ঈসা (আ:)-এর পরিবর্তে অন্য একজনকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয় এবং ঈসাকে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয় :
[১] বিশ্ববিখ্যাত তাফসীরকারক ইমাম ইবনে কাসীর (রহ:) রচিত ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ এর ২য় খন্ডের ذِكْرُ رَفْعِ عِيسى عليه السلام إلى السماء (ঈসা আলাইহিস-সালামকে আকাশে উঠিয়ে নেয়ার আলোচনা) অধ্যায় একখানা গুরুত্বপূর্ণ সহীহ হাদীসের উল্লেখ পাওয়া যায়। নিচে সনদ সহকারে হাদিসটি উল্লেখ করছি।
সনদ (ধারাবাহিক সূত্র) : “ইবনু আবী হাতিম > আহমদ ইবনু সানান > আবু মু’আবিয়া > আ’মাশ > মিনহাল ইবনু আমর > সাঈদ ইবনু জুবায়ের > আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস।” ইমাম ইবনে কাসীর তিনি বর্ণনাটির উক্ত সনদ সম্পর্কে লিখেছেন : وهذا إسناد صحيح إلى ابن عباس على شرط مسلم অর্থাৎ ইবনে আব্বাস (রা:) পর্যন্ত এই সনদটি সহীহ এবং ইমাম মুসলিম (রহ:) কৃত শর্তের উপরই প্রতিষ্ঠিত।
হাদীস :
لما أراد الله أن يرفع عيسى إلى السماء خرج على أصحابه وفي البيت اثنا عشر رجلا منهم من الحواريين، يعني فخرج عليهم من عين في البيت ورأسه يقطر ماء فقال لهم: إن منك من يكفر بي اثني عشرة مرة بعد أن آمن بي، ثم قال: أيكم يلقى عليه شِبْهِيْ فيُقتلُ مكاني فيكون معي في درجتي؟ فقام شاب من أحدثهم سنا فقال له: اجلس. ثم أعاد عليهم فقام الشاب فقال: أنا. فقال عيسى اجلس، ثم أعاد عليهم فقام الشاب فقال أنا، فقال: أنت هو ذاك. فأُلْقِىَ عَليه شِبْهُ عيسى، ورُفِعَ عيسى من روزنة في البيت إلى السماء. قال وجاء الطلب من اليهود فأخذوا الشِبْهَ فقتلوه ثم صَلبوه.
অর্থাৎ আল্লাহতালা ঈসা (আ:)-কে যখন আকাশে উঠিয়ে নিতে চাইলেন তখন তিনি (ঈসা) গৃহের অভ্যন্তরে আপনা সাথীদের অন্যতম বারোজন হাওয়ারীর সাথে [জুরুরি আলোচনায়] বসলেন। অর্থাৎ তিনি সাথীদের মাঝে একটি ঝর্ণা হতে এমন অবস্থায় উপনীত হলেন যখন তাঁর মাথা হতে ফোটায় ফোটায় পানি ঝরছিল। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে বললেন, তোমাদের মধ্য হতে জনৈক ব্যক্তি আমার প্রতি ঈমান এনেও আমার সাথে দশবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তারপর তিনি বলেছেন, তোমাদের মাঝে এমন কেউ কি (নিজেকে সপে দিতে প্রস্তুত) আছ, যার চেহারাকে আমার মত করে দেয়া হবে এবং আমার জায়গায় তাকে হত্যা করা হবে। ফলে সে আমার মর্যাদায় ভূষিত হয়ে (জান্নাতে) আমার সঙ্গী হবে? তারপর বয়সে সর্ব কনিষ্ঠ একজন হাওয়ারী তাদের মধ্য হতে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি তাকে বসে যেতে বলেন। তারপর তিনি তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণের পুনরাবৃত্তি করেন। যুবকটি আবার দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমি’। ঈসা (আ:) তাকে [আবারও] বসে যেতে বলেন। তিনি আবার ভাষণের পুনরাবৃত্তি করেন। যুবকটি (এবারও) দাঁড়িয়ে বলেন, আমি। প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, (হ্যাঁ) তুমিই সেই [ভাগ্যবান] ব্যক্তি! তারপর তাকে ঈসার অবিকল সাদৃশ করে দেয়া হল এবং ঈসাকে তাঁর বাড়ীর বাতায়ন পথে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হল। তিনি [ইবনে আব্বাস] বলেন, ইহুদীদের তল্লাশি দল আসলো অতপর ঈসার সাদৃশ যুবকটিকে পাকড়াও করে হত্যা করলো তারপর ক্রুশবিদ্ধ করলো। (অনুবাদ শেষ হল)। সুতরাং সহীহ হাদীস দ্বারাও প্রমাণ পাওয়া গেল যে, ঈসা (আ:)-কে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল এবং তাঁর জায়গায় অন্য একজনকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল।
- আকাশে উঠিয়ে নেয়া সম্পর্কে ‘ইলাছ ছামায়ি’ শব্দে হাদীস :
[২] হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেছেন فأخبره بأنه يرفعَه الى السماء و يُطهره من صُحبة اليهود অর্থ- “তিনি (আল্লাহতালা) তাঁকে (ঈসা) জানিয়ে দেন, নিশ্চয়ই তিনি [আল্লাহ] তাঁকে (ঈসা) আকাশে উঠিয়ে নেবেন এবং ইহুদীদের নাগাল পাওয়া থেকে তিনি তাঁকে (ঈসা) পবিত্র (মুক্ত) করবেন।” [রেফারেন্স : আস-সুনানুল কোবরা লিন-নাসাঈ, হাদীস নং ১১৫৯; সংকলক, ইমান আহমদ ইবনে শোয়াইব ইবনে আলী আল খোরাসানী রহ: মৃত ৩০৩ হিজরী, তাফসীরে বায়দ্বাভী ২/১৮১]।
- আকাশে উঠিয়ে নেয়া সম্পর্কে রুফি’আ ইলাছ ছামায়ি শব্দে হাদিস :
[৩] দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা:) রাসূল (সা:)-এর ইন্তেকালের সংবাদ শুনামাত্র-ই শোকে মূহ্যমান হয়ে বলেছিলেন : و انما رُفع الى السماء كما رُفع عيسى ابنُ مريمَ عليه السلام অর্থ- “নিশ্চয়ই তাঁকে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয় যেমনিভাবে ঈসা ইবনে মরিয়মকে [আকাশে] উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল।” [দেখুন, আল-মিলালু ওয়ান নাহাল, খন্ড নং ৩ পৃষ্ঠা নং ৯; সংকলক, ইমাম শাহরাস্তানী; মৃত ৫৪৮ হিজরী]।
- ঊর্ধ্বগমন করানো মর্মে ‘আসরা বি-ঈসা’ শব্দে হাদীস :
[৪] হযরত হাসান ইবনে আলী ইবনে আবী তালেব (রা:) হতে বর্ণিত আছে তিনি বলেছেন : قُتِلَ ليلةَ اَنزلَ القرآنُ و ليلةَ أُسْرِىَ بِعيسى و ليلةَ قُبِضَ مُوسى. در منثور للسيوطي অর্থ- “তিনি [আলী বিন আবী তালেব] পবিত্র কুরআন নাযিল হওয়ার রাতে (তথা শবে ক্বদরে) শহীদ হন আর সেই রাতে ঈসা (আ:) ঊর্ধ্বগমন করেন এবং মূসা (আ:) মৃত্যুবরণ করেন।” [রেফারেন্স, ইমাম সুয়ূতী সংকলিত ‘দুররে মানছূর’ খন্ড নং ২ পৃষ্ঠা নং ৩৬]।
- সশরীরে আকাশে উঠিয়ে নেয়া সম্পর্কে বি-জাছাদিহি শব্দে হাদীস :
[৫] হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত আছে তিনি বলেছেন …كان بينَ موسى بنِ عمرانَ وَ عيسى بنِ مريمَ الفُ سنةٍ وَ تِسعةُ مائةِ سنةَ و اَن عيسى عليه السلام حِين رُفِعَ كان ابنُ اثنتين و ثلاثين سنةَ و ستةَ أشهُرٍ و كانت نبوتُه ثلاثين شهراً و أَن اللهَ رَفَعَهُ بِجَسَدِهِ وَأَنهُ حَيُ الْآنَ و سَيَرْجِعُ الي الدنيا فيها مَلِكاً ثم يَموتُ كما يموتُ الناسُ. الطبقات الكبرى لابن سعد অর্থ- “মূসা ইবনে ইমরান আর ঈসা ইবনে মরিয়ম তাঁদের দু’জনের মাঝে ঊনিশশত বছরের ব্যবধান ছিল।… নিশ্চয় ঈসা (আ:)-কে যখন উঠিয়ে নেয়া হয় তখন তিনি ছিলেন বত্রিশ বছর ছয় মাসের যুবক। তাঁর নবুওয়তি কার্যক্রম চলেছিল ত্রিশ মাস অব্ধি। নিশ্চয় আল্লাহতালা তাঁকে স্বশরীরে উঠিয়ে নেন এবং তিনি এখনো জীবিত। অতিসত্বর তিনি পৃথিবীতে পুনরায় ফিরে আসবেন। আর তিনি পৃথিবীতে একজন বাদশাহ [শাসক] হবেন। তারপর তিনি অন্যান্য মানুষের ন্যায় মৃত্যুবরণ করবেন।” [দেখুন, আত তবকাতুল কোবরা লি-ইবনে সা’আদ : ১/৩৫-৩৬; ‘যিকরুল কুরূনি ওয়াস সানীনি আল্লাতি বাইনা আদাম ওয়া মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ শীর্ষক পর্ব, মাকতাবাতুল খাঞ্জী, কায়রো মিশর]।
- উপরে উঠিয়ে নেয়া সম্পর্কে ‘উরিঝা ফীহা বি-রূহ’ শব্দে হাদিস :
[৬] হাবাইরা ইবনু ইয়ারীম হতে বর্ণিত তিনি বলেছেন, আলী (রা:) যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন হযরত হাসান (রা:) মিম্বারে উঠে ভাষণ দেয়ার প্রাক্কালে বলেছেন…. و لقد قُبِضَ فى الليلةِ التى عُرِجَ فيها بِرُوْحِ عيسى ابنَ مريم ليلةَ سبعِ و عشرين مِن رمضانَ অর্থ- “এমন একটি রাত্রিতে তাঁর [আলী] রূহ কবজ [মৃত্যুদান] করা হয়েছে যেই রাত্রিতে রূহ (জিবরাইল)’র মাধ্যমে ঈসা ইবনে মরিয়মকে উপরে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। রাত্রটি ছিল রমাদ্বানের ২৭ তারিখ।” [রেফারেন্স, আত-তবক্বাতুল কোবরা, লি ইবনে সা’আদ ৩/৩৭; মাকতাবাতুল খান্জি লাহোর, সহীহ ইবনে হাব্বান খন্ড ১৫, মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবাহ খন্ড ১৭]।
- উপরে উঠিয়ে নেয়া মর্মে ‘রুফি’আ ঈসা’ শব্দে হাদীস :
[৭] যখন হযরত আলী (রা:) শহীদ হয়ে যান তখন তাঁর পুত্র হযরত হাসান (রা:) খোৎবা দানকালে উপস্থিত শ্রোতাদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন : فقد قَتلتُم الليلةَ رجلا فى ليلةٍ نَزل فيها القرآنُ و فيها رُفِع عيسى و فيها قُتل يوشع ابنُ نونٍ الخ অর্থ- “তোমরা এক ব্যক্তি [আলী]-কে এমন এক রাত্রিতে শহীদ করেছ যেই রাত্রটিতে পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছিল এবং ঈসা (আ:)-কে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল এবং ইউশা ইবনু নূন (আ:)-কেও শহীদ করা হয়েছিল।” [রেফারেন্স, তারিখুল কামিল লি-ইবনে আছীর খন্ড নং ৩ পৃষ্ঠা নং ৩০; মিসরীয় প্রকাশনী]।
- ইবনে মরিয়ম (আ:) ‘আকাশ থেকে নাযিল হবে’ মর্মে সহীহ হাদীস :
[৮] রাসূল (সা:) বলেছেন : والذي نفسى بيده ليوشكن ان ينزل ابن مريم فيكم حكما عدلا অর্থাৎ শপথ সেই সত্তার যার হাতে আমার প্রাণ অতিসত্বর তোমাদের মাঝে ইবনে মরিয়ম একজন ন্যায়পরায়ণ শাসকরূপে অবশ্যই নাযিল হবেন। (সহীহ বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া হাদীস নং ৩২৬৪)।
[৯] হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন: كيف انتم إذا نزل ابن مريم من السماء فيكم و امامكم منكم অর্থাৎ তখন তোমাদের কেমন হবে যখন ইবনে মরিয়ম আকাশ থেকে তোমাদের মাঝে নাযিল হবেন আর তখন তোমাদের ইমাম তোমাদের মধ্য হতে হবেন। [সুনানে বায়হাক্বীর সংকলক কর্তৃক সংকলিত ‘আল আসমা ওয়াস সিফাত’ ২/৩৩১; হাদীস নং ৮৯৫, বাবু ক্বওলিল্লাহি আজ্জা ওয়া জাল্লা লি-ঈসা ইন্নী মুতাওয়াফ্ফীকা ওয়া রাফিউকা ইলাইয়্যা; হাদীসের মান : সহীহ]।
- সহীহ বুখারী’র হাদীসে من السماء শব্দ নেই, অতএব বায়হাক্বী’র সংকলন الاسماء والصفات কিতাবে শব্দটি থাকতে পারেনা! কাদিয়ানীদের একটি অজ্ঞতা আর সংশয় ও তার জবাব! Click
[১০] “…আল্লাহতায়ালা তখন ঈসা ইবনে মরিয়মকে পাঠাবেন। জাফরানের রঙ্গে রঙ্গিত দুটি পোষাক পরিহিত হয়ে এবং দুইজন ফেরেশতার দুই পাখার উপর আপনা দুই বাহু রেখে দামেস্ক শহরের পূর্বপ্রান্তে শ্বেত মিনারার নিকটে তিনি নাযিল হবেন।” সংক্ষেপে। [সহীহ মুসলিম, অধ্যায় কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাতিস সা’আহ হা/৭০৭৬ ইফা ]।
পরিশেষ : পরিশেষে বলব, কাদিয়ানী সম্প্রদায় অতিব চতুরতার সাথে সত্যকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং তাদের সরলমনা অনুসারীদের বোকা বানিয়ে মুরোদ হাসিল করতে অবিরাম মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকে। এমনকি তাদের অনুসারীদেরকে সত্য থেকে পুরোদমে বঞ্চিত রাখার কৌশল হিসেবে ঢালাওভাবে উলামায়ে কেরামকে আকাশের নিচে নিকৃষ্ট জীব বলেও আখ্যা দেয়। যাতে তাদের মিথ্যা, রূপকের কাসুন্দি আর অহরহ জালিয়াতী বরাবরই ধরা-ছোঁয়া থেকে রক্ষা পায়। অধিকন্তু রাসূল (সা:) হক্কানী উলামায়ে কেরামকে সুনানে আবুদাউদ এবং তিরমীজীর হাদীসে ‘ওরাসাতুল আম্বিয়া’ (নবীগণের উত্তরসূরী) শব্দে মর্যাদাবান করেছেন এমনকি সুনানে দারেমীর ৩৭০ নং হাদীসে ‘ওয়া ইন্না খাইরাল খিয়ারি খিয়ারুল উলামা’ (এবং নিশ্চয়ই আলেমগণই সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী) শব্দেও মর্যাদাবান করেছেন। অথচ তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এগুলো চেপে যায়। উফ! কতটা ধুর্ত তারা! আল্লাহ তাদের হিদায়াত করুন।
- লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী