এখানে এই স্ক্রিনশটটি (স্ক্রিনশট নং ১) মির্যা কাদিয়ানীর রচনা “মালফুযাত” গ্রন্থের ৫ নং খন্ডের ২১ নং পৃষ্ঠার। এখানে মির্যা কাদিয়ানী হযরত ইমাম মাহদীর আগমন সংক্রান্ত হাদীসগুলোকে বিতর্কিত করার অসৎ উদ্দেশ্যে কিছু গোঁজামিল মার্কা আপত্তির জন্ম দিয়ে গেছেন, যাতে সাধারণ মানুষ মির্যার মাহদীয়ত দাবীকে হাদীসের আলোকে যাচাই না করে বরং অন্ধভাবেই মির্যার কথায় বিশ্বাস করার প্রয়াস পায়। আপত্তিগুলো দেখুন! এখানে আপত্তিগুলো তুলে ধরে সেগুলোর সলিউশন করার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।
মির্যার আপত্তি –
১. কেউ বলে থাকেন ইমাম মাহদী ফাতেমী হবেন অর্থাৎ তিনি ফাতেমা (রা.) এর বংশে জন্মিবেন।
২. কেউ বলেন, তিনি আব্বাসী হবেন অর্থাৎ তিনি হযরত আব্বাস ইবনে আবী তালিবের বংশে জন্মিবেন।
৩. কেউ বলেন, তিনি (হাসানী এবং) হোসাইনী হবেন অর্থাৎ তিনি হযরত (হাসান এবং) হোসাইন (রা.) এর বংশে জন্মিবেন।
৪. কেউ বলেন, উনি “ফয়দা হোগা” তথা জন্মিবেন।
৫. কেউ বলেন, উনি গুহা থেকে প্রকাশ পাবেন।
৬. কেউ বলেন, উনি উম্মতের মধ্য হতে জন্মিবেন।
৭. কেউ বলেন, ঈসা (আ.)-ই একজন মাহদী।
জবাব ও সলিউশন শুরু –
১। রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন (সনদ সহ হাদীসটি এই), حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ جَعْفَرٍ الرَّقِّيُّ، حَدَّثَنَا أَبُو الْمَلِيحِ الْحَسَنُ بْنُ عُمَرَ، عَنْ زِيَادِ بْنِ بَيَانٍ، عَنْ عَلِيِّ بْنِ نُفَيْلٍ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ الْمُسَيِّبِ، عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ، قَالَتْ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: الْمَهْدِيُّ مِنْ عِتْرَتِي، مِنْ وَلَدِ فَاطِمَةَ قَالَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ جَعْفَرٍ: وَسَمِعْتُ أَبَا الْمَلِيحِ، يُثْنِي عَلَى عَلِيِّ بْنِ نُفَيْلٍ، وَيَذْكُرُ مِنْهُ صَلَاحًا অর্থাৎ উম্মু সালামাহ (রা.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, মাহদী আমার পরিজন থেকে ফাতিমার সন্তানদের বংশ থেকে আবির্ভূত হবে। আব্দুল্লাহ ইবনু জা‘ফর বলেন, আমি আবুল মালীহকে আলী ইবনু নুফাইলের প্রশংসা করতে এবং তার গুণাবলী বর্ণনা করতে শুনেছি। (সুনানে আবু দাউদ, কিতাবুল মাহদী, হাদীস নং ৪২৮৪; হাদীসের মান, সহীহ)। উল্লেখ্য, মির্যা কাদিয়ানীর বক্তব্য হল, “হযরত মাহদী সম্পর্কে ফাতেমার সন্তান থেকে তাঁর আগমনী যে সংবাদ হাদীস সমূহে এসেছে আমি সেই হাদীসে বর্ণিত মাহদী নই।” (দেখুন, রূহানী খাযায়েন ২১/৩৫৬)।
২। ইমাম মাহদী হযরত আব্বাস (রা.)-এর বংশেও হবেন কিভাবে তা বুঝে নিন! প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী পিতার দিক থেকে ফাতেমা (রা.)-এর পুত্র হযরত হাসান এবং নবীজীর চাচা হযরত আব্বাস উভয়ের বংশধর হবেন। কেননা হযরত হাসানের সাথে হযরত আব্বাসের পুত্র আল-ফজলের মেয়ে উম্মে কুলছুমের বিয়ে হয়। তাদের সংসারে জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মদ আল-আসগর, জাফর, হামজা এবং ফাতেমা (দেখুন তবক্বাতে ইবনে সা’আদ ৬/৩৫২)।
এমতাবস্থায় এই উম্মে কলছুমের যে কোনো সন্তানের ঔরস থেকে ইমাম মাহদীর পিতা জন্ম গ্রহণ করার দ্বারা তিনি প্রকারান্তরে হযরত আব্বাস (রা.)-এর ঔরস থেকেও জন্ম লাভ করলেন বলে গণ্য হবেন! সুতরাং ১ আর ২ নং এর মাঝে আর কোনো মতানৈক্য রইল না।
- ৩। ইমাম মাহদী হযরত ইমাম হাসান এবং হোসাইন উভয়েরই বংশ থেকেও হওয়া কিভাবে সম্ভব তাও বুঝে নিন! ইতিপূর্বে তো জানলেন যে, প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী পিতার দিক থেকে ফাতেমা (রা.)-এর পুত্র হযরত হাসান (রা.)-এর ঔরস থেকে হবেন। এখন জেনে নেব যে, ইমাম মাহদী হযরত হোসাইন (রা.)-এর বংশেও হতে পারা সম্ভবপর কিভাবে? এর জবাব হল, ইমাম হাসান আর ইমাম হোসাইন দু’জনের সন্তানদের মধ্যকার বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ইতিহাস যাদের ভালোভাবে জানা আছে তারা কখনোই এ জাতীয় বর্ণনা দ্বারা বিভ্রান্ত হবেনা।
ইতিহাস প্রমাণ করে যে, ইমাম হোসাইন বিন আলী (রা.) এর একটি কন্যা ছিলেন ফাতেমা। তার বিয়ে হয়েছিল ইমাম হাসান বিন আলীর পুত্র হাসান আল মুছান্নাহ (৩৭-৯৭ হিজরী)-এর সাথে। হাসান আল মুছান্নাহ’র মায়ের নাম ছিল খাওলাহ বিনতে মানযূর। তাদের সংসারে জন্মগ্রহণ করেন, আব্দুল্লাহ আল-মুহায, ইবরাহীম আল-গুমার, হাসান আল-মুছাল্লাছ প্রমুখ। (সূত্র : মুনতাহিল আ-মা-ল ফী তাওরীখিন নাবী ওয়াল আ-ল, ১/৬৫১-৫৩; শায়খ আব্বাস আল-ক্বিম্মী)।
নিচের স্ট্রাকচারটি দেখুন!
আপনাদেরকে আরও একটি তথ্য দেব। হযরত হাসান বিন আলী (রা.) এর ‘ফাতেমা‘ নামে একজন কন্যা ছিল। তাঁকে বিয়ে দেয়া হয় ইমাম হোসাইন (রা.) এর পুত্র আলী যয়নুল আবেদীন এর সাথে। সে ঘরে প্রায় ষোলজন সন্তান সন্ততি জন্ম লাভ করেন। তাই নিশ্চিত ভাবে বিশ্বাস করতে পারি যে, এরই বৈবাহিক সূত্রধরে আগত ইমাম মাহদীর পিতা একই সঙ্গে হাসানী এবং হোসাইনী দুটোই হবেন। ফলে তাদের সংসারে জন্মগ্রহণকারী প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী একই সঙ্গে হাসানী এবং হোসাইনী হওয়াও সম্ভব। সুতরাং উল্লিখিত সলিউশনের বিচারে ইমাম মাহদী একই সঙ্গে ফাতেমী, আব্বাসী, হাসানী এবং হোসাইনী সবই হতে পারেন! এতে কোনোভাবেই বৈপরীত্য নেই।
৪। ইমাম মাহদী জন্মিবেন, একথা দ্বারা মির্যা সাহেব হাদীসের মধ্যে কী ধরণের বৈপরীত্য থাকার আপত্তি তুললেন আমার জানা নেই। যেহেতু আমরা মুসলমানরাও বিশ্বাস করি যে, প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী জন্মিবেন আর প্রতিশ্রুত ঈসা মসীহ (আ.) আকাশ থেকে নাযিল হবেন।
৫। ইমাম মাহদী গুহা হতে প্রকাশিত হবেন, এটা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের কনসেপশন নয়। বরং এই ধরণের প্রবক্তাদের মতে ঐ মাহদীর জন্ম আজ হতে ১১৮৭ চন্দ্রবছর আগে ২২৫ হিজরিতে ইরাকের (বর্তমান রাজধানী বাগদাদের উত্তরে) পবিত্র সামেরা শহরে হয়েছিল। নাম মুহাম্মদ আল মাহদী। পিতার নাম ইমাম হাসান আল আসগরি। সুতরাং ডালেচালে খিঁচূড়ি পাকানোর কোনো কারণ নেই।
- উল্লেখ্য, আনুমানিক ১৮৪৪ সালে শীয়া মতবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন বাহাই ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন যে আলী মুহাম্মদ বা’ব ছিলেন পুনরাবির্ভূত দ্বাদশ ইমাম ও মাহদী।
৬। উম্মতের মধ্য হতে হবেন, একথা দ্বারাও মির্যা সাহেব হাদীসের মধ্যে কী ধরণের বৈপরীত্য থাকার আপত্তি তুললেন আমার জানা নেই। মির্যা কাদিয়ানী যদি এখন বেঁচে থাকতেন তাহলে আমি তাকে জিজ্ঞেস করতাম যে, আহলে বাইয়েতের সদস্যগণ কি উম্মতে মুহাম্মদীয়ার গণ্ডীর বাহিরে? নিশ্চয়ই না। এখানে ঐ বর্ণনাটি দ্বারা সূক্ষ্মভাবে প্রমাণিত হয় যে, ইমাম মাহদী আর ঈসা দুইজনই আলাদা দুই চরিত্রের। নতুবা হাদীসে ‘তিনি জন্মিবেন’ একথা অর্থ কী? নিশ্চয়ই এর অর্থ হল, ইমাম মাহদী আর ঈসা একই চরিত্রের হবেন না, বরং তাদের একজন নাযিল হবেন আর অন্যজন জন্মিবেন! অতএব, বৈপরীত্য থাকার আপত্তি পুরোই বাগাড়ম্বর বৈ নয়।
৭। ঈসা (আ.)-ই মাহদী, একথা দ্বারা তো তখনি হাদীস সমূহের মধ্যে বৈপরীত্য থাকার আপত্তি সঠিক হত যদি এই বর্ণনাটি গ্রহণযোগ্য হত। মির্যা কাদিয়ানী নিজেই তো তার “হামামাতুল বুশরা” (বাংলা অনূদিত) গ্রন্থের ১৬১ নং পৃষ্ঠায় একে দূর্বল, ক্রটিপূর্ণ ও অগ্রহণযোগ্য বলে লিখে গেছেন।
- বিস্তারিত জানতে http://www.markajomar.org/?p=551
অতএব, বুঝা গেল প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদীর মাতা কিংবা পিতার বংশক্রম ইমাম হাসান এবং ইমাম হোসাইন দুইজনের সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই কোনো কোনো বর্ণনায় ইমাম মাহদীর বংশ হিসেবে ইমাম হোসাইন (রা.)-এরও উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রধানতম কারণ এটাই। গভীরভাবে চিন্তা করলে যে কেউই বুঝতে পারবে যে, হাদীসগুলোর কোনো কোনোটির সনদের মধ্যে কিছুটা দুর্বলতা থাকলেও মূলত মতনের ক্ষেত্রে কোনো বৈপরীত্য নেই। সংক্ষেপে।
লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী