Home ইমাম মাহদী একই রমযানে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ বর্ণনার তাহকিক

একই রমযানে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ বর্ণনার তাহকিক

0

দারাকুতনীর একটি জাল বর্ণনার আলোকে ১৮৯৪ এবং ‘৯৫ সালে একই রমাযানে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহনের ঘটনা দিয়ে মির্যা গোলাম আহমদ সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে। গোলাম আহমদ কাদিয়ানী সেটিকে ঢাক-ডোল পিটিয়ে তার ইমাম মাহদী দাবীর সত্যতার প্রমাণ হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করে। তার অনুসারীরা এ যুগে এসেও বহু মানুষকে এধরণের একটি মিথ্যা দিয়ে অনবরত পথভ্রষ্ট করেই চলছে। এ নির্বোধরা জানেনা যে, শেষনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যুগ থেকে এ পর্যন্ত (২০০১ সাল) একই রমযান মাসে চন্দ্রসূর্যগ্রহণ সংঘটিত হয়ে আসছে কমকরে হলেও ১০৯ বার। ফলে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এধরণের “গ্রহণের” ঘটনা একদমই সাধারণ ও প্রাকৃতিক, ফলে কারো পক্ষে এধরনের কোনো ঘটনাকে পুঁজি করে নিজেকে “ইমাম মাহদী” প্রমাণ করার কোনো সুযোগ-ই থাকেনি।

আসি মূল আলাপে, প্রথমকথা হচ্ছে, দারাকুতনীর ঐ বর্ণনাটি ‘হাদীস’ হিসেবে প্রমাণিত নয়। বরং এর সনদের (বর্ণনাসূত্রে) মধ্যে দুইজন মিথ্যুক এবং মুনকার পর্যায়ের রাবী (বর্ণনাকারী) থাকার কারণে বর্ণনার কথাগুলো ইমাম বাকের (রহ.)-এর কিনা তাও নিশ্চিত নয়। যদি কথাগুলো ইমাম বাকের-এর বলেও নিশ্চিত হওয়া যেত তাহলেও কথাগুলোর একটু হলেও গুরুত্ব থাকত। অতএব, বর্ণনাটি সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য ও বাতিল।

প্রিয় দ্বীনি ভাই ও বোনেরা! অত্র বিষয়টি আমি প্রশ্নোত্তর আকারে নিচে তুলে ধরছি, যাতে সবাই সহজে বুঝতে পারে। তার আগে বর্ণনাটির সনদ বা ধারাবাহিক বর্ণনাসূত্র উল্লেখ করছি। যথা- এটি বর্ণনা করেছেন গ্রন্থকার ইমাম দারাকুতনী (রহ.), তিনি আবু সাঈদ থেকে, তিনি মুহাম্মদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু নওফল থেকে, তিনি উবায়েদ ইবনু ইয়া’ঈশ থেকে, তিনি ইউনুস ইবনু বুকাইর থেকে, তিনি আমর ইবনু শিম্মির থেকে, তিনি জাবের ইবনু ইয়াজিদ থেকে, তিনি মুহাম্মদ ইবনু আলী (জন্ম-মৃত. ৫৭-১১৪ হিজরী) থেকে।

উল্লেখ্য, মুহাম্মদ ইবনু আলী হচ্ছেন হযরত হোসাইন ইবনু আলী (রহ.)-এর নাতী, যিনি ইমাম বাকের হিসেবেই পরিচিত।

প্রশ্নর্কতা : এটি ইমাম বাকেরের বক্তব্য হওয়াটাও কিজন্য নিশ্চিত নয়?

উত্তরদাতা : ঐ যে দুই মিথ্যুকের কারণে। উপরেই সনদ উল্লেখ করে দিয়েছি! সেখানে ইমাম বাকেরের নামে যে দুই ব্যক্তি চন্দ্রসূর্যগ্রহণের কথাটি মাহদীয়তের নির্দশন বলে চালিয়ে দিয়েছে তাদের নামও উল্লেখ আছে। দেখুন! ইমাম বুখারী, ইবনু হিব্বান, ইয়াহইয়া ইবনু মঈন সহ হাদীসশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞগণ পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে, এই দুই ব্যক্তি মিথ্যুক এবং মুনকার রাবী। এদের সূত্রে বর্ণিত কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং এদের বর্ণিত কথাটি এই জন্যই ইমাম বাকেরের কথাও কিনা নিশ্চিত নয়।

প্রশ্নকর্তা : ইমাম বুখারী (রহ.)ও উক্ত সনদের রাবীদের সমালোচনা করেছেন কি?

উত্তরদাতা : জ্বী, সমালোচনা করেছেন। ইমাম যাহাবী সংকলিত ‘তালখীছুল মুস্তাদরিক’ (১/২৪৬) থেকে হুবহু আরবী ইবারত তুলে ধরছি। যেমন-((قال يحيى بن معين : ليس بشيئ و قال الجورجانى : زائغ كذاب. و قال ابن حبان : رافضى يشتم الصحابة و يروى الموضوعات عن الثقات. و قال البخارى : منكر الحديث. و قال يحيى : لا يكتب حديثه و قال السليمان : كان عمرو يضع للروافض و قال ابو حاتم : منكر الحديث جدا ضعيف الحديث الخ و قال الحاكم ابو عبدالله : كان كثير الموضوعات عن جابر))

এখানে নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন যে, ইমাম বুখারী (রহ.)ও সনদে উল্লিখিত ‘আমর ইবনে শিম্মির’-কে ‘মুনকার’ রাবী বলেছেন (قال البخارى : منكر الحديث)। এছাড়া অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ তো বলেছেনই। যেমন, সকল মুহাদ্দিস বলেছেন, তার বর্ণিত রেওয়ায়েত গুরুত্বহীন, সে কপট প্রকৃতির ও মিথ্যাবাদী, সে একজন রাফেজি (শীয়া মতাদর্শী) এবং সাহাবীদের গালি দিত; সে বিশ্বস্থ রাবীদের নামে জাল হাদীস তৈরী করত, সে একজন মুনকার রাবী, তার কোনো হাদীসই লিখাযোগ্য নয়, সে রাফেজিদের জন্য হাদীস জাল করত, সে হাদীসের জগতে খুবই দুর্বল। ইমাম হাকেম (রহ.) বলেছেন, সে জাবের ইবনু ইয়াজিদের কাছ থেকে বহু জাল হাদীস বর্ণনাকারী। উপরে যে সব কথা লিখলাম তা মূলত আরবী ইবারতটিরই অনুবাদ।

একই রাবী ‘আমর ইবনে শিম্মির‘ (عَمْرو بْنُ شِمِّرٍ) (মৃত. ১৫৭ হিজরী) সম্পর্কে ‘জারহু ওয়াত-তা’দীল’ বিষয়ক কিতাবগুলোতে এভাবেও লিখা আছে যে, তার পূর্ণ নাম আবূ আব্দিল্লাহ আমর ইবনে শিম্মির আল জা’ফী আল কূফী। তিনি হাদীসের জগতে মাতরূক (متروك الحديث) তথা পরিত্যাজ্য। তার সম্পর্কে বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণের রায় হচ্ছে, ইমাম আবূ আহমদ আল হাকিম বলেন ليس بالقوي عندهم অর্থাৎ সে মুহাদ্দিসগণের নিকট শক্তিশালী রাবী নন। ইমাম আবূ আহমদ ইবনু আদী আল জুরজানী বলেন عامة ما يرويه غير محفوظ তার রেওয়ায়েত সমূহ অসংরক্ষিত ও ব্যাপক। ইমাম আবূবকর আল বায়হাক্বী বলেন لا يحتج به তার বর্ণনা দ্বারা দলিল দেয়া যাবেনা। ইমাম আবূ হাতিম আর রাযী বলেন منكر الحديث جدا ضعيف الحديث لا يشتغل به تركوه সে চরম পর্যায়ের মুনকার, দুর্বল, তার বর্ণনার পেছনে ব্যস্ত হওয়া যাবেনা, মুহাদ্দিসগণ তাকে পরিত্যাগ করেছেন। ইমাম আবূ হাতিম ইবনু হিব্বান আলবাস্তী বলেন, رافضي يشتم الصحابة ويروي الموضوعات عن الثقات সে একজন রাফেযী, সাহাবায়ে কেরামদের গালি দিত, বিশ্বস্ত রাবীর নামে জাল হাদীস বর্ণনা করত। ইমাম আবূ যুর’আ আর রাযী বলেন, متروك الحديث، ضعيف الحديث সে একজন মাতরূক রাবী, হাদীস বর্ণনায় দুর্বল। ইমাম আবূ আব্দিল্লাহ আল হাকিম আন নিশাপুরী বলেন, كان كثير الموضوعات عن جابر الجعفي জাবের আল জা’ফী এর সূত্রে তার নিকট অসংখ্য বানোয়াট হাদীস ছিল। ইমাম আবূ না’ঈম আল ইস্পাহানী বলেন, يروي عن جابر الجعفي بالموضوعات المناكير সে জাবের আল জা’ফী এর কাছ থেকে বহু বানোয়াট এবং মুনকার বিষয় বর্ণনা করত। ইমাম আহমদ ইবনে শোয়াইব আন নাসাঈ বলেন, متروك الحديث، ومرة: ليس بثقة ولا يكتب حديثه সে ছিল একজন মুনকার, বিশ্বস্থ ছিলনা, তার হাদীস লিখার উপযোগী নয়। ইমাম আহমদ ইবনে আলী আস সুলাইমানী বলেন, كان يضع للروافض সে রাফেযী (শীয়া-ইমামীয়া) সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে জাল হাদীস রচনাকারী ছিল। ইমাম ইব্রাহিম ইবনে ইয়াকুব আল জুরজানী বলেন, زائغ كذاب সে কপট ও মহা মিথ্যাবাদী। ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী বলেন, كذاب خبيث سباب شتام للصحب الكرام সে ছিল মহা মিথ্যুক, খবিস, সাহাবায়ে কেরামগণকে গালমন্দকারী। ইমাম দারাকুতনী বলেন, متروك الحديث، وذكره في السنن ضعيف সে হাদীসের জগতে মুহাদ্দিসগণের বিচার-বিশ্লেষণে মাতরূক বা পরিত্যাজ্য। সুনান গ্রন্থে তাকে তিনি দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম যাহাবী বলেন, متروك الحديث সে হাদীসে মাতরূক রাবী। ইমাম আমর ইবনু আলী আল পাল্লাস (عمرو بن علي الفلاس) বলেন, منكر الحديث حدث بأحاديث منكرة সে মুনকার রাবী, সে বহু মুনকার হাদীস বর্ণনাকারী। ইমাম বুখারী বলেন, منكر الحديث সে হাদীসের জগতে মুনকার বা পরিত্যাজ্য। ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সা’আদ কাতিব আল ওয়াক্বিদি বলেন, كان ضعيفا جدا متروك الحديث সে খুবই দুর্বল, মাতিরূক বা পরিত্যাজ্য রাবী। ইমাম ইয়াহইয়া বিন মা’ঈন বলেন, ليس بشيء، ومرة: ضعيف لا يكتب حديثه، ومرة: ليس ثقة সে গুরুত্বহীন ব্যক্তি, দুর্বল, তার বর্ণনাকৃত হাদীস লিখা যাবেনা, সে অনির্ভরযোগ্য। ইমাম ইয়াকুব ইবনে সুফিয়ান আল ফাসভী (يعقوب بن سفيان الفسوي) বলেন, ضعفه তাকে দুর্বল আখ্যা দেয়া হয়েছে। (তথ্যসূত্রঃ আল মাজরূহীন-ইবনু হিব্বান, আদ-দ্ব’আফা-আবূ না’ঈম, আল কামিল ফী দু’আফাঈর রিজাল-ইবনু আদী, আল জারহু ওয়াত তা’দীল-আবূ হাতিম আর রাযী, আদ-দ্বু’আফা ওয়াল মাতরূকীন-ইবনু জাওযী, আত তাবকাতুল কোবরা-ইবনু সা’আদ, আদ-দ্বু’আফা ওয়াল মাতরূকূন-ইমাম নাসাঈ, ইবনু জুরাইক্ব, আস সুনানুল কোবরা, কবুলুল আখবার ওয়া মা’রিফাতির রিজাল, তারীখুল কাবীর-ইমাম বুখারী)।

এবার দ্বিতীয় রাবী সম্পর্কে কী লিখা আছে শুনুন। আসমাউর রিজাল শাস্ত্রের বিখ্যাত কিতাব ইমাম ইবনু আদী (২৭৭-৩৬৫ হিজরী) রচিত ‘আল কামেল ফী দ্বু’আফাঈর রিজাল’ (খ-২/পৃ-১১৩) থেকে হুবহু আরবী ইবারত তুলে ধরছি। জাবের ইবনে ইয়াজিদ আল জা’ফী (মৃত. ১২৮ হি.) সম্পর্কে : যেমন-((عن ابى حنيفة قال : ما رأيت احدا اكذب من جابر الجعفى)) অর্থাৎ ইমামে আযম আবূ হানীফা (রহ.) বলেছেন, আমি জাবের ইবনে ইয়াজিদ আল জা’ফি এর চাইতে বড় মিথ্যাবাদী দ্বিতীয় কাউকে দেখিনি। প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ইমাম লাইছ ইবনু আবি সুলাইম (রহ.) বলেছেন, فانه كذاب অর্থাৎ নিশ্চয়ই এই ব্যক্তি মহা মিথ্যাবাদী। ইমাম মিজ্জি (রহ.)-এর ‘তাহযীবুল কামাল’ গ্রন্থে (রাবী নং ৮৭৯) উল্লেখ আছে, ইসমাঈল ইবনে আবী খালিদ বলেন, ((فما مضت الأيام والليالي حتى اتهم بالكذب)) দিবারাত্রি অতিবাহিত না হতেই সে মিথ্যাচারিতার দোষে অভিযুক্ত হয়ে যায়। একই গ্রন্থে আরও লিখা আছে, ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে ম’ঈন বলেন, ((لم يدع جابرا ممن رآه إلا زائدة ، وكان جابر كذابا)) যেই জাবেরকে দেখেছে সেই তাকে একজন অতিরঞ্জনকারী হিসেবে পেয়েছে, আর জাবের ছিল এখন কাজ্জাব (মহা মিথ্যুক)। ইমাম নাসাঈ বলেন, ((ليس بثقة ولا يكتب حديثه)) সে বিশ্বস্থ নয়, তার হাদীস লিখা যাবেনা। উল্লেখ্য, জাবের আল জা’ফী বড় মাপের একজন শীয়া পণ্ডিত, সে পুনঃজন্ম মতবাদে বিশ্বাসী ছিল। কেউ তাকে তাওসীক্ব করলেও বেশিরভাগ মুহাদ্দিস-ই তাকে ‘জরাহ’ করেছেন।

এবার তাহলে নিজের বিবেককেই প্রশ্ন করুন, যে বর্ণনার মধ্যে দুইজন রাবীই মিথ্যাবাদী এবং জাল হাদীস তৈরীকারী হিসেবে অভিযুক্ত ও মুনকার, সে বর্ণনার কথাগুলো ইমাম বাকের-এরই ছিল বলে কিভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়?

প্রশ্নকর্তা : তা বুঝলাম, কিন্তু মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ইমাম মাহদী দাবীকালে এই ধরণের ঘটনা ঘটলো কেন? এটা চিন্তার বিষয় নয় কি?

উত্তরদাতা : চন্দ্রসূর্যগ্রহণের ঘটনা ঘটা নিয়ে আপনার চিন্তার কোনো কারণ নেই। যেহেতু এটি আল্লাহর অন্যান্য প্রাকৃতিক সাধারণ নিয়মগুলোর মতই! হ্যাঁ, যদি এটি ওরকম না হত এবং এই ধরণের ঘটনা আগেও অসংখ্যবার না ঘটত তাহলে তা চিন্তাশীলদের অবশ্যই ভাবিয়ে তুলত! যেজন্য এতে বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্যই বাকি থাকেনি।

প্রশ্নকর্তা : আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে, চন্দ্রসূর্যগ্রহণের এই অলৌকিক ঘটনাটি বিশেষ কোনো নিদর্শন নয়, ইতিপূর্বেও সময় সময় এটি প্রকাশিত হয়েছিল? কী প্রমাণ আছে?

উত্তরদাতা : জ্বী, এর আগেও এটি সাধারণ নিয়মেই বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। আর এটি আমার নিজের কোনো বক্তব্য নয়। এর পক্ষে ইতিহাস সাক্ষী। ঢাকা বকশিবাজার থেকে প্রকাশিত কাদিয়ানীদের ‘পাক্ষিক আহমদী’ (পৃ-২৪, তাং ১৫-এপ্রিল-২০১৫ইং) পড়ে দেখুন, সেখানেও এ ব্যাপারটি স্বীকার করে লিখা হয়েছে যে, ‘হায়দ্রাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাস্ট্রোনমি বিভাগের প্রফেসর জি. এম. বল্লভ ও আমি (মির্যায়ী লিখক) যে হিসাব কষেছি তাতে দেখা গেছে যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যুগ থেকে এ পর্যন্ত একই রমযান মাসে চন্দ্রসূর্যগ্রহণ সংঘটিত হয়েছে মোট ১০৯ বার। এর মধ্যে তিনবার দুটি গ্রহণই নির্ধারিত তারিখে অর্থাৎ ১৩ ও ২৮ রমযানে কাদিয়ান থেকে দৃশ্যমান ছিল।’

বলে রাখা জরুরী, কাদিয়ানী লিখক এখানে ’কাদিয়ান থেকে দৃশ্যমান ছিল’ দাবী করলেও আমেরিকা মহাকাশ গবেষণা বিভাগ ‘নাসা’ তার এই দাবী প্রত্যাখ্যান করেছে। কারণ নাসা-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ১৮৯৪ সালের ৬ই এপ্রিলে সংঘটিত গ্রহণের মানচিত্রে (বেগুনি রঙ্গের একটি অঙ্কিত রেখা দ্বারা) উক্ত গ্রহণের কক্ষপথ দেখিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয় যে, সেটি বাংলাদেশ আর বেঙ্গালুরু-এর উপর দিয়ে দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে চলে যায়। এই গ্রহণ এশিয়ার নানা দেশসহ ভারতেরও কয়েকটি স্থান থেকে দৃশ্যমান হলেও কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পাঞ্জাব থেকে দেখা যায়নি। এখন প্রশ্ন হল, ‘কাদিয়ান’ কি ভারতের পাঞ্জাবের বাহিরে না ভেতরে? মজার বিষয় হল, নাসা-এর বিজ্ঞানীদের ওয়েবসাইটটিতে পরিষ্কার করে এও লিখা আছে, এই ধরণের চন্দ্রসূর্যগ্রহণের ঘটনা আজ অব্ধি প্রায় পাঁচ হাজারেরও অধিক বার ঘটেছিল। আপনি কি এরপরেও এটিকে প্রাকৃতিক সাধারণ নিয়মগুলোর মতই মানতে অস্বীকার করবেন?

প্রশ্নকর্তা : আপনি আর কোনো মাহদী দাবীদারের সময়ও এই ধরণের (চন্দ্রসূর্যগ্রহণের) ঘটনা ঘটেছিল বলে প্রমাণ করতে পারবেন?

উত্তরদাতা : জ্বী, পারব। আপনি কি মরক্কো বংশোদ্ভূত সালেহ বিন তারিফ-এর নাম শুনেছেন? তিনি নিজেকে ৭৪৪ সালে নবী দাবী করেন। তিনি ৭৯১ সাল পর্যন্ত মরক্কোর ‘বারঘৌতা বারবার’ রাজ্যের একজন শাসক ছিলেন। তিনি নিজেকে ইমাম মাহদীও দাবী করেছিলেন। তিনি যে বছর ইমাম মাহদী দাবী করেন তার পরের বছর অর্থাৎ ১২৬ হিজরী মুতাবিক ৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে একই রমাযানের ১৩ এবং ২৮ তারিখে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের ঘটনাও ঘটেছিল। আর এই ঘটনা তার সময় চারবার ঘটেছিল যথাক্রমে ৭৪৪, ৭৪৫, ৭৮৭ এবং ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে। তার প্রতিষ্ঠিত ঐ জামাতের নাম ছিল ‘সালেহুল মুমিনীন’। তার মৃত্যুর পরেও তার এই জামাত প্রায় সাড়ে তিন’শ বছর পর্যন্ত আফ্রিকায় খুব দাপটের সাথে প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। পরবর্তীতে ১০ম শতকের শেষের দিকে আল মুরাবিত রাজ-বংশের মুসলিম বীর সিপাহসালার ইউসুফ বিন তাসফিন এর নেতৃত্বে একটি যুদ্ধের মাধ্যমে সালেহ বিন তারিফের রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে ঐ মিথ্যা দলটিরও বিলুপ্তি ঘটে।

প্রশ্নকর্তা : কিন্তু মির্যা গোলাম আহমদ তো ১৮৯৪ সালের দিকে শুধু ইমাম মাহদী দাবীদারই ছিলেন, তিনি নবী দাবী করেননি? অথচ সালেহ বিন তারিফ তো নবী দাবীও করেছিল?

উত্তরদাতা : ‘বাবী জামাত’ এর প্রতিষ্ঠাতা ইরানের আলী মুহাম্মদ বাব সাহেবও ইমাম মাহদী দাবী করেছিলে (১৮৪৪ সাল)। তার আমলেও (১৮৫১ সাল) একই রমাযানে চন্দ্রসূর্য গ্রহণের ঘটনা ঘটেছিল। আর তিনিও শুধুই ইমাম মাহদী দাবী করেছিলেন। এখন সেও কি একই ঘটনার দরুন ইমাম মাহদী সাব্যস্ত হবেন? উল্লেখ্য, বর্তমানেও তার বহু অনুসারী (প্রায় ৪ মিলিয়ন, উইকিপিডিয়া) পৃথিবীতে রয়েছে। প্রায় ২১৮টি রাষ্ট্রে তার অনুসারীদের অবস্থান রয়েছে। যাইহোক, মির্যা গোলাম আহমদের জন্য একটি দুঃসংবাদ আছে, বলব?

: বলুন!

: মির্যা গোলাম আহমদ ঐ চন্দ্রসূর্যগ্রহণ সংক্রান্ত বর্ণনাটির মর্মার্থ বুঝাতে গিয়ে নিজ কিতাবে লিখে গেছেন, ‘বরং হাদীসের উদ্দেশ্য হল, কোনো নবুওয়ত বা রেসালত দাবীদারের সময়টিতে কখনো এই দুইটি গ্রহণ একত্রিত হবেনা।’ (রূহানী খাযায়েন ২২/২০৩)। মির্যা গোলাম আহমদ এই কথা বলে মূলত সে সমস্ত মাহদী দাবীদারের বিরুদ্ধে আঙ্গুল উঠাতে চাচ্ছেন যারা মাহদী দাবীর সময় নবুওয়ত ও রেসালতের দাবী করেনি, যদিও চন্দ্রসূর্যগ্রহণের ঘটনাও ঘটেছিল! হায়! মানুষ কতটা ধূর্ত হলে এইরূপ উদ্ভট ব্যাখ্যাও দিয়ে যেতে পারে! যাইহোক, এখন আমার প্রশ্ন হল, মির্যা গোলাম আহমদ ১৮৯৪ বা ১৮৯৫ সালে চন্দ্র সূর্যগ্রণের সময়ও পরিষ্কার করে নবুওয়ত বা রেসালতের দাবী করেননি, যা আপনিও জানেন; বরং তিনি ১৮৯৭ সালের দিকেও নবুওয়ত দাবিদারের প্রতি লানত (অভিশাপ) বর্ষণ করেছেন। (দেখুন মাজমু’আয়ে ইশতিহারাত ২/২৯৭-২৯৮ ও ২/২)।

এমতাবস্থায় ঐ দুই মিথ্যুকের সূত্রে বর্ণনাটি যদি সহীহও হত তবু মির্যা গোলাম আহমদকে ইমাম মাহদী সাব্যস্ত করার কোনো উপায় থাকেনা। অধিকন্তু মির্যা গোলাম আহমদের উক্ত ব্যাখ্যা অনুসারে ‘সালেহ বিন তারিফ’-ই ইমাম মাহদী সাব্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন। কারণ সে একই সময় ইমাম মাহদী এবং নবী দুটোরই দাবীদার ছিল! আশা করি, উক্ত রেওয়ায়েতটির অসারতা এবার আপনার নিকটও পরিষ্কার হয়ে গেল!

আচ্ছা! আপনি কি জানেন আপনাদের মির্যা গোলাম আহমদ সাহেব পরিষ্কার ভাষায় লিখে গেছেন যে, তার একনিষ্ঠ অনুসারীরা যে কোনো মতভেদপূর্ণ বিষয়ের সমাধান যেন তার কাছ থেকেই নেয়! (দেখুন রূহানী খাযায়েন ১৭/৬৪)। অন্তত এ দিক থেকেও আপনাদের জন্য বৈধ হবেনা ঐ দুই মিথ্যুকের বর্ণিত রেওয়ায়েতকে মাহদীয়তের কথিত নিদর্শন মনে করা। কারণ মির্যা সাহেব এও লিখে গেছেন ‘ইমাম বুখারীর কৃত শর্তের বিপরীত যে হাদীস সেটি গ্রহণযোগ্য নয়।’ (দেখুন রূহানী খাযায়েন ১৭/১১৯-২০)। পক্ষান্তরে ইমাম বুখারী উক্ত বর্ণনার সনদ (সূত্র) সম্পর্কে পরিষ্কার বলেছেন, এটি মুনকার রেওয়ায়েত। আপনি ইমাম বুখারীর সংকল ‘তারীখু কাবীর’ (৬/৩৪৪, ক্রমিক নং ২৫৮৩) কিতাব থেকেও দেখতে পারেন। তিনি সনদ সহ পরিষ্কার লিখে দিয়েছেন এভাবে যে, ((عَمْرو بْنُ شِمِّرٍ : روى بعضهم عَنْ عَمْرو بْن أَبِي عَبْد اللَّه، الجعفِي، عَنْ جَابِر، منكر الْحَدِيث)) অর্থাৎ “আমর ইবনে শিম্মির সম্পর্কে : কতিপয় ব্যক্তি আমর ইবনে আবী আব্দিল্লাহ, (আমর ইবনে শিম্মির) আল জা’ফী ও জাবির (ইবনে ইয়াজিদ আল জা’ফী) থেকে বর্ণনা করেছে। সে (আমর ইবনে শিম্মির) একজন মুনকার রাবী।” মনে রাখতে হবে, অগ্রহণযোগ্য হাদীস গুলোর একটি প্রকারকে ‘মুনকার হাদীস’ বলে। কিন্তু কাদিয়ানীদের নিকট এ প্রশ্নেরও কোনো সদুত্তর নেই। সংক্ষেপে।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here