কুরআন দ্বারা ঈসা (আ:) এর মৃত্যু সাব্যস্ত হলে তখন এই প্রশ্নগুলোর জবাব কী?

0
কুরআন দ্বারা ঈসা (আ:) এর মৃত্যু সাব্যস্ত হলে তখন এই প্রশ্নগুলোর জবাব কী?

কাদিয়ানীদের মনগড়া ও বিভ্রান্তিমূলক দাবী: পবিত্র কুরআন দ্বারা প্রমাণিত ঈসা (আ:) বেঁচে নেই, তাই তাদের নিকট এই প্রশ্নগুলোর উত্তর চাই!

  • প্রশ্নগুলো যথাক্রমে –

(১) বহু সহীহ হাদীস বলছে, আল্লাহর শপথ! নিশ্চয়ই ইবনে মরিয়ম (আ:) নাযিল হবেন (সহীহ বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া), ইবনে মরিয়ম আকাশ থেকে নাযিল হবেন (আল-আসমা ওয়াস-সিফাত ২/৩৩১; ইমাম বায়হাক্বী, হাদীসের মান : সহীহ, রাবীদের সবাই সহীহ বুখারীর), মরিয়ম পুত্র ঈসা নিশ্চয়ই রাওহা উপত্যকায় হাজ্জ অথবা উমরাহ কিংবা উভয়েরই তালবিয়াহ পাঠ করবেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৯২০)। ঈসা ইবনে মরিয়ম দুইজন ফেরেশতার পাখার উপর আপনা দুই বাহু রেখে নাযিল হবেন (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ফিতান), ঈসা ইবনে মরিয়মকে তিনি স্বশরীরে জীবিত আকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন, তিনি অতি সত্বর পৃথিবীতে ফিরে আসবেন (আত-তবকাতুল কোবরা লি-ইবনে সা’আদ ১/৩৫-৩৬; হাদীসের মান : সহীহ)! দীর্ঘ আরেকটি হাদীসের একাংশে এসেছে : ‘ছুম্মা ইয়ানযিলু ঈসা ইবনু মারইয়ামা মুছাদ্দিকান বি-মুহাম্মাদিন ও আ’লা মিল্লাতিহী’ অর্থাৎ তারপর ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:) নাযিল হবেন মুহাম্মদ (সা:)-কে সত্যায়নকারী হিসেবে ও তাঁরই উম্মত হয়ে। (আল-মু’জামুল আওসাত হাদীস নং ৪৫৮০; হাদীসের মান : হাসান)। বেশ কিছু সহীহ হাদীসের সংক্ষিপ্ত বঙ্গানুবাদ। এমতাবস্থায় হাদীসগুলো সহীহ হওয়া সত্তে¡ও কাদিয়ানীরা সেগুলো পবিত্র কুরআনের বিরুদ্ধে যাওয়ার কথা বলে তারা প্রকারান্তরে রাসূল (সা:)-কেই কুরআন বুঝতে অক্ষম কিংবা কুরআনের বিরুদ্ধবাদী বলে সাব্যস্ত করল কিনা? এবার আসুন! খোদ মির্যা কাদিয়ানী তার বইতে সহীহ হাদীসের বিশেষত্ব কেমন শব্দচয়নে তুলে ধরেছে দেখা যাক।

আল-আসমা ওয়াস-সিফাত ২/৩৩১; ইমাম বায়হাক্বী, হাদীসের মান : সহীহ

(২) মির্যা কাদিয়ানী তার বইয়ের এক জায়গায় সহীহ হাদীসের বিশেষত্ব তুলে ধরে লিখেছেন : “বরং মুওয়াফিকতে কুরআনকে হাদীসের বিশুদ্ধতার মানদন্ড স্থীর করবেনা। এই বিষয়ে উসূলে রেওয়ায়েত তথা বর্ণনার মূলনীতির দিকে রুজূ করার দুইটি কারণ রয়েছে। একটি কারণ এই যে, উসূলে রেওয়ায়েত দ্বারা সহীহ সাব্যস্তকৃত হাদীসসমূহ আপনাআপনি কুরআন মাজিদ এর মুওয়াফিক হয়ে থাকে এবং কখনোই সেটি কুরআন বিরোধী হয় না। কুরআন হচ্ছে ইমাম আর হাদীসসমূহ তার খাদেম বা সেবক ও তার বিভিন্ন বিষয় এবং অস্পষ্ট অর্থের বিশ্লেষণকারী ও সুস্পষ্টকারী যা অল্প জ্ঞানসম্পন্ন আর অসম্পূর্ণ চিন্তাবিদদের ধারণায় সাংঘর্ষিক মনে হয়ে থাকে।” (রেফারেন্স: মুবাহাছায়ে লাদূনিয়া, রূহানী খাযায়েন ৪/৫৪)। তাই প্রশ্ন হল, বর্তমানে যেসব কাদিয়ানী সহীহ হাদীসকেও কুরআন বিরোধী বলে আখ্যা দেন তারা কি একদিকে রাসূল (সা:)-কে কুরআন বিরোধী বলে আখ্যায়িত করল না? অপরদিকে মির্যা কাদিয়ানী নিজেও যেখানে “উসূলে রেওয়ায়েত (আল-মুস্তালাহাতুল আহাদীস বা হাদীসশাস্ত্রের নীতিমালা) দ্বারা সহীহ সাব্যস্তকৃত হাদীসসমূহ আপনাআপনি কুরআন মাজিদ এর মুওয়াফিক হয়ে থাকে এবং কখনোই সেটি কুরআন বিরোধী হয় না” বলল, সেখানে কথা কাদেরটা সঠিক মানবো? কাদিয়ানী নেতাদেরটা নাকি তাদের কথিত মসীহ মির্যা কাদিয়ানীরটা?

(৩) মির্যা কাদিয়ানী তার বইয়ের এক জায়গায় লিখেছেন : “আমি ‘বারাহীনে আহমদীয়া’ নামক বইতে লিখেছিলাম মসীহ ইবনে মরিয়ম আকাশ থেকে নাযিল হবেন। তবে পরবর্তিতে আমি লিখেছি, আগত মসীহ (ঈসা) আমি নিজেই।” (দেখুন, রূহানী খাযায়েন ২২/১৫২-৫৩)। এখানে বলে রাখা দরকার যে, মির্যা কাদিয়ানী তার উক্ত বারাহীনে আহমদীয়া নামক বইটি আল্লাহর পক্ষ হতে নির্দেশপ্রাপ্ত ও একজন মুলহাম [দৈব-বাণীর অধিকারী] হয়েই লিখার দাবী করেছেন। (দেখুন, রূহানী খাযায়েন ৫/৬৫৭)। তিনি আরো লিখেছেন, প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ উভয় দিক থেকে বইটির পরিচালক (পৃষ্ঠপোষক) মহান আল্লাহ। (দেখুন, মাজমু’আয়ে ইশতিহারাত ১/৫৬)। তিনি তার বারাহীনে আহমদীয়া বইকে আল্লাহর কিতাব বলেও আখ্যা দিয়েছেন। দেখুন ‘তাযকেরাতুশ শাহাদাতাঈন’ (বাংলা) পৃষ্ঠা নং ৭৭)। তাহলে এবার বলুন, ঈসা (আ:) সত্যিই বেঁচে না থাকলে মির্যা কাদিয়ানী তার উক্ত বইতে ঈসা (আ:) জীবিত থাকা, আকাশ থেকে নাযিল হওয়া ইত্যাদি কথাবার্তাগুলোও কি আল্লাহর পক্ষ হতে ইলহাম ছাড়াই কিংবা আল্লাহর পক্ষ হতে নির্দেশপ্রাপ্ত হওয়া ছাড়াই লিখেছিলেন মনে করেন? অথচ তিনি এও দাবী করতেন : আল্লাহতালা তাকে ভুলের উপর এক মুহূর্তও স্থির থাকতে দেন না। (দেখুন, রূহানী খাযায়েন ৮/২৭২)। তাহলে এবার আমাকে বলুন! যার দাবী, আল্লাহতালা তাকে ভুলের উপর এক মুহূর্তও স্থির রাখেন না সে ১৮৮৪ সালে বইটি লিখার পর হতে ১৮৯৩ সালে মসীহ দাবীর আগ পর্যন্ত বরাবরই কি ভুলের উপর স্থির ছিলেন মনে করেন? এখন তার ‘বারাহীনে আহমদীয়া’ বইয়ের সেসমস্ত ইলহাম সত্য হলে পরবর্তিতে তিনি পবিত্র কুরআনের ত্রিশ আয়াত দিয়ে ঈসা (আ:)-কে কিভাবে মৃত আখ্যা দিতে পারেন?

(৪) অসংখ্য সাহাবী থেকে ঈসা (আ:) জীবিত ও স্বশরীরে আকাশে উত্থিত হয়ে যাওয়া এবং কেয়ামতের পূর্ব মুহূর্তে দুনিয়াতে ফিরে আসার সমর্থনে বহু সহীহ হাদীস বর্ণিত আছে। যার সংখ্যা এত বেশি যে, ফলে সেগুলোর হুকুম (বিধান) তাওয়াতূর পর্যায়ে পৌছে গেছে। যেমন হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে সূরা আলে ইমরান এর ৫৫নং আয়াত ‘ইন্নী মুতাওয়াফফীকা’ এর তাফসীর বিশুদ্ধসূত্রে বর্ণিত হয়েছে এভাবে যে, তিনি বলেছেন “ক্বালা ইন্নী রাফিউকা ছুম্মা মুতাওয়াফফীকা ফী আখিরিয যামান”। অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা বলেছেন, নিশ্চয়ই আমি তোমাকে উঠিয়ে নেব অতপর শেষ যামানায় তোমাকে (মৃত্যুর মাধ্যমে) পুরোপুরি নিয়ে নেব।” (দুররে মানছ‚র, ইমাম জালালুদ্দীন আস সুয়ূতী খন্ড নং ৩ দ্রষ্টব্য)। বলে রাখা দরকার, সহীহ বুখারীর কিতাবুল ইলম অধ্যায়ে (হা/ ৭৫ ইফা) একটি হাদীসে উল্লেখ আছে, রাসূল (সা:) ইবনে আব্বাসের জন্য দোয়া করেছেন ‘আল্লাহুম্মা আ’ল্লিমহুল কিতাব’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! আপনি তাঁকে কুরআন শিখিয়ে দিন।’ এমতাবস্থায় রঈসুল মুফাসসিরীন ইবনে আব্বাস (রা:), প্রখ্যাত তাবেয়ী ও ইবনে আব্বাসের খাস শিষ্য ইমাম যাহহাক, মুজাহিদ, আলকামা, ইক্বরিমা, আবু মালেক ও আবু আ’লীয়াহ প্রমূখ তারাও কি কুরআনের সঠিক অর্থ বুঝতে অক্ষম ছিলেন মনে করেন? কাদিয়ানীরা নিজেদেরকে তাঁদের চেয়েও কুরআন বেশী বুঝার দাবী করে কি? আসতাগফিরুল্লাহ!!

(৫) ইসলামের প্রথম শতাব্দী হতে দুনিয়ার সমস্ত মুসলমান অদ্যাবধি সর্বসম্মতভাবে বিশ্বাস করে আসছেন যে, ঈসা (আ:) জীবিত এবং তিনি আকাশে রয়েছেন। এই কথার স্বীকারোক্তি খোদ কাদিয়ানী দ্বিতীয় খলীফা মির্যা বশির উদ্দীনও দিয়ে গেছেন। (তার বইগুলোর সমষ্টি আনওয়ারুল উলূম ২/৪৬৩ দ্রষ্টব্য)। তাই প্রশ্ন হল, তবে কি সর্বসম্মতভাবে সমস্ত মুসলমানও কুরআনের সঠিক অর্থ বুঝতে অক্ষম ছিলেন বলবেন? কাদিয়ানীরা কি নিজেদেরকে তাঁদের চেয়েও কুরআন বেশী বুঝে বলেই দাবী করতে চায়? অথচ হাদীসে উল্লেখ আছে, উম্মতে মুহাম্মদীয়া কখনো ভুল ও ভ্রষ্টতার উপর একমত হবেনা (তিরমিযী শরীফ, কিতাবুল ফিতান)। এখন কাদিয়ানীরা কি রাসূল (সা:)-এর ভবিষ্যতবাণীটাও সঠিক নয় বলবে? নাউযুবিল্লাহ!

(৬) যুগ শ্রেষ্ঠ ও বরেণ্য ইমামগণের তাফসীরগ্রন্থ তাফসীরে ইবনে কাসীর, বায়দ্বাভী, তাবারী, কুরতুবী, রূহুল মা’আনী, দুররে মানছূর, জালালাইন, খাজেন, আল-মা’আলিমুত তানজিল, কাশশাফ, ইমাম রাজী’র তাফসীরে কাবীর, আবু হাতিম, ইমাম শাওক্বানী’র ফাতহুল ক্বাদির ও শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেস আদ-দেহলভীর ‘ফতহুর রহমান’সহ উল্লেখযোগ্য সমস্ত তাফসীর গ্রন্থে পরিষ্কার লিখা আছে : ঈসা ইবনে মরিয়ম আকাশে জীবিত এবং তাঁর দ্বিতীয়বারের আগমন অকাট্য সত্য। এখন প্রশ্ন হল, এঁদের সবাই কি পবিত্র কুরআনের সঠিক অর্থ বুঝতে অক্ষম ছিলেন? কাদিয়ানীরা নিজেদেরকে তাঁদের চেয়েও কুরআন বেশী বুঝার দাবী করবে কি? আসতাগফিরুল্লাহ!! অথচ মির্যা কাদিয়ানী নিজেও কুরআন শরীফ অর্থগত বিকৃতি থেকে রক্ষা পাওয়ার দ্বিতীয় উপায় হিসেবে লিখে গেছেন, (অনুবাদ) “দ্বিতীয়ত : আল্লাহতালা পবিত্র কুরআনকে এমন সব ইমাম আর আকাবীরগণের মাধ্যমেও যাদেরকে প্রত্যেক শতাব্দীর শিরোভাগে কুরআনের সঠিক বুঝ দান করা হয়েছে, যারা কুরআন শরীফের অস্পষ্ট জায়গাগুলো নবীজির হাদীসসমূহ দ্বারা তাফসীর করে খোদার পবিত্র বাণীকে এবং পবিত্র শিক্ষাকে প্রত্যেক যুগে অর্থগত বিকৃতি হওয়া থেকে রক্ষা করেছেন।” (দেখুন, রূহানী খাযায়েন ১৪/২৮৮)। এমতাবস্থায় উল্লিখিত তাফসীরকারকগণ ঈসা (আ:) সম্পর্কে নাযিলকৃত কুরআনের আয়াতগুলোর সঠিক মর্ম উদঘাটনে কিভাবে অক্ষম হতে পারেন? তাহলে প্রত্যেক শতাব্দীর শিরোভাগে তাদেরকে কুরআনের সঠিক বুঝ কিভাবে দান করা হল? আপনাদের মতেও মির্যা নিজেই মিথ্যুক সাব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে কিনা?

আসুন! নিজেদের বিচার-বুদ্ধিকে এভাবে নিজ হাতে হত্যা না করে আগে বরং এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here