ইমাম মাহদী এবং নবী দাবীদার সালেহ বিন তারিফ সম্পর্কে

0
ইমাম মাহদী এবং নবী দাবীদার সালেহ বিন তারিফ সম্পর্কে

কে এই সালেহ বিন তারিফ? যিনি শুধু ইমাম মাহদী হবার দাবী করেননি, বরং নিজেকে “নবী”ও দাবী করেছিলেন! ৭৪৪ সালে “নবী” দাবীকারী এই লোকটি ৭৯১ সাল পর্যন্ত বারঘৌতা বারবার (Barghawata মরক্কো কেন্দ্রিক একটি রাজ্য) এর শাসক-ও ছিলেন! আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এই মিথ্যা ইমাম মাহদী আপনা দাবীর উপর প্রায় ৪৭ বছর স্থায়ী ছিলেন!

সালেহ বিন তারিফ
Western Eurasia and North Africa c. 800, showing the Barghawata in central Morocco

বিস্তারিত ইতিহাস :

সালিহ ইবনে তারিফ (صالح بن طريف) এর পিতার নাম ছিল তারিফ ইবনে মালেক। তিনি ছিলেন ‘বারঘৌতা বারবার’ (বর্তমান মরক্কোর একটি প্রসিদ্ধ এলাকা) রাজ্যের নেতা ও প্রথম রাজা। তার মৃত্যুর পর পুত্র সালেহ ইবনে তারিফ দ্বিতীয় রাজা হিসেবে নির্বাচিত হন। তার জন্ম – ১১০ হিজরী মুতাবেক ৭২৮ খ্রিস্টাব্দে। তিনি নিজেকে “সালেহুল মুমিনীন” নামক নতুন একধর্মের ‘নবী’ বলে ঘোষণা দেন। ৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া খলীফা হিশাম ইবনে আব্দুল মালিকের খিলাফতকালে তিনি ‘নবী‘ দাবী করেন। Click তিনি নবী দাবীর উপর প্রায় ৪৭ বছর সময় অতিবাহিত করে রাজ্য ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তিনি নিরুদ্দেশ হওয়ার পূর্বে নিজ পুত্র ইলিয়াস বিন সালেহকে (৭৯২-৮৪২) তার ধর্মের উপর অবিচল থাকতে বলেন। ২২৪ হিজরীতে পুত্রের মৃত্যুর পর পৌত্র ইউনুস ইবনে ইলিয়াস (৮৪২-৮৮৮) এই ধর্মের সেবা করেন এবং যারা সালেহ এর ধর্ম গ্রহণ করত না তিনি তাদেরকে হত্যাও করতেন। তারপর রাজত্ব করেন আবু গুফাইল মুহাম্মদ (৮৮৮-৯১৭)। ইবনু খালদুনের সূত্রমতে ইনিও নবী দাবী করেছিলেন। তারপর আবু আল আনসার আব্দুল্লাহ (৯১৭-৯৬১)। তারপর ২২ বছর বয়সে রাজ্যের শাসক হন আবু মনসুর ঈসা (৯৬১-?)। রাজ্যের প্রশাসনিক অবস্থা আস্তে আস্তে দুর্বল হতে থাকে। অত:পর ৪৫১ হিজরীতে (আনুমানিক ১০৬৮ সালে) আলমুরাবিত রাজ-বংশের মুসলিম বীর সিপাহসালার ইউসুফ ইবনে তাসফিন (রাজত্বকাল ১০৬১-১১০৬ খ্রি.) বারঘৌতা বারবার রাজ্যকে যুদ্ধের মাধ্যমে জয় করে নেন এবং উক্ত ধর্মের বিলুপ্তি ঘটান। পরবর্তীতে সালেহ ইবনে তারিফ এর প্রতিষ্ঠিত পুরো সাম্রাজ্য ইসলামের মূলধারার অনুসারী ‘আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত’-এর অধিভুক্ত হয়। এই ভিডিওটি শুনুন

সালেহ বিন তারিফ পবিত্র কুরআন থেকে নিজের পক্ষে দলিল প্রমাণও পেশ করেন। পবিত্র কুরআনের সূরা আত-তাহরীম-এর অন্যতম আয়াত وَإِن تَظَاهَرَا عَلَيْهِ فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ مَوْلاَهُ وَجِبْرِيلُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمَلاَئِكَةُ بَعْدَ ذَلِكَ ظَهِيرٌ হতে তিনি তার ধর্মের নামকরণ করেন صَالِحُ الْمُؤْمِنِينَ বা সালেহুল মুমিনীন।

মজার ব্যাপার হল, সালেহ ইবনে তারিফ একজন ইমাম মাহদী দাবীদারও ছিলেন। তিনি যেই বছর ইমাম মাহদী দাবী করেন তার পরের বছর অর্থাৎ ১২৬ হিজরীতেই একই রমাযানে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহনের ঘটনাও ঘটেছিল এবং তিনি রাজ্য শাসন করেছেন ১৭৪ হিজরী পর্যন্ত। এ সময়ে (অর্থাৎ ১২৫-১৭৪ হিজরী) একই রমাযান মাসে চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণ সংঘটিত হয়েছে চার বার। যথাক্রমে ১২৬ হিজরীতে (৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে), ১২৭ হিজরীতে (৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে), ১৭০ হিজরীতে (৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে) এবং ১৭১ হিজরীতে (৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে)। এ সম্পর্কে দেখা যেতে পারে, কাদিয়ানীদের ‘পাক্ষিক আহমদী‘ পৃ-২৫, তাং ১৫ই এপ্রিল ২০১৫ইং।

কাদিয়ানীদের পাক্ষিক আহমদি সাময়িকী

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে খালদুনের সূত্র অনুসারে, তিনি ৮০টি সূরা সহ আল্লাহর কাছ থেকে একটি নতুন কিতাব পেয়েছেন বলে দাবি করেন, যার মধ্যে কোনো কোনোটির নাম নবীগণের নামেও রয়েছে। যেমন, প্রথম সূরার নাম ছিল সূরা আইয়ুব আর শেষ সূরার নাম ছিল সূরা ইউনুস। এছাড়া সূরা নূহ, সূরা ইবলিশ নামেও ছিল। অন্যান্য বহু জিনিসের নামেও সূরার নামকরণ ছিল। যেমন হাঁস, উট, হাতি, হারুত, মারুত, কারূন, হামান, ইয়াজুজ, মাজুজ, দাজ্জাল, তালূত, নমরুদ ও গারায়িবুদ দুনিয়া ইত্যাদি। তার অনুসারীরা তাদের প্রার্থনায় এই সূরা (অধ্যায়) গুলো পড়তো। তিনি তার অনুসারীদের জন্য শরীয়ত (আইন)ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাদেরকে “সালেহুল মুমিনীন” (অর্থাৎ বিশ্বাসীদের সংশোধনকারী) নামে ডাকা হত। তার দাবিকৃত তথাকথিত ওহীগুলো ‘বারবার’ নামীয় ভাষায় লিখিত ছিল আর সে এগুলোকে ৮০টি সূরা বিশিষ্ট নতুন একটি কোরআন নাম দিয়ে প্রচার করেছিল। (কিতাবুল ই’বর [العبر وديوان المبتدأ والخبر] লি ইবনি খালদূন দ্রষ্টব্য)। উল্লেখ্য, “বারবার (ইংরেজি : Berber)” একটি হাজার বছরের পুরনো ভাষা যেটি দক্ষিণ আফ্রিকা, মরক্কো, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, লিবিয়া এবং মালি রাষ্ট্রসমূহে এখনো প্রচলিত। সূত্র (Click)। সালেহ বিন তারিফের ঘোষণা মতে, তার পরে আর কাউকে নবী বানানো হবে না অর্থাৎ সে নিজেই একজন শেষনবী।

‘বার্ঘৌতা বারবার’ রাজ্যের দ্বিতীয় রাজা সালেহ ইবনে তারিফ নিজেকে ইমাম মাহদী বলেও দাবী করেন এবং প্রচার করতে থাকেন যে, হযরত ঈসা (আ.) তাঁর সঙ্গী হবেন এবং তাঁর পিছনে সালাত আদায় করবেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, আরবী ভাষায় তার নাম ‘সালেহ’, সিরিয়াক ভাষায় ‘মালিক’, পার্সিয়ান ভাষায় ‘আলিম’, হিব্রু ভাষায় ‘রুবিয়া’ এবং বারবার ভাষায় ‘ওয়ারবা’ তথা শেষনবী। সালেহ বিন তারিফ নবুওয়ত দাবীর ৪৭ বছরে পৌঁছার পর বার্ঘৌতা বারবার রাজ্য ছেড়ে পূর্ব আফ্রিকার দিকে কোথাও আত্মগোপনে চলে যান এবং তার উত্তরাধিকারীদের সপ্তম রাজার রাজত্বে পুনরায় ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দেন।

তিনি তার ছেলে ইলিয়াসকে আন্দালুসের উমাইয়া শাসকদের সমর্থন করতে এবং নিজেদেরকে প্রকাশ্যে ইসলামের পক্ষের শক্তি বলে দাবী করতে বলে যান। তিনি আরো বলে যান যে, যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠলে তখনি যেন তার ‘সালেহুল মুমিনীন’ ধর্ম প্রকাশ্যে প্রচার করেন। ইতিহাস সাক্ষী যে, তার পৌত্র ইউনুস ইবনে ইলিয়াস পিতামহের ওসীয়তটি আমলে নেন। অর্থাৎ শক্তিশালী হওয়ার পরই তিনি উক্ত ধর্ম প্রচারের কাজ প্রকাশ্যে আঞ্জাম দিতে থাকেন।

কিছু সূত্র অনুসারে, সালিহ ইবনে তারিফ নিজেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উত্তরসূরী বলে মনে করতেন। সালেহ ইবনে তারিফের ১০ জন শিষ্য এবং অনেক স্ত্রী ছিল। ঐতিহাসিক ইবনে খালদূন লিখেছেন, সালেহ ইবনে তারিফ একজন আন্দুলুসীয় ইহুদীবংশীয় ছিলেন। তিনি উবায়দুল্লাহ মু’তাজিলির কাছ থেকে জ্যোতিষশাস্ত্রের উপর দক্ষতা অর্জন করেন এবং যাদু বিদ্যায় পারদর্শীও ছিলেন। তিনি সাধারণ মানুষদের এগুলোর মাধ্যমে সহজেই নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে পারতেন। তিনি মৃতদের সাথে কথা বলতে এবং অসুস্থদের সুস্থ করতে সক্ষম বলেও দাবি করতেন।

  • ইসলামের সাথে বৈপরীত্যের অন্যান্য নীতিগুলোর মধ্যে রয়েছে চুরির জন্য মৃত্যুদণ্ড, একজন পুরুষের সীমাহীন সংখ্যক স্ত্রী রাখার অনুমতি, রমাযানের পরিবর্তে রজব মাসে রোজার প্রচলন করা, ১০ই জিলহজ্জ মাসের পরিবর্তে ২১শে মহররমে কুরবানির প্রচলন করা। পাঁচ ওয়াক্তের পরিবর্তে দৈনিক দশ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের প্রচলন করা, সম্পূর্ণ নামায ইশারায় পড়া তবে শেষ রাকাতে একত্রে শুধু ৫টি সেজদা দেয়া। অজু, নামাজের নিয়মে পরিবর্তন এবং চাচাতো ভাইয়ের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ করা এবং জানাবতের গোসল মওকুফ ইত্যাদি। সালেহ বিন তারিফের উক্ত ধর্মের বিশদ বিবরণ অনেক আরবীয় সূত্রেও উল্লেখ রয়েছে। তাদের মধ্যে ঐতিহাসিক ইবনে হাজম, ইবনে খালদুন, ইবনে আছীর প্রমুখ অন্যতম।
সালেহুল মুমিনীনধর্মের অনুসারীদের নামাজের দৃশ্য

ইসলামী সাহিত্যে সালেহ ইবনে তারিফের মতবাদ ও বিশ্বাসকে কুফুরী বলে মনে করা হয়। তবে আধুনিক কিছু ‘বারবার’ কর্মী সালেহ বিন তারিফকে উমাইয়াদের বিজয়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং বারঘৌতা রাজ্যের ভিত্তি স্থাপনের জন্য একজন নায়ক হিসাবে বিবেচনা করে থাকে। বলাবাহুল্য, সালেহ ইবনে তারিফ কর্তৃক প্রবর্তিত ও প্রচারিত ধর্মটি প্রায় সাড়ে তিন’শ (৩৫০) বছর পর্যন্ত আফ্রিকায় খুব দাপটের সাথে প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং বহু মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। কিন্তু ১০ম শতকের শেষের দিকে আলমুরাবিত রাজ-বংশের মুসলিম বীর সিপাহসালার মুসলিম সেনাপতি ইউসুফ বিন তাসফিন এর নেতৃত্বে একটি যুদ্ধের মাধ্যমে সালেহ বিন তারিফের উক্ত রাজত্বসহ তার মিথ্যা ধর্ম পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় এবং অল্প বছর কতেকের মধ্যেই মিথ্যাধর্মটির বিলুপ্তি ঘটতে শুরু করে।

মুসলিম সেনাপতি ইউসুফ বিন তাসফিন

আলমুরাবিত ছিল মরক্কো কেন্দ্রিক একটি ‘বারবার’ ভাষীয় সুন্নী মুসলিম রাজবংশ। মুসলিম সেনাপতি ইউসুফ বিন তাসফিন (মৃত. ১১০৬) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আলমুরাবিতের রাজধানী ছিল (মরক্কোর একটি বিখ্যাত শহর) মারাকেশ। তিনি ছিলেন আমীর আবুবকর ইবনে উমরের অধীনস্থ একজন মুসলিম সেনাপতি। ‘মারাকেশ’ এমন একটি শহর যেটি আমীর আবু বকরের হাত ধরে প্রায় ১০৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাজবংশটি উদ্ভব হয়েছিল লামতুনা, গুদালা, পশ্চিম সাহারার যাযাবর বারবার উপজাতি, ড্রা এবং নাইজারের মধ্যবর্তী অঞ্চল জুড়ে ও সেনেগাল নদীর পাশে। উল্লেখ্য, আমীর আবু বকর ইবনে উমর (মৃত. ১০৮৭ইং) ছিলেন সেনাপতি ইউসুফ ইবনে তাসফিন এর চাচাত ভাই। তিনি ‘লামতুনা’ গোত্রের একজন স্বাভাবিক নেতা ও ইবনে ইয়াসিনের অন্যতম শিষ্য, যিনি ইসলামী বিচার বিভাগের মালেকি ফিকহের অনুসারী হিসেবে বিচারালয়ের কাজ করতেন। তিনি তার ভাই ইয়াহিয়া ইবনে উমর আল-লামতুনির মৃত্যুর পর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন। তার ভাই ছিলেন ইবনে ইয়াসিনের সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধায়ক। কিন্তু তিনি ১০৫৬ সালে গোদালা উপজাতিদের বিরুদ্ধে তাবফারিলার যুদ্ধে নিহত হওয়ার তিন বছর পর ইবনে ইয়াসিনও বারঘাওয়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিহত হন।

সূত্র : অনলাইন (উইকিপিডিয়া, আরবী ও ইংরেজি সহ বিভিন্ন এ্যারাবিক ব্লগ এবং বেশ কিছু আরবী ইউটিউব চ্যানেল)।
ভাষান্তর – লিখক ও শিক্ষাবিদ
প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী এম.এ
এডমিন www.markajomar.org

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here