلمى] আশ-শাফেয়ী (১৩১৩-১৩৮৬ হিজরী)ও একই কথা বলেছেন। যেমন তিনি লিখেছেন, و لم يثبت هذا عن ابن معين অর্থাৎ হযরত ইয়াহইয়া বিন মাঈন হতে তার ছিকাহ (বিশ্বস্ত) হওয়ার কথাটি প্রমাণিত নয় [ইবনুস সুলাহ কৃত ‘আল আমালী’ (الأمالى لابن الصلاح) পৃষ্ঠা নং ৫২]।
কাজেই ইবনে মাঈন (রহ.)-এর নাম ভেঙ্গে কাদিয়ানী আমীর জনাব আব্দুল আউয়াল সাহেব যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি সঠিক নয়। তিনি খুব সম্ভব জেনে-বুঝেই তার ভক্তদের প্রতারিত করেছেন। অনেকটা আসহাবে কাহাফের ঐ সাত যুবককে ঘুমন্ত দাজ্জাল বলে ব্যাখ্যা দেয়ার মতই। জনাব আব্দুল আউয়াল সাহেব ইমাম ইবনে মাঈন (রহ.) সম্পর্কিত কথাটি পেশ করার ক্ষেত্রে ইমাম যাহাবী (রহ.)-এর আংশিক বক্তব্যই উল্লেখ করেছেন। অথচ ইমাম যাহাবীর ঐ বক্তব্যের পরেই والله اعلم (আল্লাহই ভালো জানেন) কথাটুকুও রয়েছে, যাতে প্রমাণিত হয় যে, ইমাম যাহাবী (রহ.) হতে ইবনে মাঈন (রহ.)-এর “সিকাহ” সংক্রান্ত উক্তিটি দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত কোনো কথা ছিলনা। কিন্তু আব্দুল আউয়াল সাহেব এটি চেপে গেছেন। মজার ব্যাপার হল, বিশ্ববিখ্যাত ইমাম ইবনুস সুলাহ (রহ.)ও পরিষ্কার করে বলে গেছেন, فان هذا لم يثبت له وصف العدالة অর্থাৎ ‘তবে অবশ্য তার (মুহাম্মদ ইবনে খালিদ আলজানাদী) ক্ষেত্রে কোনো রকম আদালত (ন্যাপরায়ণতা/বিশ্বস্ততা/গ্রহণযোগ্য) এর কোনো গুণাগুণ প্রমাণিত নয়।’ [আল আমালী পৃষ্ঠা নং ৫২, ইমাম আবু উমর ইবনুল মুফতি সালাহউদ্দীন আব্দুর রহমান ইবনে উসমান ইবনে মূসা আল কুরদি আশ শাহরুযুরী আল মুছুলি ইবনুস সুলাহ (৫৭৭-৬৪৩ হিজরী)]।
অধিকন্তু আব্দুল আউয়াল সাহেব ইমাম ইবনে মাঈন (রহ.)-এর আরেকটি কথাও পুরোপুরি এড়িয়ে যান। সেটি হল, ইমাম ইবনে মাঈন (রহ.) বলেছেন, و روى عنه ثلاثة رجال سوى الشافعي অর্থাৎ আর তার (মুহাম্মদ ইবনে খালিদ আল জানাদী) কাছ থেকে তিন ব্যক্তিই হাদীস বর্ণনা করেছেন, ইমাম শাফেয়ী (কোনো কিছুই) বর্ণনা করেননি। ইমাম যাহাবী লিখেছেন, সনদের ইউনুস ইবনে আব্দুল আ’লা এর সূত্রে একটি দল এটি বর্ণনা করেছে। কিন্তু বিশুদ্ধ কথা হল, والصحيح انه لم يسمعه منه অর্থাৎ ইউনুস ইমাম শাফেয়ীর কাছ থেকে বর্ণনাটি শুনেননি। (দেখুন, ইমাম যাহাবী’র মীযানুল ই’তিদাল ৩/৫৩৫ দ্রষ্টব্য)। আবার বর্ণনাটির আরেক রাবী ابان ابن ابى عياش (আবান ইবনে আবী আয়্যাশ) সম্পর্কে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) লিখেছেন, و هو متروك অর্থাৎ সে একজন পরিত্যাজ্য ও মিথ্যাবাদী। (তাহযীবুত তাহযীব ৯/১৪৪, ইবনে হাজার আসকালানী)। এমনকি তাহযীবুল কামাল কিতাবের ২৫ নং খণ্ডের ১৫০ নং পৃষ্ঠায় (রাবী নং ৫১৮১) পরিষ্কার লিখা আছে, قال الشافعى ما هذا من حديثى و لا حدثت به، كذب على يونس অর্থাৎ ইমাম শাফেয়ী বলেছেন যে, এটি আমার বর্ণিত কোনো হাদীস নয়। আমি এমন হাদীস বর্ণনা করিনি। ইউনুস (-এর সূত্রে) আমার উপর অসত্য আরোপ করেছে। এছাড়া প্রায় ডজনের অধিক স্কলারদের মতে و لا المهدى الا عيسى ابن مريم শীর্ষক রেওয়ায়েতটি দুর্বল এবং মুনকার ও মিথ্যাবাদী রাবী দ্বারা বর্ণিত। আফসোস! কাদিয়ানীদের নিকট এই স্তরের বর্ণনাও অথেনটিক ও দলিলযোগ্য! তারা ইমাম যাহাবীর আংশিক বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনে মাঈনের যেই মতটির প্রচার করে বেড়ায় সেটি ভিত্তিহীন ও অপ্রমাণিত হওয়া স্বয়ং ইমাম যাহাবীরই ঐ একই উক্তি হতেই পরিষ্কার। কিন্তু কাদিয়ানীরা কত জঘন্য প্রতারক হলে সত্য-মিথ্যা মিশ্রিত করে কালোকে সাদা বানানোর স্পর্ধা দেখাতে পারে, চিন্তা করুন! আমরা তাদেরকে আল্লাহর নিকট সোপর্দ করলাম।
এখানে কয়েকটি বিষয় সুস্পষ্ট,
(১) ইমাম ইবনে মাঈন (রহ.) মুহাম্মদ ইবনে খালিদ আল জানাদীকে “সিকাহ” বলার ব্যাপারটি ইমাম যাহাবী সহ বেশ কয়জন ইমামই অপ্রমাণিত বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। (তার কারণ নিচে উল্লেখ করা হবে)। (২) যে বর্ণনায় و لا المهدى الا عيسى ابن مريم অংশটিও রয়েছে সেটিতে সূত্রের বিচারে انقطاع তথা সূত্র-বিচ্ছিন্নতার ক্রুটি রয়েছে। কারণ মুহাদ্দিসগণ বলেছেন, উক্ত সনদে উল্লিখিত মুহাম্মদ ইবনে খালিদ আল জানাদী থেকে ইমাম শাফেয়ী (রহ.)-এর سماع তথা শ্রবণ প্রমাণিত নয়। ইমাম যাহাবী (রহ.) মীযানুল ইতিদাল কিতাবে এসব পরিষ্কার করে দিয়ে গেছেন। রেফারেন্স উপরে দেয়া হয়েছে, আবার দেখুন।
এবার জানার বিষয় হল, ইমাম যাহাবী সহ অন্যান্য ইমামগণ ইমাম ইবনে মাঈন (রহ.)-এর “সিকাহ” (বিশ্বস্ত) বলার মতটি অপ্রমাণিত বলেছেন কেন?
এর উত্তর হল, বর্ণনাটির সনদে উল্লিখিত ইউনুস ইবনে আব্দুল আ’লা (রহ.) একটি গল্প বলেছেন। গল্পটি ‘মানাকেবুশ শাফেয়ী‘ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। গ্রন্থকার ইমাম আবুল হাসান মুহাম্মদ ইবনে হোসাইন আল আবুরী (ابو الحسن محمد بن الحسين الاّبري) (রহ.) [মৃত. ৩৬৩ হিজরী] গল্পটি সনদ সহ উল্লেখ করেছেন। সনদ সহ গল্পটি এরকম, فقال: اخبرني محمد بن عبد الرحمن الهمذاني ببغداد قال: حدثنا محمد بن مخلد وهو العطار وقال : حدثنا أحمد بن محمد بن المؤل العدوي قال: قال لي يونس بن عبد الأعلى : جاءني رجل قد وخطه الشيب سنة ثلاث عشر يعني و مائتين عليه مبطنة وازير يسألني عن هذا الحديث فقال لي : من محمد بن خالد الجندي ؟ فقلت : لا ادري . فقال لي : هذا مؤذن الجند وهو ثقة . فقلت له : انت يحيى بن معين ؟ فقال نعم…الخ
অর্থাৎ (সনদ/সূত্র) মুহাম্মদ ইবনে আব্দুর রহমান আল হামদানী, মুহাম্মদ ইবনে মুখলাদ, আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুয়াল আল-আদাবী। (গল্পটি হচ্ছে), আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুয়াল আল-আদাবী বলেছেন, আমাকে ইউনুস ইবনে আব্দুল আ’লা বলেছেন, আমার নিকট এক ব্যক্তি এসে এই হাদীস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন যে, মুহাম্মদ ইবনে খালিদ আল জানাদী সম্পর্কে তোমার ধারণা কী? আমি বললাম, আমি জানিনা। তখন সে আমাকে বলল, সে ইয়েমেনের “আল-জানাদ” এলাকার একজন মুয়াজ্জিন আর সে একজন সিকাহ। অত:পর আমি তাকে বললাম, তুমি কি ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন? তিনি বললেন, জ্বী হ্যাঁ। (মানাকেবুশ শাফেয়ী)। অনুরূপ গল্পটি ইমাম যাহাবী’র ‘তাহযীবুত তাহযীব’ এর মধ্যেও (৯/২৪৪) উল্লেখ রয়েছে, তবে সেখানে এর কোনো সনদ উল্লেখ করা হয়নি।
এবার উক্ত গল্পের সনদ ও আনুষাঙ্গিক কিছু শিক্ষা:-
গল্পটি কয়েকটি কারণে প্রমাণযোগ্য নয়। ফলে এর উপর ডিফেন্ড করে এমন একজন রাবীকে ইবনে মাঈন (রহ.) “সিকাহ” বলেছেন বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা অসম্ভব, যাকে জরাহ-তাদীলের ইমামগণ সর্বসম্মতিক্রমে অজ্ঞাত (مجهول) এবং দুর্বল বলেই সিদ্ধান্ত দিয়ে গেছেন। কেননা,
(১) ইউনুস ইবনে আব্দুল আ’লা-এর মত একজন হাদীসের প্রসিদ্ধ বর্ণনাকারী মুহাম্মদ ইবনে খালিদ আল জানাদীর ব্যাপারে জানতে চেয়ে ইবনে মাঈনের প্রশ্নের উত্তর দেবেন অথচ ইবনে মাঈনকেই তিনি তখন চিনলেন না, বরং ইবনে মাঈন নিজের পরিচয় দিয়ে নিজেকে পরিচিত করতে হল, এটা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। কারণ সেই যুগে ইবনে মাঈন (রহ.)-এর মত প্রসিদ্ধ একজন ব্যক্তিকে ইউনুস ইবনে আব্দুল আ’লা চেনবেন না, তা হতে পারেনা।
(২) আর গল্পের ধারাবাহিক সূত্রে “আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুয়াল আল-আদাবী” নামীয় এমন এক ব্যক্তি রয়েছেন যাকে খতিব আল বাগদাদী (রহ.) তার ‘তারিখে বাগদাদ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি ইউনুস ইবনে আব্দুল আ’লা এবং হাসান ইবনে উরফা হতে রেওয়ায়েতকারী। কিন্তু তার সম্পর্কে কোনো জরাহ এবং আদল কিছুই খোঁজে পাওয়া যায়না, ফলে সে এক প্রকারের অজ্ঞাত (مجهول) রাবীই বলে গণ্য হন। সুতরাং যে বর্ণনাসূত্রে এধরণের রাবীও রয়েছে সেই সূত্রে প্রাপ্ত কোনো গল্পের তথ্যের উপর কিভাবে ডিফেন্ড করা যায়? কিভাবে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে অপরাপর সমস্ত ইমামের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে, ইবনে মাঈন (রহ.) মুহাম্মদ ইবনে খালিদ আল জানাদীকে “সিকাহ” বা বিশ্বস্ত বলেছেন? অধিকন্তু ইমাম যাহাবী সহ অনেকেই এই মতের বিরুদ্ধে অনাস্থা দিয়েছেন এবং প্রমাণিত নয় বলেও অভিমত দিয়ে গেছেন।
সুতরাং, এমতাবস্থায় তাকওয়া আর নিরপেক্ষ বিবেকের দাবী হল, ইমামগণের সর্বসম্মত মতামতের প্রতিই শ্রদ্ধা রাখা ও অগ্রাধিকার দেয়া। মেশকাত কিতাবের ব্যাখ্যাগ্রন্থ “মেরকাত” এর লিখক মোল্লা আলী ক্বারী (রহ.) লিখেছেন, এই বর্ণনা সূত্রের বিচারে সমস্ত হাদীস বিশারদের সর্বসম্মতিক্রমে জঈফ তথা দুর্বল (ضعيف باتفاق المحدثين) । (মেরকাত, কিতাবুল ফিতান, বাবু আশরাতিস সা’আহ باب أشراط الساعة, ভলিয়ম নং ১০, পৃষ্ঠা নং ১০১)। এতেও প্রমাণ হয় যে, ইবনে মাঈনের নামে চালিয়ে দেয়া কথিত ‘সিকাহ’ এর মতটি অপ্রমাণিত ও মিথ্যা। অন্যথা মোল্লা আলী ক্বারী (রহ.) কখনো এর দুর্বল হবার সিদ্ধান্তে “সর্বসম্মতিক্রমে” শব্দ ব্যবহার করতেন না। অতএব, কাদিয়ানীদের জন্য কোনোভাবেই উচিত হবেনা, এই ধরনের একটি পরিত্যাজ্য ও মুনকার রেওয়ায়েতের উপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া, যা অপরাপর অসংখ্য সহীহ হাদীস ও তাওয়াতূর পর্যায়ের হাদীস এবং উম্মাহার ইজমায়ী আকীদার বিরুদ্ধে! (প্রয়োজনীয় স্ক্রিনশট সংযুক্ত)।
সংক্ষেপে,
প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী এম. এ