প্রশ্ন : ঈসা (আ.) শেষ যামানায় “আকাশ” থেকে নাযিল হবেন, এ মর্মে ‘আকাশ’ এর আরবী “সামা” শব্দটি কি কোনো সহীহ হাদীসে রয়েছে?
উত্তর : জ্বী হ্যাঁ, অবশ্যই রয়েছে। হযরত ঈসা (আ.) শেষ যামানায় পৃথিবীতে আকাশ থেকে নাযিল হবেন। এই মর্মে সহীহ বুখারী এবং সহীহ মুসলিম শরীফে হুবহু ‘মিনাস সামায়ি’ (من السماء) অর্থাৎ “আকাশ থেকে” শব্দচয়নে উল্লেখ না থাকলেও তা অন্যান্য একাধিক সহীহ হাদীসে ঠিকই উল্লেখ রয়েছে। ফলে আগমনকারী ঈসা ইবনে মরিয়ম একজন “রূপক ঈসা”—কাদিয়ানীদের উক্ত মতবাদ সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও বাতিল।
কাদিয়ানী লিটারেচার থেকে –
মির্যা কাদিয়ানী নিজেকে ‘মসীহ’ দাবী করা সত্ত্বেও তার রচনাবলীর সমষ্টি ‘রূহানী খাযায়েন’ খন্ড নং ৫ পৃষ্ঠা নং ৪০৯ এর এক স্থানে পরিষ্কার লিখেছেন যে,
يا حسرة عليهم ان لا يعلمون أن المسيح ينزل من السماء بجميع علومه، لا يأخذ شيئا من الأرض ما لهم لا يشعرون.
অর্থাৎ হায় আফসোস! তাদের জানা নেই যে, নিশ্চয়ই মসীহ আকাশ থেকে যখন নেমে আসবেন তখন তিনি সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়েই নেমে আসবেন। আর তারা বোধশক্তি রাখবেনা যে, তিনি পৃথিবী থেকে তাদের জন্য কোনো কিছুই গ্রহণ করবেন না।

মির্যা কাদিয়ানী অনুরূপ তার রচনাবলীর আরও অনেক জায়গায় স্বীকার করে লিখে গেছেন যে, শেষ যুগে আগমনকারী হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:) “আকাশ থেকে” (من السماء) নাযিল হওয়ার কথা নবীকরীম (সা:)-এর ভবিষ্যৎবাণীতে এসেছে। যেমন তিনি লিখেছেন, ‘এই জন্যই তাঁর সম্পর্কে নিষ্পাপ নবীর ভবিষ্যৎবাণীতে এসেছে যে, তিনি [ঈসা] ‘আসমান’ থেকে নাযিল হবেন। (রূহানী খাযায়েন: ৫/২৬৮; রচনাকাল ১৮৯২ইং)।
প্রামাণ্য স্ক্যানকপি দ্রষ্টব্য

কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের নিকট অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, মির্যা কাদিয়ানী তার রচনার আরেকটি জায়গায় পরিষ্কার করে লিখে গেছেন যে,
مثلا صحیح مسلم کی حدیث میں جو یہ لفظ موجود ہے کہ حضرت مسیح جب اسمان سے اترے گئے تو ان کا لباس زرد رنگ کا ہوگا
অর্থাৎ যেমন সহীহ মুসলিম গ্রন্থের হাদীসে এমন শব্দ বিদ্যমান আছে যে, হযরত মসীহ যখন আকাশ থেকে নামবেন তখন তাঁর পোশাক হবে হলুদ রঙের। (রূহানী খাযায়েন খ-৩/পৃ-১৪২)।
প্রামাণ্য স্ক্যানকপি দ্রষ্টব্য

মির্যা সাহেব একই বক্তব্য লিখে গেছেন তার আরেকটি রচনা মালফুযাত গ্রন্থের খন্ড নং-৫ এবং পৃষ্ঠা নং-৩৩ এর মধ্যেও। উর্দূ চতুর্থ এডিশন দ্রষ্টব্য।
ইসলামী অথেনটিক লিটারেচার থেকে –
বিখ্যাত হাদীস সংকলক, ইমাম বায়হাক্বী (রহ.)-এর সংকলন ‘আল আসমা ওয়াস সিফাত’ (১/৩৩১) গ্রন্থের একটি হাদীসে পরিষ্কার উল্লেখ আছে, হযরত ঈসা (আ.) আকাশ থেকে নাযিল হবেন। হাদীসের من السماء শীর্ষক শব্দের উপর এক লাহোরি কাদিয়ানী-এর আপত্তির সংক্ষিপ্ত জবাব পড়তে এখানে ক্লিক করুন!
এখানে একটা প্রশ্ন হতে পারে যে, হাদীসটির সহীহ বুখারীর সনদে তো ‘সামা’ বা আকাশ শব্দটি নেই! এখন ইমাম বায়হাক্বীর সনদে এই ‘সামা’ (আকাশ) শব্দ কোত্থেকে বা কিভাবে এলো? এর দালিলিক উত্তর এখানে।
প্রামাণ্য স্ক্যানকপি দ্রষ্টব্য



মুসনাদে বাজ্জার গ্রন্থ থেকে –
হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে একটি টনটনে সহীহ ও মারফূ এবং মুত্তাসিলুস সানাদে বর্ণিত হাদীস পেশ করছি যেখানে পরিষ্কার শব্দে উল্লেখ আছে যে, হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম “আকাশ থেকে” নাযিল হবেন। সনদসহ হাদীসটি,
حَدَّثَنَا عَلِىُّ بْنُ الْمُنْذِرِ, نَا مُحَمَّدُ بْنُ فُضَيْلٍ, عَنْ عَاصِمِ بْنِ كُلَيْبٍ, عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ, قَالَ : سَمِعْتُ مِنْ أَبِى الْقَاسِمِ الصَّادِقِ الْمَصْدُوْقِ يَقُوْلُ : يَخْرُجُ الْأَعْوَرُ الدَّجَّالُ مَسِيْحُ الضَّلاَلَةُ قِبَلِ الْمَشْرِقِ فِىْ زَمَنِ اخْتِلَاِف مِنَ النَّاسِ وَ فُرْقَةٍ, فَيَبْلُغُ مَا شَاءَ اللهُ أَنْ يَّبْلُغَ مِنَ الْأَرْضِ فِىْ أَرْبَعِيْنَ يَوْمًا, اَللهُ اَعْلَمُ مَا مِقْدَأرُهَا, فَيَلْقَى الْمُؤْمِنُوْنَ شِدَّةً شَدِيْدَةً, ثُمَّ يَنْزِلُ عِيسْىَ ابْنُ مَرْيَمَ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ مِنَ السَّمَاءِ فَيَؤُمُّ النَّاسَ, فَاِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنْ رَكَعَتَيْهِ قَالَ : سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ, قَتَلَ اللهُ الدَّجَالَ وَ ظَهَرَ الْمُؤْمِنُوْنَ. فَأَحْلَفَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهُ أَبَا الْقَاسِمِ الصَّادِقُ الْمَصْدُوْقُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ قَالَ : اِنَّهُ لَحَقٌّ وَ إمَّا اِنَّهُ قَرِيْبٌ, فَكُلُّ مَا هُوَ آتٍ قَرِيْبٌ. (اَلْكِتَابْ: اَلْبَحْرُ الزُّخَارُ اَلْمَعْرُوْفُ بِمُسْنَدِ الْبَزَّارِ. اَلْمُؤَلِّفُ: أَبُوْ بَكْرٍ أَحْمَدُ بْنُ عَمَرُو بْنُ عَبْدِ الْخَالِقِ بْنِ خَلَّادِ بْنِ عُبَيْدِ اللهِ اَلْعَتْكِىْ اَلْمَعْرُوْفٌ بِالْبَزَّارِ اَلْمُتَوَفَّى مِأَتَانِ وَ اِثْنَانٍ وَّ تِسْعُوْنَ سَنَةً مِنَ الْهِجْرَةِ.
অর্থাৎ “ইমাম বাজ্জার (রহ.) আলী ইবনুল মুনযির থেকে, তিনি মুহাম্মদ ইবনে ফুদাইল থেকে, তিনি আসেম ইবনে কুলাইব থেকে তিনি হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) হতে। তিনি বলেন, আমি আবুল কাসেম আস-সাদিকুল মাসদূক (তথা রাসূল সা.) থেকে শুনেছি, তিনি বলেছেন: “দলাদলি আর মানুষের মাঝে মতানৈক্যের যুগে (অর্থাৎ শেষ যামানায়) পূর্ব দিক থেকে মাসীহুদ দ্বলালাহ কানা দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। আল্লাহর যেখানে যেখানে ইচ্ছে সে সেখানে পৌঁছে যাবে। সে দুনিয়ায় চল্লিশ দিন অবস্থান করবে। আল্লাহই ভালো জানেন যে, সেই দিনগুলোর পরিমাণ (বিশালতা) কত? ফলে মুমিনগণ অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে যাবে। তারপর (এমনি অবস্থায় হঠাৎ একদিন) হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি) আকাশ থেকে (দামেস্কে) অবতরণ করবেন। অতপর তিনি (দাজ্জালকে খুঁজতে খুঁজতে এক পর্যায়ে বাহিনী সহকারে যখন বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছবেন তখন উপস্থিত) জনতার সালাতের ইমামতি করবেন (তবে প্রথম যখন দামেস্কে নাযিল হবেন তখন সালাতের ইমামতি করবেন হযরত ইমাম মাহদী)। এরপর তিনি যখন তার সালাতের দ্বিতীয় রাকাত থেকে স্বীয় মাথা উত্তোলন করে পড়বেন : (অর্থ) ‘আল্লাহ তাকে শুনছেন যিনি তাঁর প্রশংসা করছেন, আল্লাহ (অচিরেই আমার মাধ্যমে) দাজ্জালকে হত্যা করবেন, তখন মুমিনগণ বিজয় লাভ করবে’। (আবূ হুরায়রা বলেন) এ কথার পর আবুল কাসেম আস-সাদিকুল মাসদূক রাসূলুল্লাহ (সা.) শপথ করে বলেছেন : নিশ্চয়ই এটি সত্য ভবিষ্যৎবাণী, এটি নিঃসন্দেহে খুবই নিকটবর্তী। প্রত্যেক ঘটনাবলী যা আসন্ন (তা) খুবই সন্নিকটে।” [শায়খ আলবানীর ‘কিচ্ছাতুল মাসীহিদ দাজ্জাল’ কিতাব থেকে ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ সমাপ্ত হল]।
রেফারেন্স : আল বাহরুয যুখার বা মুসনাদে বাযযার হাদীস নং ৯৬৪২, সংকলক : ইমাম আবূ বকর আহমদ ইবনে আমর আল বাযযার রাহিমাহুল্লাহ, (মৃত. ২৯২ হিজরী)।

ইমাম নূরুদ্দীন আল হাইছামী (রহ.) রচিত ‘মাজমাউয যাওয়ায়েদ’ গ্রন্থে হাদীসটির সনদে বিদ্যমান রাবীগণ সম্পর্কে লিখেছেন,
وَ رِجَالُهُ رِجَالُ الصَّحِيْحِ غَيْرَ عَلِىِّ بْنِ الْمُنْذِرِ وَ هُوَ ثِقَةٌ. مَجْمَعُ الزَّوَائِدِ : اَلْمُجَلَّدُ اَلسَّابِعُ رَقْمُ الصَّفْحَةِ ثَلَاثُ مِأئَةٍ وَّ تِسْعُ وَّ اَرْبَعُوْنَ
অর্থাৎ “এর সকল বর্ণনাকারী সহীহ (বুখারী)’র বর্ণনাকারী তবে আলী ইবনুল মুনযির ছাড়া। কিন্তু সেও একজন সিকাহ তথা বিশ্বস্ত রাবী।” খণ্ড নং ৭ পৃষ্ঠা নং ৩৪৯।
প্রামাণ্য স্ক্যানকপি দ্রষ্টব্য

ধূর্ত কাদিয়ানীদের মুখোশ উন্মোচন –
অপ্রিয় হলেও সত্য, ধূর্ত কাদিয়ানীরা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:)-এর ঐতিহাসিক একখানা বক্তব্যের প্রসঙ্গ রহস্যজনকভাবে এড়িয়ে যায় যেখানে হযরত উমর (রা:) থেকে একথাও বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছিলেন, যে বলবে মুহাম্মদ (সা:) মৃত্যুবরণ করেছেন আমি তাকে আমার এই তলোবারি দ্বারা হত্যা করব। তিনি আরও বলেছিলেন,
و انما رفع الى السماء كما رفع عيسى ابن مريم عليه السلام
এর মানে হল, “নিশ্চয়ই মুহাম্মদ (সা:)-কে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে যেমনিভাবে ঈসা (আ:)-কে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল।” (আল মিলাল ওয়ান নিহাল ১/২; ইমাম শাহরাস্তানী)। মির্যা কাদিয়ানী সাহেব নিজেও কথাটি উদ্ধৃত করেছেন। রূহানী খাযায়েন ১৫/৫৮১ দ্রষ্টব্য। কিন্তু কাদিয়ানী জ্ঞানপাপীরা হযরত উমর (রা:)-এর বক্তব্যের প্রথমাংশ বললেও শেষের অংশটুকু উদ্দেশ্যমূলকভাবে এড়িয়ে যায়।
প্রামাণ্য স্ক্যানকপি দ্রষ্টব্য

অথচ উমর (রা:)-এর ঐ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই হযরত আবুবকর (রা:) সূরা আলে ইমরান এর ১৪৪ নং আয়াত তুলে ধরে বয়ান দিয়েছিলেন যে, من كان يعبد محمدا فان محمدا قد مات و من كان يعبد اله محمد فانه حى لا يموت و قرأ هذه الاية و ما محمد الا رسول قد خلت من قبله الرسل الخ এর অর্থ হল, “যে মুহাম্মদ (সা:)-এর ইবাদত করে থাকে (সে যেন জেনে নেয়) মুহাম্মদ (সা:) মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যে মুহাম্মদ (সা:) এর প্রভুর ইবাদত করে থাকে (তার জেনে রাখা উচিত) নিশ্চয়ই তিনি জীবিত, মৃত্যুবরণ করেননি। (তারপর) আবুবকর এই আয়াত তেলাওয়াত করেন, وما محمد الا رسول قد خلت من قبله الرسل الخ (অর্থ-মুহাম্মদ একজন রাসূল মাত্র তাহার পূর্বে অনেক রাসূল গত হইয়া গিয়াছে)”।
সুতরাং এটি একথারই প্রমাণ যে, ঈসা (আ:) এর আকাশে উঠিয়ে নেয়ার আকিদা স্বয়ং সাহাবীদেরও। নইলে তিনি কেন একথা বললেন। আর আবুবকর (রা:)ও বা কেন সেকথার রদ (প্রত্যাখ্যান) করলেন না!? জ্ঞানীদের নিশ্চয়ই ভাবিয়ে তুলবে!
এ লেখাগুলোও পড়া যেতে পারে
কুরআনের কোথায় আছে ঈসা (আ:)-কে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে, কাদিয়ানীদের একটি মূর্খতাসুলভ প্রশ্নের উত্তর। Click (FB থেকে)।
১- পবিত্র কুরআন দ্বারাও প্রমাণিত ঈসা (আঃ) এখনো জীবিত এবং তিনি দ্বিতীয়বার পৃথিবীতে ফিরে আসবেন। Click
২- ত্রিশ আয়াতের ভুল ব্যাখ্যার খন্ডনমূলক জবাব Click
৩- হাদীসের অপব্যাখ্যায় কাদিয়ানীদের দুই ঈসা তথ্যের খন্ডন Click
৪- বাইবেল দ্বারাও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত আছে যে, কথিত রূপক ঈসার কনসেপশন শুধুই মানুষকে ঠকানো! Click
লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী