পীর খাজা মেহের আলী শাহ (রহ.) এর সাথে বাহাস থেকে মির্যা কাদিয়ানীর পলায়নের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস :
কাদিয়ানী ফেতনা মুকাবিলায় প্রখ্যাত পীর খাজা মেহের আলী শাহ (রহ.) এর কৃতিত্ব :
কাদিয়ানী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মির্যা গোলাম আহমদ। তিনি ১৮৩৯ সালে ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের গুরুদাসপুর জেলার “কাদিয়ান” গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম গোলাম মর্তুজা, মাতা চেরাগ বিবি। মির্যা গোলাম আহমদ পরিণত বয়সে পেশায় একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক এবং জমিদার ছিলেন। একাধিক গৃহ শিক্ষকের মাধ্যমে আরবী ভাষা ও ব্যাকরণ সহ ফারসী ভাষা ইত্যাদি শিক্ষা লাভ করেন। নিজ পিতার কাছ থেকে হোমিওপ্যাথিকের উপরও জ্ঞান লাভ করেন। ১৮৬৪ সাল থেকে তিনি প্রায় চার বছর শিয়ালকোট জেলা প্রশাসকের অফিসে কেরানির চাকুরী করেন, তারপর তিনি চাকুরী ছেড়ে নিজ গ্রাম “কাদিয়ান” চলে যান। কাদিয়ান গিয়ে তিনি হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ সহ বিভিন্ন ধর্মের উপর ধর্মীয় বইপুস্তক অধ্যয়ন করতে থাকেন এবং ধর্মীয় বিতর্কে অংশ নেয়াও শুরু করেন।
যতদূর জানা যায়, তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন হানাফী ফিকহের মুকাল্লিদ। মির্যা নিজেও তার প্রথম জীবনে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন। ততদিন পর্যন্ত মির্যার বিশ্বাস আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত-এর মুসলমানদের মতই ছিল। তিনি মুহাম্মদ (সা.)-কে নবীদের মধ্যে মুক্ত অর্থে “শেষনবী” বলেও বিশ্বাসী ছিলেন। তৎকালীন সময়ে মির্যা নিজেও ঈসা (আ.)-এর আকাশে উঠিয়ে যাওয়া এবং কেয়ামতের আগে দামেশকে দুইজন ফেরেশতার মাধ্যমে অবতারণের আকীদায় বিশ্বাসী ছিলেন।
১৮৫৭ সালে দখলদার ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু যুদ্ধে দেশবাসী জয়লাভ করতে না পারায়, বিশেষকরে মুসলিমরা তাদের রাজনৈতিক আধিপত্য হারাতে বসেছিল। তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও হতাশ হয়ে পড়েছিল এবং তাদের অসহায়ত্ব থেকে মুক্তি পেতে কখন একজন মহাপুরুষ আসবেন তা দেখার জন্য চারপাশে তাকিয়েছিল। এই দ্বিধা ও অস্থিরতার সময় মুসলমানদের মনে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল মির্যা গোলাম আহমদকে তার উপদেষ্টা হেকিম নূরউদ্দীন তা কাজে লাগাতে পরামর্শ দিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, তিনি যদি প্রতিশ্রুত ঈসা (আ.)-এর রূপক সত্তা (অবতার) হিসেবে নিজেকে জাতির সামনে উপস্থাপন করেন তবে সমগ্র জাতি তাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাবে এবং তিনি জাতির পুনরুজ্জীবনের জন্য একটি মহৎ কাজ করতে সক্ষম হবেন।
অধিকন্তু মির্যার এই আন্দোলনের পিছনে কোন ইসলাম বিরোধীশক্তির ইন্ধন ছিল তা অনুমান করা কঠিন নয়, কারণ ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় মুসলমানদের ব্যাপারে আগ্রহ হারালেও কিন্তু মির্যা কাদিয়ানী আর তার প্রতিষ্ঠিত আহমদীয়া দলের প্রতি তাদের সুধারণাই ছিল। মির্যা কাদিয়ানী সেই সময়কার স্বাধীনতাকামী মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও পণ্ডিতদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের কাছে বিভিন্ন দরখাস্ত ও সমন পাঠিয়েছিল, যা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, তিনি ব্রিটিশ সরকারের বিশেষ ব্যক্তিদের একজন। আর যখন তিনি দেখলেন যে, হিন্দুরা স্বাধীনতার দৌড়ে মুসলমানদের সঙ্গী হয়ে লড়াই করছে এবং ক্ষমতাও লাভ করছে, তখন তিনি তার দলের প্রতি হিন্দুদের নেক দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তার পুস্তকাদিতে হিন্দুধর্মের নানা অবতার এবং ঋষি মুনিদের প্রশংসায় লিখতে এবং বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। তার বই “শাহাদাতুল কুরআন”-এ তিনি ব্রিটিশ সরকারের আনুগত্যকে ইসলামের অংশ বলেও ঘোষণা করেছেন।
মির্যা কাদিয়ানী তার উপদেষ্টা ও অনুসারী হেকিম নূরউদ্দীনের পরামর্শ অনুসরণ করে নিজেকে ঈসা (আ.)-এর মাসীল (অবতার) হিসেবে দাবি করেন এবং বলেন, “আমি মরিয়মের পুত্র মসীহ হওয়ার দাবি করি না, আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করি না, তবে আমি নিজেকে মাছীলে মসীহ (ঈসার অবতার) হবার দাবি করি।”
মির্যা তখন ঈসা (আ.)-এর সাদৃশ্যের এই দাবিকে বেশিদিন ধরে রাখেননি বরং আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে সর্বপ্রথম ঈসার (যীশুখ্রিস্টের) জীবিত থাকার বিশ্বাস অস্বীকার করে তার মৃত্যুর ঘোষণা দেন। তারপর তিনি তার প্রতিশ্রুত মসীহ ঘোষণা করেন। যেমন তিনি লিখেছেন, “আমার দাবী হল আমি সেই প্রতিশ্রুত মসীহ, যাঁর সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী আছে ঈশ্বরের সমস্ত পবিত্র গ্রন্থে যে, তিনি শেষকালে আবির্ভূত হবেন।” তারপর এই সময়কালটিও অতিবাহিত হয় এবং পরবর্তী পর্যায়টি ছিল প্রতিশ্রুত মসীহ (সা.) হবার দাবী। মির্যা কাদিয়ানী প্রায় ১০ বছর ধরে তাঁর মসীহ হওয়ার দাবি বজায় রাখেন। এরপর তিনি ১৯০১ সালের নভেম্বরে তাঁর নবুওয়ত দাবীর ঘোষণা করেন।
এই দাবির পর মির্যা কিছুকাল নানা শব্দের (আনুগত্য /জিল্লি/বুরুজি/উম্মতি) আশ্রয় নিয়ে নবী হওয়ার ভান করতে থাকেন। ইতিপূর্বে খাতামুন নাবিয়্যীন সম্পর্কে মির্যার ব্যাখ্যা ছিল যে, এর অর্থ হল আপনি নবীদের সীলমোহর এবং আপনার সীল ছাড়া কারো নবী দাবী নিশ্চিত হতে পারে না। আপনি যাকে সীল মেরে নিশ্চিত করবেন তিনিই হবেন নবী। কিছু সময়ের জন্য মিথ্যা নবী হওয়ার পর, মির্যা কাদিয়ানী সাহেব অবশেষে শরীয়তধারী নবী এবং মুহাম্মদী সিলসিলায় শেষনবী হওয়ার বড় বড় দাবিও করে বসেন। তাঁর রচিত “হাকীকাতুল ওহী” গ্রন্থে তিনি পবিত্র কুরআনের আয়াতগুলোকে নিজের সাথে এডজাস্ট করে ফেলেন, যেগুলো মহানবী (সা.)-এর মহিমায় অবতীর্ণ হয়েছিল। আর যারা তার এই সমস্ত দাবীকে ফালতু আর মিথ্যা বলেছিল তাদের সবাইকে তিনি কাফের বলে ঘোষণা করে বললেন “সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমার নিকট প্রকাশ করেছেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তি যে আমার দাওয়াত পাওয়া সত্ত্বেও আমাকে গ্রহণ করেনি সে মুসলমান নয়।” (তাযকিরাহ ৫১৯ নতুন এডিশন)।
অথচ মুসলমানদের অন্যতম একটি চিরন্তন বিশ্বাস যে, মুহাম্মদ (সা.)-ই আল্লাহতালার শেষনবী। তারপর আর কোনো নবীর জন্ম হবেনা। আর মহানবী (সা.)-এর ফরমান মুতাবেক হযরত ঈসা (আ.) দ্বিতীয়বার আসবেন “উম্মতি” হিসেবে, নবী হিসেবে নয়। কেননা পবিত্র কুরআনের সূরা মায়েদা আয়াত নং ৩ এর اليوم اكملت لكم دينكم (আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি) অনুসারে বর্তমানে নবুওয়তি দায়িত্ব সহকারে দ্বিতীয় কারো আসার প্রয়োজন নেই। সুতরাং ঈসা (আ.)-এর আগমনও নবুওয়তি দায়িত্ব সহকারে হবেনা, বড়জোর “উম্মতি” হিসেবে হবেন।
মুসলিম উম্মাহার নিকট ইসলামে কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য প্রয়োজন যথাক্রমে, ১. আল্লাহ’র কিতাব ২. মহানবীর হাদীস ৩. সালাফের ইজতিহাদ ৪. সাহাবা আজমা’ঈনের ঐকমত্য। এই চারটির দাঁড়িপাল্লায় যা সত্য, তা মুসলমানদের জন্য গৃহীত; আর যা মিথ্যা তা তাদের নিকট প্রত্যাখ্যাত। কিন্তু মির্যা কাদিয়ানীর সমুদয় দাবী এই স্কেলে সত্য প্রমাণিত হয়নি। তাই মুসলমানদের পক্ষে এটি বিশ্বাস করা সম্ভব ছিল না। তথাপি তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য লিখনীর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন। ফলে তার সত্য-মিথ্যায় মিশ্রিত ক্ষুরধার লিখা কতিপয় নির্বোধ ও সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করে।
মির্যা কাদিয়ানীর এই সমস্ত লিখালিখির অসারতা উন্মোচন করতে সেই সময়কার প্রসিদ্ধ আলেমেদ্বীন খাজা পীর মেহের আলীশাহ (রহ.) একখানা বই রচনা করেন, যেখানে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণ করে দেন যে, হযরত মসীহ ইবনে মরিয়ম (আ.)-কে হত্যা করা হয়নি বা ক্রুশবিদ্ধ করাও হয়নি বরং শারীরিকভাবে জীবিত অবস্থায় আকাশে তুলে নেওয়া হয়েছে এবং কিয়ামতের আগে তিনি দ্বিতীয়বার আবির্ভূত হবেন। হযরত ইমাম মাহদী আসবেন, ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করবেন। তারপর ঈসা (আ.) দামেস্কে আকাশ থেকে অবতরণ করবেন এবং ইমাম মাহদী (আ.)-এর সাথে এক হয়ে যুদ্ধ করবেন এবং ফিলিস্তিনের “বাব লূদে” ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) “মসীহে দাজ্জাল”-কে হত্যা করবেন। এরপর ইয়াজুজ-মাজুজ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে।
খাজা পীর মেহের আলী শাহ (রহ.)-এর রচিত “শামসুল হিদায়া” গ্রন্থটি উপমহাদেশের ইসলামিক পণ্ডিতদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তার প্রতিটি লিখা ছিল অত্যন্ত আনন্দদায়ক ও ফলপ্রসূ। অমৃতসর শহরের একজন আহলে হাদীস মানহাজের আলেম মৌলভী হাবীবুল্লাহ সাহেব লিখেছেন যে, “শামসুল হিদায়া” বইটি পড়ার পর বহু সংখ্যক মির্যায়ী (কাদিয়ানী) তওবা করে এবং সঠিক পথে চলে আসে। মৌলভী হাবীবুল্লাহ সাহেব নিজেও আগে মির্যায়ীদের যাদুময় লিখনী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন কিন্তু খাজা সাহেবের বই তাকে সরল পথে অবিচল থাকতে সাহায্য করে এবং তিনি তার তাবৎ সংশয় খাজা মেহের আলী সাহেবের নিকট উল্লেখ করে সমাধান নিয়ে নিতেন। একই মৌলভী হাবীবুল্লাহ সাহেব পরবর্তীতে কাদিয়ানী মতবাদের খণ্ডনে এমন এমন গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছিলেন যে, বিখ্যাত আলেম আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী (রহ.)ও তাঁর পাদটীকায় সূরা আল মুমিনুনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
১৯০০ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি, মির্যা কাদিয়ানীর বিশেষ উপদেষ্টা হেকিম নূরউদ্দীন সাহেব খাজা পীর মেহের আলী শাহ (রহ.)-কে একটি চিঠি লেখেন, যাতে তিনি বারোটি প্রশ্নের তালিকা করেন। খাজা সাহেবের উক্ত জবাব পরবর্তীতে দেশের আনাচে কানাচে সমস্ত মানুষের হাতে পৌঁছে যেতে থাকে এবং নামীদামী ইসলামিক স্কলাররা সেই জবাবগুলোর পাদটীকাও সংযোজন করে দেন। খাজা সাহেবের ‘শামসুল হিদায়া’ বইটি বাজারে ছড়িয়ে পড়ার পর মির্যায়ীরা কোনঠাসা হয়ে পড়ে এবং জায়গায় জায়গায় পাকড়াও হতে থাকে। মির্যায়ীয়ত গেল গেল রব পড়তে শুরু করে। অবস্থা বেগতিক দেখে মির্যা কাদিয়ানী সাহেব খাজা পীর মেহের আলী সাহেবকে মুনাজারার (দ্বিপাক্ষিক বিতর্ক) আহবান করেন। খাজা সাহেব তো এটাই চাচ্ছিলেন। তিনি আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন। কারণ, এবার সবার সামনে মির্যার ভণ্ডামি উন্মোচন করার সুযোগ পাওয়া গেল। এই বিতর্কের আহবান খাজা পীর মেহের আলী শাহের পক্ষ থেকে ছিল না। তা বরং মির্যা কাদিয়ানীর ইচ্ছানুযায়ীই হয়েছিল। কিন্তু ধূর্ত মির্যা তার বিশ্বাস এবং দাবীকে খণ্ডন করার জন্য এই বিতর্কের আহবান করেননি, বরং খাজা সাহেবকে তার সাথে পাল্লা দিয়ে আরবীতে তাফসীর লিখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। যেন দুইজনই তাফসীর লেখার সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারে।
যাইহোক, খাজা মেহের আলী সাহেব শুধু আমন্ত্রণই গ্রহণ করেননি বরং মির্যা সাহেবকে লিখিত বিতর্কের পাশাপাশি বক্তৃতা বিতর্কের জন্যও আমন্ত্রণ জানান। বিতর্কের স্থান “শাহী মসজিদ লাহোর” হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ৩ জন বিদ্যানকে ফয়সাল (বিচারক) হিসাবে মনোনীত করা হয়। ২২শে জুলাই ১৯০০ তারিখে মির্যা সাহেব সারা ভারতে একটি বিজ্ঞাপন বিতরণ করা হয়, যাতে উপমহাদেশের সকল মাশায়েখ ও উলামা এবং খাজা মেহের আলী শাহ সহ বিশেষভাবে ৮৬ জন বিশিষ্ট উলামাকে উদ্দেশ্য করে মির্যার মুকাবিলায় ২৫শে আগস্ট ১৯০০ তারিখে লাহোরে বিতর্কানুষ্ঠানের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। খাজা মেহের আলীই প্রথম এই উন্মুক্ত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং তার পক্ষে ২৫শে জুলাই ১৯০০ সালে তিনি একটি বিজ্ঞাপনও প্রকাশ করেন এবং প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিনি ২৫শে আগস্ট ১৯০০ তারিখে লাহোর সফর করেন।
তাই যখন প্রতিশ্রুতির দিন ঘনিয়ে আসছিল, তখন হাজার হাজার মুসলমান লাহোরে উপস্থিত হন। বিভিন্ন মতের প্রায় সবাই (শিয়া, দেওবন্দি, বেরেলি, আহলে হাদীস) এমনকি কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের অনুসারীসহ সমাজের সর্বস্তরের মুসলমানরা দূর-দূরান্ত থেকে একত্রিত হন। ২৫ শে আগস্ট ১৯০০ ইং পুলিশ নির্ধারিত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তখনও মির্যা অবশ্যই আসবেন, এমনি কথা শুনা যাচ্ছিল। কিন্তু দীর্ঘ অপেক্ষার পর মির্যা কাদিয়ানী সাফ জানিয়ে দেন যে, আমি কোনো মূল্যে লাহোরে আসতে প্রস্তুত নই। অজুহাত ছিল, সেখানকার মানুষজন নাকি তাকে তার নবুওয়তের দাবীতে মিথ্যাবাদী প্রমাণের জন্য হত্যা করতে পারে। যদিও মির্যার নিজস্ব অনুরোধেই বিতর্কটি পরিচালিত হয়েছিল এবং মির্যার নিজের ইচ্ছা অনুযায়ীই উক্ত বিতর্কের উপর ৫০০০ কপি বিজ্ঞাপন ছাপানোও হয়েছিল। (বর্তমানেও কাদিয়ানীরা প্রতিপক্ষকে এমনি প্রতারণা দিয়ে থাকে। তারা তর্জনগর্জন করে প্রথমে চ্যালেঞ্জ দেবে কিন্তু পরবর্তীতে হুবহু মির্যার মতই নানা অজুহাতে পিছটান দিয়ে থাকে – অনুবাদক)।
বলে রাখা দরকার, এই বিজ্ঞাপন তাদের কাছে একটি নিবন্ধিত ডাকযোগে মির্যার কাছে পাঠানো হয়েছিল। ডাকযোগে পাঠানো হয়েছিল পাঞ্জাব এবং ভারত, এনডব্লিউএফপি এবং আফগানিস্তানের আরও অনেক আলেম ও পণ্ডিতদের কাছেও। এভাবেই বিতর্কের আমন্ত্রণ এবং আমন্ত্রণের প্রতিক্রিয়া সম্প্রচার করা হয়েছিল, যা সর্বত্র আগ্রহ জাগিয়েছে। মির্যার পলায়ন যখন জনগণের মধ্যে ব্যাপক হতাশার সৃষ্টি করে, তখন ২৫ শে আগস্ট লাহোরের শাহী মসজিদে মুসলমানদের একটি বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে সমস্ত ইসলামী নেতৃস্থানীয় আলেমগণ মিম্বরে উঠে বয়ান দিয়েছিলেন। তারা ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর শেষনবী এবং তাঁরপরে আর কোনো ধরণের নবীর জন্ম হবেনা এবং যে এই বিশ্বাসকে অস্বীকার করে সে ইসলামের আওতার বাইরে। লাহোরের উক্ত বিতর্ক থেকে মির্যার পলায়ন তার সুনামকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার পর তিনি বেপরোয়া হয়ে পড়েন। তিনি তার হারানো সুনাম উদ্ধারের জন্য অনেক চেষ্টা চালান। প্রথমে “ইজাযুল মসীহ/ইজাযে মসীহ (اعجاز المسيح)” নামে একটি বইতে সূরা ফাতিহার আরবি তাফসীর প্রকাশ করেন। তারপর সুযোগ বুঝে এক বছর পরে ১৯০১ সালের নভেম্বরে নিজেকে একজন “নবী” ঘোষণা করেন। তার এক বছর পরে তার বেতনভুক্ত মুরিদ মুহাম্মদ হাসান আমরোহীকে দিয়ে “শামসে বাযেগা (شمس بازغة)” নামে একটি বই লিখান, যা খাজা মেহের আলী শাহ (রহ.)-এর “শামসুল হিদায়া” বইয়ের খণ্ডন করার উদ্দেশ্যে ছিল। তার জবাবে খাজা মেহের আলী শাহ (রহ.) বিখ্যাত গ্রন্থ “সাইফে চিশতিয়াই (سيف چشتيائى)” রচনা করেন। বইটির যাদুময় লিখনীশক্তি ছিল অতুলনীয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে উপমহাদেশের বিশিষ্ট আলেম উলেমা তাঁকে এখনো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। এই বইটিতে মির্যার “শামসে বাযেগা” বইয়ের দাঁতভাঙা উত্তর দেওয়া হয়েছে অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে। আজ পর্যন্ত মির্যায়ীরা (কাদিয়ানীরা) এর কোনো যুক্তিই খন্ডন করতে পারেনি। কিন্তু আফসোস! সাধারণ কোনো কাদিয়ানীই এ সমস্ত ঐতিহাসিক বিষয়ে কোনো জ্ঞানই রাখেনা। আল্লাহ তাদেরকে সহীহ বুঝদান করুন। আমীন।
অনুবাদক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী। এডমিন www.markajomar.org