প্রশ্ন : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘নূর’ ছিলেন, এ কথা থেকে উদ্দেশ্য কী?
উত্তর : রাসূল (সা.) নিঃসন্দেহে নূর, তাঁর ছায়ার অস্তিত্ব নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য, তবে মাঝেমধ্যে ‘ছায়া মুবারক’ মুজিজা স্বরূপ জমিনে পতিত হত না, সে কথাও সঠিক! বিস্তারিত….
রাসূল (সা.) নিঃসন্দেহে ‘সিফাতি নূর’ ছিলেন (সূরা মায়েদা ১৫), মাঝেমধ্যে তাঁর ‘ছায়া মুবারক’ জমিনে পড়ত না (সাধারণ ছায়ার মত দৃষ্টিগোচর হত না-লিখক), আর সেটির উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল এ যে, উনার ছায়া মুবারক যাতে কেউ পদদলিত করতে না পারে। আর এটিকে উনার (সা.) বিশেষ মুজিজা-ও বলা যায়।
উল্লেখ্য, অস্বাভাবিক ঘটনা-ই মুজিজা হয়ে থাকে, স্বাভাবিক বা সাধারণ কোনো জিনিসকে মুজিজা বা অলৌকিকতা বলেনা। কাজেই, যদি বলা হয় যে, রাসূল (সা.)-এর ছায়া (প্রতিবিম্ব) ছিল-ই না অর্থাৎ ছায়ার অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয় তখন “মাঝেমধ্যে ছায়া জমিনে না পড়া কিংবা আলোতে দৃশ্যমান না হওয়া” সাধারণ ঘটনা বলে গণ্য হবে। অথচ একজন প্রকৃত আশেক বা নবী-প্রেমিক তার মা’শুক (নবীজী)-এর মুজিজাকে কখনো অস্বীকার করতে পারেনা। তাফসীরে মাদারিক প্রণেতা খুব চমৎকার বলেছেন,
لئلا يقع انسان قدمه على ذالك الظل
অর্থাৎ আল্লাহতালা নবীজীর ছায়া মুবারক মাটিতে পতিত করেন না, যাতে কেউ উনার ছায়াকে মাড়াতে না পারে। (পারা নং ১৮ দ্রষ্টব্য)। খেয়াল করুন, আমাদের সালফে সালেহীন-ও ছায়ার অস্তিত্ব অস্বীকার করতেন না।
জ্ঞানীদের নিশ্চয়ই ভাবিয়ে তুলবে।
ইমাম সুয়ূতী (রহ.)-এর ছাত্র আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ শামী (মৃত. ৯৪২ হিজরী)। তিনি তাঁর রচিত প্রসিদ্ধ সীরাতগ্রন্থ ‘সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ ফী সীরাতি খাইরিল ইবাদ’ এর মধ্যে হাকিম তিরমিজি থেকে তাবেয়ী যাকওয়ান (রহ.) এর কথাটির ব্যাখ্যাও এনেছেন। যা সাধারণত আমাদের সরলমনা আশেক বন্ধুরা উল্লেখ করতে ভুলে যান। সেটি এইরূপ,
قال ذكوان لم ير لرسول الله ظل في شمس ولا قمر. رواه الحكيم الترمذي. وقال: معناه لئلا يطأ عليه كافر فيكون مذلة له
অর্থাৎ ‘যাকওয়ান (রহ.) বলেন, সূর্যের বা চাঁদের আলোয় রাসূল (সা.)-এর ছায়া দেখা যেত না। হাকীম তিরমিজি কথাটি সংকলন করেছেন। তিনি বলেছেন, এর অর্থ হল, যেন কোনো কাফের তাঁর ছায়া পদদলিত করতে না পারে; কারণ এতে তাঁর অবমাননা হয়।’’ খুব খেয়াল করুন, পূর্ববর্তী ইমামগণের কেউই ছায়ার অস্তিত্ব অস্বীকার করেননি। সুতরাং বিভ্রান্ত হবার কোনো কারণ নেই।
আর হ্যাঁ, অন্যান্য হাদীসে রাসূল (সা.) এর ছায়া মুবারক এর উল্লেখ রয়েছে। ফলে “ছায়া” এর অস্বীকার এক প্রকারের ভ্রান্তি ও হাদীস বিরোধিতা। যা কখনো সঠিক মানহাজ হতে পারেনা।
দলিল –
(ক) উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, হযরত যয়নব (রা.) তিনি নবীজীর ছায়া দেখা সম্পর্কে পরিস্কার বলেছেন : ‘ফা রাআইতু জিল্লাহু।’ আরবী ইবারত –
فرأيت ظله
অর্থাৎ আমি তাঁর ছায়া দেখেছি। (মুসনাদে আহমদ ৭/৪৭৪; হাদীস নং ২৬৩২৫, সহীহ)।
(খ) উম্মুল মুমিনীন হযরত সাফিয়্যাহ বিনতে হুয়াইহি (রা.) হতেও বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘ইয্ আনা বি-জিল্লি রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুক্ববিলুন।’ আরবী ইবারত –
إذ أنا بظل رسول الله صلى الله عليه وسلم مقبل
অর্থাৎ ইত্যবসরে আমি আল্লাহ’র রাসুলের ছায়ার নাগাল পেয়ে যাই। সংক্ষেপে।
সনদ সহ সম্পূর্ণ রেওয়ায়েত –
قال:حَدَّثَنَا عَفَّانُ حَدَّثَنَا حَمَّادٌ قَالَ ثَابِتٌ عَنْ شُمَيْسَةَ عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: فَبَيْنَمَا انَا يَوْما بِنِصْفِ النَّهَارِ اذَا انَا بِظِلِّ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مُقْبِلٌ. وإسناده حسن عند الحافظ، فكل رجاله ثقات إلا شميسة قال الحافظ عنها: مقبولة.
রেফারেন্সঃ মুসনাদে আহমদ ৬/১৩২; হাদীস নং ২৫০০২; হাদীসের সব রাবী ছিক্বাহ।
(গ) নবীজী (সা.)-এর দীর্ঘ দশ বছরের খাদেম হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) হতে মারফূ সনদে ও একদম সহীহসূত্রে বর্ণিত আছে, তিনি (সা.) কোনো এক ঘটনা প্রেক্ষিতে বলেছেন, ‘রাআইতু জিল্লি ওয়া জিল্লাকুম ফীহা’। আরবী ইবারত –
رأيت ظلى و ظلكم فيها
অর্থাৎ তথায় (জাহান্নামের অগ্নির আলোতে) আমি আমার এবং তোমাদের ‘ছায়া’ দেখেছি। সংক্ষেপে।
সনদ সহ সম্পূর্ণ রেওয়ায়েত-
عبد الله بن وهب حدثني معاوية بن صالح عن عيسى بن عاصم عن زر بن حبيش عن أنس بن مالك قال :صَلَّيْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم صَلاَةَ الصُّبْحِ ، قَالَ : .. ثُمَّ عُرِضَتْ عَلَيَّ النَّارُ بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ ، حَتَى رَأَيْتُ ظِلِّي وَظِلَّكُمْ. وهذا إسناد صحيح لا غبار عليه.
রেফারেন্সঃ সহীহ ইবনে খোজায়মা ২/৫০, হাদীস নং ৮৯; মুসতাদরাক লিল হাকিম ৫/৬৪৮; হাদীস নং ৮৪৫৬; হাদীসের মান, সহীহ।
(ঘ) মাজমাউয যাওয়ায়িদ থেকে, এর সনদ সহীহ এবং সকল রাবী সহীহ বুখারী ও মুসলিমের, হাদীসের খণ্ডাংশ,
أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يمشي في أناس من أصحابه فتستر بثوب، فلما رأى ظله رفع رأسه فإذا هو بملاءة قد ستر بها
অর্থাৎ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর কিছু সঙ্গীদের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি কাপড় দ্বারা ঢেকে থাকলেন। অত:পর তিনি যখন নিজের ছায়া দেখলেন, মাথা উঠালেন; তৎক্ষনাৎ একটি চাদর দ্বারা নিজেকে ঢেকে ফেললেন।
সনদ সহ সম্পূর্ণ রেওয়ায়েত-
وعن عبد الله بن جبير الخزاعي: أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يمشي في أناس من أصحابه فتستر بثوب، فلما رأى ظله رفع رأسه فإذا هو بملاءة قد ستر بها ، فقال له : مه. وأخذ الثوب فوضعه ، فقال : إنما أنا بشر مثلكم .رواه الطبراني ، ورجاله رجال الصحيح ..
রেফারেন্সঃ মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৯/২১, হাদীস নং ১৪২২৫, ইমাম নূরউদ্দীন আল হাইসামী (রহ.) বলেন, এর সকল বর্ণনাকারী সহীহ’র বর্ণনাকারী। ইমাম তাবারানী (রহ.)ও এটি তার ‘সুনানু তাবারানী’ গ্রন্থে নিজ সনদে উল্লেখ করেছেন।
যাকওয়ান এর রেওয়ায়েত-এর তাহকিক,
তাবেয়ী হযরত যাকওয়ান (রহ.)-এর বর্ণনাটির সনদ খুবই জইফ। তাহকীক করলে দেখা যাবে, দুইজন রাবীই তাতে যথাক্রমে অভিযুক্ত এবং অজ্ঞাত। আর আকীদার ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো বর্ণনার রেফারেন্স টানাও অন্যায়। কিন্তু আমি যাকওয়ান (রহ.)-এর বর্ণনাটি আমলে নিয়েই কথা বলছি, তার ঐ বর্ণনায় ‘রাসূল (সা.)-এর ছায়া এর অস্তিত্ব ইংগিতেও অস্বীকার করার কোনো রসদ নেই।
জ্ঞানীদের উদ্দেশ্যে সনদের দুজন রাবী সম্পর্কে ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী (রহ.)-এর কিতাব থেকে নিচে তুলে ধরছি, তিনি লিখেছেন,
عبد الرحمن بن قيس، وهو مطعون، عن عبد الملك بن عبد الله بن الوليد، وهو مجهول، عن ذكوان
অর্থাৎ যাকওয়ান থেকে আব্দুল মালেক বিন আব্দুল্লাহ বিন ওয়ালিদ একজন মাজহূল (অপরিচিত), আর আব্দুর রহমান বিন কায়েস একজন মাত্ব’ঊন তথা অভিযুক্ত।
– শারহুশ শিফা ১/৭৫৩, মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী মাতুরিদি।
শেষকথা হচ্ছে, রাসূল (সা.) সহ সকল নবী রাসূল এমনকি সুপথপ্রাপ্ত সমস্ত মুমিন মুসলমান আল্লাহর “সিফাতি নূর”। যদিও নবীগণ আর সাধারণ মুমিনগণের মধ্যকার ঐ “নূর” এর কোয়ান্টিটি সম্পূর্ণ ভিন্ন, বরং তুলনাহীন। সহীহ মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাকারক কাজী ইয়াজ (রহ) তার ‘ইকমালুল মুসলিম’ কিতাবের ৩য় খন্ডের ১২৫-২৬ নং পৃষ্ঠায় খুব চমৎকার করে বিষয়টি বুঝিয়ে দিয়েছেন। যেমন তিনি اللهم اجعلنى نورا-এর তাৎপর্য বুঝিয়ে দিতে লিখেছেন, معنى النور هنا بيان الحق والهداية اليه অর্থাৎ এখানে (নবীজীর শানে ব্যবহৃত) ‘নূর’ এর তাৎপর্য হল, তিনি সত্য ও হিদায়াতের দিকে পথপ্রদর্শনকারী। উদাহরণস্বরূপ, আমরা দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে বলি- সোনার বাংলাদেশ। এখানে আর যাইহোক অন্তত বাংলাদেশকে “সোনা” -এর তৈরী বুঝায়নি! অনুরূপ মক্কা হতে ৬ কিঃ মিঃ দূরে অবস্থিত “গারে হেরা”-কে বলা হয় ‘জাবালে নূর’ বা নূরের পাহাড়! তার মানে এই নয় যে, ওই পাহাড়টি “নূরের তৈরী”! এগুলো জাস্ট ভাষার অলংকার কিবা বাগধারা-ই বলা যায়। যাদের একাডেমিক নলেজ ভালো তাদের এগুলো বুঝতে সমস্যা হবার কথা নয়। অল্প শিক্ষিত বা ‘আনাড়ি’ পরিবেশ থেকে উঠে আসা সাধারণদের বুঝানোর সাধ্য কারো নেই, স্বয়ং ফেরেশতা নেমে আসলেও….! সংক্ষেপে।
লিখক, মুহাম্মদ নূরুন্নবী এম.এ
শিক্ষাবিদ ও গবেষক