পশ্চিম আকাশে সূর্যোদয় হওয়ার হাদীসের অপব্যাখ্যার খন্ডন

0
পশ্চিম আকাশে সূর্যোদয় হওয়ার হাদীসের অপব্যাখ্যার খন্ডন

পশ্চিম আকাশে সূর্যোদয় হওয়া ও কাদিয়ানীদের অপব্যাখ্যা খন্ডন

পশ্চিম আকাশে সূর্যোদয় সংক্রান্ত হাদীসকে কাদিয়ানী সম্প্রদায় কর্তৃক অস্বীকার করার মতলবসিদ্ধ অপব্যাখ্যাটি প্রায় এরকম :

  • “হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামতের যে দশটি আলামতের কথা বলেছেন যার মধ্যে আছে পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়, আমরা বরাবরের মতোই মনে করি, পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় আলামতটি একটি রূপক। বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত বিপ্লবের মাধ্যমে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ পশ্চিমা সভ্যতার আবির্ভাব এবং সমগ্র বিশ্বের উপর এর ক্রমবর্ধমান আধিপত্যকে আমরা (আপাতদৃষ্টিতে) পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়ের প্রতীক হিসেবে সনাক্ত করেছি, এবং এটাই শেষ সময়ের একটি বড় আলামত।”

খন্ডনমূলক জবাব :

বর্তমানে প্রতিদিন পূর্ব দিক থেকে সূর্য উদিত হচ্ছে। আখেরী যামানায় কিয়ামতের সন্নিকটবর্তী সময়ে এ অবস্থার পরিবর্তন হয়ে পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয় ঘটবে। এটি হবে কিয়ামতের অত্যন্ত নিকটবর্তী সময়ে। পশ্চিমাকাশে সূর্য উঠার পর তাওবার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। কুরআন ও সহীহ হাদীসের মাধ্যমে এ বিষয়টি প্রমাণিত। কিন্তু কাদিয়ানী সম্প্রদায় তাদের সাধারণ কাদিয়ানীদেরকে এই ধরনের অপব্যাখ্যা দ্বারা বিভ্রান্ত করা সত্ত্বেও তারা এক্ষেত্রে আরও যে বিষয়টি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে সেটি হল, ওই সময় তাওবার দ্বার বন্ধ হয়ে যাবে মর্মে যে কথাটিও হাদীসে রয়েছে সেটি এড়িয়ে যাওয়া। যাতে তারা নিজেদের এ সমস্ত ব্যাখ্যার নামে ভন্ডামি ও প্রতারণার মুখোশ উন্মোচন হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পেতে পারে।

এই পর্যায় আমি পবিত্র কুরআন থেকে কয়েকটি আয়াত এবং কয়েকটি সহীহ হাদীস এখানে তুলে ধরছি। যার ফলে খুব সহজেই বুঝতে পারবেন যে, তারা কত নিকৃষ্ট মিথ্যাবাদী আর ভন্ড হলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা:)-এর কথাকে অস্বীকার করার উদ্দেশ্যে বিকৃত-ব্যাখ্যার পথ বেচে নিয়েছে। পশ্চিম আকাশে সূর্যোদয় হওয়ার পর কাফেরদের ঈমান গ্রহণ তাদের উপকারে আসবেনা, এই মর্মে আল্লাহতালা বলেন,

  • هَلْ يَنظُرُونَ إِلَّا أَنْ تَأْتِيَهُمْ الْمَلَائِكَةُ أَوْ يَأْتِيَ رَبُّكَ أَوْ يَأْتِيَ بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ يَوْمَ يَأْتِي بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ لَا يَنفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِنْ قَبْلُ أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْرًا قُلْ انتَظِرُوا إِنَّا مُنتَظِرُونَ

অর্থাৎ ‘‘তারা শুধু এ বিষয়ের দিকে চেয়ে আছে যে, তাদের কাছে ফেরেশতা আগমণ করবে কিংবা আপনার পালনকর্তা আগমণ করবেন। অথবা আপনার পালনকর্তার কোনো নিদর্শন আসবে। যে দিন আপনার পালনকর্তার কোনো নিদর্শন এসে যাবে তখন এমন ব্যক্তির ঈমান কোনো উপকারে আসবেনা যে পূর্ব থেকে ঈমান আনয়ন করেনি কিংবা স্বীয় বিশ্বাস অনুযায়ী কোনো সৎকাজ করেনি। হে নবী! আপনি বলুনঃ তোমরা অপেক্ষা করতে থাক। আমরাও অপেক্ষা করতে থাকলাম’’ (সূরা আনআমঃ ১৫৮)।

অধিকাংশ মুফাসসিরে কুরআনের মতে অত্র আয়াতে ‘‘কোনো নিদর্শন’’ বলতে পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়কে বুঝানো হয়েছে। ইবনে জারীর আত্-তাবারী বলেনঃ আয়াতে বর্ণিত নিদর্শনটি পশ্চিমাকাশ থেকে সূর্য উদিত হওয়াই অধিক বিশুদ্ধ। কারণ এ ব্যাপারে অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে (তাফসীরে তাবারী, ৮/ ১০৩)।

১। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ

  • لَا تَقُوْمُ السَّاعَةُ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا فَإِذَا طَلَعَتْ وَرَآهَا النَّاسُ يَعْنِي آمَنُوا أَجْمَعُونَ فَذَلِكَ حِينَ ( لَا يَنْفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِنْ قَبْلُ أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْرًا )

অর্থাৎ ‘‘যতদিন পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হবেনা ততদিন কিয়ামত হবেনা। যখন পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হবে এবং মানুষ তা দেখতে পাবে তখন সকলেই ঈমান আনবে। তখন এমন ব্যক্তির ঈমান কোনো উপকারে আসবেনা যে পূর্ব থেকে বিশ্বাস স্থাপন করেনি কিংবা স্বীয় বিশ্বাস অনুযায়ী কোনো সৎকাজ করেনি’’। (বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুর রিক্বাক)।

২। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেনঃ

  • إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يَبْسُطُ يَدَهُ بِاللَّيْلِ لِيَتُوبَ مُسِيءُ النَّهَارِ وَيَبْسُطُ يَدَهُ بِالنَّهَارِ لِيَتُوبَ مُسِيءُ اللَّيْلِ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا

অর্থাৎ ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহতালা দিনের বেলায় অপরাধকারীদের তাওবা কবূল করার জন্য সারা রাত স্বীয় হাত প্রসারিত করে রাখেন এবং রাতের বেলায় অপরাধকারীদের তাওবা কবূল করার জন্য সারা দিন তাঁর হাত প্রসারিত করে রাখেন। পশ্চিম আকাশ দিয়ে সূর্য উদয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এভাবে তাওবার দরজা খোলা থাকবে’’। (মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুত তাওবা)।

পশ্চিম আকাশে সূর্য উঠার পর তাওবার দরজা বন্ধ হয়ে যাবেঃ

আল্লাহতালা অত্যন্ত পরম দয়াময় ও ক্ষমাশীল। বান্দা গুনাহ করে যখন তাঁর কাছে ক্ষমা চায় তখন তিনি খুশী হন এবং বান্দার গুনাহ ক্ষমা করে দেন। পশ্চিম আকাশে সূর্য উঠার পূর্ব পর্যন্ত তিনি বান্দার তাওবা কবুল করতে থাকবেন। কিন্তু যখন পশ্চিম আকাশে সূর্য উঠে যাবে তখন কারো ঈমান গ্রহণযোগ্য হবেনা এবং ফাসেক ও গুনাহগারের তাওবাও কবুল হবেনা। কারণ পশ্চিম আকাশে সূর্য উদিত হওয়া একটি বিরাট নিদর্শন যা সে সময়কার প্রতিটি জীবিত ব্যক্তিই দেখতে পাবে এবং প্রত্যেক কাফেরই কিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে। অথচ ইতিপূর্বে তারা অস্বীকার করতো। মরণ উপস্থিত হওয়ার পর পাপী মু’মিন ব্যক্তির মতই হবে তাদের অবস্থা। মরণ উপস্থিত হওয়ার পর গুনাহগার বান্দার তাওবা যেমন কবুল হয়না পশ্চিম আকাশে সূর্য উঠার পর তেমনি কাফেরের ঈমান ও গুনাহগারের তাওবা কবুল হবেনা। আল্লাহতালা বলেনঃ

  • فَلَمَّا رَأَوْا بَأْسَنَا قَالُوا آمَنَّا بِاللَّهِ وَحْدَهُ وَكَفَرْنَا بِمَا كُنَّا بِهِ مُشْرِكِينَ (84) فَلَمْ يَكُ يَنْفَعُهُمْ إِيمَانُهُمْ لَمَّا رَأَوْا بَأْسَنَا سُنَّةَ اللَّهِ الَّتِي قَدْ خَلَتْ فِي عِبَادِهِ وَخَسِرَ هُنَالِكَ الْكَافِرُونَ

অর্থাৎ ‘‘তারা যখন আমার শাস্তি প্রত্যক্ষ করলো তখন বললোঃ আমরা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করলাম এবং যাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করতাম তাদেরকে পরিহার করলাম। অতঃপর তাদের এ ঈমান কোনো উপকারে আসলোনা যখন তারা শাস্তি প্রত্যক্ষ করল। আল্লাহতালার এ নীতি পূর্ব থেকে তাঁর বান্দাদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে। সেখানে কাফেরেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়’’ (সূরা গাফেরঃ ৮৪-৮৫)।

ইমাম কুরতুবী (রহঃ) পূর্ববর্তী যামানার আলেমদের থেকে বর্ণনা করে বলেনঃ পশ্চিম আকাশে সূর্য উঠার পর ঈমান ও তাওবা কবূল না হওয়ার করণ এই যে, তখন অন্তরে ভয় ঢুকে যাবে, পাপ কাজ করার আশা-আকাঙ্খা মিটে যাবে এবং শরীরের শক্তি শেষ হয়ে যাবে। কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার সময় সকল মানুষ মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে উপস্থিত ব্যক্তির ন্যায় হয়ে যাবে। তাই পশ্চিম আকাশে সূর্য দেখে কেউ তাওবা করলে তার তাওবা কবূল হবেনা। যেমন মালকুল মাওতকে দেখে তাওবা করলে কারো তাওবা কবুল হয়না (তাফসীরে কুরতুবী, ৭/ ১৪৬)

ইমাম ইবনে কাসীর (রহঃ) বলেনঃ ‘‘সে দিন যদি কোনো কাফের ঈমান এনে মুসলমান হয়ে যায় তার ঈমান গ্রহণ করা হবেনা। সে দিনের পূর্বে যে ব্যক্তি মুমিন থাকবে সে যদি ঈমানদার হওয়ার সাথে সাথে সৎকর্ম পরায়ন হয়ে থাকে তাহলে সে মহান কল্যাণের উপর থাকবে। আর যদি সে গুনাহগার বান্দা হয়ে থাকে এবং পশ্চিম আকাশে সূর্য উঠতে দেখে তাওবা করে তার তাওবা কবূল হবেনা’’ (তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৩/৩৭১)।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here