মেরাজ জাগ্রতাবস্থায় ও সশরীরে হওয়ার প্রমাণ

0
মেরাজ জাগ্রতাবস্থায় ও সশরীরে হওয়ার প্রমাণ

ইসরা এবং মেরাজ কী? কখন ও কিভাবে সংঘটিত হয়েছিল? ভ্রান্তি নিরসন

আজকের এ আলোচনায় “ইসরা এবং মেরাজ” এর অর্থ, সময়কাল এবং ঘটনা উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ। এখানে বলে রাখতে চাই যে, নবী করীম (সা:) এর মেরাজ প্রথমে স্বপ্নযোগে তারপর জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে সংঘটিত হয়েছিল। তাই যেসব হাদীসে মেরাজ স্বপ্নযোগে সংঘটিত হওয়ার উপর আলোকপাত করা হয়েছে তদ্দ্বারা একথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, মেরাজ শুধুই স্বপ্নযোগে সংঘটিত হয়েছিল, জাগ্রতাবস্থায় ও সশরীরে হয়নি! বরং মেরাজ জাগ্রতাবস্থায় ও সশরীরে সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারেও শক্তিশালী ও মজবুত দলিল এবং যুক্তি-প্রমাণ বিদ্যমান।

এ সম্পর্কে হিজরী ষষ্ঠ শতকের বিশিষ্ট হাদীস বিশারদ ও সীরাতগ্রন্থকার শায়খ আব্দুর রহমান সুহাইলী (রহ:) [মৃত. ৫৮১হিজরী] বলেন – وَرَأَيْت الْمُهَلّبَ فِي شَرْحِ الْبُخَارِيّ قَدْ حَكَى هَذَا الْقَوْلَ عَنْ طَائِفَةٍ مِنْ الْعُلَمَاءِ وَأَنّهُمْ قَالُوا: كَانَ الْإِسْرَاءُ مَرّتَيْنِ مَرّةً فِي نُوُمِهِ وَمَرّةً فِي يَقَظَتِهِ بِبَدَنِهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: قَالَ الْمُؤَلّفُ وَهَذَا الْقَوْلُ هُوَ الّذِي يَصِحّ، وَبِهِ تَتّفِقُ مَعَانِي الْأَخْبَارِ الخ (الروض الأنف شرح سيرت ابن هشام)

অর্থাৎ আমি বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ “শরহুল মুহাল্লাব লি সহীহিল বুখারী” এর মধ্যে দেখেছি, সেখানে গ্রন্থকার (অর্থাৎ মুহাল্লাব ইবনে আবী ছুফরাহ আল মারিয়্যি আল উন্দুলুসি [মৃত. ৪৩৫ হিজরী] – অনুবাদক) আহলে ইলমের এক জামাতের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন যে, মূলত মেরাজ দুইবার হয়েছে। একবার স্বপ্নযোগে দ্বিতীয়বার জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে। (আর-রওজুল আনফ ফী শরহিস সীরাতিন নাবাবিয়্যাহ লি-ইবনে হিশাম-১/২৪৪ দ্রষ্টব্য)। আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের মতও এটাই। মেরাজ দুইবার হয়েছে। মেরাজ স্বপ্নযোগেও হয়েছে আবার জাগ্রতাবস্থায় সশরীরেও হয়েছে। প্রথমে হয়েছে স্বপ্নে তারপর হয়েছে জাগ্রতাবস্থায় সশরীরে।

ইসরা ও মেরাজ অর্থ কী?

ইসরা অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ। ইসরা বা রাত্রিকালীন ভ্রমণ বলতে নবী করীম (সা:)-এর মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত সফরকে বুঝানো হয়। মেরাজ শব্দের অর্থ ঊর্ধ্বগমন। আর জমিন হতে ঊর্ধ্বলোকে ভ্রমণকে মেরাজ বলা হয়। আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম বান্দা মুহাম্মদে আরাবী (সা:)-কে বিশেষ দিক-নির্দেশনার জন্যে নবুওয়তের ১০ম বছরের কোনো এক রাতে (প্রসিদ্ধ মতে, ২৭ শে রজব) আকাশে ডেকে নেন। ইসলামের ইতিহাসে এটাকে মেরাজ নামে অভিহিত করা হয়।

এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন : سُبۡحٰنَ الَّذِیۡۤ اَسۡرٰی بِعَبۡدِہٖ لَیۡلًا مِّنَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ اِلَی الۡمَسۡجِدِ الۡاَقۡصَا الَّذِیۡ بٰرَکۡنَا حَوۡلَہٗ لِنُرِیَہٗ مِنۡ اٰیٰتِنَا ؕ اِنَّہٗ ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ অর্থাৎ পবিত্র মহান সে সত্ত্বা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে নিয়ে গিয়েছেন মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বরকত দিয়েছি, যেন আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” (সূরা বনী ইসরাইল : ১)।

উক্ত আয়াত নবী করীম (সা:)-এর ইসরা সংক্রান্ত ঘটনার অকাট্য দলিল। যেটি জাগ্রতাবস্থায় ও সশরীরে হয়েছিল বলেই সুস্পষ্ট প্রমাণিত। তাই যাদের ধারণা যে, মেরাজ শুধুই স্বপ্নযোগে হয়েছিল তাদের নিকট প্রশ্ন, সহীহ বুখারীর যেই হাদীসটিতে মেরাজের ঘটনা বিধৃত হয়েছে সেখানে ঘটনার ধারাবাহিকতায় প্রথমে ‘ইসরা’ এর ঘটনা অতপর عرج بى الى السماء অর্থাৎ আমাকে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয় (সহীহ বুখারী), দ্বারা ঐশী ভ্রমণের দ্বিতীয় পর্ব মেরাজের ঘটনাও উল্লেখ রয়েছে। যার ফলে নবী করীম (সা:) এর ইসরা’র ঘটনার ন্যায় মেরাজের ঘটনাটিও জাগ্রতাবস্থায় ও সশরীরেই সংঘটিত হয়েছিল বলেই প্রমাণ হয় কিনা? অবশ্যই প্রমাণ হয় বলতে হবে।

এখানে আরেকটি কথা না বললেই নয়, সেটি হল ইসরার ঘটনার ন্যায় মেরাজের ঘটনাটিও পবিত্র কুরআনের সূরা আন-নাজমের আয়াত নং ১১-১২ দ্বারা ইংগিতে প্রমাণিত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতালা বলেন, مَا کَذَبَ الۡفُؤَادُ مَا رَاٰی অর্থাৎ যা সে দেখেছে তাঁর হৃদয় তা অস্বীকার করেনি। ‘তাফসীরে আহসানুল বায়ান’ এর মধ্যে লিখা আছে, এর তাৎপর্য হল, নবী করীম (সা:) জিবরাইল (আ:)-কে তাঁর আসল আকৃতিতে দেখেন যে, তাঁর ছয়শত ডানা রয়েছে। তাঁর প্রসারিত ডানা পূর্ব ও পশ্চিমের (আকাশ ও পৃথিবীর) মধ্যবর্তী স্থানকে ঘিরে রেখেছিল। এ দর্শনকে নবী করীম (সা:)-এর অন্তর মিথ্যা মনে করেনি। বরং আল্লাহর এই বিশাল ক্ষমতাকে স্বীকার করে নিয়েছে।

পরের আয়াতে এসেছে, اَفَتُمٰرُوۡنَہٗ عَلٰی مَا یَرٰی অর্থাৎ ‘সে যা দেখেছে তোমরা কি সে বিষয়ে তাঁর সঙ্গে বিতর্ক করবে?’

এখন নবী করীম (সা:)-এর মেরাজ যদি শুধুই স্বপ্নযোগে হত তাহলে কিন্তু স্বপ্নে দেখা জিনসগুলো নিয়ে সমসাময়িককালের ইসলাম বিরোধীদের বিতর্ক করা কিংবা অস্বীকার করার কোনোই কারণ ছিলনা! কেননা স্বপ্নে দেখা জিনিসগুলো যতই অবিশ্বাস্য হয় না কেন কিন্তু সেটিকে দুনিয়ার কোনো বিবেকবান ব্যক্তি চ্যালেঞ্জ করেনা। অথচ মেরাজের বিরুদ্ধে তদানিন্তন সময়ও একশ্রেণীর ইসলাম বিরোধীর চুলকানি ছিল। তারা বরাবরই সেটির বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলেছিল। পবিত্র কুরআনের সূরা আন-নাজমের উক্ত আয়াত সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। আর হাদীসে তো সে সম্পর্কে বহু বর্ণনা রয়েছেই। এই পর্যায় আমি সহীহ বুখারী থেকে সেই হাদীসখানা উল্লেখ করছি যেটি নবী করীম (সা:)-এর মেরাজ জাগ্রতাবস্থায় ও সশরীরেই হওয়ার পক্ষে দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করে থাকে।

এখানে একটি কথা বলে রাখতে চাই, নবী করীম (সা:)-এর মেরাজ জাগ্রতাবস্থায়সশরীরে সংঘটিত হয়েছিল মর্মে কাদিয়ানী জামাতের প্রতিষ্ঠাতা, ভন্ডনবী মির্যা কাদিয়ানী থেকেও স্বীকারোক্তি রয়েছে। যদিও বর্তমানে তার অনুসারীদের অনেকেই এটি স্বীকার করেনা! মির্যার রচিত “হামামাতুল বুশরা” (বাংলা অনূদিত) পৃষ্ঠা নং ৬০ থেকে দেখুন। স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য।

মিরাজের ঘটনা :

মিরাজের ঘটনাটি সহীহ বুখারী ও মুসলিমেও বর্ণিত হয়েছে। সহীহ বুখারীতে এসেছে, হযরত আনাস (রা:) মালেক ইবনে সা’সাআহ (রা:) হতে বর্ণনা করেছেন :-

একদিন সকাল বেলা হযরত মুহাম্মদ (সা:) প্রকাশ করেন, ‘গত রাতে আমার প্রভু আমায় অত্যন্ত সম্মানিত করেন। আমি শুয়ে বিশ্রাম করছিলাম, এমন সময় জিবরাইল এসে আমাকে জাগিয়ে কা’বা মসজিদে নিয়ে যান। সেখানে তিনি আমার বক্ষ বিদীর্ণ করেন এবং তা জমজমের (কা’বার মধ্যকার পবিত্র কূপের) পানি দ্বারা ধুয়ে ফেলেন। অতঃপর তাকে ঈমান ও হিকমত দ্বারা পূর্ণ করে বিদীর্ণ স্থান পূর্বের ন্যায় জুড়ে দেন। এরপর তিনি আমার আরোহণের জন্যে খচ্চরের চেয়ে কিছু ছোট একটি সাদা জানোয়ার উপস্থিত করেন। তার নাম ছিলো বুরাক। এটি অত্যন্ত দ্রুতগতিসম্পন্ন জানোয়ার ছিলো। আমি তার ওপর আরোহণ করতেই বায়তুল মুকাদ্দাস গিয়ে উপনীত হলাম। এখানে বোরাকটি মসজিদে আকসার দরজার সঙ্গে বেঁধে রেখে আমি মসজিদের মধ্যে প্রবেশ করে দুই রাকা’আত নামায পড়লাম। এ সময় জিবরাইল আমার সামনে দুটি পেয়ালা উপস্থিত করলেন। তার একটিতে শরাব এবং অপরটিতে ছিলো দুধ। আমি দুধের পেয়ালাটি গ্রহণ করে শরাবেরটি ফেরত দিলাম। এটা দেখে জিবরাইল বললেন, ‘আপনি দুধের পেয়ালাটি গ্রহণ করে স্বভাব-ধর্মকেই (দ্বীনে ফিতরাত) অবলম্বন করেছেন।

এরপর মহাকাশ ভ্রমণ শুরু হলো। আমরা যখন প্রথম আকাশ (পৃথিবীর নিকটতম আকাশ) পর্যন্ত পৌঁছলাম, তখন জিবরাইল পাহারাদার ফেরেশতাকে দরজা খুলে দিতে বললেন। সে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার সঙ্গে কে আছেন?’ জিবরাইল বললেন, ‘মুহাম্মদ’। ফেরেশতা আবার জিজ্ঞেস করলো, এঁকে কি ডাকা হয়েছে? জিবরাইল বললেন, ‘হ্যাঁ ডাকা হয়েছে। একথা শুনে ফেরেশতা দরজা খুলতে খুলতে বললো, ‘এমন ব্যক্তিত্বের আগমন মুবারক হোক।’ আমরা ভেতরে ঢুকতেই হযরত আদম (আ:)-এর সঙ্গে সাক্ষাত হলো। জিবরাইল আমায় বললেন, ‘ইনি আপনার পিতা (মানব বংশের আদি পুরুষ) আদম। আপনি এঁকে সালাম করুন। আমি সালাম করলাম। তিনি সালামের জবাবদান প্রসঙ্গে বললেন, ‘খোশ আমদেদ! হে নেক পুত্র, হে সত্য নবী’।

এরপর আমরা দ্বিতীয় আকাশে পৌঁছলাম এবং প্রথম আকাশের ন্যায় সওয়াল-জবাবের পর দরজা খুলে দেয়া হলো। আমরা ভেতরে গেলাম এবং হযরত ইয়াহ্ইয়া ও হযরত ঈসা (আ:)-এর সঙ্গে সাক্ষাত হলো। জিবরাইল তাঁদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনি সালাম করুন।’ আমি সালাম করলাম। উভয়ে জবাবদান প্রসঙ্গে বললেন, ‘খোশ আমদেদ! হে নেক ভ্রাতা, হে সত্য নবী!’ অতঃপর আমরা তৃতীয় আকাশে পৌঁছলাম। এখানে হযরত ইউসুফ (আ:)-এর সঙ্গে দেখা হলো। আগের মতোই তাঁর সঙ্গে সালাম-কালাম হলো। অনুরূপভাবে চতুর্থ আকাশে হযরত ইদরীস (আ:)-এর সঙ্গে, পঞ্চম আকাশে হযরত হারুন (আ:)-এর সঙ্গে এবং ষষ্ঠ আকাশে মূসা (আ:)-এর সঙ্গে সাক্ষাত হলো। সর্বশেষ সপ্তম আকাশে হযরত ইবরাহীম (আ:)-এর সঙ্গে সাক্ষাত হলো এবং তিনিও সালামের জবাবদান প্রসঙ্গে বললেন, ‘খোশ আমদেদ! হে নেক পুত্র, হে নেক নবী! এরপর আমাকে ‘সিদরাতুল মুন্তাহা’ (সিদরাতুল মুনতাহা হলো সপ্তম আকাশে আরশের ডান দিকে একটি কুল জাতীয় বৃক্ষ, সকল সৃষ্টির জ্ঞানের সীমার শেষ প্রান্ত। তারপর কি আছে, একমাত্র আল্লাহই জানেন) নামক একটি সমুন্নত বরই গাছ পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়া হলো। এর উপর অগণিত ফেরেশতা জোনাকির মতো ঝিকমিক করছিলো।’ (হাদীসের অনুবাদ সমাপ্ত হল, সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৬৭৪)।

নবী করীম (সা:)-এর মেরাজ জাগ্রতাবস্থায় ও সশরীরে সংঘটিত হওয়ার সমর্থনে আরো বেশকিছু দলিল-প্রমাণ পড়তে এখানে ক্লিক করুন!

  • সম্পূর্ণ লিখাটি আমার ফেইসবুক পেইজ থেকেও পড়তে পারেন Click

লিখক ও গবেষক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here