খ্রিস্টান পাদ্রী ডেপুটি আব্দুল্লাহ আথহাম সম্পর্কে মির্যা কাদিয়ানীর ভবিষ্যৎবাণী প্রসঙ্গে:
প্রশ্নকর্তা : মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী খ্রিস্টান পাদ্রী ডেপুটি আব্দুল্লাহ আথহাম সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করেছিল যে, তিনি ১৫ মাস পর মারা গিয়ে হাবিয়া দোজখে নিক্ষিপ্ত হবেন, পরে কি ভবিষ্যৎবাণীটি পূর্ণ হয়েছিল?
উত্তরদাতা : অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আথহাম সম্পর্কে মির্যা কাদিয়ানী আপনা অনুসারীদের নিয়ে বেঁধে দেয়া নির্দিষ্ট সময়ের শেষ দিনটির সারা রাত্রি পর্যন্ত খুবই দোয়া, মোনাজাত ইত্যাদি করেছিলেন। খুব বেশি কান্নাকাটিও করেছিলেন মাবুদের দরবারে। তাহলিল, খতম (অজিফা) ও দানা-ফানা পড়েও আথহামের মৃত্যুর ফরমান জারি করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, মির্যার সেই তাবৎ প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়। যার ফলে সুচতুর ও ধুর্ত মির্যা কাদিয়ানী কাসুন্দির পথ বেছে নেন এবং নিজেকে রক্ষা করতে আপনা কৃত ‘শর্ত’-এর ব্যাখ্যা দিয়েও ব্যর্থ হন। কেননা তার বেধে দেয়া নির্ধারিত সময়ের ভেতর আথহামের মৃত্যু না হওয়ায় তিনি নিজেকে রক্ষা করতে ‘শর্ত’-এর যে বেলুন নিয়ে উড়ো উড়ি করতে চেয়েছিলেন সেখানে ‘সত্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করা‘র শর্ত জুড়ে দেয়ার পর নিজেই সেই “সত্য” এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন অর্থাৎ ‘সত্য খোদাকে মানা‘ এবং সেটির উপর ‘প্রতিষ্ঠা থাকা‘। এটিকে এক শব্দে প্রকাশ করলে হয় ‘আথহাম ইসলাম গ্রহণ করা‘। কিন্তু আথহাম আমৃত্যু খ্রিস্টান ধর্মের উপরই বহাল ছিলেন, ইসলামে প্রত্যাবর্তন করেননি।
আথহাম সম্পর্কে মির্যা কাদিয়ানীর সম্পূর্ণ ঘটনাটি আমি এখানে তাদেরই লেখিত লিটারেচার থেকে পাঠকের উদ্দেশ্যে তুলে ধরছি। একজন বিজ্ঞ ও সচেতন পাঠক মাত্র পুরো লিখাটি পড়ে সহজেই আসল ব্যাপারটা বুঝতে সক্ষম হবেন, তারা সেটিকে মিথ্যার বেসাতি করে যতই সুন্দর ভাবে প্রলেপ দেয় না কেন! এখানে যে বইটির স্ক্রিনশট তুলে ধরছি এটি তাদের বর্তমান কাদিয়ানী খলীফা মির্যা মাসরূর আহমদ এর কথিত খুতবাহ। তাদেরই নিজেস্ব প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত। অনলাইন থেকে পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
- রেফারেন্স, খুতবাতে মাসরূর (ত্রয়োদশ খন্ড) পৃষ্ঠা ৫৪-৫৭, ২০১৫ ইং
উপরের দীর্ঘ আলোচনা পড়া শেষে এবার প্রাসঙ্গিক আরও কিছু তথ্য জেনে রাখুন:
ডিপুটি আব্দুল্লাহ আথহাম সম্পর্কিত উল্লিখিত ঘটনার সাথে আরো বেশ কিছু কথার সংযোগ রয়েছে যেগুলো ঐ পাতাগুলোয় অনুপস্থিত। যেমন মির্যায়ী রচনাবলীতে উল্লেখ আছে,
১। আমি এই মুহূর্তে স্বীকারোক্তি দিচ্ছি যে, যদি এই ভবিষ্যৎবাণী মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলে আমি সব ধরনের শাস্তি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত। (রূহানী খাযায়েন ৬/২৯২)।
২। আথহামের মৃত্যুর ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছিল ১৮৯৩ সালের ৫ই জুন থেকে ১৮৯৪ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, প্রায় ১৫ মাসের জন্য। উল্লেখ্য, আব্দুল্লাহ আথহাম নির্ধারিত সময়ের আরও প্রায় তিন বছর পর ১৮৯৬ সালের ২৭শে জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু ঐ নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর আথহাম যখন মারা যায়নি তখন মির্যা আর তার মুরিদদের নানা স্ববিরোধী ও হাস্যকর কাসুন্দি এমনকি মিথ্যার আশ্রয়ও নিতে পিছপা হননি। যেমন, তাদের বিভিন্ন লিটারেচারে উল্লেখ রয়েছে –
(ক) আব্দুল্লাহ আথহাম মনে মনে ইসলাম গ্রহণ করায় সে মরেনি। অথচ অথহাম তার এই অভিযোগ অস্বীকার করে এবং বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রত্যাখ্যান করে। (লাহোর থেকে প্রকাশিত ‘অপাদার‘ পত্রিকায় আব্দুল্লাহ আথহামের প্রেরিত পত্র দ্রষ্টব্য, তাং ৬ই সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ সাল)। আথহাম সে পত্রে উল্লেখ করেছেন যে, আমার ব্যাপারে এটি মির্যা কাদিয়ানীর জলজ্যান্ত মিথ্যা। কেননা আমি ধর্ম পরিবর্তন করিনি। আগেও খ্রিস্টান ছিলাম, এখনো খ্রিস্টান আছি। এরপর মির্যা কাদিয়ানীকে চুপসে যেতে হয়।
- (খ) আথহাম মনে প্রাণে খুব ভয় পেয়ে যায়। এটি তার সত্যের দিকে ফিরে আসার নিদর্শন। তাই মৃত্যু হয়নি। কাদিয়ানী নেতাদের জন্য দুঃসংবাদ হল, নির্ধারিত সময়ের ভেতর আথহামের মৃত্যু না হওয়ায় মির্যাকে রক্ষা করতে ‘শর্ত’-এর বেলুন উড়ানোর আর কোনো সুযোগই থাকেনি। কারণ মির্যা সাহেব ‘সত্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করা’র শর্ত জুড়ে দেয়ার পর নিজেই সেই “সত্য” এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন অর্থাৎ ‘সত্য খোদাকে মানা’ এবং সেটির উপর ‘প্রতিষ্ঠা থাকা’। এটিকে এক শব্দে প্রকাশ করলে হয়, আথহাম ইসলাম গ্রহণ করা। কিন্তু আথহাম আমৃত্যু খ্রিস্টান ধর্মের উপরই বহাল ছিল, ইসলামে প্রত্যাবর্তন করেনি।
(গ) আব্দুল্লাহ আথহামের তওবাহর কারণে এটি সাময়িকভাবে বিলম্বিত হয় ঠিকই কিন্তু অবশেষে সে ধরা পড়ে। তাদের আরেকটি হাস্যকর বক্তব্য হল, আব্দুল্লাহ আথহাম সে তার তওবাহ পড়ে নেয়ার বিষয়টি গোপন করে দুনিয়াকে ধোকা দিতে চেয়েছিল বলে তাকে শপথ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি শপথ করতে রাজি হননি। ফলে তিনি পরবর্তী ২-৩ বছরের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, আথহামকে শপথ করতে হবে এমন কোনো শর্তও কি মির্যার কথিত ইলহামে উল্লেখ ছিল? কোনো কাদিয়ানী কি এর প্রমাণ করতে পারবে?
(ঘ) আব্দুল্লাহ আথহামের মৃত্যুও হয়েছে, ভবিষ্যৎবাণীও পূর্ণ হয়েছে। তবে এই মৃত্যুটা জাগতিক মৃত্যু নয়, বরং আধ্যাত্মিক মৃত্যু। তারা এটিকে কথিত এক পীর খাজা গোলাম ফরীদের নামে ভিত্তিহীন একটি রসালো গল্পের মাধ্যমে বুঝানোর চেষ্টা করে, অথচ ঘটনাটির কোনো ভিত্তিই নেই।
পাঠকবৃন্দ! খেয়াল করুন, মির্যার উক্ত বানোয়াট ভবিষ্যৎবাণীকে বাস্তব করে দেখাতে তারা কত নোংরা খেল খেলেছে। কতটা বেপরোয়া আর খোদাদ্রোহী হলে একটা মিথ্যাকে ঢাকতে কতগুলো মিথ্যা আর কাসুন্দির জন্ম দিতে পারে! এরই নাম কাদিয়ানীয়ত। অথচ মির্যা কাদিয়ানীর ঘনিষ্ঠ সহচর ইয়াকুব আলী ইরফানী সাহেবের বইতেও পরিষ্কার লিখা আছে, ‘আথহামের মৃত্যুর ভবিষ্যৎবাণীর শেষ দিনটি যখন এসে গেল জামাতের লোকদের চেহারা বিবর্ণ ধারণ করল, মন ছোট হয়ে গেল। কেউ কেউ তো অজ্ঞতাবশত বিরুদ্ধবাদীদের জন্য মৃত্যু কামনা করাই শুরু করে দিল। চারো দিকে উদাসীনতা আর বেপরোয়া ভাব প্রকাশ পেল। লোকজন চেঁচিয়ে কান্না করতে লাগল। কাঁদাকণ্ঠে ফরিয়াদ শুরু করল, ‘আয় খোদা হামে রসোয়া মত করো’। হে খোদা, আমাদের লাঞ্চিত করো না।’ (সীরাতে মসীহ মওউদ পৃষ্ঠা ৭, ইয়াকুব আলী ইরফানী; এডিটর সাপ্তাহিক আল হিকাম পত্রিকা)।
- মির্যা বশির আহমদ এম.এ লিখেছেন, ‘যখন আব্দুল্লাহ আথহামের নির্ধারিত সময়ের শুধু একদিন বাকি তখন মসীহ মওউদ (মির্যা) তার শিষ্য আব্দুল্লাহ সানূরী আর মিয়া হামেদ আলীকে খতম (অজিফা) পড়ার জন্য কিছু দানা (বিচি) কুড়ে আনতে নির্দেশ দেন। তিনি (আব্দুল্লাহ সানূরী) বলেন, আমরা এই খতম প্রায় সমগ্র রাত্রি পর্যন্ত পড়ে সম্পন্ন করলাম। খতম (অজিফা) শেষ করার পর আমরা সেই দানাগুলো তাঁর নিকট নিয়ে আসি। যেহেতু তিনি বলেছিলেন যে, খতম পড়া শেষ হলে দানাগুলো যেন তার নিকট নিয়ে আসি। এরপর তিনি আমাদের দুইজনকে কাদিয়ানের বাহিরে, সম্ভবত উত্তর দিকে নিয়ে গেলেন আর নির্দেশ দিলেন যে, এই দানাগুলো অন্য কোনো অনাবাদি কূপে ফেলে আসতে হবে। তিনি আরও নির্দেশ দিলেন, এই দানাগুলো যখন ফেলে আসব তখন পেছনে তাকানো ছাড়াই যেন দ্রুতবেগে সেখান থেকে সরে আসি। ঘাড় ঘুরিয়েও যেন পেছন দিকে না দেখি। তারপর হযরত সাহেব দানাগুলো একটি অনাবাদি কূপে নিক্ষেপ করে দ্রুত আমাদেরকে সাথে নিয়ে ফিরে আসেন।’ (সীরাতে মাহদী ১/১৬২-৬৩; বর্ণনা নং ১৬০ নতুন এডিশন)।
দৈনিক আল ফজল (২০-জুলাই-১৯৪০ইং) এর মধ্যে পরিষ্কার লিখা আছে, আথহাম সম্পর্কে কৃত ভবিষ্যৎবাণীর শেষ দিন কাদিয়ানের সমস্ত কাদিয়ানী মুরিদ চিল্লাফাল্লা করে কেঁদে কেঁদে ফরিয়াদ করেছিল এই বলে যে, ইয়া আল্লাহ! আথহাম মর যায়ে, ইয়া আল্লাহ! আথহম মর যায়ে। হে আল্লাহ! আথহাম যেন মরে যায়, হে আল্লাহ! আথহাম যেন মরে যায়।
- আফসোস! একজন নবী দাবীদার নিজ অনুসারীদের দিয়ে অন্যের মৃত্যু কামনা করে দোয়া করাচ্ছে!! আবার সে দোয়া ব্যর্থও হয়েছে। এখানে প্রশ্ন আসে, ঐ নির্দিষ্ট দিনে আথহামের মৃত্যু না হওয়াটা যদি সত্যি সত্যিই মির্যার কথা অনুসারে সে তাওবা করার কারণে বা মনে মনে ইসলাম গ্রহণ করার কারণেই হয় তাহলে মির্যা কাদিয়ানী কিজন্য শেষ দিনটিতে নিজ অনুসারীদের দিয়ে আথহামের বিরুদ্ধে মৃত্যু কামনা করে খতম পড়িয়েছিলেন? কী জন্য খতম (অজিফা)ও পড়িয়ে ছিলেন, দানা পড়িয়ে সেগুলো অনাবাদি কূপে নিজেই ফেলে আসলেন? কেনই বা আপনা অনুসারীদের বুক ফাটা আত্ম-চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারি করে তুলে ছিলেন? তিনি তখনই সবার মাঝে আথহামের তাওবা কিংবা সত্যের দিকে ফিরে আসার বাণী দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা দিলেই তো হত! কেন নিজ অনুসারীদের সাথে এই জঘন্য তামাশা করতে গেলেন? সে সময় দেশে স্বাক্ষরতার হার ৬% এরও নিচে ছিল বলেই সে সুযোগটা কাজে লাগালেন বুঝি! এটি কি প্রকৃত ইমাম মাহদীর চরিত্র হতে পারে?
এখন আরও একটি প্রশ্ন হল, সত্যিই যদি মির্যার উক্ত ভবিষ্যৎবাণী শর্তযুক্ত (অর্থাৎ সে সত্যের দিকে তথা ইসলামে ফিরে আসলে বেঁচেও যাবে, এইরূপ) হয়ে থাকে আর তার মৃত্যু নির্দিষ্ট সময়ে না হওয়াই ঐ শর্তের কারণে হয়, তাহলে ঐ স্ববিরোধপূর্ণ কথাবার্তার কী মানে? যেমন, আধ্যাত্মিকভাবে তার মৃত্যু হয়ে গেছে বলে আখ্যা দেয়া, কিছুদিন পরে হলেও তার মৃত্যু অবধারিত বলে ব্যক্ত করা! আর সত্যিই যদি মির্যার অপর এক বক্তব্য অনুসারে আথহাম সত্যের দিকে ফিরে আসেন, তাহলে জানার বিষয় হল, সেই সত্যটা কী যার সৌভাগ্যক্রমে সে ‘হাবিয়া দোযখে নিক্ষিপ্ত‘ হওয়া থেকে রক্ষা পেল? উল্লেখ্য, কারো জন্য ‘দোযখ’ থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হল ইসলাম গ্রহণ করা। কেননা, আল্লাহ নিজেই বলেছেন, আল্লাহ কারো কাছ থেকে ইসলাম ব্যতীত অন্য আর কোনো ধর্ম গ্রহণ করবেন না (আলে ইমরান ৮৫)। এখন একথাগুলোর কী জবাব?
- এবার প্রামাণ্য কিছু সংযুক্তি নিম্নরূপ, রূহানী খাযায়েন খ-৬ পৃ-২৯১-৯৩ দেখুন,
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক