কাদিয়ানীদের বইতে ঈসা (আ:)-কে মৃত প্রমাণের উদ্দেশ্যে উত্থাপিত একটি প্রশ্ন ও তার খন্ডনমূলক জবাব
কাদিয়ানী মুরুব্বী শাহ মুস্তাফিজুর রহমান রচিত ‘ঈসা আঃ এর মৃত্যুতে ইসলামের বিজয়’ বইয়ের খন্ডনে আমার রচিত ‘ঈসা আঃ এর মৃত্যু শেষ যুগে হবে’ বই থেকে নিচের উত্তরটি নেয়া।
প্রশ্ন :
খ্রিষ্টানদের পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়া সম্পর্কে কেয়ামতের দিনে এ ব্যাপারে আল্লাহ তাঁকে (ঈসা) অবহিত না করা পর্যন্ত ঈসা (আ:) তাঁর অনুসারীদের পথভ্রষ্টতা সম্পর্কে কিছুই জানবেন না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঈসা (আ:) যদি পুনরায় পৃথিবীতে আসেন, তাহলে কি তিনি দেখতে পাবেন না যে, খ্রিষ্টানরা তাঁকে খোদার পুত্র বানিয়ে তাঁর পূজা করছে? শিরক করছে? অবশ্যই দেখতে পাবেন এবং পৃথিবীতে পুনরায় এসে খ্রিষ্টানদের এই অধঃপতিত অবস্থা দেখে তাঁর পক্ষে খোদার কাছে একথা বলা কি সম্ভব হবে যে, তিনি এসব ব্যাপারে কিছুই জানতেন না? সম্ভব হবে না। কাজেই এক্ষেত্রে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত এটাই হবে যে, ঈসা (আ:)-এর ওফাতের পরেই খ্রিষ্টানরা শিরকে লিপ্ত হয়েছে, ধর্মচ্যুত হয়েছে।
খন্ডনমূলক জবাব :
সত্য বলতে, কাদিয়ানী মুস্তাফিজুর তিনি তার বইটিতে মির্যা কাদিয়ানীর ‘আল ওসীয়্যত’ (বাংলা অনূদিত) বইটির “তখন আবার আমি কিভাবে জানতাম যে, আমার পরে তারা কোন্ বিপথগামিতায় নিপতিত হয়েছিল” (পৃষ্ঠা নং ১৫) বিকৃত অনুবাদেরই চর্বিতচর্বন করে উপরের যুক্তিটার গোড়াপত্তন করেছেন। মির্যার বইগুলো এ সমস্ত আরো বহু আকর্ষণীয় মিথ্যা আর যুক্তিতে ভরপুর, যা লোকাল কোনো মৌলভীর পক্ষে ধরতে পারা সম্ভব নয়। এখানে পবিত্র কুরআনের নামে মির্যা কাদিয়ানীর মোটাদাগে দুইটি মিথ্যা তুলে ধরব।
[মিথ্যা : ১] আল্লাহ তায়ালা ঈসাকে খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদ সম্পর্কে কেয়ামতের দিন অবহিত করবেন—এটি মির্যা কাদিয়ানীর সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা।
[মিথ্যা : ২] ঈসা (আ:) এসব ব্যাপারে কিছুই জানতেন না—এটিও ঈসা (আ:) এর নামে মির্যা কাদিয়ানীর জঘন্য মিথ্যা কথা।
একটু পরেই আমি তাদের সেসব জঘন্য মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন করব, ইনশাআল্লাহ। তার আগে পবিত্র কুরআনের সেই আয়াতদুটির অনুবাদ ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে অনূদিত কুরআনুল কারীম থেকে নিচে উল্লেখ করছি। আল্লাহতালা বলেন:
“[১১৬] আল্লাহ যখন (কেয়ামতের দিন) বলিবেন, হে মারইয়াম তনয় ঈসা! তুমি কি লোকদেরকে বলিয়াছিলে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত আমাকে ও আমার জননীকে দুই ইলাহ রূপে গ্রহণ কর? সে বলিবে, তুমিই মহিমান্বিত! যাহা বলার অধিকার আমার নাই তাহা বলা আমার পক্ষে শোভন নয়। যদি আমি তাহা বলিতাম তবে তুমি তো তাহা জানিতে। আমার অন্তরের কথা তো তুমি অবগত আছ, কিন্তু তোমার অন্তরের কথা আমি অবগত নই; তুমি অদৃশ্য সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত।
[১১৭] তুমি আমাকে যে আদেশ করিয়াছ তাহা ব্যতীত তাহাদের আমি কিছুই বলি নাই, তাহা এই : ‘তোমরা আমার প্রতিপালক ও তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর ইবাদত কর এবং যতদিন আমি তাহাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন আমি ছিলাম তাহাদের কার্যকলাপের সাক্ষী; কিন্তু যখন তুমি আমাকে তুলিয়া লইলে তখন তুমিই তো ছিলে তাহাদের কার্যকলাপের তত্ত্বাধায়ক এবং তুমিই সর্ববিষয়ে সাক্ষী’।”
বিজ্ঞপাঠক! এবার নিজেরাই ভেবে দেখুন, তারা উপরে যেই দুইখানা যুক্তি প্রদর্শন করলো আয়াতের সাথে তার সম্পর্ক কোথায়? উফ! কত নিকৃষ্ট মিথ্যাচার! কে জানে কত সহজ-সরল মুসলমান তাদের এই গোবেলসীয় মিথ্যার বলি হয়ে পথভ্রষ্ট হয়েছে!!
এবার তাদের সেই দুইখানা মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন করতে তাদের উদ্দেশ্যে মাত্র তিন (৩)টি পাল্টা প্রশ্ন :
- [১] আল্লাহতায়ালা ঈসা (আ:)-কে যখন জিজ্ঞেস করবেন “তুমি কি লোকদেরকে বলিয়াছিলে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত আমাকে ও আমার জননীকে দুই ইলাহ রূপে গ্রহণ কর”—সে সময় ঈসা (আ:) প্রতিউত্তরে কেন বলবেন যে, তুমি আমাকে যে আদেশ করিয়াছ তাহা ব্যতীত তাহাদের কিছুই বলি নাই! এতে কি প্রমাণিত হয় না যে, ঈসা (আ:) তখনও খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদ সম্পর্কে জানবেন!
- [২] ঈসা (আ:) পৃথিবীতে পুনরায় এসে খ্রিষ্টানদের ত্রিত্ববাদী মতবাদ অবস্থা দেখে না গেলে তিনি (লাম্মা আমাত্তানী) لما أمتني (অর্থাৎ যখন আপনি আমাকে মৃত্যুদান করলেন) এই শব্দ বাদ দিয়ে বরং (লাম্মা তাওয়াফ্ফাইতানী) لما توفيتني শব্দে কেন বলতে যাবেন? আল্লাহতায়ালা কি ভবিষ্যতের ব্যাপারে জানবেন না যে, ঈসা (আ:) ‘তাওয়াফফা’ এর ন্যায় এমন একটি দ্বৈত শব্দে বললে পরবর্তীতে মানুষের মাঝে এর প্রকৃত তাৎপর্য নিয়ে প্রচন্ড ঝগড়া বাধবে! এখন এর কী জবাব?
- [৩] হাদীসে আছে, হাশরবাসীরা ঈসা (আ:) এর নিকটেও (শাফায়াতে কোবরা মুহূর্তে) শাফায়াতের আবেদন করলে তিনি তখন এই বলে অক্ষমতা প্রকাশ করবেন যে ‘ইন্নী উত্তুখিযতু ইলা-হান মিন দূনিল্লাহি ওয়া আন্নাহু লা ইউহিম্মুনিল ইয়াওমা ইল্লা নাফ্সী (আরবী : إنى اتخذت إلها من دون الله و أنه لا يهمنى اليوم إلا نفسى)।’ অর্থাৎ আমি আল্লাহ ব্যতীত একজন উপাস্যরূপে গৃহিত ছিলাম। তাই আজ (হাশর দিবসে) আমি শুধুমাত্র নিজেকে নিয়েই চিন্তিত। (রেফারেন্স, মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, কিতাবুল বি’ছি : ১/৩৭৩; হাদীস নং ১৮৫০৪, মসনদে আবী ইয়া’লা আল-মওছলী, হাদীস নং ২২৭৪; আবুদাউদ আত্-ত্বয়ালিসী ২/২২৬ ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত, হাদীসের মান : হাসান, রাবীদের সবাই সহীহাইন এর রাবী।)
তাই প্রশ্ন আসে, ঈসা (আ:) পৃথিবীতে পুনরায় ফিরে আসা ব্যতীত হাশরের দিবসে তিনি (আ:) কিভাবে জানতে পারবেন যে, খ্রিস্টানরা তাঁকে ইলাহ তথা উপাস্য রূপে গ্রহণ করেছিলো!? ভাবিয়ে তুলে কিনা?
এতেই প্রমাণিত হয় যে, তিনি দ্বিতীয়বার দুনিয়াতে আগমন করবেন বলেই খ্রিষ্টানদের ত্রিত্ববাদ সম্পর্কে জানতে পারবেন। সুতরাং প্রমাণিত হল, এই সমস্ত আয়াত কোনোভাবেই ঈসা (আ:)-কে দুনিয়ায় তাঁর পুন: আগমনের আগে মৃত প্রমাণ করেনা।
আল্লাহতালা সরলমনা ও ইসলামি আকীদায় অপরিপক্ক এবং বিভ্রান্ত সকল কাদিয়ানীবন্ধুকে ইসলামের মূলধারায় ফিরে আসার তাওফিক দিন!
- কাদিয়ানীদের বইতে পবিত্র কুরআনের ত্রিশ আয়াতের ভুল ব্যাখ্যার খন্ডনমূলক জবাব পড়ুন Click
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক