কলেমা তাইয়্যেবাহ নিয়ে কথিত শায়খদের গবেষণার ইলমি দুরাবস্থা ও আমাদের পরিতাপ
সহীহ হাদীসে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ সম্পূর্ণ কলেমাটি একত্রে আছে কি?
আমাদের এই দেশের তথাকথিত এক শায়খের কথা দিয়েই শুরু করছি, তার নামটি এখানে উল্লেখ করতে চাই না। তিনি এমন এক ব্যক্তি যিনি কথায় কথায় সহীহ হাদীস এর বুলি আওড়িয়ে থাকেন। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার যে, তিনি সূরা ফাতিহাটাও সহীহশুদ্ধভাবে তেলাওয়াত করতে পারেননা। বাংলায় ভালো মত কথাও বলতে পারেননা।
তিনি নাকি ৬ মাস ধরে গবেষণা করেও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ‘ সম্পূর্ণ কলেমা একত্রে খুঁজে পাননি! আর তাই এই কলেমা নাকি এক সাথে লেখা এবং পড়া শিরিক! মানুষটি কথায় কথায় সৌদি আরবকে নিজের আইডল হিসেবে জাহির করারও চেষ্টা করে। প্রকৃত তাওহীদ নাকি শুধু সৌদি আরবেই, আর কোথাও নেই। অথচ সৌদী আরবের পতাকায়ও এ কালিমাই অংকিত রয়েছে। মানুষটি এতটাই বেসামাল যে, তার মতে আফগান ইমারাতে ইসলামীয়া’র সবাই নাকি মুশরিক, মাজারপূজারি! আচ্ছা, অনেক হয়েছে; আজ আর না। এবার চলি মূল আলোচনায়! সত্যিই কি সহীহ হাদীসের কোথাও কলেমা সম্পূর্ণভাবে একত্রে লিখা নেই? তাহলে দেখা যাক, প্রথমে কয়েকটি হাদীস অনুবাদ সহ নিচে উল্লেখ করছি,
হাদীস ১। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, دَخَلْتُ الجَنَّةَ فَرَأيْتُ فِي عارِضَتِي الجَنَّةِ مَكْتُوباً ثلاثة أسطر بالذهب: السطر الأول لا إله إِلَّا الله محمَّدٌ رَسوُلُ الله والسَّطرُ الثَّانِي ما قدمنا وَجَدْنا وَمَا أكَلْنا رَبِحْنا وَمَا خَلَّفْنا خَسِرْنا والسَّطْرُ الثَّالِثُ أُمَّةٌ مُذْنِبَةٌ وَرَبٌّ غَفُورٌ অর্থ, মেরাজকালে আমি বেহেশতে প্রবেশের সময় এর দু’পাশে দেখি তিনটি লাইনে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। যথা, ১. লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। ২. আমরা যে ভালো কর্ম পেশ করেছি, তা পেয়েছি। যা খেয়েছি তা থেকে উপকৃত হয়েছি; যা ছেড়ে এসেছি তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। ৩. উম্মত হলো গোনাহগার, আর রব হলো ক্ষমাশীল। (জামেউস সগীর, কৃত ইমাম জালালউদ্দীন আস-সুয়ূতী ১/৮৭১ হাদীস নং ৪১৮৬, ইমাম সুয়ূতী রহ. লিখেছেন, হাদীসটির মান, সহীহ)।
হাদীস ২। হযরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ একটি হাদীসে রাসূল (সা.) তদানীন্তন কাফের ও সত্যিকারের মুসলমানদের অবস্থার বিবরণ দিতে গিয়ে নিম্নোক্ত আয়াতের আলোকে বলেন, إِذْ جَعَلَ الَّذِينَ كَفَرُوا فِي قُلُوبِهِمُ الْحَمِيَّةَ حَمِيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ فَأَنْزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَى رَسُولِهِ وَعَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَأَلْزَمَهُمْ كَلِمَةَ التَّقْوَى وَكَانُوا أَحَقَّ بِهَا وَأَهْلَهَا وهى : لا اله إلا الله محمد رسول الله- অর্থ, কাফেররা মুসলমানদের সাথে সেই অজ্ঞ যুগের বাড়াবাড়িতে লিপ্ত ছিল। এমতাবস্থায় আল্লাহতালা (মুসলমানদের একত্ববাদের ফলে) রাসূল (সা.) ও ঈমানদারদের ওপর স্বীয় প্রশান্তি অবতরণ করেন। আর তাদের জন্য তাকওয়ার কালিমা আবশ্যক করে দেন। যার সত্যিকার ধারক তারাই। এই তাকওয়ার কালিমাটি হচ্ছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। (আল-আসমা ওয়াস-সিফাত পৃষ্ঠা নং ১৩১, হাদীস নং ১৯৫; , সংকলক ইমাম আবু বকর আহমদ ইবনে হোসাইন আল-বায়হাক্বী রহ. মৃত. ৪৫৪ হিঃ)। হাদীসটির সনদে উল্লিখিত সকল বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য ও হাদীসটির মান, সহীহ।
- উল্লেখ্য, এই হাদীসটি মূলত কুরআনে কারীমের সূরায়ে ফাতহ-এর ২৬ নম্বর আয়াতে উল্লিখিত كلمة التقوى (কালিমাতুত তাক্বওয়া)-এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বর্ণিত অসংখ্য হাদীসগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়া তাফসীরের প্রায় সব কিতাবে কালিমাতুত তাক্বওয়ার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখা আছে, তা হলো “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”। (প্রায় ৫০টিরও বেশি তাফসীরগ্রন্থ আমরা যাচাই করেছি। বিশেষ কয়েকটি গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/১৬৫, রূহুল মা’আনী ১৩/২৯২, কুরতুবী ১৬/১৯০, তাবারী ১১/৩৬৫, বাগাভী ৫/১১৬)।
হাদীস ৩। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, কুরআনে কারীমের সূরা কাহাফ-এর ৮২ নম্বর আয়াত অবলম্বনে, “এর নিচে ছিল তাদের গুপ্ত ধন”। এখানে গুপ্ত ধন বলতে একটি স্বর্ণের বোর্ড, এতে কয়েকটি বিষয় লেখা ছিল। সবশেষে লেখা ছিল “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”। (তাবরানী কিতাবুদ দু’আ, হাদীস নং ১৬২৯, বায়হাকী যুহদ, হাদীস নং ৫৪৪, ইমাম সুয়ূতী আদ-দুররুল মনসূর ৯/৬০০ দ্রষ্টব্য)।
- এই হাদীসের বর্ণনাকারীদের সবাই ثقة বা বিশ্বস্থ, শুধু বুশাইর নামক একজন রাবী এমন রয়েছেন যাকে ইমামগণের অনেকে صدوق তথা গ্রহণযোগ্যও বলেছেন। তাই হাদীসটির মান, হাসান বা অন্যান্য হাদীসের সমন্বয়ে সহীহ।
হাদীস ৪। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, كَانَتْ رَايَةُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سَوْدَاءَ وَلِوَاؤُهُ أَبْيَضُ، مَكْتُوبٌ عَلَيْهِ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ- অর্থ, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ঝাণ্ডাটি ছিল কালো এবং পতাকাটি ছিল সাদা রঙের। এই পতাকায় লেখা ছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। (আল মু’জামুল আওসাত লিত-তাবরানী ১/১২৫, হাদীস নং ২২১, শামায়েলে ইমাম বাগাভী, হাদীস নং ৮৯৪)। এই হাদীসের বর্ণনাকারীগণ সবাই নির্ভরযোগ্য। তবে এর একজন বর্ণনাকারী “হাইয়্যান” সম্পর্কে কেউ কেউ অপরিচিত বলেছেন। কিন্তু তার সম্পর্কে প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ইমাম আবু হাতেম (রহ.) صدوق বা নির্ভরযোগ্য বলে মত ব্যক্ত করেছেন। এ ছাড়া ইমাম বাজ্জারও (রহ.) তাকে সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণের মধ্যে গণ্য করেছেন । (ইমাম ইবনে আদী সংকলিত ‘আল জারহু ওয়াত-তা’দীল’ ৩/২৪৬ দ্রষ্টব্য)।
হাদীস ৫। সাহাবী হযরত বুরাইদা (রা.) হতে বর্ণিত আছে তিনি বলেন, انطلق أبو ذر ونعيم ابن عم أبي ذر، وأنا معهم يطلب رسول اللَّه صلّى اللَّه عليه وآله وسلّم وهو مستتر بالجبل، فقال له أبو ذر: يا محمد، أتيناك لنسمع ما تقول، قال: أقول لا إله إلا اللَّه محمد رسول اللَّه، فآمن به أبو ذر وصاحبه. অর্থ, আবুজর এবং নু’আইম তারা দু’জন রাসূল (সা.)-এর খুঁজে বের হন। আমি তাঁদের সাথে ছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন এক পাহাড়ের আড়ালে ছিলেন। তখন আবুজর (রা.) রাসূল (সা.)-কে বললেন, হে মুহাম্মদ (সা.) আপনি কি বলেন আমরা তা শুনতে এসেছি। তখন রাসূল (সা.) বলেন, আমি বলি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। (আল ইছাবাহ ফী তাম-ঈযিস সাহাবাহ, ইমাম ইবনে হাজর আল আসকালানী ৬/৩৬৫, হাদীস নং ৮৮০৯, যিয়াদাতুল মাগাযী ইউনুস ইবনে বুকাইর দ্রষ্টব্য)। এই হাদীসের সনদও সহীহ, এর সকল বর্ণনাকারী ছিকাহ বা বিশ্বস্থ।
হাদীস ৬। হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ﺃﻥ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻛﺎﻥ ﻓﺺ ﺧﺎﺗﻢ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﺣﺒﺸﻴﺎ، ﻭﻛﺎﻥ ﻣﻜﺘﻮﺑﺎ ﻋﻠﻴﻪ : ﻻ ﺇﻟﻪ ﺇﻻ ﺍﻟﻠﻪ ﻣﺤﻤﺪ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ، ﻻ ﺇﻟﻪ ﺇﻻ ﺍﻟﻠﻪ ﺳﻄﺮ، ﻭﻣﺤﻤﺪ ﺳﻄﺮ، ﻭﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺳﻄﺮ অর্থ, নবী করীম (সা.)-এর আংটির পানরটি ছিল আবিসিনীয়। আর তাঁর উপর লেখা ছিল ‘,লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’। এর প্রথম লাইন ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’’, দ্বিতীয় লাইন ‘‘মুহাম্মাদ’’, তৃতীয় লাইন ‘‘রাসূলুল্লাহ’’। (আখলাকুন নবী, আবুশ শাইখ আল ইছবাহানী রহ., হাদীস নং ৩৩৫, হাদীসের মান সহীহ)।
- আবুশ শাইখ (রহ.) এর সংক্ষিপ্ত পরিচায় হল, তার পুরো নাম আবু মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে জাফর ইবনে হাইয়্যান, তিনি ‘আবুশ খাইখ’ নামে প্রসিদ্ধ। তার উপাধী আল ইমামুল হাফেজুস সাদিক মুহাদ্দিসু ইছবাহান। মৃত ২৭৪ হিজরী। ইমাম যাহাবী তার ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’ গ্রন্থে (১৬/২৭৭) তাঁর মৃত্যু সন এটাই লিখেছেন। বিস্তারিত উইকিপিডিয়া থেকে দেখুন। ক্লিক করুন।
আল্লাহ তাআলা এমন অজ্ঞ গবেষকদের মুর্খতাসূলভ গবেষণা থেকে উম্মতের ঈমান ও আমলকে হিফাজত করুন। আমীন।
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক