ঐতিহাসিক একটি প্রামাণ্য তথ্য ও সমালোচকদের দাঁতভাঙা জবাব!
এঁরাও বিখ্যাত মহামনীষী! কিন্তু এঁদের বিয়ে সংক্রান্ত বয়স নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলেনা! প্রশ্ন তুলবে-ই বা কেন? সময় আর অঞ্চল ভেদে বিবাহের আদর্শ বয়স যে বিভিন্ন হয়ে থাকে, যদিও সময়ের পরিক্রমায় সেই নিয়মেও পরিবর্তন আসতে থাকে! বলতে ছিলাম, ইতিহাসবিখ্যাত অনেকের জীবন ঘাটলে আমরা দেখি,
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিয়ে করেছিলেন ১৪ বছর বয়সে তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল ৮ বছর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেছিলেন ২২ বছর বয়সে তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল ১১ বছর।
বঙ্কিমচন্দ্র বিয়ে করেছিলেন ১১ বছর বয়সে তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেছিলেন ১৪ বছর বয়সে তখন তাঁর স্ত্রী সারদা দেবীর বয়স ছিল মাত্র ৬ বছর।
শিবনাথ শাস্ত্রী বিয়ে করেছিলেন ১৩ বছর বয়সে, তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল ১০ বছর।
রাজনারায়ণ বসু বিয়ে করেছিলেন ১৭ বছর বয়সে তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল ১১ বছর।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেছিলেন ১৯ বছর বয়সে, তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল মাত্র ৮ বছর।
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেছিলেন ১৭ বছর বসে তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল মাত্র ৭ বছর।
লিনা মেদিনা! ৫ বছর ৭ মাস ২১ দিন বয়সে সন্তানের জন্ম দেয়ায় বিশ্বরেকর্ড করা সর্বকনিষ্টা মা উল্লেখ করে তার বন্ধনা করা হয়।
দ্বিতীয় কিং রিচার্ড ৩০ বছর বয়সে ফরাসি রাজকুমারী ৭বছর বয়সী ইসাবেলাকে বিয়ে করেন।
পর্তুগালে রাজা ডেনিস ১২ বছর বয়সী সেন্ট এলিজাবেথকে বিবাহ করেছিলেন।
নরওয়ের ষষ্ঠ রাজা হাকোন ১০ বছরের রাণী মার্গারেটকে বিবাহ করেছিলেন।
এসেক্সের কাউন্ট আগ্নেসের বিয়ের পাকা কথা হয় মাত্র ৩ বছর বয়সে। ১২ বছর বয়সে তার বিবাহ হয় পঞ্চাশ বছর বয়সী সঙ্গির সাথে।
রোমানোস ইতালির রাজকন্যা ৪ বছর বয়সী বার্থা ইউডোকিয়াকে বিবাহ করেন। ইতিহাসের পাতায় এরকম অসংখ্য নজির আছে। এগুলো আমাদের ইতিহাসের অংশ। এসব আমাদের ভুলে যাওয়া সমীচিন নয়।
একসময় সতীদাহ প্রথা ছিল। জীবন্ত নারীকে সহমরণে তার মৃত স্বামীর সঙ্গে চিতায় আত্মহুতি দিতে হতো। কিন্তু সতীদাহ বা সহমরণই হিন্দু ধর্মের বৈশিষ্ট্য বলার অর্থ হিন্দুর প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ চর্চা করা। হিন্দু শাস্ত্রের ধূয়া তুলে হিন্দুর প্রতি ঘৃণা ও সহিংসতা একালে কেউ প্রদর্শন করে না। কারণ, সমাজ, আইন, সংস্কৃতি ও ইতিহাস ইত্যাদি সম্পর্কে আমাদের চেতনা উপলব্ধি ও বিচার ক্ষমতা অনেক বিকশিত হয়েছে। আগের মতো নাই। ইতিহাস ও সমাজ স্থির কিছু নয়, বদলায়। ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু দেশ ও কাল বিবেচনায় না নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে দোষী করলে সেটা কাণ্ডজ্ঞানের অভাব হবে। তাই না?
তাহলে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে এত বিতর্ক কেন? এই তো মাত্র গত শতাব্দীর কথাই ধরে নেয়া যাক। প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বয়স যখন ১৩ ও বেগম ফজিলাতুন্নেসার বয়স যখন মাত্র তিন, তখন পরিবারের বড়রা তাদের বিয়ে ঠিক করেন। ১৯৩৮ সালে বিয়ে হবার সময় বেগম ফজিলাতুন্নেসা রেনুর বয়স ছিল ৮ বছর ও শেখ মুজিবের ১৮ বছর। এখানে কারো সাথে কারো তুলনা টানা উদ্দেশ্য নয়, আর এটি সম্ভব না; কারণ মহানবীর সাথে শেখ সাহেবের তুলনা করতে চাওয়াই বোকামি! বড়জোর এখানে সেই সময়কার বিয়ের আদর্শ বয়স যে মাত্র ৮-১২ এর ভেতরই ছিল সেটা বুঝাতে চাচ্ছি। ফলে এতে ব্যক্তি বা সমাজ কেউই অভিযুক্ত নয়।
বলা হয় যে, হযরত আয়েশা (রা.) ৯ বছর বয়সে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে সংসার শুরু করেছিলেন। ব্যাস আর কী লাগে!! মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় শুরু! কিন্তু এটা কেমন ন্যায় বিচার? মহানবীর সেই সময়টিতে বিবাহের আদর্শ বয়স যদি ওটাই হয়ে থাকে তবে তো উচিত ছিল, সেটিকে সেই সময়ের প্রচলিত আইনে বিচারকরা! মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে কন্যা আর কন্যাপক্ষের কিংবা সে সময়কার প্রচলিত নিয়ম ভঙ্গের যদি কোনো অভিযোগ না থাকে, তবে তো তিনি ন্যায়বিচার পাওয়ারই যোগ্য, তাই নয় কি?
- অপ্রিয় হলেও সত্য, হযরত আয়েশা (রা.)-এর বয়স তখন ৬-৯ বছর ছিল মর্মে তথ্যটিও সঠিক নয়, বরং ঐতিহাসিক বিতর্কিত। এমনকি সহীহ বুখারীরই সূত্র পরম্পরায় দু’টি মতই প্রথম থেকে প্রচলিত। কারণ সহীহ বুখারীসহ আরও বহু ঐতিহাসিক প্রামাণ্য তথ্য মতে সুস্পষ্ট আছে যে, হযরত আয়েশা (রা.)-এর বিয়ের সময় বয়স কম চে কম ১৩-১৯ এর ভেতরেই ছিল। অধিকন্তু ৬ আর ৯ বছরের বর্ণনার সূত্রে উল্লিখিত হিশাম ইবনে উরওয়াহ নামের রাবী (হাদীসের বর্ণনাকারী জনৈক তাবেয়ী) সম্পর্কে ইমাম মালেক (রহ.) আজ থেকে ১২ বছর আগেই বলে গেছেন যে, তিনি শেষ বয়সে (তথা ৭১ বছর বয়সে উপনীত হলে) মদিনা থেকে ইরাক চলে যাওয়ার পর স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ফলে তার বর্ণনায় অনেক কিছুই উল্টোপাল্টা হয়ে যেত। সেজন্য তার থেকে কোনো ইরাকী রাবী যত হাদীসই বর্ণনা করবে, সেগুলো গ্রহণযোগ্য হবেনা।
উল্লেখ্য, বুখারী শরীফে হযরত হিশাম ইবনে উরওয়াহ তিনি ইরাকি রাবী থেকেই এটি বর্ণনা করেন। দেখুন, তাহযীবুত তাহযীব, লেখক ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.)। প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ ইমাম আবুল হাসান ইবনে ক্বাত্তান (রহ.) ‘বায়ানুল ওয়াহাম ওয়াল ইবহাম‘ (بيان الوهم و الإبهام) কিতাবের ৫ম খন্ডের ৫০৪ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন: أن هشام اختلط في آخر عمره অর্থ হিশাম ইবনে উরওয়াহ শেষ বয়সে উল্টাপাল্টা করে ফেলত।’
- ইমাম যাহাবী (রহ.) ‘মিযানুল ই’তিদাল‘ কিতাবের ৪র্থ খন্ডের ৩০১-৩০২ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, هشام بن عروة أحد الأعلام، حجة إمام، لكن في الكبر تناقض حفظه و لم يختلط أبداً অর্থ হিশাম ইবনে উরওয়াহ (রহ.) তিনি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন। নির্ভরযোগ্য ইমাম ছিলেন। তবে বৃদ্ধাবস্থায় তার স্মৃতিলোপ পায় অথচ (ইতিপূর্বে) তিনি কখনো উল্টাপাল্টা করেননি।’ আরো দেখুন, আল-জারহু ওয়াত তা’দীল ৬/৪৯০, ইমাম যাহাবী (রহ.)।
আসলে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে নিয়ে অহেতুক সমালোচনার প্রধান কারণ হলো তার অতুলনীয় উত্তম চরিত্র মাধুরী। যে চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে দেড় হাজার বছর ধরে মানুষ অনবরত ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বিতর্কিত করে তারা বিশ্বব্যাপী ইসলাম গ্রহণের অগ্রযাত্রা রুখে দিতে চায়।
বিজেপি নেতা নেত্রি ও নূপুর শর্মাগং যা-ই বলুক না কেন, স্বয়ং আল্লাহতালা তাঁর প্রিয় হাবীবের চরিত্রের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, اِنَّکَ لَعَلٰی خُلُقٍ عَظِیۡمٍ (ইন্নাকা লা’আলা খুলুকিন আযীম)। অর্থ-নিশ্চয়ই আপনি সর্বোৎকৃষ্ট চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত। (আল কুরআন)। কিয়ামত পর্যন্ত এই চরিত্র মাধুরী পৃথিবীর সকল মানুষের কাছে প্রধান আকর্ষণ হয়ে থাকবে। দলে দলে মানুষ মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মত হবার সৌভাগ্য অর্জন করতে থাকবে, ইনশাআল্লাহ। তোমাকে ভালোবাসি হে প্রিয়নবী! তোমার চরণে উৎসর্গ করছি আমার স্বর্গ-নরক প্রিয় বাবা-মা।
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক