এমদাদুস সুলুক গ্রন্থে নবীজীর ছায়া ও নূর এর তাৎপর্য সম্পর্কে

0
এমদাদুস সুলুক গ্রন্থে নবীজীর ছায়া ও নূর এর তাৎপর্য সম্পর্কে

এমদাদুস সুলুক গ্রন্থে ‘নবী করীম (সা.)-এর ছায়া থাকা এবং তিনি আল্লাহর নূর দ্বারা সৃষ্ট – মর্মে দলীলবিহীন ও মনগড়া যত সব আকীদার উল্লেখ রয়েছে সেসব আকীদা থেকে আমি আল্লাহর নিকট পানাহ চাচ্ছি! কারণ আমি ‘আকীদা’ এর ক্ষেত্রে শুধুই কুরআন এবং সহীহ হাদীস অত:পর মাতুরিদি ধারার ব্যাখ্যামূলক আকীদারই একনিষ্ঠ অনুসারী। এর বিপরীতে কোনো ব্যক্তি কী বলল তা আমার নিকট কোনো গুরুত্ব রাখেনা। হোক সে ব্যক্তি মর্যাদা ও সম্মানে অনেক বড় জ্ঞানী, কুতুবে জামান কিংবা মুজাদ্দিদে দাওরান!

মূল আলাপে আসা যাক,

মওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহিমাহুল্লাহ। একজন সমসাময়িক বিজ্ঞ স্কলার ও ফকীহ। আধ্যাত্মিক ধারার একজন বিখ্যাত পীর সাহেব। উনার অন্যতম রচনা ‘এমদাদুস সুলুক’। রচনাটি আধ্যাত্মিক কনসেপ্ট এর উপরই রচিত। এর মূল ভাষা ফার্সী, সেটিকে উর্দূতে ভাষান্তর করেছেন মওলানা আশেক ইলাহী মিরাঠি।

আমি এখানে বইটির উর্দূ এডিশন এর ২০১ এবং ২০২ নং পৃষ্ঠা থেকে বাংলায় অনুবাদ করে দিচ্ছি। পাঠকবৃন্দ খুব ভালো করে উর্দূর সাথে আমার অনুবাদটি মিলিয়ে নেবেন। এখানে যে বিষয়টির আলোকপাত করতে চাচ্ছি সেটি হচ্ছে, মওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী সাহেবের একটি আকীদা, যা তিনি সম্পূর্ণ মনগড়া ব্যাখ্যার আলোকে চিত্রিত করে গেছেন। তিনি লিখেছেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছায়া ছিলনা, তিনি আরও লিখেছেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তিনি আল্লাহর নূর দ্বারা সৃষ্টি হন এবং তাঁর নূর দ্বারা মুমিনগণ সৃষ্টি হন। অথচ তিনি এর সমর্থনে কোনো দলীল প্রমাণ উল্লেখ করেননি, কোনো নির্ভরযোগ্য হাদীস থেকে কিছুই উদ্ধৃত করেননি। যদিও বা একজন কুতুবে জামান খ্যাত, দারুলউলুম দেওবন্দের শীর্ষস্থানীয় একজন মান্যবর আলেম এবং ফকীহ থেকে এধরণের দলীল বিহীন ও মনগড়া আকীদা কেউই আশা করেনা, করতে পারেনা।

আমি একজন হানাফী মাযহাবের ফলোয়ার ও মাতুরিদি ধারার ব্যাখ্যামূলক আকীদার অনুসারী। সে হিসেবে আমি মওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী সাহেবের উক্ত আকীদার সমর্থন না হানাফী মাযহাবের স্বীকৃত কোনো কিতাবে পেয়েছি, আর না মাতুরিদি ধারার ব্যাখ্যামূলক আকীদার কোনো কিতাবে পেয়েছি, কোথাও পাইনি। বরং নির্ভরযোগ্য অসংখ্য হাদীসের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক হিসেবেই দেখতে পাই। অথচ একথা কারোরই অজানা নয় যে, কুরআন এবং বিশুদ্ধ হাদীসের বিপরীতে শুধুমাত্র দুর্বল রেওয়ায়েত কিংবা উম্মাহার প্রধান প্রধান ইমামগণের নিজেস্ব মত দ্বারা আকীদার কোনো বিষয় কখনোই সাব্যস্ত হয়না।

এবার রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী সাহেবের কিতাব থেকে হুবহু অনুবাদ তুলে ধরছি। যাতে উম্মাহ তাঁর মত একজন বিশিষ্ট ফকীহ ও আল্লামার নিজেস্ব মত ও বক্তব্য দ্বারা বিভ্রান্ত না হন। মওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী লিখেছেন,

প্রামাণ্য স্ক্যানকপি সহ এখানে

(এমদাদুস সুলুক পৃ-২০১ থেকে শুরু) আল্লাহ তায়ালা পরিষ্কার ভাষায় বলেন, ((قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى)) অর্থাৎ নিশ্চয়ই সে ব্যক্তি সফলকাম হয়েছে যে নিজের নফসের তাযকিয়া ও পরিশুদ্ধি করেছে। (সূরা আ’লা আয়াত ১৪)।

অর্থাৎ মোজাহাদার তরবারি দ্বারা নফসের কামনা বাসনার কদার্যতা কেটে ফেলেছে। উল্লেখ্য সায়ের ও পরিভ্রমনের কারণে মানুষের নফস আলোকিত হয়ে যায়। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা আপন হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শানে বলেছেন, ((قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ)) অর্থাৎ নিঃসন্দেহে আল্লাহতালার পক্ষ থেকে নূর ও স্পষ্ট কিতাব এসেছে। (সূরা মায়েদা আয়াত ১৫)। এখানে ‘নূর’ দ্বারা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম-এর পবিত্র সত্তা উদ্দেশ্য।

আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ((يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا وَدَاعِيًا إِلَى ٱللَّهِ بِإِذْنِهِۦ وَسِرَاجًا مُّنِيرًا)) অর্থাৎ হে নবী! নিশ্চয়ই আমি আপনাকে একজন সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা, ভয়প্রদর্শনকারী, আল্লাহর দিকে তারই নির্দেশে আহ্বানকারী এবং সিরাজাম মুনীরা তথা আলোকবর্তিকা প্রদীপ স্বরূপ বানিয়ে প্রেরণ করেছি (সূরা আহযাব আয়াত ৪৬)।

‘মুনীর’ অর্থ আলোকদাতা। যিনি অন্যকে আলো প্রদান করেন। যদি অন্যকে আলোকিত করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব হতো, তাহলে এ যোগ্যতা ও কামাল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভেতরে পাওয়া যেত না। কারণ তিনি তো আদম সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু আপন সত্তাকে এত পুতঃপবিত্র বানিয়ে নিয়েছিলেন যে, নির্মল নূরে পরিণত হয়েছিলেন। পরন্তু আল্লাহতালাও তাঁকে ‘নূর’ বলে অভিহিত করেছেন। প্রসিদ্ধ মতে সাব্যস্ত আছে যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোনো ছায়া ছিল না। অথচ দেহ বলতেই তার ছায়া থাকে। কেবল নূরেরই কোনো ছায়া থাকে না। যেভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং নূর বা আলোকবর্তিকা ছিলেন, তেমনিভাবে তাঁর অনুসারীদের অন্তরাত্মা ভালো করে তাদেরকেও নূরে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই তাদের কারামতের বর্ণনা দ্বারা কিতাব ভরপুর। এমনকি সেগুলো এত প্রসিদ্ধ যে, বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ((وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ نُورُهُمْ يَسْعَى بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ يَقُ)) অর্থাৎ যারা আমার হাবীবের প্রতি ঈমান এনেছে তাদের নূর তাদের সামনে এবং ডানে ছুটাছুটি করতে থাকবে। (সূরা তাহরীম আয়াত ৮)। আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেন, ((يَوْمَ تَرَى ٱلْمُؤْمِنِينَ وَٱلْمُؤْمِنَٰتِ يَسْعَىٰ نُورُهُم بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَٰنِهِم)) অর্থ- স্মরণ কর সেদিনটি যেদিন মুমিন পুরুষ ও নারীদের দেখবে, তাদের নূর ছুটছে তাদের সামনে ও ডানে। (সূরা হাদীদ আয়াত ১২)।

(তারপর ‘এমদাদুস সুলুক‘ পৃ-২০২ থেকে শুরু) আল্লাহতালা আরো বলেছেন, ((يَوْمَ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ لِلَّذِينَ آمَنُوا انظُرُونَا نَقْتَبِسْ مِن نُّورِكُمْ)) অর্থ- ঐ দিনকে স্মরণ কর, যেদিন মুমিনদের নূর তাদের সামনে ও ডানে ছুটবে। মুনাফিকরা বলবে, একটু থামো! আমরাও তোমাদের আলো থেকে কিছু জ্যোতি নেব। (সূরা হাদীদ আয়াত ১৩)।

আলোচ্য আয়াতগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ দ্বারা ঈমান ও নূর উভয়টি সাধিত হয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আল্লাহ তায়ালা আপন নূর দ্বারা আমাকে সৃষ্টি করেছেন, আমার নূর দ্বারা সৃষ্টি করেছেন সকল মুমিনকে।”

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরূপ দোয়াও করেছেন, “আমার পরওয়ারদিগার! আমার কান, চোখ ও কলবকে নূর বানিয়ে দিন, বরং আমাকেই নূর বানিয়ে দিন।” যদি মানুষের নফস আলোকিত হওয়া অসম্ভব হতো, তাহলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরূপ দোয়া কখনোই করতেন না। কেননা উলামায়ে কেরামের ঐক্যমতে অসম্ভব কাজের দোয়া করাও নিষেধ। হযরত আবুল হাসান নূরী (রহ.)-কে ‘নূরী’ বলার কারণ হচ্ছে, বহুবার তার থেকে নূর দেখা গিয়েছিল। এভাবে অসংখ্য আউলিয়া, সাধারণ ও শহীদের কবর থেকে নূর উঠতে দেখা যায়।

এটি মূলত তাঁদের পবিত্র আত্তারই ‘নুর’। কেননা যখন নফসের কাজ উচ্চাঙ্গের হয়ে যায়, তখন তার নূর সম্পূর্ণ শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। অতঃপর তা শরীরের মেজাজ ও স্বভাবে পরিণত হয়। এরপর যদি নফ্স শরীর থেকে আলাদাও হয়ে যায়, তবুও সে শরীর নূরের অনুরূপ উৎস ও কেন্দ্রস্থল থেকে যায়, যেমন ছিল জীবদ্দশায় নফস বাকি থাকা অবস্থায়।

(সম্পূর্ণ দুই পৃষ্ঠার অনুবাদ সমাপ্ত হল)

রেফারেন্সঃ এমদাদুস সুলুক (امداد السلوك ), ২০১-২০২, মূল লিখক মওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী, উর্দূ অনুবাদ মওলানা আশেক ইলাহী মিরাঠি।

শেষকথাঃ উপরে তার দীর্ঘ আলোচনা হতে আমি যা বুঝলাম তার আলোকে বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে, মওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী সাহেব রাসূল (সা.)-কে ‘রূপকার্থেই নূর’ বলেছেন। নইলে তিনি একই লাইনের শেষাংশে ‘মুমিনগণ তাঁর নূর দ্বারা সৃষ্টি’ – একথার কোনো অর্থই থাকেনা। তিনি এ ক্ষেত্রে দলীল বিহীন আরেকটি কথা লিখেছেন যে, “প্রসিদ্ধ মতে সাব্যস্ত আছে যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোনো ছায়া ছিল না।” তাঁর উপস্থাপনার ধরণ থেকে দুটি বিষয়ের যে কোনো একটি খুবই পরিষ্কার। তা হচ্ছে,

১. ছায়া ছিল না – এটি তাঁর আকীদা ছিলনা। বড়জোর তিনি ‘প্রচলিত আকীদা’ অনুসারেই এটি উদ্ধৃত করেছিলেন মাত্র। যেহেতু তিনি কোনো নস তথা গ্রহণযোগ্য কোনো প্রমাণ ছাড়াই এটি লিখেছেন এমনকি কথার শুরুতেই ‘প্রসিদ্ধ মতে’- শব্দে শর্ত আরোপ করেছেন।

২. ছায়া ছিল না, এটি তাঁর নিজেস্ব আকীদা, আর একথাই বাস্তব বলে বুঝা যায়। যেহেতু তিনি রাসূল (সা.)-কে কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের আলোকে ‘নূর’ সাব্যস্ত করার ধারাবাহিকতায় ঐ কথাটুকু টেনে এনেছেন। আর শেষে লিখেছেন, “অথচ দেহ বলতেই তার ছায়া থাকে। কেবল নূরেরই কোনো ছায়া থাকে না।”

তিনি এটুকু বলেই কথা শেষ করেননি। বরং তিনি একই লাইনের শেষাংশে আরও লিখেছেন,

“যেভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং নূর বা আলোকবর্তিকা ছিলেন, তেমনিভাবে তাঁর অনুসারীদের অন্তরাত্মা ভালো করে তাদেরকেও নূরে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।”

বলাবাহুল্য যে, মওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী সাহেব তাঁর ঐ কথা দ্বারা সাধারণদের মনে একটা প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেলেন। সেটি হচ্ছে, তাহলে কি একই যুক্তিতে রাসূল (সা.)-এর সকল অনুসারীর-ও ছায়া থাকেনা বলেই সাব্যস্ত হল না? অবশ্যই সাব্যস্ত হচ্ছে। নতুবা “তেমনিভাবে তাঁর অনুসারীদের অন্তরাত্মা ভালো করে তাদেরকেও ‘নূরে’ পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন”- তার এ কথার কী অর্থ?

আসলে মওলানা গাঙ্গুহী সাহেবের উপরিউক্ত কথাবার্তাগুলো শতভাগ আধ্যাত্মিক ও রূপকার্থেই ধর্তব্য ; নইলে তাঁর উক্ত কথাবার্তায় যে পরিমাণে অসঙ্গতি বিদ্যমান, তা বলাইবাহুল্য।

লিখক, মুহাম্মদ নূরুন্নবী এম.এ অ্যাডমিন ফিকহ মিডিয়া

তারিখ ১৫/০৫/২৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here