প্রশ্নকর্তা : মিলাদ কিয়াম জায়েজ না নাজায়েজ?
উত্তরদাতা : আগে মিলাদ কিয়ামের সংজ্ঞা দিন, তারপর উত্তর দিচ্ছি?
প্রশ্নকর্তা : কিছু লোক একত্রিত হয়ে যেভাবে নবীজীর জন্মালোচনা করেন এবং জন্মালোচনার মাঝখানে সবাই দাঁড়িয়ে ইয়া নবী সালামু আলাইকা… বলেন এটি কি জায়েজ না নাজায়েজ?
উত্তরদাতা : ও আচ্ছা! এই সম্পর্কে আমার বক্তব্য হল, যদি দলিল থাকে তবে অবশ্যই জায়েজ।
প্রশ্নকর্তা : আপনি কি জায়েজ মনে করেন না?
উত্তরদাতা : আমি মনে করি প্রিয়নবী (সা:)-এর জন্মালোচনা অবশ্যই সাওয়াবের কাজ। তবে এক্ষেত্রে কোনোরূপ বাড়াবাড়ি কাম্য নয়।
প্রশ্নকর্তা : বাড়াবাড়ির একটি উদাহরণ দিন!
উত্তরদাতা : নবীজী (সা:)-এর জন্মালোচনা মুহূর্তে মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাওয়াকে প্রয়োজন বা আবশ্যক মনে করা যেমন বাড়াবাড়ি, তেমনি ঢালাওভাবে ‘মিলাদুন্নবী’-কে বিদয়াত আখ্যা দিয়ে ফতুয়াবাজি করা আরেক বাড়াবাড়ি। এতে উভয়পক্ষই অভিযুক্ত। এই ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা হচ্ছে, মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠানের সংখ্যাধিক্যের কাজকে সম্মান দেয়া। যেখানে সবাই দরূদ বসে পড়তে অভ্যস্ত সেখানে বসে পড়া আর যেখানে কিয়ামে অভ্যস্ত সেখানে তাদেরকে তাদের অভ্যাসের উপর ছেড়ে দেয়া। তবে সাধারণ মানুষদের বলে দিতে হবে যে, কিয়াম এটি রাসূল (সা:)-কে হাজের মনে করে নয়। অনুরূপ দরূদ শরীফ বসে পড়াও রাসূল (সা:)-এর শানে বেয়াদবি নয়। নতুবা কোনো মুসলমানই নামাযে দরূদ শরীফ কখনো বসে পড়তেন না!
প্রশ্নকর্তা : রবিউল আউয়াল মাসে অনুষ্ঠিতব্য ‘মিলাদুন্নবী’ এর আমল জায়েজ নাকি নাজায়েজ?
উত্তরদাতা : সাল্ফে সালেহীনের পন্থায় অবশ্যই জায়েজ। তবে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেলে নাজায়েজ। কেননা বহু সাওয়াবের কাজ এমন আছে যা সীমা অতিক্রম করার কারণে যে কেউই নাজায়েজ বলবে। যেমন, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ। কিন্তু ছয় ওয়াক্ত পড়তে চাওয়া বাড়াবাড়ি। তেমনি রোজা রাখাও সাওয়াবের কাজ। তবে তা ঈদের দিনে হলে নিঃসন্দেহ বাড়াবাড়ি।
প্রশ্নকর্তা : প্রতি সোমবার রোজা রাখা দ্বারাও আমালুল মওলিদের হক্ব আদায় হবে কি?
উত্তরদাতা : অবশ্যই আদায় হবে। হাদীসে এসেছে, প্রিয়নবী (সা:) নিজে সোমবার রোজা রাখার কারণ বলেছেন ‘যালিকা ইয়াওমুন উলিদতু ফীহি’। অর্থাৎ এটি এমন একটি দিন যে দিনটিতে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। (সহীহ মুসলিম শরীফ সিয়াম অধ্যায়, হাদীস নং ১১৬২; হযরত আবু কাতাদা আল আনসারী হতে বর্ণিত)। সত্যি বলতে, প্রকৃত ‘আমালুল মওলিদ’ (মিলাদুন্নবী) কিন্তু এটাই যা সুন্নাতে রাসূলিল্লাহ্ হিসেবে বিশুদ্ধ হাদীসে উল্লেখ রয়েছে।
প্রশ্নকর্তা : মিলাদুন্নবী তথা আমালুল মওলিদকে মুস্তাহাব বা মুস্তাহসান হিসেবে বিবেচনা করলে শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনো অসুবিধা আছে কি?
উত্তরদাতা : না, কোনো অসুবিধা নেই। তবে সেটি শরীয়ত অনুমোদিত সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মপদ্ধতি (System)’র আলোকে হওয়া চাই। কেননা, মনগড়া কাজ যতই সুন্দর হোক, তা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রশ্নকর্তা : সাম্প্রতিককালে ১২ ই রবিউল আউয়ালে উদ্যাপিত জশ্নে জুলূস কি শরীয়তে অনুমোদিত?
উত্তরদাতা : বেরলভী মানহাজের বরেণ্য মুফতিয়ে আজম মুনিবুর রহমান সাহেব কর্তৃক সত্যায়িত (উর্দূ) কিতাব ‘ঈদে মীলাদুন্নবী (দ.) আওর চন্দ ইছলাহ তলব পহলূ’ এর মধ্যে এ সম্পর্কে লিখা আছে “সালাতের মত একটি ইবাদত আদায় করার জন্য যদি পথিকের অধিকার পথচলা বন্ধ করা না যায়, তাহলে কিভাবে সম্ভব হতে পারে যে, ঈদে মীলাদুন্নবী মাহফীল (জশ্সে জুলূস) উদ্যাপনের উদ্দেশ্যে পথিকের পথচলা বন্ধ করে দেয়ার অনুমতি রয়েছে!” (পৃষ্ঠা নং ১০০, লিখক মুফতী সাইয়েদ ছাবের হোসাইন; আল মুনিব শরিয়াহ্ একাডেমী করাচী হতে প্রকাশিত)। জ্ঞানীদের বুঝার জন্য এইটুকুই যথেষ্ট।
প্রশ্নকর্তা : প্রচলিত মিলাদুন্নবী তথা আমালুল মওলিদকে নাজায়েজ বলা যাবে কি?
উত্তরদাতা : বাড়াবাড়ি পর্যায় না পৌঁছলে তখন তাকে অবশ্যই নাজায়েজ বলা যাবেনা; বরং মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখার স্বার্থে সর্বাবস্থায় শাখাগত পার্থক্যগুলো সকলেরই ক্ষমা ও সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা জুরুরি। নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, উভয় পক্ষের মাঝে মৌলিকভাবে কোনোই পার্থক্য নেই। বড়জোর পার্থক্য শুধুই নিয়ম (System) মানা ক্ষেত্রে। এক পক্ষ যেমন বিশ্বাস, নবীপ্রেম ঈমানের পূর্বশর্ত তেমনি এটি বিপক্ষেরও। পার্থক্য হল, এক পক্ষ মনে করেন নবীপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ সাহাবায়ে কেরামের নমুনায় হওয়া উচিত। বিপরীতে বিপক্ষের ভাইয়েরা মনে করেন প্রচলিত নিয়মেও হতে পারে। অথচ নবীজী (সা:) বলেছেন: ‘মা আনা আলাইহি ওয়া আস্হাবী অর্থাৎ আমি এবং আমার সাহাবায়ে কেরাম যে মত ও পথে রয়েছে সেটাই মুক্তিপ্রাপ্ত দল’। (তিরমিযী হাদীস নং ২৬৪১)।
প্রশ্নকর্তা : নবীজির চারিত্রিক গুণাবলী আলোচনার নাম সীরাতুন্নবী না হয়ে আখলাকুন্নবী হওয়া উচিত কিনা?
উত্তরদাতা : হ্যাঁ উচিত। কিন্তু চারিত্রিক গুণাবলীর পাশাপাশি নবীজির অন্যান্য দিকগুলোও যদি আলোচনায় স্থান পায় তখন তাকে অবশ্যই ‘সীরাত’ শব্দে চয়ন করতে হবে। যেমন জিহাদ, মেরাজ ও দাওয়াত ইত্যাদি। কারণ, সীরাত আর আখলাক শব্দ দুটি সমার্থক নয়। বরং ১০০% সীরাত বা Lite history আম (ব্যাপকার্থক) আর আখলাক বা Character শব্দ খাস (নির্দিষ্টবাচক)। সংক্ষেপে।
প্রশ্নকর্তা : ওয়াজ মাহফীলে কোনো কোনো বক্তা থেকে শুনেছি, মিলাদুন্নবী তথা আমালুল মওলিদের দলিল নাকি কুরআনেও রয়েছে!
উত্তরদাতা : পবিত্র কুরআনে দলিল থাকলে তবে তো উনাদের উচিত মিলাদুন্নবীর আমলকে ফরজ অথবা ওয়াজিব বলা! অধিকন্তু বর্তমানে যারা প্রচলিত মিলাদুন্নবীর দলিল পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ-তে খুঁজে পাওয়ার দাবী করেন; আমি মনে করি, উনারা অন্তত প্রজ্ঞা, যোগ্যতা আর ইনসাফের বিচারে কিছুতেই ইমাম সুয়ূতী (রহ:)-এর সমতূল্য নন! এবার তাহলে দেখুন, ইমাম সুয়ূতী (রহ:) এর মত জগত বিখ্যাত ও মাননীয় মুহাদ্দিস ও মুফাসসীর ‘আমালুল মওলিদ’ (সাধারণের ভাষায় মিলাদুন্নবী) এর সোর্স (উৎস) সম্পর্কে কী লিখেছেন! তিনি তার ‘হুসনুল মাকছিদ ফী আমালিল মওলিদ’ পত্রে শায়খ তাজুদ্দীন ফাকিহানী আল মালেকী (রহ:)-কে তারদীদ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘ওয়া ইল্লাম ইউরিদ ফীহি নাস্সুন ফা-ফীহিল কিয়াসু আলাল আছলাইন’। অর্থাৎ যদিও আমালুল মওলিদ (নবী জন্মে করণীয়) পালনকরার পক্ষে কোনো নস (কিতাবুল্লাহ এবং সুন্নাহ) প্রমাণিত নয়, তবে তা প্রমাণে দুটো মৌলিকত্বের বিচারে ক্বেয়াস (অনুমান নির্ভর দলিল) ঠিকই রয়েছে। (পৃষ্ঠা নং ১১ দ্রষ্টব্য)। জ্ঞানীদের নিশ্চয় ভাবিয়ে তুলবে।
প্রশ্নকর্তা : কিন্তু সাহাবায়ে কেরামের উদ্ধৃতি দ্বারাও তো কেউ কেউ দলিল দিতে চান!
উত্তরদাতা : সাহাবায়ে কেরামের নামে ওই সমস্ত উদ্ধৃতির সনদ (সূত্র) কতটুকু প্রমাণিত সেই বিতর্কে না হয় নাই গেলাম, কিন্তু ইমাম সুয়ূতী রহ: (মৃত ৯১১ হিজরী) তো মিলাদুন্নবী পালনকরার প্রচলিত এই পন্থার প্রথম উদ্ভাবক ইরবিলের (ইরাক) বাদশাহ মুজাফফর আবু সাঈদ কূকুবরী’র ইতিহাস তুলে ধরেছেন। তখন ছিল ৬০৪ হিজরী। কিতাবের ভাষ্য : ‘আউয়ালু মান আহ্দাছা ফে’লা যালিকা ছাহেবু ইরবিলিল মালিকিল মুজাফফর আবু সাঈদ কূকুবরী’। রেফারেন্স, ইমাম সুয়ূতীর ‘হুসনুল মাকছিদ ফী আমালিল মওলিদ’ দ্রষ্টব্য। আরো জানার বিষয় যে, ১১০ হিজরীর পরে দুনিয়ায় একজন সাহাবীও কিন্তু বেঁচে থাকেননি, যা সর্বসম্মত মত। এখন এর সমীকরণ কিভাবে মিলাবেন? ইমাম সুয়ূতী (রহ:) কি তাহলে ইতিহাস ভুল লিখলেন? অবশ্যই না। আরো দেখুন, আল মুদখাল, লিখক বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে খালদূন (রহ:)।
লিখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক