বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।
হিজরত ভূমি নির্ণয় ক্ষেত্রে কি নবীজীর ইজতিহাদি ভুল হয়েছিল?
উত্তর, কোনো নবী রাসূলের ক্ষেত্রে এধরণের প্রশ্ন তোলাই সঠিক নয়। যেহেতু একে তো নবী রাসূলগণের জন্য দ্বীনি বিষয়ে ইজতিহাদ করার প্রয়োজন পড়েনা, দ্বিতীয়ত উনাদের ইজতিহাদী (গবেষণালব্ধ মতের) ভ্রান্তি মূলত ওহীরই ভ্রান্তি হিসেবে গণ্য হবে। কারণ দ্বীনি বিষয়ে নবী রাসূলগণ কখনো ওহী থেকে কোনো অবস্থাতেই বিরত থাকেন না।” বলে রাখা দরকার, শুধুমাত্র দ্বীনি বিষয়ে শরীয়তের দলিল ও নিয়মনীতির ভিত্তিতে উলামায়ে কেরামের গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তকেই ‘ইজতিহাদ’ বলা হবে। সেযাইহোক, নবী রাসূলগণের ক্ষেত্রে ‘ইজতিহাদ’ শব্দ কিজন্য বেমানান, জানতে এই লিখাটি পড়ুন।
রাসূল (সা.)-এর প্রতি এইরূপ অভিযোগ কাদের?
উত্তর, এইরূপ অভিযোগ মির্যা কাদিয়ানী ও তার অনুসারীদের। তাদের দাবী হচ্ছে, দো-জাহানের সরদার হযরত মুহাম্মদ (সা.) আপনা ‘হোদায়বিয়ার যাত্রাকালে’ স্থান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে “ইয়ামামা” আর “হাজর/হিজর” নামক স্থান ভেবে ইজতিহাদি ভুল করেছিলেন’! (দেখুন, হাকীকাতুল ওহী বাংলা অনূদিত পৃষ্ঠা নং ৩২৯)। নাউযুবিল্লাহ।
পাঠকবৃন্দ একটু খেয়াল করুন!
মির্যা গোলাম আহমদ হাদীসের সম্পূর্ণ কনসেপ্ট বিকৃত করে উপস্থাপন করেছে এবং সারা দুনিয়াকে বোকা বানানোর চেষ্টা করেছে। কেননা সঠিক তথ্যটি হচ্ছে, (১) ঐতিহাসিক ‘হোদায়বিয়ার যাত্রা’ ৬ষ্ঠ হিজরীতে হয়েছিল। (২) সেই ‘যাত্রা’ মদীনা থেকে মক্কা অভিমুখে ছিল। (৩) হোদায়বিয়ার যাত্রা সম্পর্কিত বর্ণনায় ‘ইয়ামামা’ (الْيَمَامَةُ) বা হাজর/হিজর (الهجر) নামক স্থানের উল্লেখ-ই নেই। আসুন, হোদায়বিয়ার যাত্রা সম্পর্কেও জেনে নেয়া যাক!
হোদায়বিয়ার সফর বা যাত্রা :
ঐতিহাসিক হোদায়বিয়ার যাত্রা ইতিহাস সম্পর্কে বলতে গেলে, হিজরী ৬ষ্ঠ সনের জ্বিলকদ মাসে হোদায়বিয়ার অভিযান সংঘটিত হয়। এই সনে নবী করীম (সা.) একদা স্বপ্নে দেখেন যে, তিনি তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে মদীনা থেকে মক্কায় গমন করেন এবং সেখানে উমরাহ পালন করলেন। নবী (সা.)-এর স্বপ্ন নিছক একটি স্বপ্ন নয়, বরং সেটিও একধরনের ওহী। সুতরাং এরপর তিনি চৌদ্দশত সাহাবীসহ উমরাহ পালন করার জন্য মক্কা রওয়ানা হলেন। এখন প্রতারক মির্যা কাদিয়ানীর প্রতি প্রশ্ন উঠে যে, এমতাবস্থায় নবী করীম (সা.)-এর বিরুদ্ধে কথিত ইজতিহাদি ভুলের অভিযোগের ভিত্তি কী? আহা! কোটি কোটি লানত এমন নিকৃষ্ট মিথ্যাবাদীর উপর।
নবী রাসূলগণের উপর কথিত ইজতিহাদি ভুলের ট্যাগ লাগানোর কারণ কী?
উত্তরে বলা যায় যে, মির্যা গোলাম আহমদ আল্লাহর নামে যখন তখন বানোয়াট ভবিষ্যৎবাণী প্রচার করত আর ব্যর্থ হত। এটি তার মজ্জাগত স্বভাব ছিল। আর এ সমস্ত ব্যর্থতার দায় এড়ানোর জন্যই নবী রাসূলগণের বিরুদ্ধে সে অবিরাম মিথ্যা অভিযোগ করে যেত। তার অশিক্ষিত মুরিদরা বিনাবাক্যে তা বিশ্বাসও করে নিত। যেমন সে কথিত ওহী ইলহামের কথা বলে কাদিয়ান অধিবাসী জনৈক স্ত্রীলোকের একটি পুত্র সন্তান হবার ভবিষ্যৎবাণী দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে কন্যা সন্তান হয়। আর তার কিছুদিন পরেই স্ত্রীলোকটি মারা যান। (এ সম্পর্কে পড়তে এখানে ক্লিক করুন, ৩ নং ভবিষ্যৎবাণী দ্রষ্টব্য)। মির্যা গোলাম আহমদের জন্য এ সমস্ত অহেতুক ভবিষ্যৎবাণীর দায় এড়ানো ছিল খুবই কঠিন। তাই সে নবী রাসূলগণের উপর ওসব অপবাদ দিয়ে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করত। প্রমাণের জন্য দেখুন, হাকীকাতুল ওহী (বাংলা অনূদিত) পৃষ্ঠা নং ৮০, রূহানী খাযায়েন ২২/৫৭৩। স্ক্রিনশট এই,
এখন যে সমস্ত সহজ সরল কাদিয়ানী (আহমদী) মির্যা কাদিয়ানীর যেনতেন কথাবার্তা অন্ধের মতো এতকাল ধরে বিশ্বাস করে আসছেন এখন তাদের মাথার উপর পুরো আকাশটা কি ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা হল না?
হোদায়বিয়ার যাত্রার সাথে ইয়ামামা বা হিজর-এর প্রাসঙ্গিকতা আছে কি?
উত্তরে বলা যায়, কোনো প্রাসঙ্গিকতাই নেই। কেননা ‘ইয়ামামা’ শব্দ শীর্ষক হাদীসটিতে বলা হচ্ছে, রাসূল (সা.) স্বপ্নে দেখলেন যে, তিনি হিজরত করছেন মক্কা থেকে মদীনা অভিমুখে! অথচ ‘হোদায়বিয়ার যাত্রা’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘মদীনা থেকে মক্কায়‘; রাসূল (সা.)-এর মদনীযুগে ও ৬ষ্ঠ হিজরীতেই। জ্ঞানীরা এখন কিছু বলুন!
এখন আমরা রাসূল (সা.)-এর হাদীস থেকেই দেখব যে, হিজরত সংশ্লিষ্ট ঐ কথাটিতে “ইয়ামামা” শব্দটি কিভাবে উল্লেখ আছে?
রাসূল (সা.) থেকে যেই হিজরত সম্পর্কে স্বপ্নে দেখার ঘটনা বর্ণিত আছে সেটি ‘হোদায়বিয়ার যাত্রা’ ছিলনা, বরং মক্কা থেকে মদীনা অভিমুখে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক হিজরতই ছিল, যেই হিজরতে রাসূল (সা.)-এর সফরসঙ্গী মাত্র ২জন ছিলো। এই পর্যায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, রাসূল (সা.) সাহাবীদেরকে সেই হিজরতের ভূমি সম্পর্কে না ইজতিহাদ করেন আর না আগাম কোনো তথ্যই দেন, কিছুই করেননি, প্রয়োজনও ছিল না; যেহেতু একজন ওহীর বাহক কখনো ইজতিহাদের মুখোমুখি হন না। সুতরাং এ জন্যই এখানেও রাসূল (সা.) থেকে কোনো ইজতিহাদি গলতি হয়েছিল বলা নিতান্তই গর্হিত কাজ এবং জঘন্য মিথ্যাচার। এখন আমরা দেখব যে, এই হিজরত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসটি কীরকম? আমি হাদীসটির উদ্দিষ্ট অংশটি এখানে উল্লেখ করছি। (অর্থাৎ) “রাসূল (সা.) স্বপ্নে হিজরত ভূমিকে “খেজুরগাছ” সমৃদ্ধরূপে দেখতে পেয়েছিলেন (إِلَى أَرْضٍ بِهَا نَخْلٌ)। তিনি এভাবে স্বপ্নে দেখার পরপরই মনে মনে ধারণা করেছিলেন যে, খেজুরগাছ সমৃদ্ধ সেই এলাকাটি হয়ত ইয়ামামা অথবা হাজর/হিজর নামক স্থান হবে (وَهَلِي إِلَى أَنَّهَا الْيَمَامَةُ أَوْ هَجَرُ)। কিন্তু পরবর্তীতে হিজরত মদীনায় হওয়াতে রাসূল (সা.)-এর মনের সংশয় দূর হয়ে যায় এবং নিশ্চিত হন যে, খেজুরগাছ সমৃদ্ধ সেই ভূমিটি ‘ইয়ামামা’ কিংবা ‘হাজর/হিজর’ কোনোটাই নয়, বরং ইয়াসরিব তথা মদীনা-ই। ব্যাস, বিষয়টি এই পর্যন্তই।
এখন এটিকে ইজতিহাদি গলতি বলা কিভাবে বৈধ হতে পারে? কোনো কাদিয়ানী কি বলবেন ‘ইজতিহাদ‘ কাকে বলে আর ইজতিহাদ করা কাদের বৈশিষ্ট্য? নবী রাসূলগণের না সাধারণদের? উল্লেখ্য, মির্যা কাদিয়ানীর মতে “নবী’র ইজতিহাদী (গবেষণালব্ধ মত) ভুল মূলত ওহীরই ভুল। কেননা নবী কখনো ওহী থেকে কোনো অবস্থাতেই বিরত থাকেন না।” (রূহানী খাযায়েন: ৫/৩৫৩; রচনাকাল ১৮৯২ইং)। স্ক্রিনশট এই,
- (১) ইয়ামামা (يمامة) হল, আধুনিক সৌদি আরবের দক্ষিণ-পূর্ব নজদের একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল। যাইহোক, মির্যা কাদিয়ানী কত নিকৃষ্ট মিথ্যুক হলে সে নিজের দুর্বলতা ঢাকতে আল্লাহর সত্য নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সত্তাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে পেছনে দৌঁড়তে পারে, অনর্থক দাবী করে লিখতে পারে যে, রাসূল (সা.) হিজরতের ভূমি ‘ইয়ামামা’ সাব্যস্ত করে ইজতিহাদি ভ্রান্তির শিকার হন! নাউযুবিল্লাহ, ছুম্মা নাউযুবিল্লাহ।
- (২) হাজর/হিজর (هجر) হচ্ছে, সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় একটি প্রাচীন শহর, যেটির বর্তমান নাম ‘আল ইহছা‘, (الاحساء) ; শহরটি রাজধানী রিয়াদ থেকে পূর্বে প্রায় ৩২৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
হাদীসটি অনুবাদ সহ :
আবু আমির আব্দুল্লাহ ইবনু বাররাদ আশআরী ও আবূ কুরায়র মুহাম্মদ ইবনু আলা (রহ.) … আবু মূসা (রা.) সূত্রে নবী করীম (সা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, رَأَيْتُ فِي الْمَنَامِ أَنِّي أُهَاجِرُ مِنْ مَكَّةَ إِلَى أَرْضٍ بِهَا نَخْلٌ فَذَهَبَ وَهَلِي إِلَى أَنَّهَا الْيَمَامَةُ أَوْ هَجَرُ فَإِذَا هِيَ الْمَدِينَةُ يَثْرِبُ وَرَأَيْتُ فِي رُؤْيَاىَ هَذِهِ أَنِّي هَزَزْتُ سَيْفًا فَانْقَطَعَ صَدْرُهُ فَإِذَا هُوَ مَا أُصِيبَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ أُحُدٍ ثُمَّ هَزَزْتُهُ أُخْرَى فَعَادَ أَحْسَنَ مَا كَانَ فَإِذَا هُوَ مَا جَاءَ اللَّهُ بِهِ مِنَ الْفَتْحِ وَاجْتِمَاعِ الْمُؤْمِنِينَ وَرَأَيْتُ فِيهَا أَيْضًا بَقَرًا وَاللَّهُ خَيْرٌ فَإِذَا هُمُ النَّفَرُ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ أُحُدٍ وَإِذَا الْخَيْرُ مَا جَاءَ اللَّهُ بِهِ مِنَ الْخَيْرِ بَعْدُ وَثَوَابُ الصِّدْقِ الَّذِي آتَانَا اللَّهُ بَعْدُ يَوْمَ بَدْرٍ.
অর্থাৎ আমি স্বপ্লে দেখলাম যে, আমি মক্কা থেকে এমন এক দেশে হিজরত করতে যাচ্ছি যেখানে খেজুর গাছ রয়েছে। তাতে আমার ধারণা এদিকে গেল যে, তা ইয়ামামা কিংবা হাজর/হিজর (এলাকা) হবে। পরে (বাস্তবে) দেখি যে, তা হল মদীনা (যার পূর্ব নাম) ইয়াসরিব। আমি আমার এ স্বপ্নে আরও দেখলাম যে, আমি একটি তরবারি নাড়াচাড়া করলাম, ফলে তার মধ্যখানে ভেঙ্গে গেল। তা ছিল উহুদের দিনে, যা মুমিনগণের উপর আপতিত হয়েছিল।
পরে আমি আরেকবার সেই তরবারি নাড়া দিলে তা আগের চাইতে উত্তম হয়ে গেল। মুলত তা হল সেই বিজয় ও ঈমানদারদের সম্মিলন, সংহতি যা আল্লাহ সংঘটিত করলেন (তথা মক্কা বিজয়)। আমি তাতে একটি গরুও দেখলাম। আর আল্লাহ তা’আলাই কল্যাণের অধিকারী। মূলত তা হল উহুদের যুদ্ধে (শাহাদাতপ্রাপ্ত) ঈমানদারগণের দলটি। আর কল্যাণ হল সে কল্যাণ, যা পরবর্তীতে আল্লাহতালা দান করেছেন এবং সততা ও নিষ্ঠার সে সাওয়াব ও প্রতিদান যা আল্লাহতালা আমাদের বদর যুদ্ধের পরে দিয়েছেন। [সহীহ মুসলিম (ইফা.) অধ্যায়: ৪৪/ স্বপ্ন (كتاب الرؤيا) হাদিস নম্বরঃ ৫৭৩৫]।
শেষকথা, ভ্রষ্ট কাদিয়ানী জামাত সহ আরো যত অমুসলিম সম্প্রদায় নিজেদের মুসলিম পরিচয় দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে থাকে তাদের উচিত, নিজেদের হীনস্বার্থে এই জাতীয় সমস্ত অপপ্রচার থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ আমাদেরকে প্রকৃত সত্যটা বুঝার তাওফিক দিন। আমীন।
লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী।