ঈসা (আ:) উম্মতে মুহাম্মদীয়ার অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়ে প্রার্থনা করেছিলেন কি?

0
ঈসা (আ:) উম্মতে মুহাম্মদীয়ার অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়ে প্রার্থনা করেছিলেন কি?

প্রশ্নকর্তা : একটি বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, এই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়ে প্রার্থনা করেছিলেন হযরত মূসা (আ:) কিন্তু আমাদের সমাজে হযরত ঈসা (আ:) সম্পর্কেও প্রচলিত আছে যে, তিনিও নাকি একই ধরণের প্রার্থনা করেছিলেন এবং আল্লাহ তায়ালা সেই প্রার্থনা কবুলও করেছেন!? এ সম্পর্কে দলিল সহ জানতে চাই!

উত্তরদাতা :

(ক)

প্রশ্নকারী যদি কোনো আহমদী তথা কাদিয়ানী হন তাহলে তাকে সবিনয়ে জানিয়ে দিতে চাই যে, ঈসা (আ:) নবী হিসেবে নয় বরং “উম্মত” হিসেবে আসবেন একথা স্বয়ং মির্যা কাদিয়ানীও লিখে গেছেন। যেমন তিনি লিখেছেন : ‘আনে ওয়ালে মসীহ কেলিয়ে হামারে সাইয়েদ ওয়া মওলা নে নবুওয়ত শর্ত নিহি ঠেহরায়ি (উর্দূ : آنیوالے مسیح کے لیے ہمارے سید و مولا نے نبوت شرط نہیں ٹہرائ )।’ অর্থাৎ আগমনকারী মসীহ’র জন্য আমাদের নবী করীম (সা:) নবুওয়ত শর্ত করেননি। (মির্যা কাদিয়ানীর ৮৩টি বইয়ের সমষ্টি ২৩ খন্ডে প্রকাশিত ‘রূহানী খাযায়েন’ খন্ড নং ৩ এর ৫৯ নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)। এখানে সুস্পষ্টভাবে স্বীকার করা হয়েছে যে, আগত ঈসা (আ:) নবুওয়তের দায়িত্বে থাকবেন না। তার মানে দাঁড়াল, শেষ যুগে আগমনকারী ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:) শুধুমাত্র একজন “উম্মত” হিসেবে আসবেন! রাসূল (সা:)-এর একাধিক হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত আছে যে, আগত ঈসা (আ:) “উম্মত” হিসেবে আসবেন। দলিল, আল-মু’জামুল আওসাত, হাদীস নং ৪৫৮০; হাদীসের মান : হাসান লি-গয়রিহি। আমি মনে করি, একজন কাদিয়ানী মতাবলম্বীর জন্য বিষয়টি বুঝার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।

এখন প্রশ্ন আসবে যে, এমতাবস্থায় মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে ঈসা (আ:)-কে “নাবিউল্লাহ” তথা আল্লাহর নবী বলা হয়েছে কেন? এর উত্তর হল, আগত ঈসা কোনো রূপক ঈসা নন, বরং বনী ইসরায়েলের জন্য ইতিপূর্বে যিনি প্রেরিত হয়েছিলেন শেষ যুগে তিনি-ই পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসবে, এ কথাটি সুস্পষ্ট করে দিতেই হাদীসে “নাবিউল্লাহ” বলে ইংগিত দেয়া হয়েছে। যাতে রূপক ঈসা দাবীদারদের উদ্দেশ্যমূলক ও বিকৃত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দ্বারা সাধারণ মানুষ প্রতারিত হয়ে প্রকৃত ঈসাকে বাদ দিয়ে কথিত রূপক ঈসার জালে বন্দী হয়ে না যায়!

(খ)

হযরত মূসা (আ:) সম্পর্কিত যে বর্ণনাটিতে ‘উম্মতে মুহাম্মদীয়া’য় শামিল হতে চেয়ে তাঁর প্রার্থনা করার কথা রয়েছে এবং আবু না’ঈমের সীরাতগ্রন্থ ‘হুলিয়া’-তে যেটি উল্লেখও হয়েছে সেটির সনদ (ধারাবাহিক বর্ণনাসূত্র) সর্বসম্মত হাদীস বিশারদগণের অনুসন্ধান মতে খুবই দুর্বল। রিজালশাস্ত্রের অন্যতম স্কলার ইমাম ইয়াহ্ইয়া বিন মঈন, ইবনে আদী, ইমাম বুখারী, আবু যুর’আ প্রমুখ মুহাদ্দিসগণও বর্ণনাটির রাবীগণের কঠোর সমালোচনা করেছেন [ইমাম যাহাবী (রহ:) রচিত ‘মীযানুল ইতিদাল’ ৩/৬৭ দ্রষ্টব্য]। শায়খ আলবানী (রহ:) লিখেছেন, এর সূত্র খুবই দুর্বল ও বানোয়াট (ইমাম ইবনে আবী আ’ছেম রচিত কিতাবুস সুন্নাহ’র তাহ্কিক শায়খ আলবানীর ‘যিলালুল জুন্নাহ ফী তাখরীজিস্ সুন্নাহ ১/৩০৬ দ্রষ্টব্য)। ফলে বর্ণনার ঐ কথাগুলো প্রকৃতপক্ষে রাসূল (সা:)-এরই কথা কিনা তা নিশ্চিত নয়, বরং সন্দেহজনক।

পক্ষান্তরে প্রাচীনতম বরেণ্য তাফসীরগ্রন্থ “তাফসীরে সামরকন্দী”-তে হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:)-এর ক্ষেত্রে ‘উম্মতে মুহাম্মদীয়া’য় শামিল হতে চেয়ে প্রার্থনা করার কথা রয়েছে সেটির সূত্র (Chain of narration) সম্পর্কে কোনো স্কলার থেকে নেতিবাচক মন্তব্য পাওয়া যায়না। বরং সিয়াহ সিত্তাহ’র অনেকগুলো হাদীসের আলোকে বর্ণনাটির কথাগুলো গ্রহণযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে মজবুত সমর্থন পাওয়া যায়। ফলে এর সনদ অপরাপর বর্ণনাগুলোর সমর্থনপুষ্ট হওয়ায় ‘হাসান লি-গয়রিহি’ (উসূলে হাদীসের পরিভাষায় যে হাদীসের সূত্র বিশুদ্ধ হওয়ার পার্সেন্টেজ ৯৯% তাকে হাসান হাদীস বলে – লিখক) স্তরে উন্নীত।

  • ১. পবিত্র কুরআনের ইংগিত দ্বারাও ঈসা আঃ এখনো জীবিত থাকার প্রমাণ Click
  • ২. ঈসা আ: -কে আকাশে জীবিত উঠিয়ে নেয়া ও সেখান থেকে অচিরেই নাযিল হওয়া মর্মে কয়েকটি হাদীস Click
  • প্রথমেই হযরত ঈসা (আ:) সম্পর্কিত বর্ণনাটির সম্পূর্ণ অনুবাদ পেশ করছি। যারা আরবি বুঝেন তাদের জন্য তাফসীরে সামরকন্দীর উক্ত পৃষ্ঠার স্ক্রিনশট দিয়ে রাখলাম :

আরবীটা দেখুন,

قوله تعالى: (اذ قال الله يا عيسى انى متوفيك و رافعك إلى) ففى الآية تقديم و تاخير و معناه انى رافعك من الدنيا إلى السماء، و متوفيك بعد أن تنزل من السماء على عهد الدجال . و يقال انه ينزل و يتزوج امرأة من العرب بعد ما يقتل الدجال، و تلد له ابنة فتموت ابنته، ثم يموت هو بعدما يعيش سنين، لأنه قد سأل ربه أن يجعله من هذه الأمة فاستجاب الله دعاه- (تفسير السمرقندي المسمى بحر العلوم لأبي الليث نصر بن محمد بن إبراهيم/السمرقندي، المتوفى سنة ٣٧٥. جلد ١ رقم الصفحة ٢٧٢ سورة آل عمران الآيات ٥٥-٥٨).

বাংলায় অনুবাদ দেখুন,

অর্থ, ‘আল্লাহতালার বাণী : যখন আল্লাহতালা বললেন, হে ঈসা নিশ্চয় আমি তোমাকে নিয়ে নিচ্ছি এবং তোমাকে নিজের কাছে তুলিয়া লইতেছি।’ (কুরআন ০৩:৫৫; অনুবাদ, মির্যায়ী প্রথম খলিফা হেকিম নূরুদ্দিন কৃত তাসদীকে বারাহীনে আহমদিয়া ১/৮) আয়াতটিতে অগ্রপশ্চাৎ হয়ে আছে। তার অর্থ নিশ্চয়ই আমি তোমাকে পৃথিবী থেকে আকাশে তুলিয়া লইতেছি এবং দাজ্জালের সমসাময়িক কালে আকাশ থেকে নাযিল করার পর তোমাকে নিয়ে নিচ্ছি। বলা হয়েছে যে, নিশ্চয়ই তিনি নাযিল হবেন, দাজ্জালকে হত্যা করার পর আরবের কোনো এক মহিলাকে বিবাহ করবেন, উনার এক কন্যা সন্তানের জন্ম হবে অতপর তিনি বছর কতেক শেষে মৃত্যুবরণ করবেন। কেননা তিনি (ঈসা) স্বীয় প্রভুর নিকট এই উম্মতের (উম্মতে মুহাম্মদীয়া) অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়ে প্রার্থনা করেন। ফলে আল্লাহ দোয়া কবুল করেন।’

বাংলা অনুবাদ সমাপ্ত হল।

(রেফারেন্স, তাফসীরে সামরকন্দী, যার অপর নাম বাহরুল উলূম। রচিতা ইমামুল হুদা আবুল লাইস নাসির বিন মুহাম্মদ বিন আহমদ বিন ইবরাহীম আস-সামরকন্দী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, মৃত ৩৭৫ হিজরী, খন্ড নং ১ পৃষ্ঠা নং ২৭২; সূরা আলে ইমরান আয়াত ৫৫-৫৮)।

স্ক্রিনশট : তাফসীরে সামরকন্দী ১/২৭২, সূরা আলে ইমরান

দৃষ্টি আকর্ষণ, পাঠকবৃন্দ! আপনারা খুবই লক্ষ্য করেছেন যে, পরিষ্কার শব্দে উল্লেখ রয়েছে যে, لأنه قد سأل ربه أن يجعله من هذه الأمة فاستجاب الله دعاه অর্থাৎ তিনি (ঈসা) স্বীয় প্রভুর নিকট এই উম্মতের (উম্মতে মুহাম্মদীয়া) অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়ে প্রার্থনা করেন। ফলে আল্লাহ দোয়া কবুল করেন।’ আশাকরি, দলিল পেয়েছেন।

এবার তাফসীরে সামরকন্দী (রহ:) এর লিখক সম্পর্কে অতিব সংক্ষেপে জেনে নেব, বিস্তারিত আন্তর্জাতিক বিশ্বকোষ ‘উইকিপিডিয়া‘ থেকেও দেখে নিতে পারেন!

তাফসীরে সামরকন্দী (রহ:) এর লিখকের নাম ইমাম নাসির বিন মুহাম্মদ বিন আহমদ বিন ইবরাহীম। রাশিয়ার সামরকন্দ শহরে জন্ম। তিনি আবুল লাইস আস-সামরকন্দী নামে পরিচিত। আজ থেকে ১০৩৪ বছর আগে ৩৭৩/৩৭৫ হিজরীতে আয়েম্মায়ে মুজতাহিদীনের যুগে ইন্তেকাল করেন। তিনি ইসলামি বিশ্বে তদানীন্তন সময়কার ‘ইমামুল হুদা’ তথা হিদায়াতের ইমাম’ উপাধিতে ভূষিত হন।

এবার উল্লিখিত বর্ণনার সমর্থনে নিচে কয়েকটি হাদীস পেশ করছি। যাতে জ্ঞানীদের নিকট বর্ণনাটির কথাগুলো আরো দৃঢ়তার সাথে প্রমাণিত হয়ে যায়।

  • ১. একটি হাদীসে এসেছে, ‘ছুম্মা ইয়ানযিলু ঈসা ইবনু মারইয়ামা মুছাদ্দিকান বি-মুহাম্মাদিন ও আ’লা মিল্লাতিহী’ (আরবী : ثم ينزل عيسى بن مريم مصدقا بمحمد و على ملته)। অর্থাৎ তারপর ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:) নাযিল হবেন মুহাম্মদ (সা:)-কে সত্যায়নকারী হিসেবে ও তাঁরই উম্মত হয়ে। (আল-মু’জামুল আওসাত হাদীস নং ৪৫৮০; হাদীসের মান : হাসান)।
  • ২. মেরাজের একটি হাদীসে উল্লেখ আছে “ফা রুদ্দাল হাদীসু ইলা ঈসা ইবনে মরিয়ম ফা-ক্বলা ক্বদ ও’হিদা ইলাইয়্যা ফী-মা দূনা ওয়াজবাতিহা ফা-আম্মা ওয়াজবাতুহা ফা-লা ই’য়ালামুহা ইল্লাল্লাহু” (আরবী : فرد الحديث إلى عيسى ابن مريم قال‏:‏ قد عهد إلي فيما دون وجبتها فأما وجبتها فلا يعلمها إلا الله عز وجل)। অর্থাৎ অতপর কেয়ামতের বিষয়টি ঈসা (আ:)-এর নিকট পেশ করা হলে তিনি বলেন, আমার থেকে কেয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে দুনিয়াতে ফেরার প্রতিশ্রুতি নেয়া হয়েছে। কিন্তু কেয়ামতের সঠিক জ্ঞান আল্লাহ ব্যতীত কারো কাছে নেই। (সুনানু ইবনে মাজাহ : হাদীস নং ৪০৮১)।
  • ৩. মির্যা কাদিয়ানী কর্তৃক স্বীকৃত ৯ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী (রহ:) লিখেছেন, ‘আ’ন ইবনে আব্বাস মাদ্দা ফী উমরিহি হাত্তা আহবাত্বা মিনাস সামায়ি ইলাল আরদি ওয়া ইয়াক্বতুলুদ দাজ্জাল’ (আরবী : ﻋﻦ ﺍﺑﻦ ﻋﺒﺎﺱ ﻣﺪ ﻓﻲ ﻋﻤﺮﻩ ﺣﺘﻰ ﺍﻫﺒﻂ ﻣﻦ ﺍﻟﺴﻤﺎﺀ ﺍﻟﻲ ﺍﻷﺭﺽ ﻭ ﻳﻘﺘﻞ ﺍﻟﺪﺟﺎﻝ)। অর্থাৎ হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত আছে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর (ঈসা) আয়ুষ্কাল বিলম্বিত করে দিয়েছেন। তিনি আকাশ থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করবেন। (দুররে মানছূর ২/৩৫০)।

মনে রাখতে হবে যে, ঈসা (আ:) ছাড়া অন্য আর কোনো নবী দুনিয়াতে ফেরার কথা বলেননি। সুতরাং এতেও প্রমাণিত হয় যে, আকাশে ঈসা (আ:) অন্য নবীদের মত শুধুই আত্মিকভাবে নন, বরং সশরীরেই জীবিত আছেন। সে সাথে এটিও প্রমাণিত হয়ে যায় যে, হযরত ঈসা (আ:) কর্তৃক স্বীয় প্রভুর নিকট এই উম্মতের (উম্মতে মুহাম্মদীয়া) অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়ে প্রার্থনা করা এবং সেটি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কর্তৃক কবুল হওয়ার বিষয়টি একদম সত্য ও প্রমাণিত।

লিখার পরিধি সংক্ষেপ রাখতে আজ এটুকুর মধ্যেই ইতি টানছি। আমার কাজ হল, সত্যটা সাহস করে তুলে ধরা। এবার সেটি কে গ্রহণ করল আর কে করল না সেটি আমার দেখার বিষয় নয়। সবাইকে ধন্যবাদ। ওয়াসসালাম।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী।
শিক্ষাবিদ ও গবেষক।
তাং ২৬/১২/২০২০ ইং

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here