মসীহ দাজ্জাল এর প্রকৃত পরিচয় :
পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্যে রূপ দেয়ার ঘটনা কম ঘটেনি। ‘দাজ্জাল’ তন্মধ্যে অন্যতম। গভীর অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা গেছে তার সিংহভাগই রাজনৈতিক কিবা গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিল করার উদ্দেশ্যেই ছিল। অথচ ‘দাজ্জাল’ এর পরিচয় সম্পর্কে আমাদের প্রিয় নবী (সা:) থেকে সহীহ সনদে আমাদের নিকট যেসমস্ত বর্ণনা পেীঁছেছে তা খতিয়ে দেখলে বুঝা যায় :
১. দাজ্জাল একজন মানবাকৃতির হবে। কারণ হাদীসে ‘রাজুলুন জাসিমুন আহমারু’ (رجل جسيم احمر) শব্দ আসছে। যার অর্থ লালচে বর্ণের ও স্থূলদেহের এক ব্যক্তি। (সূত্র সহীহ বুখারী হাদীস নং ৭১২৮)। সুতরাং কোনো সভ্যতা কিংবা কোনো মিশনারী গোষ্ঠীকে হাদীসে বর্ণিত সেই ‘দাজ্জাল’ ব্যাখ্যা দেয়া ভুল এবং সুস্পষ্ট হাদীস বিকৃতির শামিল। যেহেতু সভ্যতাকে যেমন মানুষ বলা যায় না, তেমনি দলবদ্ধ কোনো মিশনারীও একব্যক্তি হয় না।
২. দাজ্জালের চুল হবে কোঁকড়ানো। তার উভয় চোখই ক্রুটিযুক্ত থাকবে। তার যে চোখটি কানা থাকবে সেটি দেখতে ফোলা আঙ্গুরের ন্যায় দেখাবে। (সূত্র ঐ)। আর তার ডান চোখটি সম্পূর্ণ নষ্ট থাকবে। (সূত্র ফাতহুল বারী ১৩/৯৭; ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী)। এভাবে অসংখ্য সহীহ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় রাসূল (সা:) যেই ‘দাজ্জাল’ এর ভবিষ্যৎবাণী দিয়ে গেছেন সেটিকে কাদিয়ানী, হেযবুত তওহীদসহ কতিপয় নির্বোধ সম্প্রদায় নানা প্রকারের রঙ চড়িয়ে নানা কল্পনা করে যেই কাল্পনিক অ-মানবীয়রূপে চিত্রিত করে থাকে সেটি পুরোপুরি বাতিল, সত্যের সাথে লেশমাত্র সম্পর্কও নেই।
- বলাইবাহুল্য এসবই আজগুবি কল্পনা, সত্যের সঙ্গে এগুলোর কোনোই সম্পর্ক নেই। তাদের সেসব কল্পিত-নির্ভর অ-মানবীয় ও রূপক ব্যাখ্যার সমর্থনে কোনো প্রমাণ না আছে কুরআনে, না আছে সহীহ কোনো হাদীসে। অদ্যাবধি কেউ দেখাতে পারেনি, পারবেও না। কথাটা আমি জেনেশুনেই বলছি। এই পর্যায়ে বেশি না আমি তাদের উদ্দেশ্যে বেশকিছু হাদীসের খন্ডিত উদ্ধৃতি পেশ করব। যদি হাদীসে বর্ণিত ‘দাজ্জাল’ তাদের বিচারে রূপক কিবা অ-মানবীয় কিছু হয়ে থাকে তখন তারা নিচের প্রশ্নগুলোর কী ব্যাখ্যা দেবে? যেমন,
(ক) দাজ্জাল সম্পর্কে হাদীসে ‘রাজুল’ (Man) শব্দ আসছে। রাজুল অর্থ মানুষ বা ব্যক্তি। রাসূল (সা:) তাকে তৎকালীন আব্দুল উজ্জাহ ইবনে কাতান নামক জনৈক ব্যক্তির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে আখ্যা দিয়েছেন। (সূত্র সহীহ বুখারী হাদীস নং ৭১২৮)। এখন দাজ্জাল মানবাকৃতির না হলে রাসূল (সা:) তাকে অন্য আরেকজন মানবের সাথে কিজন্য সাদৃশ্য থাকার সংবাদ দিলেন?
(খ) দাজ্জালের চুল কোঁকড়ানো হবে উল্লেখ আছে। (সূত্র সহীহ বুখারী হাদীস নং ৭১২৮)। এখন এর কী ব্যাখ্যা দেবেন?
(গ) দাজ্জাল আবির্ভাবের পূর্বে পৃথিবীতে ধারাবাহিক তিন বছর খরা ও দুর্ভিক্ষ নেমে আসবে। (মুসনাদে আহমদ হাদীস নং ২৭৫৬৮)। এখন কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন আসে মির্যা কাদিয়ানীর সময় কি এধরণের ঘটনা ঘটেছিল?
(ঘ) রাসূল (সা:) বলেছেন, আমি তোমাদের মাঝে জীবিত থাকতেই যদি দাজ্জাল আগমন করে তাহলে ….। (তিরমিজী কিতাবুল ফিতান)। এতে বুঝা গেল, তখনো পর্যন্ত দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ হয়নি। বড়জোর দাজ্জালকে আবিস্কার করা হয়েছিল মাত্র। সে হিসেবে আধুনিক গবেষকদের কেউ কেউ মনে করেন দাজ্জাল বারমুডা ট্রায়েঙ্গেলে থাকতে পারে। কারো কারো মতে জাপানের ড্রাগন ট্রায়েঙ্গেল (Triagle) বা ডেভিল সী-তে থাকতে পারে। তবে এগুলো নিছক কারো কারো গবেষণাধর্মী বক্তব্য, যার সমর্থনে ইসলামের অথেনটিক সোর্সগুলো নিরব।
(ঙ) হযরত তামীম আদ-দারী (রা:) তার কাফেলাসহ দাজ্জালকে মদীনার পূর্বদিকের এক অজানা দ্বীপে সচক্ষে শিকলাবদ্ধ হয়ে অবস্থান করতে দেখেছেন। রাসূল (সা:) তাঁর এই তথ্য নাকচও করেননি, সহমত-ও ব্যক্ত করেননি। (সহীহ মুসলিম কিতাবুল ফিতান হাদীস নং ২৯৪২)। এটি তামীম আদ-দারী (রা:)-এর হয়ত স্বপ্নের বর্ণনা! যার উপর না সাহাবাদের ইজমা হয়েছিল আর না সালাফদের ইজমা প্রতিষ্ঠা লাভ করে, কিছুই না। সুতরাং ইজমার বিপরীতে বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনাপূর্ণ বর্ণনার উপর দাজ্জালের কনসেপ্ট দাঁড় করতে চাওয়া দুষ্টমি ছাড়া কিছুই না।
(চ) তামীম আদ-দারীর বর্ণনামতে, দাজ্জাল যথাসময় আল্লাহতালার অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ে পৃথিবীর প্রাচ্যে অবস্থিত পারস্য অঞ্চল খোরাসানের ইস্পাহান শহরের ‘ইয়াহুদিয়া’ এলাকা থেকে আসলরূপে আত্মপ্রকাশ করবে বলে উল্লেখ রয়েছে। (তিরমিজী কিতাবুল ফিতান)। সহীহ বুখারীর একটি হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ:) লিখেছেন, দাজ্জাল তার আসলরূপে আত্মপ্রকাশের পূর্বে ‘নবী’ দাবী করবে। তারপর ‘খোদা’ দাবী করবে। তখনি সে আসলরূপে আত্মপ্রকাশ হয়ে দুনিয়াব্যাপী ফেতনা ছড়াবে। (ফাতহুল বারী, কিতাবুল ফিতান)। তাই প্রশ্ন আসে আধুনিক যান্ত্রীক সভ্যতা বা খ্রিস্টান মিশনারীরা কবে কিভাবে নবী আর খোদা দাবী করলো, বলবেন কি?
(ছ) দাজ্জাল মদীনার অদূরে এক পাশ্বে এসে পৌঁছবে। এই সময় মদীনা তিনবার কেঁপে উঠবে। তখন মদীনায় অবস্থানকারী সকল কাফের মুনাফিক বেরিয়ে পড়বে এবং দাজ্জালের সাথে মিলিত হবে। (সহীহ বুখারী হাদীস নং ৭১২৪)। এখন এর কী ব্যাখ্যা দেবেন?
(জ) দাজ্জাল পৃথিবীতে চল্লিশ দিন অবস্থান করবে। তখন প্রথম দিনটি এক বছর সমান দীর্ঘ হবে। রাসূল (সা:) সেই দীর্ঘ সময়টিতে সময়ের অনুমান করে নামায পড়তে বলেছেন। (সহীহ মুসলিম কিতাবুল ফিতান)। এখন প্রশ্ন হল, কল্পনাবীদদের রূপক দাজ্জাল কি পৃথিবীতে শুধুই চল্লিশ দিন অবস্থান করছে?
(ঝ) দাজ্জাল মদীনার অদূরে এক যুবককে হত্যা করার পর পুনরায় জীবিত করে আবার যখন হত্যা করতে চাইবে তখন সে আর হত্যা করতে সক্ষম হবেনা। (সহীহ বুখারী কিতাবুল ফিতান)। কল্পনাবীদদের দাজ্জাল কবে কাকে হত্যার পর পুনরায় জীবিত করল, বলবেন কি?
লিখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক