আদম (আ:) কি প্রথম মানুষ নন? কাদিয়ানী মতবাদের খন্ডন

0
আদম (আ:) কি প্রথম মানুষ নন? কাদিয়ানী মতবাদের খন্ডন

হযরত আদম (আ:) কি একই সাথে প্রথম নবী এবং প্রথম মানুষ নন? কাদিয়ানীদের একটি ইসলাম পরিপন্থী কুফুরী আকীদার দাঁতভাঙা জবাব :

কাদিয়ানীদের বইগুলো অসম্ভব রকমের স্ববিরোধ কথাবার্তায় ভরা! এদের মু’আল্লিমদের যদি প্রশ্ন করেন যে, হযরত আদম (আ:)-ই আমাদের আদি-পিতা ছিলেন, তোমরা কি এটা মানো? তারা জবাবে বলবে, না আমরা এটা মানিনা! তারা তাদের মতের পক্ষে অনেক যুক্তি এবং পবিত্র কুরআন থেকে আয়াত উল্লেখ করে অপব্যাখ্যাও দিতে চাইবে!

কিন্তু এই যে একখানা বইয়ের স্ক্রিনশট দেখতে পাচ্ছেন, এটিও কিন্তু তাদেরই বই। মির্যা কাদিয়ানীর ১৯০৪ সালের সেপ্টেম্বরে লাহোরে একটি জনসমাবেশে তারই একটি লেকচারের বঙ্গানুবাদ। এই বইয়ের ৪৮ নং পৃষ্ঠায় দেখুন পরিষ্কারভাবে আগের মতবাদেরই বিপরীতে লিখা আছে, ‘পূর্ববর্তী সকল সভ্যতার পর যে আদম (আ:) আগমন করেন, যিনি আমাদের সবার আদি পিতা, পৃথিবীতে তাঁর আগমনের যুগ থেকে বর্তমান মানব সভ্যতা সূচিত হয়েছে। আর এই (সমস্ত) সভ্যতার পূর্ণ চক্রের আয়ু সাত হাজার বছর পর্যন্ত প্রসারিত।’ এতে পরিষ্কার বুঝায় যাচ্ছে, মানব সভ্যতার পূর্ণ চক্রের আয়ু সাত হাজার বছর বলিয়া মির্যা সাহেব বুঝাতে চাচ্ছেন যে, মানুষের আদি পিতা হযরত আদম (আ.) ও তাঁর যুগ থেকেই মানবসভ্যতা সূচিত হয়। আর সাত হাজার বছর পরপরই উক্ত সভ্যতার পরিসমাপ্তি ঘটবে তথা কেয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে। কিয়েক্টাবস্থা! গায়েবের সংবাদও তিনি দিয়ে দিচ্ছেন!!

অপ্রিয় হলেও সত্য তাদের বইগুলো পড়লে যে কেউই এভাবে অসংখ্য স্ববিরোধ কথাবার্তার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাবেন। স্ক্রিনশট :-

যাইহোক, এবার সামনে চলুন!

কাদিয়ানীধর্ম এর অনুসারীরা ডারউইন এর বিবর্তনবাদ তত্ত্ব কুরআনের সাথে মিশিয়ে বলতে চায় প্রথম মানব আদমের পূর্বেও বহু বন্য মানুষ ছিল । নাউযুবিল্লাহ। এর মানে এদের বিশ্বাস হল, হযরত আদম (আ:) প্রথম মানব ছিলেন না, বরং তাঁর পূর্বেও মানব গোষ্ঠী ছিল! তাই এদের উদ্দেশ্যে এখানে আমি কিছু দলিল ও যুক্তি-নির্ভর প্রশ্ন উত্থাপন করছি। আমি তাদের বিবেকের নিকট প্রশ্নগুলোর উত্তর চাইব! তাই প্রথমেই একটি আয়াত দিয়েই শুরু করছি,

আল্লাহতালা ইরশাদ করেন :

إن مثل عيسى عند الله كمثل آدم خلقه من تراب ثم قال له كن فيكون অর্থাৎ নিঃসন্দেহে আল্লাহ’র নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আদমেরই মতো। তিনি তাঁকে মাটি দিয়ে তৈরী করেছিলেন তারপর তাঁকে বলেছিলেন, হয়ে যাও! সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেলেন (সূরা আল ইমরান – ৫৯)।

সম্পর্কিত আলোচনা : মহান আল্লাহ পিতা বিহীন ঈসা (আ:)-কে সেভাবেই সৃষ্টি করেছেন যেভাবে প্রথম মানব আদমকে সৃষ্টি করেছিলেন। আদমের সাথে ঈসার দৃষ্টান্ত এটাই। উক্ত আয়াতে আবার বলা হল, আদমকে মাটি দ্বারাই সৃষ্টি করা হয়েছে এবং হয়ে যাও বলতেই পূর্ণাঙ্গ রক্তে মাংসে পরিণত হয়ে গেছে, এই আয়াতে ইহা একেবারেই সুস্পষ্ট। অতএব, আদমের পূর্বে কোনো মানুষ ছিল না বলেই অকাট্যরূপে প্রমাণিত। ডারউইনের ভ্রান্ত মতবাদকে বিজ্ঞান আখ্যা দিয়ে মহাগ্রন্থে আল কুরআনের আয়াতকে বিকৃত করে ব্যতিক্রম কিছু সাব্যস্ত করার আর কোনো সুযোগই থাকেনি।

হয়ত প্রশ্ন করতে পারেন, হযরত আদম (আ:)ই যদি প্রথম মানুষ হন তাহলে তখন তো আর কোনো মানুষই জগতে ছিলো না। এমতাবস্থায় তিনি কাদের জন্য নবী হয়ে আসলেন কিংবা কোন সম্প্রদায়ের জন্য প্রেরিত হলেন? এতেই বুঝা যায়, মূলত যিনি প্রথম আদম তিনি নবুওয়তের অধিকারী হযরত আদম নন, বরং ভিন্ন একজন। (কাদিয়ানীদের দাবী ও যুক্তি শেষ হল)।

  • তাদের উক্ত দাবী এবং যুক্তির জবাব একদম শেষেই দেয়া হবে। তার আগে তাদেরই উক্ত দাবী এবং যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে আমি তাদের উদ্দেশ্যে পালটা কিছু প্রশ্ন করতে চাই।

১। পবিত্র কুরআনে কয়জন আদম এর উল্লেখ আছে? কয়েকজন আদমের নাকি শুধুই একজন আদমের? এর জবাব আগে দিন! যদি বলেন, কয়েকজন আদমের কথাই উল্লেখ আছে। তাহলে এর সুস্পষ্ট প্রমাণ উল্লেখ করুন।

২। এই প্রশ্নটি বুঝার সুবিধার্থে প্রথমে হাদীসটি পড়ুন। সহীহ বুখারীর কিতাবুল আম্বিয়া পর্বের অধ্যায় নং ৫০ এবং হাদীস নং ৩১০০ দেখুন, হাদীসের আরবী عَنْ عَبْدِ اللَّهِ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ لاَ تُقْتَلُ نَفْسٌ ظُلْمًا إِلاَّ كَانَ عَلَى ابْنِ آدَمَ الأَوَّلِ كِفْلٌ مِنْ دَمِهَا، لأَنَّهُ أَوَّلُ مَنْ سَنَّ الْقَتْلَ

অর্থ, আবদুল্লাহ‌ ইবনু মাসঊদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “কোনো ব্যাক্তিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলে, তার এ খুনের পাপের একাংশ আদম (আ.)-এর প্রথম ছেলের (কাবিলের) উপর বর্তায়। কারণ সেই সর্বপ্রথম হত্যার প্রচলন করেছে।” এবার প্রশ্নটি এই,

এই হাদীসটিও কাদিয়ানী মতবাদের অসারতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয় কি? কেননা, আদম যদি কয়েকজনই হত তাহলে অন্তত এই হাদীসে সেদিকে ইংগিত নেই কেন? যেজন্য এখানে আদম (আ.)-এর সন্তান ‘কাবিল‘ এর যে ব্যাপারটি আলোচিত হল, এর পরিপ্রেক্ষিতে কাদিয়ানীদের প্রতি যে প্রশ্নটি উঠে আসে তা হল, তবে কি তাদের (কাদিয়ানীদের) কনসেপ্ট অনুসারে আরও যত আদম ছিলেন তাদের সন্তানদের মধ্য হতে কেউই কখনো খুন-খারাবি করেনি? যদি করে থাকে তাদের আলোচনা কোথায়?

৩। আর যদি বলেন, শুধুই একজন আদমের কথাই উল্লেখ আছে, তাহলে আমার নিচের এই প্রশ্নটির কী জবাব?

আমার প্রশ্নটি হল :

আল্লাহতালা সূরা আল বাক্বারা এর ৩০ নং আয়াতে আদম (আ:) সম্পর্কে ফেরেশতাদের সম্বোধন করে বলেছিলেন, “ইন্নী জা’ইলুন ফিল আরদ্বি খলীফা” অর্থাৎ নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি (খলীফা) মনোনীত করব। এখানে আদমকে ভবিষ্যতের একজন “খলীফা” তথা আল্লাহর প্রতিনিধি বা একজন নবী হওয়ার সংবাদ দেয়া হয়েছে। তারপর একই সূরার ৩৫ নং আয়াতে আদম হাওয়া দুইজনের ব্যাপারে এসেছে, “উসকুন আন্তা ওয়া ঝাউজুকাল জান্নাতা” অর্থাৎ তুমি এবং তোমার স্ত্রী দুইজনই জান্নাতে অবস্থান কর।

উপরের দুইটি আয়াত দ্বারা সুস্পষ্ট হল যে, আদম এবং হাওয়া দুইজনই পৃথিবীতে আসার আগে জান্নাতে ছিলেন এবং আদম (আ:) পরবর্তীতে নবুওয়তের অধিকারী হয়েছেন। বর্তমান দুনিয়ার সমস্ত মানুষ তারই বংশধর, ফলে তাদেরকে বলা হয় বনি-আদম বা আদমের সন্তান-সন্ততি।

একই সূরার ৩৬ নং আয়াতে এসেছে, “ওয়া কুলনাহবিতূ বা’দ্বুকুম লি-বা’দ্বিন আদ্বু-উ ওয়ালাকুম ফিল আরদ্বি মুস্তাতাক্বাররুন ওয়া মাতা-‘উন ইলা-হীন।” অর্থাৎ আমি তাদের বললাম, তোমরা একজন আরেকজনের দুশমন হিসেবে এখান থেকে নেমে পড়ো, তোমাদের (পরবর্তী) বাসস্থান (হচ্ছে) পৃথিবী, সেখানে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদের জন্যে জীবনের (যাবতীয়) উপকরণ থাকবে।”

সহীহ মুসলিম শরীফ এর ৮৫৪ নং হাদীসে উল্লেখ আছে, আদম (আ:)-কে জুমাবার সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁকে জুমাবারেই জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছিলেন। সূরা আ’রাফ এর ২৭ নং আয়াতটিও এর পক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণ। আল্লাহতালা বলেন, “ইয়া বানী আদামা লা ইউফতিনান্নাকুমুশ শায়ত্ব-না কামা আখরাজা আবাওয়াইকুম মিনাল জান্নাতি।” অর্থাৎ হে আদম সন্তান! শয়তান তোমাদেরকে যেন ফেতনায় ফেলে না দেয় যেমনিভাবে তোমাদের আদি মাতা-পিতাকে সে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছিল।

উল্লেখ্য, আদি মাতা-পিতা আদম হাওয়াকে ফাঁদে ফেলতে শয়তানের জন্য জান্নাতে প্রবেশ করার প্রয়োজন ছিলনা। কেননা আল্লাহতালা শয়তানকে অনেক দূর থেকে মানুষকে প্ররোচিত করার সক্ষমতা দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনের সূরা আ’রাফ এর ২০ নং আয়াত “ফা ওয়াসওয়াসা লাহুমা” অর্থাৎ সে তাদের দুইজনকে প্ররোচিত করেছিল, পরিষ্কার উল্লেখ আছে। অতএব শয়তান তাদের দুইজনকে জান্নাতের বাহির থেকেই প্ররোচিত করেছিল, ভেতরে প্রবেশ করতে হয়নি; বুঝা গেল।

এই দীর্ঘ আলোচনার পরের অংশ দ্বারা বুঝা গেল, জান্নাত (আকাশ) থেকে যাঁকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়া হল তিনি একই সাথে পৃথিবীর প্রথম মানুষও। অন্যথা তাঁর সাথে আদি-মাতা হযরত হাওয়া (حواء) এর কী সম্পর্ক?

কিংবা আল্লাহতালা আদম-হাওয়া এবং শয়তান তিনোজনকে “ইহবিতূ” (ا) বহুবচনে কিজন্য বললেন, ‘তোমরা নেমে যাও’ যদি এই আদমের আগেও মানব মণ্ডলীর অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকত?

আরো প্রশ্ন আসে, এই আদমের আগেই যদি মানব গোষ্ঠী পৃথিবীতে বিদ্যমান থাকত তাহলে আল্লাহতালা কিজন্য “ওয়া লাকুম ফিল আরদ্বি মুস্তাকাররুন” অর্থাৎ এখান থেকে নেমে পড়ো, তোমাদের (পরবর্তী) বাসস্থান (হচ্ছে) পৃথিবী, সেখানে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদের জন্যে জীবনের (যাবতীয়) উপকরণ থাকবে”-এভাবে বললেন? এতে কি প্রমাণিত হয়না যে, এই আদমই প্রথম মানুষ যিনি পৃথিবীতে আদি-মাতা হাওয়া সহ জান্নাত থেকে নেমে আসার পরবর্তী সময়ে নবুওয়তের অধিকারী হয়েছিলেন!? অন্যথা পবিত্র কুরআন থেকেই আপনাদের তথাকথিত প্রথম মানুষটির অস্তিত্ব প্রমাণ করতে হবে যিনি উক্ত আয়াতে উল্লিখিত আদম (আ:) ছাড়া দ্বিতীয় আর কেউ!

এবার তাদের বালখিল্য টাইপের উক্ত প্রশ্নের উত্তর :

  • তাদের প্রশ্ন ছিল, হযরত আদম (আ:)ই যদি প্রথম মানুষ হন তাহলে তখন তো আর কোনো মানুষই জগতে ছিলো না। এমতাবস্থায় তিনি কাদের জন্য নবী হয়ে আসলেন কিংবা কোন সম্প্রদায়ের জন্য প্রেরিত হলেন?

জবাব হল, আচ্ছা প্রশ্নকারী কি আমাকে একথা প্রমাণ করে দিতে পারবেন যে, হযরত আদম (আ:)-কে যখন জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়া হচ্ছিল তিনি তখনই নবুওয়তের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন? নাকি আদম (আ:) পৃথিবীতে নেমে আসার পরবর্তীতে যথাসময়ে নবুওয়ত লাভ করেছিলেন? প্রশ্নকারীদের প্রতি কেয়ামত পর্যন্ত আমার চ্যালেঞ্জ থাকল, তারা কখনো প্রমাণ করতে পারবেনা যে, হযরত আদম (আ:) যখন পৃথিবীতে নেমে আসেন তাঁকে আল্লাহতালা তখনই নবুওয়ত দান করেছিলেন! বরং আমাদের বিশ্বাস হল, আল্লাহতালা আদম (আ:)-কে পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়ার পরবর্তীতে যথাসময়ে নবুওয়ত দান করেছিলেন। অতএব কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উল্লিখিত প্রশ্ন পুরোই অসার সাব্যস্ত হল।

শেষকথা হল, কাদিয়ানীরা মূলত এইধরনের আরো বহু ইসলামপরিপন্থী মতাদর্শ পোষণ করার কারণে তারা ইসলাম থেকে খারিজ এবং কাফের জাতির অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এদের সমুদয় ঈমান বিধ্বংসী কুফুরী আকীদা থেকে রক্ষা করুন। আমীন।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here