কাদিয়ানী মতবাদের পোস্টমর্টেম

0
কাদিয়ানী মতবাদের পোস্টমর্টেম

কাদিয়ানীবন্ধুর ইসলাম সম্পর্কে সীমাহীন অজ্ঞতা, জিহালাত, জাল জঈফ ও বিকৃত শিক্ষার খণ্ডনমূলক সরল উত্তর,

(জনৈক কাদিয়ানীবন্ধুর জিহালাত ও তার সরল উত্তর)

কাদিয়ানীবন্ধুঃ

ঈসা এবং মাহদী কি একই ব্যক্তি হবেন, নাকি ভিন্ন ব্যক্তি হবেন?

এর উত্তর হচ্ছে, যদি কুরআন থেকে প্রমাণিত হয় হযরত ঈসা (আ.) মারা গিয়েছেন, তার মানে হচ্ছে সেই বনী ইসরাইলী ঈসা (আ.) আর কখনো পৃথিবীতে আসবেন না। কুরআন থেকে প্রমাণিত যে, বনী ইসরাঈলী ঈসা মারা গেছেন। তাই তাঁর দ্বিতীয়বার আগমনের কোনো সুযোগ নাই (কাদিয়ানীদের বক্তব্য)।

সরল উত্তরঃ

পবিত্র কুরআনের নামে এগুলো কাদিয়ানীদের জঘন্য মিথ্যাচার। কারণ ইসলামের গত চৌদ্দশত বছরেও এধরণের দাবী কোনো বরেণ্য যুগ ইমাম, ফকীহ, মুফাসসির, মুহাদ্দিস কেউই করেননি। সুতরাং এধরণের দাবী ও মতবাদ সম্পূর্ণ বাতিল ও বিদয়াতি মতবাদ। সত্যের সাথে যার লেশমাত্র সম্পর্কও নেই। বরং অসংখ্য আয়াতে ঈসা (আ.)-এর পুনরায় আগমনী ইংগিত থাকা প্রমাণিত, উম্মতে মুহাম্মদীয়ার ইজমাও এর উপর বিদ্যমান যে, মরিয়ম পুত্র হযরত ঈসা (আ.)-এর পুনঃআগমন অকাট্য সত্য এবং এ বিশ্বাস ইসলামে তাওয়াতূর স্তরীয় বিশ্বাস।

এখন কাদিয়ানীদের মতে, কুরআন দ্বারা বনী ইসরাঈলী ঈসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা গেছেন বলে প্রমাণিত হলে, তখন পবিত্র কুরআন থেকে এ কথাও প্রমাণ করে আমাদেরকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, কুরআনে ঈসা (আ.)-এর আসার যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা হতে কাদিয়ানের চেরাগ বিবির পুত্র মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীই উদ্দেশ্য। কেননা মির্যা গোলাম আহমদ নিজেই তার আরেক রচনায় স্বীকার করে লিখেছেন,

اب ثبوت اس بات کا کہ وہ مسیح موعود جس کے آنے کا قران کریم میں وعدہ دیا گیا ہے یہ عاجز ہی ہے

অর্থ-“এখন একথা সাব্যস্ত হয়ে গেল যে, পবিত্র কুরআনে যেই মসীহ মওউদের আসার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে সে এই অধমই।” (রূহানী খাযায়েন ৩/৪৬৮)।

স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য

উল্লেখ্য, মির্যা কাদিয়ানীর ৮৩টি রচনার সমষ্টি ২৩ খণ্ডে প্রকাশিত রূহানী খাযায়েন, যার বাংলা অর্থ- আধ্যাত্মিক ভাণ্ডার।

কাদিয়ানীবন্ধুঃ

হযরত রসূল করীম (সা.) ঈসা (আ.) এর অবতরণের কথা বলেছেন। এর মানে হল, শেষ যুগে যিনি আগমন করবেন তিনি ঈসা (আ.)-এর সদৃশ হবেন। এর সমাধান তিনি নিজেই বলে গেছেন। হাদিসে উল্লেখ আছে,

((لاَ يَزْدَادُ الأَمْرُ إِلاَّ شِدَّةً وَلاَ الدُّنْيَا إِلاَّ إِدْبَارًا وَلاَ النَّاسُ إِلاَّ شُحًّا وَلاَ تَقُومُ السَّاعَةُ إِلاَّ عَلَى شِرَارِ النَّاسِ وَلاَ الْمَهْدِيُّ إِلاَّ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ))

অর্থাৎ, দিনে দিনে বিপদাপদ বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। দুনিয়াতে অভাব অনটন ও দুর্ভিক্ষ বাড়তেই থাকবে। কৃপণতা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে। নিকৃষ্ট লোকদের উপর কিয়ামত সংঘটিত হবে। মাহদী ঈসা ইবনে মরিয়ম ব্যতিরেকে অপর কেউ নন। (ইবনে মাজাহ, বাবু শিদ্দাতিয্যামান, হাদীস নং-৪০৩৯)। অতএব, যিনি ঈসা তিনিই মাহদী।

সরল উত্তরঃ

বর্ণনাটি সহীহ নয়। সর্বসম্মত ইমামগণের মতে এর সনদ বা সূত্র খুবই দুর্বল ও মুনকার (মেরকাত শরহে মেশকাত, কিতাবুল ফিতান ১০/১০১, মোল্লা আলী ক্বারী)। ইমাম মিজ্জি (রহ.) এর সনদে উল্লিখিত ‘মুহাম্মদ বিন খালিদ আল জানাদী’ (محمد ابن خالد الجندى) নামক বর্ণনাকারী সম্পর্কে লিখেছেন, সে অপরিচিত এবং মাতরূক তথা পরিত্যাজ্য। দেখুন, তাহযীবুল কামাল : খণ্ড নং ২৫ পৃষ্ঠা নং ১৪৬; রাবী নং ৫১৮১)। ইমাম শাওক্বানী (রহ.) বলেন, ইমাম সাগানী আল হিন্দী-الصغانى (মৃত. ৬৫০ হি.) ‘তাযকিরাতুল মওযূ’আত’ কিতাবে (১/২২৩) লিখেছেন, এ হাদীস জাল তথা বানোয়াট (আল ফাওয়ায়েদুল মাজমু’আহ-الفوائد المجموعة ১/৫১০)।

মজার ব্যাপার হল, মির্যা কাদিয়ানী নিজেও তার রচনায় স্বীকার করে লিখে গেছেন যে, এর সনদ খুবই দুর্বল, ফলে এর উপর নির্ভর করা যাবেনা। দেখুন, হামামাতুল বুশরা (বাংলা অনূদিত) পৃষ্ঠা নং ১৬১। তাছাড়া যুগ ইমামগণ বর্ণনাটির “ওয়া লাল মাহদী ইল্লা ঈসা”-((وَلَا الْمَهْدِىْ اِلَّا عِيْسَى بْنُ مَرْيَمَ)) উপবাক্যটির অর্থ করেছেন ((مَعْنَاهُ وَ لَا مَهْدِىٌّ كَامِلُ اَوْ مَعْصُوْمُ اِلَّا عِيْسَى ابْنُ مَرْيَمَ)) ‘তখন ঈসা ইবনে মরিয়ম ব্যতীত নিষ্পাপ বা পরিপূর্ণ সুপথপ্রাপ্ত আর কেউ নন1।’ এ অনুবাদ করেছেন, ইমাম কুরতুবি, ইমাম ইবনুল কাইয়ুম এবং ইবনে কাসীর প্রমুখ। দেখুন, আল আহাদীসুয য’ঈফাহ ১/৮৯, শায়খ আলবানী।

মজার ব্যাপার হল, মির্যা গোলাম কাদিয়ানী তার রচনার এক জায়গায় লিখেছেন, ((آنحضرت صلی اللہ علیہ وسلم بھی مہدی تہے)) অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ (সা.)ও ‘মাহদী’ ছিলেন। দেখুন, রূহানী খাযায়েন খণ্ড নং ১৪, পৃষ্ঠা নং ৩৯৪। সুতরাং বুঝা গেল, আক্ষরিক অর্থে শুধু ঈসা (আ.) কেন, বরং যে কোনো সুপথপ্রাপ্ত পুরুষকেও ‘মাহদী’ শব্দে সম্বোধন করা যেতে পারে। তাতে সবাইকে একই ব্যক্তি বুঝাবেনা। যাইহোক, সর্বশেষ কথা হচ্ছে, বর্ণনাটি ‘সহীহ’ মানলেও কাদিয়ানীদের যে শিক্ষা ও মতবাদ সে ধরনের কোনো কিছুই এর দ্বারা ইংগিতেও প্রমাণিত হয় না।

কাদিয়ানীবন্ধুঃ

রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ((يُوْشِكُ مَنْ عَاشَ مِنْكُمَ اَنْ يَلْقَى عِيْسَى بْنَ مَرْيَمَ إِمَامًا مَهْدِيًّا وَحَكَمًا عَدَلًا فَيَكْسِرُ الصَّلِيْبَ وَيَقْتُلُ الْخِنْزِيْرَ وَيَضَعُ الْجِزْيَةَ وَتَضَعُ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا))

অর্থঃ “তোমাদের মধ্যে তখন যারা জীবিত থাকবে তারা ঈসা ইবনে মরিয়মকে ইমাম মাহদী হিসেবে পাবে যিনি শাসক ও ন্যায় বিচারক হিসেবে আগমন করবেন। এরপর তিনি ক্রুশ ধ্বংস করবেন, শূকর হত্যা করবেন এবং জিযিয়া বা যুদ্ধকর বন্ধ করবেন আর তখন অস্ত্রযুদ্ধ রহিত হবে।” (মুসনাদ আহমদ বিন হাম্বল, হাদীস নং ৯০৬৮, প্রকাশনা: দারূল আহহীয়াউত্তুরাস আল আরাবী, বৈরুত, লেবানন)।

সরল উত্তরঃ

হাদীসটি সহীহ, তবে এটিও কাদিয়ানীদের শিক্ষা ও মতবাদকে ইংগিতেও সমর্থন করেনা। কেননা, হাদীসটিতে পরিষ্কার শব্দে وَيَضَعُ الْجِزْيَةَ অর্থাৎ ঈসা (আলাইহিস সালাম) এসে ‘যুদ্ধকর’ রহিত করবেন, উল্লেখ আছে। জ্ঞানীদের জানা আছে যে, যুদ্ধকর রহিত করার এ সক্ষমতা বেসামরিক কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নেই। বরং এ ধরনের সক্ষমতা শুধুই রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী প্রশাসনিক ব্যক্তির-ই রয়েছে। কাজেই এ হাদীসটিও অকাট্য ইংগিত দিচ্ছে যে, আগমনকারী ঈসা হতে প্রকৃত ঈসা ইবনে মরিয়মই উদ্দেশ্য, যিনি আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত হবেন এবং যথাসময়ে উম্মাহার নেতৃত্বে থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ করবেন এবং রাসূল (সা.)-এর ফরমান অনুযায়ী তিনি রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি করে “যুদ্ধকর” স্থগিত করবেন।

বলে রাখা জরুরি যে, মির্যা গোলাম আহমদ সারা জীবনে মেম্বার চেয়ারম্যান হতে পারা তো দূরের কথা, তিনি কোনোদিন সর্বনিম্ন “গ্রাম সরকার” বা চকিদার-ও ছিলেন না। সুতরাং এ হাদীস জীবন গেলেও তার সাথে খাপ খাবেনা।

এবার হাদীসটির সঠিক অনুবাদ জেনে নিইঃ

রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন,

((يُوْشِكُ مَنْ عَاشَ مِنْكُمَ اَنْ يَلْقَى عِيْسَى بْنَ مَرْيَمَ إِمَامًا مَهْدِيًّا وَحَكَمًا عَدَلًا فَيَكْسِرُ الصَّلِيْبَ وَيَقْتُلُ الْخِنْزِيْرَ وَيَضَعُ الْجِزْيَةَ وَتَضَعُ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا))

অনুবাদঃ “তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে তারা অবশ্যই অচিরেই মরিয়ম পুত্র ঈসার সাথে মিলিত হবে, যিনি একজন ন্যায়বিচারক এবং সুপথপ্রাপ্ত নেতা হবেন, তিনি ক্রুশ চূর্ণ করবেন, শুয়োর হত্যা করবেন, যুদ্ধকর রহিত করবেন, এবং ধর্মযুদ্ধ তার সমস্ত যুদ্ধ-সরাঞ্জাম ভারমুক্ত করবে।”

এখানে হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে বিশেষণমূলক (মুরাক্কাবে তাওসীফী) যৌগিক উপবাক্য ((إِمَامًا مَهْدِيًّا)) অর্থ- “একজন সুপথপ্রাপ্ত ইমাম”। কাদিয়ানীরা এর ব্যকরণ-বিরুদ্ধ অনুবাদ তো করেই, তার উপর অপব্যাখ্যা দিয়ে বলে যে, এতে নাকি এটাই বুঝানো উদ্দেশ্য যে, ঈসা আর ইমাম মাহদী দু’জন মূলত একই। নাউযুবিল্লাহ। মূর্খতারও একটা সীমা থাকা দরকার। আফসোস! এ নির্বোধরা এতই বেপরোয়া যে, একই ধরণের আরো যত বিশেষণমূলক হাদীস রয়েছে তারা সেগুলোর উদ্দেশ্য নিয়ে একদমই চিন্তা করেনা।

যেমন, হযরত জারির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন ((ﻭَإجْعَلْهُ هَادِيًا مَهْدِيًّا)) অর্থাৎ হে আল্লাহ আপনি তাকে “একজন সুপথপ্রাপ্ত হিদায়াতকারী” বানিয়ে দিন (বুখারী কিতাবুল জিহাদ ওয়াস সিয়ার)।

তারপর হযরত মু’আবিয়া (রা.) সম্পর্কেও বলা হয়েছে যে, ((اَللَّهُمَّ إجْعَلْهُ هَادِيًا مَهْدِيًّا وَ إهْدِ بِهِ)) অর্থাৎ হে আল্লাহ আপনি তাঁকে “একজন সুপথপ্রাপ্ত হিদায়াতকারী” বানিয়ে দিন আর তার মাধ্যমে [মানুষকে] হিদায়াত দান করুন। (তিরমিযী কিতাবুল মানাকিব)।

তদ্রুপ হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে আরেকটি হাদীসে এসেছে ((إِمَامًا عَادِلاً وَ قَاضِيًاً)) “তিনি একজন ন্যায়পরায়ণ ও বিচারক ইমাম…”। দেখুন, ইমাম আবু বকর আশ-শাফেয়ী (মৃত ৩৫৪ হিজরী) সংকলিত, আল ফাওয়ায়িদুশ শাহীর বিল গাইলানিয়াত : হাদীস নং ৭৯৩ ও ৮২৪।

এখন প্রশ্ন হল, তবে কি রাসূল (সা.) জারির ইবনে আব্দুল্লাহ আর হযরত মু’আবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) তাঁদের দু’জনকেও প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী বুঝালেন?

হাদীসটিকে অপরাপর সহীহ হাদীসগুলোর সাথে মিলিয়ে পড়ার পর পাঠকের নিকট পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, হাদীসটিতে ঈসা (আ.)-কে শুধু আক্ষরিক অর্থেই ‘মাহদী’ আখ্যা দেয়া হয়েছে। যার দরুন হযরত ফাতেমা (রা.)-এর বংশ থেকে আসন্ন শেষ যুগের প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদীর ধারণা বাতিল হয়ে যাবেনা। কারণ, আক্ষরিক অর্থে আবুবকর, উমর, উসমান এবং আলীকেও রাসূল (সা.) একত্রে ‘আল-মাহদিয়্যীন’ ((فعليكم بسُنَّتي وسُنَّةِ الخُلَفاءِ الرَّاشِدينَ المَهْدِيِّينَ)) বলেছেন। দেখুন, তিরমিযী শরীফ, কিতাবুল ইলম হা/২৬৭৬, সনদ সহীহ। আর সে হিসেবে তথা আক্ষরিক অর্থে শুধু ঈসা (আ.) নয়, বরং সকল নবী-ই ছিলেন ‘মাহদী’ তথা সুপথপ্রাপ্ত। আশাকরি, উত্তর পেয়েছেন।

কাদিয়ানীবন্ধুঃ

রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন,

كَيْفَ أَنْتُمْ إِذَا نَزَلَ ابْنُ مَرْيَمَ فِيكُمْ وَإِمَامُكُمْ مِنْكُمْ

অর্থ “তোমাদের অবস্থা তখন কেমন হবে, যখন ইবনে মরিয়ম তোমাদের মধ্যে আবির্ভূত হবেন এবং (তিনি) তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের ইমাম হবেন (কাদিয়ানী অনুবাদ)।” (বুখারী-৩৪৪৯, মুসলিম, কিতাবুল ঈমান-২৮৩)।

সরল উত্তরঃ

কাদিয়ানীদের অনুবাদে নিকৃষ্ট তাহরিফ (বিকৃতি) রয়েছে। অথচ সঠিক অনুবাদ হচ্ছে,

“তোমাদের অবস্থা তখন কেমন (আনন্দের) হবে, যখন ইবনে মরিয়ম তোমাদের মধ্যে নাযিল হবেন আর তোমাদের ইমাম (মাহদী) তোমাদেরই মধ্য থেকে হবেন (ফাতহুল বারী, ইবনু হাজার আসকালানী রহ.)।” (বুখারী-৩৪৪৯, মুসলিম, কিতাবুল ঈমান-২৮৩)।

সরল উত্তরঃ

এ হাদীসটি বরং কাদিয়ানীদের শিক্ষা ও মতবাদেরই সম্পূর্ণ বিরোধী। প্রথমতঃ তার কারণ, হাদীসটিতে “ইবনু মরিয়ম” বলা হয়েছে। যার অর্থ- মরিয়মের পুত্র। কিন্তু মির্যা গোলাম আহমদের মায়ের নাম ছিল চেরাগ বিবি। সুতরাং মিললো না।

দ্বিতীয়তঃ এ হাদীসের ((ابْنُ مَرْيَمَ فِيكُمْ وَإِمَامُكُمْ مِنْكُمْ)) উপবাক্যটি পরিষ্কার বলছে যে, ইমাম মাহদী এবং ঈসা ইবনে মরিয়ম দু’জনই শেষযুগে পৃথিবীতে সমসাময়িক হবেন। সহীহে বুখারীর উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) ফাতহুল বারী গ্রন্থে বিভিন্ন হাদীসবিদগণের উদ্ধৃতির পরিপ্রেক্ষিতে জোরালো যে মতটিকে সুস্পষ্ট করে গেছেন তা হচ্ছে, হাদীসটির ((وَإِمَامُكُمْ مِنْكُمْ)) “আর তোমাদের ইমাম তোমাদেরই মধ্য হতে হবেন” এর দ্বারা ইমাম মাহদীকেই বুঝানো উদ্দেশ্য। (ফাতহুল বারী, কিতাবু আহাদীসিল আম্বিয়া হাদীস নং ৩৪৪৯)।

ইবনে মাজাহ’র দাজ্জাল সম্পর্কিত আবূ উমামাহ’র দীর্ঘ হাদীসে এসেছে,

((كُلُّهُمْ أَىْ الْمُسْلِمُوْنَ بِبِيْتِ الْمُقَدَّسِ وَ اِمَامُهُمْ رَجُلٌ صَالِحٌ قَدْ تَقَدَّمَ لِيُصَلِّى بِهِمْ, اِذْ نَزَلَ عِيْسَى فَرَجَعَ الْاَمامُ يَنْكُصُ لِيَتَقَدَّمَ عِيْسَى, فَيَقِفُ عِيْسَى بَيْنَ كَتِفَيْهِ ثُمَّ يَقُوْلُ: تَقَدَّمْ فَاِنَّهَا لَكَ اُقِمَتْ))

অর্থ- “মুসলমানগণ বায়তুল মুকাদ্দাসে (সালাতের জন্য অপেক্ষা রত) থাকবে। তখন তাদের ইমাম থাকবেন জনৈক নেককার ব্যক্তি। তিনি তাদের সালাত পড়ানোর জন্য সামনে অগ্রসর হবেন। এমতাবস্থায় হঠাৎ (তারা দেখতে পাবে) ঈসা অবতরণ করছেন। ফলে ইমাম সাহেব পেছনে সরে আসবেন যাতে ঈসা সামনে অগ্রসর হন। হযরত ঈসা তাঁর কাঁধের মাঝখান বরাবর এসে দাঁড়াবেন, তারপর (ইমামকে) বলবেন ‘আপনিই অগ্রসর হোন, ইক্বামত আপনার জন্যই দেয়া হয়েছে’। ইমাম আবুল হাসান আল খাস’ঈ আল আবিদী ‘মানাকিবে শাফেয়ী’ গ্রন্থে বলেন, মুতাওয়াতির ভাবে বহু হাদীস বর্ণিত আছে যে, নিশ্চয়ই ঈসা (আ.) এই উম্মতের (ইমাম) মাহদীর পেছনেই সালাত আদায় করবেন। তিনি এটি ইবনে মাজাহ’র হাদীসে আনাস থেকে বর্ণিত [মুনকার রেওয়ায়েত] ((وَلَا مَهْدِيّ إِلَّا عِيسَى)) “ঈসা ব্যতীত আর কোনো মাহদী নেই” (কাদিয়ানী অনুবাদ)-এরই রদ করার উদ্দেশ্যে উল্লেখ করেছেন।

ইমাম আবূ ঝার আল হারাভী বলেন, ইমাম আল যাওযাকী কোনো কোনো মুতাকাদ্দিমীনের কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ((وَإِمَامكُمْ مِنْكُمْ)) “তখন তোমাদের ইমাম তোমাদেরই মধ্য থেকে হবেন” এ কথার অর্থ হচ্ছে, তিনি (ঈসা) পবিত্র কুরআন দিয়েই রাষ্ট্রপরিচালনা করবেন, ইঞ্জিল কিতাব দিয়ে নয়। ইমাম ইবনে তীন বলেন, ((وَإِمَامكُمْ مِنْكُمْ)) এর অর্থ ((أَنَّ الشَّرِيعَةَ الْمُحَمَّدِيَّةَ مُتَّصِلَةٌ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامِ وَ أَنَّ كُلَّ قَرْنٍ طَائِفَةٌ مِنْ أَهْلِ الْعِلْمِ فِي الخ)) “নিশ্চয়ই শরীয়তে মুহাম্মদীয়া কেয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে এবং প্রতি শতাব্দীতে আহলে ইলমগণ থেকে একটি দল (তার সেবায়) বিদ্যমান থাকবে”। ফাতহুল বারী শরহে সহীহ বুখারী। (অনুবাদ সমাপ্ত হল)।

এখন হয়ত কাদিয়ানীবন্ধু বলবে যে, আগত ঈসা একজন “রূপক ঈসা”। কাজেই, হাদীসটির “ইবনু মরিয়ম” বলতেও “রূপক মরিয়ম পুত্র” উদ্দেশ্য! কিন্তু কাদিয়ানীবন্ধুরা হয়ত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর বইগুলো খেয়াল করে পড়লে জানার কথা যে, তিনি নিজেই তার একটি রচনায় লিখেছেন,

“রাসূল (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর ভিত্তিতে কসম খেয়ে যা বলেছেন তার ব্যতিক্রম কীভাবে হতে পারে? এই ক্ষেত্রে এই কসমটি সাব্যস্ত করছে প্রদত্ত সংবাদটি বাহ্যিক অর্থেই পূর্ণ হবে এর রূপক অর্থ করা যাবেনা আর কোনো ব্যতিক্রমও হবেনা। আর যদি তাই হয় তাহলে কসম খেয়ে কী লাভ? অতএব অনুসন্ধিৎসু ও গবেষকের ন্যায় চিন্তা করে দেখ।” দেখুন, হামামাতুল বুশরা (বাংলা অনূদিত) পৃষ্ঠা নং ২৭।

কি বুঝলেন?…. কসমটি সাব্যস্ত করছে প্রদত্ত সংবাদটি বাহ্যিক অর্থেই পূর্ণ হবে এর “রূপক” অর্থ করা যাবেনা!

এখন যিনি নিজেই “রূপক” অর্থ করা যাবেনা বলছেন তাকেই আপনারা কসম সম্বলিত হাদীসের আলোকে আপনারা “রূপক” মসীহ বলে চিৎকার করতেছেন! এটা কি নিজের আক্বল ও বিবেকের সাথে ঠাট্টা মশকরা করা নয়?

এ দেখুন, কসম বা শপথ বাক্য সহকারে বর্ণিত সহীহ বুখারীর হাদীসটি অর্থ সহ,

সহীহ বুখারী (ইফা), অধ্যায়ঃ ৫০/ আম্বিয়া কিরাম (আ.) (كتاب أحاديث الأنبياء), হাদীস নম্বরঃ ৩২০৫, ((حَدَّثَنَا إِسْحَاقُ، أَخْبَرَنَا يَعْقُوبُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، حَدَّثَنَا أَبِي، عَنْ صَالِحٍ، عَنِ ابْنِ شِهَابٍ، أَنَّ سَعِيدَ بْنَ الْمُسَيَّبِ، سَمِعَ أَبَا هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏’‏ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَيُوشِكَنَّ أَنْ يَنْزِلَ فِيكُمُ ابْنُ مَرْيَمَ حَكَمًا عَدْلاً، فَيَكْسِرَ الصَّلِيبَ، وَيَقْتُلَ الْخِنْزِيرَ، وَيَضَعَ الْجِزْيَةَ، وَيَفِيضَ الْمَالُ حَتَّى لاَ يَقْبَلَهُ أَحَدٌ، حَتَّى تَكُونَ السَّجْدَةُ الْوَاحِدَةُ خَيْرًا مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا ‏’.‏ ثُمَّ يَقُولُ أَبُو هُرَيْرَةَ وَاقْرَءُوا إِنْ شِئْتُمْ ‏(‏وَإِنْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ إِلاَّ لَيُؤْمِنَنَّ بِهِ قَبْلَ مَوْتِهِ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكُونُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا‏)‏‏.‏))

অনুবাদঃ ‘ইসহাক (রহ.) … আবূ হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, কসম সেই সত্তার, যার হাতে আমার প্রাণ, অচিরেই তোমাদের মাঝে মরিয়মপুত্র ঈসা (আ.) শাসক ও ন্যায় বিচারক হিসেবে অবতরণ করবেন। তিনি ‘ক্রুশ’ ভেঙ্গে ফেলবেন, শুয়োর মেরে ফেলবেন এবং তিনি জিজিয়া (রাষ্ট্রীয় কর) পরিসমাপ্তি ঘটাবেন। তখন সম্পদের স্রোতে বয়ে চলবে। এমনকি কেউ তা গ্রহণ করতে চাইবে না। তখন আল্লাহকে একটি সিজদা করা সমগ্র দুনিয়া এবং তার মধ্যকার সমস্ত সম্পদ থেকে বেশী মূল্যবান বলে গণ্য হবে। এরপর আবূ হুরায়রা (রা.) বলেন, তোমরা ইচ্ছা করলে এর সমর্থনে এ আয়াতটি পড়তে পারঃ কিতাবীদের মধ্যে প্রত্যেকে তাঁর [ঈসা (আ.) এর] মৃত্যুর পূর্বে তাঁকে বিশ্বাস করবেই এবং কিয়ামতের দিন তিনি তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবেন। (সহীহ বুখারী, হা/৩২০৫; ঈসা ইবনে মরিয়ম নাযিল হওয়া শীর্ষক পরিচ্ছেদ)।

হাদীসটির শুরুতেই কসম বা শপথ বাক্যটি আরেকবার দেখুন,

“রাসূল (সা.) বলেছেন, কসম সেই সত্তার, যার হাতে আমার প্রাণ, অচিরেই তোমাদের মাঝে মরিয়মপুত্র ঈসা (আ.) শাসক ও ন্যায় বিচারক হিসেবে অবতরণ করবেন।”

এখন এর কী উত্তর?

(লিখাটির উপর কারো কোনো মন্তব্য থাকলে তা মন্তব্যের জায়গায় লিখুন)

  1. আহাদীসুয যু’ঈফাহ শায়খ আলবানী রহ. খ ১ পৃ ৮৯, আল কওলুল মুখতাসার, ইবনু হাজার আল হাইতামী পৃ-৩২ ↩︎

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক
প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী
Principal NurunNabi
তাং ১৫/০৬/২৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here