কথিত ইলিয়া (ইলিয়াস) থেকে ইউহান্না (ইয়াহিয়া) উদ্দেশ্য?
কাদিয়ানীঃ বাইবেলে উল্লেখ আছে, বনী ইসরাইলের পূর্বেকার বহু নবী ভবিষ্যৎবাণী দিয়ে বলেছেন, মাসীহ মওঊদ ততক্ষণ পর্যন্ত আগমন করবেন না যতক্ষণ না “ইলিয়া” (ইলিয়াস) নামের একজন নবীর পুনঃআগমন হচ্ছে!
আমিঃ আচ্ছা, তারপর!
কাদিয়ানীঃ তারপর যখন মাসীহে মওঊদ হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আঃ) নবুওত দাবী করলেন তখন ইহুদী সম্প্রদায় এই বলে তা অস্বীকার করলো যে, আপনার পূর্বে তো “ইলিয়া” (ইলিয়াস) নামের একজন নবীর পুনঃ আগমন হওয়ার কথা! তিনি আসার আগে আপনি কিভাবে মাসীহ হন? মাসীহ’র আগে তো তাঁর আসার কথা!
আমিঃ আচ্ছা তারপর!
কাদিয়ানীঃ তারপর মাসীহে মওঊদ হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আঃ) বললেন, ইলিয়া তো এসে গেছেন! ইউহান্না তথা ইয়াহিয়া (আঃ) এর প্রতি ইংগিত করে ঈসা (আঃ) বললেন, ইনি-ই সেই ইলিয়া! যার আসার কথা তিনি এসে গেছেন!
(ইঞ্জিল মথি, অধ্যায় ১১, আয়াত ১৩-১৫; অধ্যায় ১৭, আয়াত ১০-১৩ দ্রষ্টব্য)
উল্লেখ্য, সাধারণভাবে মনে করা হয়, মথি লিখিত সুসমাচারটি হিব্রু বা আরামিক ভাষায় সন্ত মথির দ্বারা প্রথমে লিখিত হয়েছিল ও পরে গ্রিক ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। কিন্তু কোথাও লেখক দাবি করেননি যে, তিনি কোনো ঘটনার সাক্ষী ছিলেন। অধিকাংশ গবেষকের মতে, মথি-লিখিত সুসমাচার রচিত হয়েছিল খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দীর শেষ ভাগে। অর্থাৎ, এটি দ্বিতীয় প্রজন্মের খ্রিস্টানদের রচনা। (উইকিপিডিয়া, সাধু মথি লিখিত সুসমাচার দ্রষ্টব্য)
আমিঃ কিন্তু এসব জেনে আমার কী লাভ?
কাদিয়ানীঃ বুঝেননি!! ওই যে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী যাকে আপনারা ভন্ডনবী বলেন; অথচ আমরা তাঁকে হাদীসে বর্ণিত প্রতিশ্রুত সেই মাসীহে মওঊদ বলেই বিশ্বাস করি! কারণ বাইবেলে যেমন “ইলিয়া” নবীর পুনঃআগমন এর কথা থাকা সত্ত্বেও তাঁর স্থলে ইউহান্না অর্থাৎ যোহনকে-ই “ইলিয়া” আখ্যা দেয়া হয়েছিল ঠিক তেমনি হাদীস শরীফে বনী ইসরাইলী যেই ঈসা আকাশ থেকে আসার ভবিষ্যৎবাণী এসেছে তদ্দ্বারা মূলত ভারতের কাদিয়ান গ্রামের মির্যা গোলাম আহমদ-ই উদ্দেশ্য। অতএব যার আসার কথা তিনি এসে গেছেন!
আমিঃ ও আচ্ছা, তাই নাকি? তার মানে আপনি বুঝাতে চাচ্ছেন, যেই ঈসা ইবনে মরিয়ম (আঃ) এর পুনঃ আগমনের ভবিষ্যৎবাণী হাদীসে আছে সেই ঈসা বলতে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী!?
কাদিয়ানীঃ জ্বী হ্যাঁ।
আমিঃ আচ্ছা, ওই যে ইলিয়া আর ইউহান্না আরো যা যা বললেন—একথাগুলো বাইবেল (ইঞ্জিল) কিবা আগের যুগের কিতাবগুলো ছাড়া আমাদের কুরআন হাদীসের কোথাও আছে কিনা?
কাদিয়ানীঃ না নেই, এগুলো শুধুমাত্র বাইবেলের নতুন নিয়মে (New Testament) রয়েছে।
আমিঃ যদি তাই হয়, তাহলে তো আমাদের মুসলমানদের নিকট এসমস্ত গল্পের কানাকড়িও মূল্য থাকার কথা না! আফসোস! আপনি নিজেকে মুসলমান দাবী করেন আবার বাইবেলকেও দলিল মানেন! লোকমুখে শুনতাম, কাদিয়ানিরা ইহুদী খ্রিস্টানের জাত-ভাই, আর এখন তো প্রমাণ-ই পেলাম!
কাদিয়ানীঃ কেন, বাইবেলের রেফারেন্স কী অগ্রহণযোগ্য? বাইবেল কি ঐশী গ্রন্থ ছিল না?
আমিঃ এই প্রশ্ন আমাকে না করে বরং আপনার মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে করুন। কেননা তিনি নিজেও লিখেছেন غرض یہ چاروں انجیلیں جو یونانی سے ترجمہ ہو کر اس ملک میں پہیلائی جاتی ہیں ایک ذرہ بہی قابل اعتبار نہیں۔ تریاق القلوب (অর্থাৎ মোটকথা হচ্ছে এই চারো ইঞ্জিল [বাইবেল পুরাতন বা নতুন নিয়ম–অনুবাদক] যা ইউনানি (গ্রীস) ভাষায় অনুবাদ হয়ে এই রাজ্যে প্রচারিত হয়েছে এগুলো এক অণু পরিমাণ-ও গ্রহনযোগ্য নয়)। দেখুন রূহানী খাযায়েন ১৫/১৪২।
মির্যা কাদিয়ানী সাহেব আরেক জায়গায় আর-ও লিখেছেন بلکہ سچ تو یہ بات ہے کہ وہ کتابیں آنحضرت صلی اللہ علیہ و سلم کے زمانہ تک ردی کی طرح ہو چکی تہیں اور بہت سے جہوٹ ان میں ملائے گئے تہے جیساکہ قرآن شریف فرمایا گیا ہے کہ وہ کتابیں محرف مبدل ہیں اور اپنی اصلیت پر قائم نہیں رہیں۔ چشمہ معرفت (অর্থাৎ বরং সত্যকথা তো এটাই যে, এ সমস্ত কিতাব [আগের ঐশীগ্রন্থ গুলো–অনুবাদক] হুজুর সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ পর্যন্ত নষ্ট বস্তুতে পরিণত ছিল এবং প্রচুর মিথ্যা তাতে মিশ্রিত ছিল। যেমনটা কুরআন শরীফে বলা হয়েছে যে, এ সমস্ত কিতাব বিকৃত ও পরিবর্তিত এবং আপনা মৌলিকত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়)। দেখুন, রূহানী খাযায়েন ২৩/২৬৬)। স্ক্রিনশট দেখুন।
মির্যা সাহেবের বক্তব্যের সারাংশ হচ্ছে, (১) ইঞ্জিলের যতগুলো কপি রয়েছে তার একটির-ও অণু পরিমাণ গ্রহনযোগ্যতা নেই। (২) এগুলো রাসূল (সাঃ) এর যুগ পর্যন্ত নষ্ট আর অকেজো বস্তুতে পরিণত ছিল। (৩) এগুলোর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে মিথ্যার মিশ্রণ ঘটেছে। (৪) কুরআন শরীফ দ্বারাও প্রমাণ আছে যে, এই কিতাবগুলোতে বিকৃতি আর পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছে। (৫) এই কিতাব গুলো মৌলিকত্বের উপর অক্ষুণ্ণ থাকেনি ইত্যাদি।
এমতাবস্থায় আপনার ওই সব ইলিয়া কিবা ইউহান্না টাইপের কেচ্ছা কাহিনীর সত্যতার গ্যারান্টি কোথায়? এমন একটি অগ্রহণযোগ্য ও বিকৃত সোর্সের উপর ডিফেন্স করে আমি কিভাবে আমার নবী মুহাম্মদে আরাবী (সাঃ)-এর ভবিষ্যৎবাণীকে বেঁকিয়ে ব্যাখ্যা দিতে পারি?
কাদিয়ানীঃ (পুরোই লা-জবাব!) হুম!
আমিঃ এরপরও যদি বলেন যে, ইলিয়া হতে ইউহান্না-ই উদ্দেশ্য কিবা বাইবেলের উক্ত গল্প সঠিক তখন আপনার নিকট নিচের প্রশ্নগুলোর আদৌ কোনো জবাব থাকবে না।
(১) ইউহান্না অর্থাৎ যোহনের ইঞ্জিল এর মধ্যে পরিস্কার উল্লেখ আছে, সে সময়ের জেরুজালেম এর নেতৃস্থানীয় ইহুদীরা ইউহান্না’র নিকট কতিপয় ভবিষ্যদ্বক্তাসহ লোকজন প্রেরণ করেছিলেন এই মর্মে যে, ইউহান্না-ই সেই প্রতিশ্রুত ‘ইলিয়া‘ কিংবা ‘মাসীহ‘ কিনা—তা যেন খোদ ইউহান্না’র মুখ থেকেই জেনে আসেন। তাই ইউহান্নাকে যখন প্রশ্ন করা হল তখন তিনি পরিস্কার করে জানিয়ে দিলেন যে ‘আমি (ইউহান্না) সেই প্রতিশ্রুত মাসীহ নই’। তারা তাঁকে আরো জিজ্ঞেস করলো, তাহলে আপনি কে? ইলিয়া? ইউহান্না উত্তরে বললেন : না, আমি তা-ও নই। (রেফারেন্স : ইউহান্না’র ইঞ্জিল ১ম অধ্যায়, আয়াত ১৯-২১)। উল্লেখ্য, ইউহান্না আর যোহন একই জিনিস। প্রমাণের জন্য স্ক্রিনশট দেখুন!
এবার ইউহান্না তিনি যে ইলিয়া (ইলিয়াস নবী) হওয়া অস্বীকার করতেন সে কথা মির্যা কাদিয়ানী সাহেবের বই থেকে জেনে নিন! মির্যা সাহেবের পুস্তক “নুসরাতুল হক্ব” এর মধ্যে লিখা আছে اور عجیب یہ ہے کہ یوحنا اپنے الیاس ہونے سے خود منکر ہے۔ مگر تا ہم یسوع ابن مریم نے زبردستی اسکو الیاس ٹہراہی دیا۔ نصرة الحق অর্থাৎ আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ইউহান্না (তথা যোহন) নিজেও ইলিয়াস অর্থাৎ ইলিয়া হওয়া অস্বীকার করতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসোয়া তথা ঈসা ইবনে মরিয়ম জবরদস্তির সাথে তাঁকে ইলিয়া আখ্যা দেন।’ দেখুন, রূহানী খাযায়েন ২১/৪২-৪৩।
ইউহান্না তথা যোহনের ইঞ্জিল আর মির্যা সাহেবের ‘নুসরাতুল হক্ব’ দুটির বক্তব্যের সার-সংক্ষেপ হল, ঈসা (আঃ) ইউহান্নাকে ইলিয়া আখ্যা দিলে ইউহান্না নিজে “ইলিয়া” হওয়া অস্বীকার করেন। ফলে অর্থ দাঁড়াল, ঈসা (আঃ) আপনা কথায় সত্যবাদী হলে তখন ইউহান্না হয়ে যান মিথ্যাবাদী আর যদি ইউহান্না সত্যবাদী হন তাহলে ঈসা (আঃ) হয়ে যান মিথ্যাবাদী! (নাউযুবিল্লাহ)। তো এবার নিরপেক্ষতার সাথে ভেবে দেখুন, বাইবেলের গল্পটি সঠিক হলে তখন উক্ত দুইজনের যে কোনো একজন নিশ্চিত মিথ্যাবাদী হয়ে যাচ্ছেন কিনা? শুধুমাত্র একবার চিন্তা করে দেখুন, এমন একটি বিকৃত ও সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য সোর্সের উপর ভিত্তি করে ‘ইলিয়া আর ইউহান্না’ গল্পে কিভাবে ঈমান রাখতে পারেন যার পরিণতিতে আল্লাহ’র মনোনীত কোনো না কোনো পয়গাম্বরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে হচ্ছে? অথচ এই প্রসঙ্গে আমি জীবনেও যদি কথা না বলি, তবুও আল্লাহ আমাকে কেয়ামতের দিন এজন্য পাকড়াও করবেন না।
(২) তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নিই যে, ইউহান্না তিনি নিজেকে “ইলিয়া” হওয়া অস্বীকার করেননি, বরং স্বীকার করেছেন যে তিনি-ই ইলিয়া। তা সত্ত্বেও সেটির উপর কিয়াস করে মুহাম্মদে আরাবী (সাঃ) এর হাদীসকে তাবীল (ব্যাখ্যা) করে ‘ঈসা ইবনে মরিয়ম’ বলতে “রূপক ঈসা” এর ধারণা কোনোমতেই ঠিক হবেনা। কারণ, “ইলিয়া” এর দ্বিতীয় আগমন সম্পর্কে বনী ইসরাইলের পূর্বেকার নবীদের ভবিষ্যৎবাণীতে “শপথ বাক্য” এর উল্লেখ নেই।
অপরদিকে হাদীস শরীফে নুযূলে ঈসার বর্ণনায় “শপথ বাক্য” এর উল্লেখ আছে। এ সম্পর্কে মির্যা সাহেবের বক্তব্য নিম্নরূপ-
মির্যা সাহেব ‘হামামাতুল বুশরা’ (মূলগ্রন্থ) এর ১৪ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন “শপথ (কসম করে কিছু বলা) একথারই প্রমাণ বহন করে যে, নিশ্চয়ই খবর বা হাদীসটি জাহেরি (আক্ষরিক) অর্থই বুঝাবে। সেখানে কোনো তাবীল (ব্যাখ্যা) চলবে না, ব্যতিক্রম মর্মার্থ নেয়াও চলবেনা। নচেৎ শপথ করে লাভ কী হল?”
এবার দেখা যাক, ঈসা (আঃ) এর নুযূল হওয়া সম্পর্কে সহীহ বুখারী’র কিতাবুল আম্বিয়া-তে হাদীসটি কেমন শব্দচয়নে এসেছে! রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ওয়াল্লাজী নাফসি বি-ইয়াদিহি অর্থাৎ সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ….অবশ্যই ইবনে মরিয়ম একজন ন্যায়পরায়ন শাসক হিসেবে নাযিল হবেন।
তাহলে এবার চিন্তা করার বিষয় যে, ঈসা (আঃ) এর দ্বিতীয়বারের আগমন সম্পর্কিত হাদীসে ‘শপথ’ বাক্যের উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও সেখানে তাবীল করে ‘রূপক ঈসা‘ এর ধারণা নেয়া কতটুকু গ্রহণযোগ্য? এটি খোদ মির্যা কাদিয়ানীর-ও নীতিবিরুদ্ধ নয় কি? এখানে কী জবাব? (সংক্ষেপে এ পর্যন্ত)।
কাদিয়ানীঃ হুম! আগে তো কখনো এই বিষয়গুলো ভাবিনি!!
আমিঃ আমি সাহস করে সত্যটা তুলে ধরলাম মাত্র। এবার যাচাইবাচাই করে গ্রহণ করা কিবা এড়িয়ে যাওয়া যার যার ব্যাপার।
হাসবুনাল্লাহ নি’মাল ওয়াকিল নি’মাল মওলা ওয়া নি’মান নাছীর! আল্লাহ আপনাকে সুমতি দিন!
পবিত্র কুরআন দ্বারাও ঈসা (আ:) এখনো জীবিত থাকার প্রমাণ Click
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক