Home আকীদা আকাবির মান্যতা

আকাবির মান্যতা

আকাবির মান্যতা

সর্বপ্রথম আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়, আকাবিরগণ কি মা’সুম (ভুলের উর্ধ্বে) ছিলেন? এর উত্তর হল, অবশ্যই না। অমুক আকাবির এই এই বিষয়ে ভুল করেছেন।অমুক আরও বেশি কিছু বিষয়ে ভুল করেছেন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল সেই অমুক আকাবির আসলেই ভুল করেছেন। তাহলে প্রমাণিত হয়ে গেল, আকাবিররা মা’সুম না। তাদের ভুল হয় বা হয়েছে। আকাবির যেহেতু ভুলের উর্ধ্বে না, তাহল আমাদের কী করণীয়? আকাবিরদের যেহেতু ভুলের সম্ভাবনা আছে, এজন্য আকিবিরদের কথা আমরা কুরআন-সুন্নাহর দলিলের আলোকে মানব। কুরআন-সুন্নাহর দলিলের আলোকে যদি আকাবিরদের কথা ঠিক হয়, তাহলে মানব, নতুবা মানব না। এই পর্যন্ত কথাগুলো যে কারও কাছে একেবারে টাটকা মজবুত মনে হবে। একটু অপেক্ষা করুন। আমরা কথাগুলো একটু বিশ্নেষণ করতে চাই।

আশ্চর্য্যের বিষয় হল, উপরের যুক্তিটা আহলে কুরআনদের কাছ থেকে ধার করা। এটা তাদের একটা হট আর্গুমেন্ট। আমাদের খুব খারাপ একটা স্বভাব আছে। আমরা অনেক সময় বুঝে অথবা না বুঝে বাতিলের দলিল ব্যবহার করি। সেদিন একজন আলিমকে বলতে শুনলাম, আমি এতায়াতীও না, শুরাও না। আমি কুরআন-হাদীস মেনে চলি। এটা তো সেই হানাফীও না-শাফেয়ীও না, আমি মুসলমানের কার্বন কপি। এগুলোর দরকার কী ভাই? উপরের যুক্তির বিষয়ে আসি। আহলে কুরআনরা একই কথা বলে। ইমাম বোখারী বা মুসলিম কি মা’সুম (ভুলের উর্ধ্বে) ছিলেন। উত্তর হল, না। তারা ভুল করতে পারেন। এরপর এই কথার স্বপক্ষে আপনাকে ১০-২০টা অথবা ধরেন ১০০টা ভুল দেখাবে। এবং বলবে যেহেতু তারা ভুলের উর্ধ্বে ছিলেন না এবং তাদের এই এই ভুল আছে, সুতরাং তাদের কথা যাচাই-বাছাই করা ছাড়া মানা যাবে না।এজন্য তাদের কথা কুরআন দিয়ে যাচাই করতে হবে। তাদের যেসব কথা কুরআনের সাথে মিলবে, সেগুলো বিশ্বাস করব। যেগুলো মিলবে না, সেগুলো পরিত্যাগ করব। এবার উপরের কথার সাথে আরেকবার মিলিয়ে নেন। আকাবির না মানার যুক্তিটা কোথা থেকে ধার করা হল? সমস্যার গোড়া কোথায়? এখানে মূলত: খুব বাজে একটা টেকনিক ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও এই টেকনিকের ব্যবহার খুব কমন। নবী-রাসূলগণ ছাড়া মানুষ ভুল করে বা করতে পারে, এটাই স্বাভাবিক বিষয়। একজন মানুষ ভুল করতে পারে, এর অর্থ কি সে সারা জীবন তার সমস্ত কাজে ভুল করে?

ডাক্তার ভুল করে বা করতে পারে। এর অর্থ কি তার জীবনের সমস্ত চিকিৎসা ভুল। ইঞ্জিনিয়ার ভুল করে বা করতে পারে, এর অর্থ কি ইঞ্জিনিয়ারের সমস্ত কাজ ভুল। একজন ড্রাইভার এক্সিডেন্ট করে বা করতে পারে, এর অর্থ কি সে সারা জীবন এক্সিডেন্ট করে? একজন শিক্ষক ভুল পড়াতে পারে, এর অর্থ কী সে সারা জীবন ভুল পড়ায়? মানুষ ভুল করে বা করতে পারে, এর অর্থ কি তার সমস্ত গবেষণা ও আবিষ্কার ভুল? এখানে টেকনিক হল, কারও ৫-১০ টা ভুল দেখিয়ে তার পুরো কাজের উপর অনাস্থা তৈরি করা। সময়ে-অসময়ে মানুষ এটা ব্যবহার করে। তবে আহলে কুরআনরা এটা দিয়ে সাধারণ মানুষকে খুব সহজে বিভ্রান্ত করতে পারে। এটা বাস্তব যে ইমাম বোখারী রহ: ভুলের উর্ধ্বে ছিলেন না এবং তার সামান্য কিছু ভুল হয়েছে, এর অর্থ কি ইমাম বোখারীর সমস্ত কিতাবই ভুল? এখানে আরেকটা বিষয় বলে রাখি। কারও যদি ভুল করাটা স্বভাবে পরিণত হয়ে যায়, অথবা সে প্রায়-ই ভুল করে, তাহলে সে উক্ত বিষয়ে কাজ করার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। একজন ডাক্তার যদি প্রায়-ই ভুল করে তাহলে সে ডাক্তারির গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। এটা শুধু এই ডাক্তারের সমস্যা। একজন ব্যক্তির সমস্যাকে এখানে জেনারেলাইজ করা যাবে না।

এখন আসি ভুল সংশোধনের উপায় নিয়ে। ইমাম বোখারী রহ: একটা দু’টো ভুল হলে আমাদের কী করণীয়? তার পুরো কিতাব বাদ দিয়ে শুধু কুরআন মানা শুরু করব? এটাই কি ভুল শোধরানোর উপায়? কখনও না। আপনার উপরের টেকনিক থেকে এটা আরও ভয়ঙ্কর। যে কোন বিষয়ে ভুল হলে তা সংশোধনেরও কিছু সঠিক পদ্ধতি আছে। আপনি যে পদ্ধতি বলেছেন, এটা কোনভাবেই সঠিক নয়। ইমাম বোখারী রহ: ভুল করলে সেটা হাদীস শাস্ত্রে অভিজ্ঞ মুহাদ্দিসরা সংশোধন করে দিবেন। আর বাস্তবে মুহাদ্দিসরা যুগে যুগে তা করেছেনও। এটা তো সংশোধনের কোন পদ্ধতি যে, একটা – দু’টো ভুলের জন্য সমস্ত হাদীসকেই পরিত্যাগ করতে হবে? এবার আসি আকাবিরদের বিষয়ে।

যারা আকাবিরদের প্রতি অনাস্থা তৈরি করতে চান, তারাও তাদের একটা দু’টো ভুল সামনে এনে অনাস্থা তৈরির চেষ্টা করেন। একই টেকনিক। বাকী রইল, আকাবিরদের ভুল সংশোধনের পদ্ধতি। তাদের ভুল হলে সংশোধনের সঠিক পদ্ধতি কোনটি? কুরআন-সুন্নাহর দলিলের আলোকে তাদের কথা যাচাই করা? এটাই কি সঠিক পদ্ধতি? জ্বী, না। মুহতারাম, দু:খের বিষয় হল, এই কথাটা আপনি আহলে হাদীসদের কাছ থেকে ধার করেছেন। আপনার জন্য প্রথম পরামর্শ হচ্ছে, আপনি যুক্তি ধার করা বন্ধ করেন। আহলে হাদীসরা বলে, যেহেতু ইমাম আবু হানীফা রহ: বা অন্যান্য ইমামগণ ভুল করতে পারেন বা করেছেন, সুতরাং আমরা তাদের বক্তব্যকে কুরআন-হাদীস দিয়ে যাচাই করব। যদি কুরআন-হাদীসের অনুগামী হয়, তাহলে মানব, নতুবা পরিত্যাগ করব। মুহতারাম, একটু মিলিয়ে নেন। কথাগুলো কোথা থেকে ধার করা হয়েছে। এবার আসি, ইমাম আবু হানীফা রহ: বা অন্য ইমাম অথবা যে কোন যুগের যে কোন আলিম ভুল করলে তা সংশোধনের উপায় কি? তাদের কথা আমি আর আপনি কুরআন-হাদীস দিয়ে যাচাই করলেই তা সংশোধন হবে?

এখানে বড় একটা ঘাপলা আছে। সাধারণ মানুষ এটা ধরতে হিমশিম খায়। এই যে, কুরআন-হাদীস দিয়ে যাচাই করব, এই কথাটার মধ্যেই সমস্যা। কথাটা শুনতে সুন্দর। কিন্তু এর পেছনে একটা অন্ধকার আছে। আমরা সাধারণত: সুন্দর কথার তালে অন্ধকারে ডুবে যাই। সহজ কথা হল, কোন বিষয় যদি এত স্পষ্ট হয় যে, কুরআন-হাদীস খুলেই আমি আপনি ভুল বের করে ফেলব, তাহলে সাধারণত: এমন বিষয়ে বড় বড় আলিমরা ভুল করেন না। আর যদি এমন স্পষ্ট ভুল কখনও হয়ে যায়, সেটা বলে দেয়ার জন্য সব যুগেই আলিমরা ছিলেন। আছেন। তারা দেখেই বলে দিয়েছেন, অমুক বিষয়ে এই আলিমের এই বক্তব্য স্পষ্ট ভুল। এটার জন্য কারও প্রতি অনাস্থা তৈরি বা তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ থাকে না।

তাহলে মূল সমস্যা কোথায়? মূল বিষয় হল, কুরআন-হাদীসের আলোকে গবেষণা (ইজতিহাদ) নিয়ে। এই গবেষণা কুরআন-হাদীস খুললেই পাওয়া যায় না। বিষয়টা কুরআন ও হাদীসে স্পষ্ট নেই। কেউ গবেষণা করে বের করেছে। যে বিষয় কুরআন ও হাদীসে স্পষ্ট নেই, সেই গবেষণার ভুল কুরআন-হাদীস খুললেও কীভাবে পাওয়া যাবে? আর এই দাবীই বা কি করে যৌক্তিক হতে পারে যে, উক্ত গবেষণার ভুল আমি কুরআন-হাদীস খুলেই বের করে ফেলব? আপনি হয়ত বড় জোর এতটুকু বলতে পারেন, অমুক আলিমের গবেষণাকে আমি আমার নিজের গবেষণা দিয়ে যাচাই করে ভুল বের করব। একথা বললে তো আপনার আসল বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে যাবে। আমি জানি, আপনি সেটা বলবেন না।

এবার আসি মূল বিষয়ে। ইমামগণ বা আকিবরদের গবেষণায় যদি ভুল হয়, তাহলে ভুল সংশোধণের উপায় কী?

এই ভুল সংশোধনের সঠিক উপায় হল, উক্ত বিষয়ে পন্ডিত আলিমগণ সেই গবেষণাকে যাচাই করবে। গবেষণার ভুল-ত্রুটি যাচাই করাও এক ধরণের গবেষণা। বরং অনেক ক্ষেত্রে গবেষণা থেকে কঠিন। এক্ষেত্রে যারা যাচাই করবেন, তাদের শাস্ত্রীয় যোগ্যতার পাশাপাশি তাকওয়া, আমানতদারি, আল্লাহর ভয় থাকা শর্ত। যে কেউ যেমন গবেষণা করতে পারবে না, যে কেউ গবেষণার ভুলও ধরবে না। আমরা যারা আকাবিরদের কথা কুরআন-হাদীস খুলেই ভুল বের করতে চাই, তাদের সুন্দর একটা উদাহরণ মনে পড়েছে। সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে থিসিস হয়। সেই থিসিসগুলো বিভিন্ন জার্নালে পাবলিশ হয়। ভাই বলল, চলেন ভাই! নীল ক্ষেতে গিয়ে বিজ্ঞানের দু’চারটা বই কিনে এসব থিসিসের ভুল যাচাই করি। এসব থিসিসে তো ভুল থাকতেই পারে। আমরা বিজ্ঞানের বই খুলব, আর থিসিস যাচাই করব। কেমন হবে ভাইয়া? আমার আর কী বলার আছে। বলব, ভালো হবে ভাইয়া। এর আগে চলেন আমরা কুরআন-হাদীস খুলে ইমাম ও আকাবিরদের ভুল বের করি।

  • লিখেছেন, ইজহারুল ইসলাম আল-কাউসারী। বিশিষ্ট কলামিস্ট ও ইসলামি আকীদা বিষয়ক গবেষক। মাগুরা, খুলনা, বাংলাদেশ। ফেইসবুক
Previous article কুরআন দ্বারা ঈসা (আ:) এর মৃত্যু সাব্যস্ত হলে তখন এই প্রশ্নগুলোর জবাব কী?
Next article মিলাদ কিয়াম
প্রিয় পাঠকবৃন্দ! এটি সম্পূর্ণ দ্বীনি ও অলাভজনক একটি ওয়েবসাইট। প্রতি বছর এটির ডোমেইন ও হোস্টিং ফি হিসেবে আমাকে এর ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। যদি উক্ত ব্যয় বহন করতে অপারগ হই তাহলে এই সাইটটি নিশ্চিত বন্ধ হয়ে যাবে। সেহেতু আপনাদের সবার নিকট আবেদন থাকবে যে, আপনারা সাইটটির উক্ত ব্যয় বহনে এতে বিজ্ঞাপন দিতে বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করবেন এবং নিজেরাও সহযোগিতায় এগিয়ে আসবেন। বিনীত এডমিন! বিকাশ : ০১৬২৯-৯৪১৭৭৩ (পার্সোনাল)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here