উলামা-উহুম শাররুম মান তাহতা আদীমিস সামায়ি সম্পর্কে

0
উলামা-উহুম শাররুম মান তাহতা আদীমিস সামায়ি সম্পর্কে

উলামা-উহুম শাররুম মান তাহতা আদীমিস সামায়ি…হাদীসটির উপর নাতিদীর্ঘ কিছু বিশ্লেষণ ও কিছু প্রশ্ন!

হাদীসের আরবী ইবারত : يُوشِكُ أَنْ يَأْتِيَ عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ لَا يَبْقَى مِنَ الْإِسْلَامِ إِلَّا اسْمُهُ، وَلَا يَبْقَى مِنَ الْقُرْآنِ إِلَّا رَسْمُهُ، مَسَاجِدُهُمْ عَامِرَةٌ وَهِيَ خَرَابٌ مِنَ الْهُدَى، عُلَمَاؤُهُمْ شَرُّ مَنْ تَحْتَ أَدِيمِ السَّمَاءِ منْ عِنْدَهُمْ تَخْرُجُ الْفِتْنَةُ وَفِيهِمْ تَعُودُ. হাদীসটির তাহকিক, শায়খ আলবানী (রহ.) লিখেছেন, এর সনদ খুবই যঈফ বা দুর্বল। (আস-সিলসিলাতুয য’ঈফাহ, নং ১৯৩৬; আলবানী রহ.)। Click

আমার কলিজার আহমদীবন্ধুরা! ‘শেষ যুগের নিকৃষ্ট আলেম’ সম্পর্কিত বর্ণনাটির সনদ (ধারাবাহিক বর্ণনা-সূত্র/Chain of narration) যে খুবই দূর্বল; ফলে এর কথাগুলো রাসূল (সা:) থেকে হওয়াটা পুরোপুরি নিশ্চিত নয়—এ কথাগুলো কাদিয়ানী-নেতারা আপনাদেরকে কখনোই বলবেনা। কেন জানেন? যদি ওরা এটি বলতেন তাহলে আপনাদেরকে হক্কানী উলামায়ে কেরামের সংশ্রব থেকে কোনোভাবেই দূরে রেখে ধোকা দিতে পারতো না।

অধিকন্তু উলামায়ে কেরাম এর মর্যাদা সম্পর্কে আরো যেসব সহীহ সূত্রে বর্ণনা অগণিত হাদীসগ্রন্থে রয়েছে তারা জীবন চলে গেলেও আপনাদেরকে সেগুলো বলবেনা! এ দেখুন, হাক্কানী উলামায়ে কেরাম সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসুল (সাঃ) কত সুন্দর কথা বলে গেছেন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন : انما يخسى الله من عباده العلماء অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালাকে তার বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই বেশী ভয় করে। (সুরা ফাতির আয়াত ২৮)।

প্রাসঙ্গিক সামান্য কয়েকটা হাদীস :

(ক) হাদীসে এসেছে রাসূল (সা:) বলেছেন,… وَاِنَّ الْمَلَائِكَةَ لَتَضَعُ اَجْنِحَتَهَا رِضًا لِّطَالِبِ الْعِلْمِ وَاِنَّ الْعَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَه مَنْ فِى السَّموتِ وَمَنْ فِى الاَرْضِ وَالْحِيْتَانُ فِى جَوْفِ الْمَاءِ وَاِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ عَلى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ وَاِنَّ الْعُلمَاءَ وَرَثَةُ الاَنْبِيَاءِ وَاِنَّ الاَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوْا دِيْنَارًا وَلَا دِرْهَمًا وَاِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ فَمَنْ اَخَذَه اَخَذَ بِحَظٍّ وَّافِرٍ. رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِيُّ وَأَبُوْ دَاوٗدَ وابن مَاجَةَ وَالدَّارِمِيُّ

অর্থাৎ কাসীর বিন ক্বায়স (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি দিমাশক-এর মাসজিদে আবুদ দারদা (রা:)-এর সাথে বসা ছিলাম, এমন সময় তার নিকট একজন লোক এসে বললো, হে আবুদ দারদা! আমি রাসূল (সা:)-এর শহর মদীনাহ থেকে শুধু একটি হাদীস জানার জন্য আপনার কাছে এসেছি। আমি শুনেছি আপনি নাকি রাসূল (সা:) থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এছাড়া আর কোনো উদ্দেশে আমি আপনার কাছে আসিনি।

তার এ কথা শুনে আবুদ দারদা (রা:) বললেন, রাসূল (সা:)-কে আমি এ কথা বলতে শুনেছি, তিনি (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি (কুরআন ও হাদীসের) ইলম সন্ধানের উদ্দেশ্যে কোনো পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জান্নাতের পথসমূহের একটি পথে পৌঁছিয়ে দিবেন এবং ফেরেশতারা ইলম অনুসন্ধানকারীর সন্তুষ্টি এবং পথে তার আরামের জন্য তাদের পালক বা ডানা বিছিয়ে দেন। অতঃপর আলিমদের জন্য আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সকলেই আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ও দু‘আ করে থাকেন, এমনকি পানির মাছসমূহও (ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে)। আলিমদের মর্যাদা মূর্খ-ইবাদাতকারীর চেয়ে অনেক বেশী। যেমন পূর্ণিমা চাঁদের মর্যাদা তারকারাজির উপর এবং আলিমগণ হচ্ছেন নবীদের ওয়ারিস। নবীগণ কোনো দীনার বা দিরহাম (ধন-সম্পদ) মীরাস (উত্তরাধিকারী) হিসেবে রেখে যান না। তাঁরা মীরাস হিসেবে রেখে যান শুধু ইলম। তাই যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করেছে সে পূর্ণ অংশগ্রহণ করেছে। (আহমাদ, তিরমিযী, আবূ দাঊদ, ইবনু মাজাহ্ ও দারিমী)। রেফারেন্স, মেশকাত শরীফ , কিতাবুল ইলম হা/২১২ দ্রষ্টব্য। হাদীসের মান, সহীহ।

(খ) নবী কারীম (সা:) আরো এরশাদ করেছেন : فضل العالم علي العابد كفضلي علي ادناكم অর্থাৎ একজন আলেমের মর্যাদা একজন সাধারণ ইবাদত কারীর উপর, তোমাদের একজন সাধারণ ব্যক্তির উপর আমার মর্যাদার ন্যায়। (তিরমিজি শরিফ ২৬৮৬)।

(গ) নবী কারীম (সা:) আরও এরশাদ করেছেন : ان العلماء ورثة الانبياء وانا لانبياء لم يو رثو دينارا و لا درهما و انما ورثو العلم অর্থাৎ নিশ্চয় আলেমগণ নবীগণের ওয়ারিশ আর নবীগণ কখনো দিনার দিরহামের ওয়ারিস বানান না, তারা দ্বীনি শিক্ষার ওয়ারিস বানান। (মুসনাদে আহমাদ ২১৭১৫, সহীহ বুখারি ১/২৪, সুনানে আবু দাউদ ৩৬৪৯)।

(ঘ) হাদিস শরিফে হযরত আবু দারদা ও ইবনে মাসউদ (রা:) থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা:) বলেছেন : كن عالما او متعلما اومحبا اومتبعا و لا تكن الخامس فتهلك۔ قال قلت للحسن من الخامس قال المبتدع অর্থাৎ তুমি আলেম হও। নয়তো আলেমের ছাত্র হও। নয়তো আলেমকে মহব্বতকারী হও। নয়তো আলেমের অনুসারী হও, পঞ্চম ব্যক্তি হয়োনা। তাহলে তোমার ধংস অনিবার্য। হাদিসে বর্ণিত হযরত হাসান (রহ:)-কে জিজ্ঞাসা করা হল, পঞ্চম ব্যক্তি কে? তিনি বলেন পঞ্চম ব্যাক্তি হচ্ছে বিদআতি। (আল ইবানাহ ইবনে বাত্তাহ হাদিস ২১০ আল মাদখাল বায়হাকি, হাদিস ৩৮১ জামিউ বায়ানিল ইলম ইবনু আব্দ বার হাদিস ১৪২)।

(ঙ) সুনানে দারেমীর ৩৭০ নং হাদিসে আরো এসেছে, রাসূল (সা:) বলেছেন, ওয়াইন্না খাইরাল খিয়ারি খিয়ারুল উলামা। অর্থাৎ এবং নিশ্চয় আলেমরাই সর্বশ্রেষ্ট মর্যাদার অধিকারী।

কিন্তু তারা (কাদিয়ানী পন্ডিতরা) আপনাদেরকে মগজ ধোলাই দিয়ে মনঃস্তাত্ত্বিকভাবে আজ যেমন নির্বোধ বানিয়ে রেখেছেন, যে কোনো ভাবেই সত্য উন্মোচন হয়ে গেলে তাদেরকে চাঁদা দেয়া বন্ধ করে দিতে পারেন এই আশংকায় ইসলামী স্কলার ও বিজ্ঞ আলেমের সংশ্রব থেকেও দূরে রাখতে হরহামেশা আপনাদের মন-মগজে তাদের ব্যাপারে যেই বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে, তা কখনোই সম্ভব হতনা। তারা খুব ভালো করেই জানেন যে, তাদের সমুদয় প্রতারণাপূর্ণ কথাবার্তা, তাবিলাত, রূপকের কাসুন্দি সবই ধরা পড়ে যাবে; যদি আপনারা বিজ্ঞ আলেমদের সাথে এসব নিয়ে কথা বলতে আসেন!

হাদীসটির বর্ণনা-প্রসঙ্গ ও সার্বিক বিচারের আলোকে যা বুঝা যায় :

উল্লিখিত বর্ণনাটির কথাগুলো সার্বিক বিচারে পরিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, এর কথাগুলো হযরত ইমাম মাহদীর আবির্ভাবের পূর্বেকার সময়ের সাথেই সম্পর্কিত, পরবর্তীতে তাঁর মাধ্যমেই এর আমূল-পরিবর্তন সাধিত হতে থাকবে, ইনশাআল্লাহ। যেমন হাদীসে এসেছে, ইমাম মাহদীর যুগে সারা দুনিয়ায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। জুলুম নিপীড়ন এমনভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে যেভাবে ইতিপূর্বে তাতে সারা দুনিয়া ভরপুর হয়ে গিয়েছিল (দেখুন, ইবনে মাজাহ, কিতাবুল ফিতান হাদীস নং ৪০৭৭; হাদীসের মান – সহীহ) ।

  • খুব খেয়াল করুন, হাদীসটিতে শেষ যুগের বর্ণনা দিতে গিয়ে নিকৃষ্ট আলেম সম্পর্কিত কথাটির আগে আরও ৩টি কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।

১. নাম ব্যতীত ইসলামের কিছুই অবশিষ্ট থাকবেনা।

২. তখন পবিত্র কুরআনের শুধুই অক্ষরগুলো অবশিষ্ট থাকবে, যার তাৎপর্য হল কুরআনের কোনো আইন কানূন (শাসন-ব্যবস্থা)ই সমাজে প্রতিষ্ঠিত থাকবে না।

৩. বাহ্যিকভাবে মসজিদগুলো ঝলমল করতে থাকবে কিন্তু হিদায়াত শূন্য পড়ে থাকবে।

উপরের কথাগুলোর পরেই এসেছে ‘তখন (সেই যুগের) তাদের (এক শ্রেনীর) আলেমরা আকাশের নীচে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট লোক হবে।

সুতরাং কাদিয়ানীদের জেনে রাখা জরুরি যে, তারা এ বর্ণনাটি খুব বেশি প্রচার-প্রসার করে প্রকারান্তরে নিজেরাই প্রমাণ করল যে, অন্তত এর দ্বারাও সাব্যস্ত হচ্ছে যে, প্রকৃত ইমাম মাহদীর আগমন এখনো বাকি! যেজন্য মির্যা কাদিয়ানীর ইমাম মাহদী দাবীও সঠিক নয়। কেননা, উক্ত বর্ণনার কথাগুলো নিয়ে চিন্তা করলে যে কেউই বুঝতে পারবে যে, এর সবই এ যুগেও আমরা আমাদের চোখের সামনে প্রতিনিয়ত দৃশ্যমান দেখতে পাচ্ছি। যা আমাদের ডেকে ডেকে বলছে যে, ওহে জ্ঞানীরা! দুনিয়ার বিচক্ষণ ও সত্যানুসন্ধিৎসুরা! একটু ভেবে দেখো! ইমাম মাহদীর আবির্ভাবের সময় ঘনিয়ে আসছে মাত্র। তার আগমনের পূর্ব যুগ-লক্ষণগুলো সবে মাত্র একেক করে পূর্ণতা পেতে চলেছে। তাই আজ থেকে আরো প্রায় ১৩০ বছর আগেই ইমাম মাহদী দাবীকারী ব্রিটিশ সরকারের রোপিত চারাগাছ খ্যাত মির্যা কাদিয়ানী (মৃত. ১৯০৮ইং) একজন মিথ্যাবাদী! নইলে সূর্য আকাশে উদিত হবে অথচ দুনিয়া অন্ধকারে ভাসবে, এটি হয় কিভাবে?? অতএব চিন্তা করে দেখো!

আল্লাহ আমাদেরকে বুঝার এবং চিন্তা করার তাওফিক দিন। আমীন।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী
শিক্ষাবিদ ও গবেষক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here