নামাযে কোথায় হাত বাঁধা উত্তম?
হানাফীদের দলিল সহীহ হাদীস থেকে
নামাযের মধ্যে হাত কোথায় বাঁধা উত্তম, এ নিয়ে ফোকাহায়ে কেরাম (ইসলামি আইনশাস্ত্রবিদ)গণের মাঝে শুধুমাত্র উত্তম-অনুত্তম প্রশ্নে মতপার্থক্য রয়েছে। সেটি হল, হাত নাভীর নিচে বাঁধবে নাকি উপরে! শায়খ মুবারকপুরী (রহ.) তার তিরমিজি শরিফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ تحفة الأحوذى (তুহফাতুল আহওয়াজি)-তেও (২/৭৪-৭৮) একথাই লিখেছেন। যেমন তিনি লিখেন, أَنَّ الِاخْتِلَافَ بَيْنَهُمْ في الْوَضْعِ فَوْقَ السُّرَّةِ وَتَحْتَ السُّرَّةِ إنما هو في الِاخْتِيَارِ وَالْأَفْضَلِيَّةِ অর্থাৎ ‘এই ইমাম চতুষ্টয়ের মধ্যকার মতপার্থক্য হচ্ছে, নামাযে দুইহাত নাভীর নিচে রাখা উত্তম নাকি উপরে রাখা উত্তম!’ তবে ‘বুকের উপর বাঁধা’ সংক্রান্ত চূড়ান্ত কোনো মতের উল্লেখ প্রসিদ্ধ চার ইমামের কারো থেকে পাওয়া যায় না। যেহেতু ইমাম শাফেয়ীর মত (ফতুয়া) ‘আল-মাজমূ শরহুল মুহাজ্জাব’ গ্রন্থে (المجموع شرح المهذب) পরিষ্কার লিখা আছে এইভাবে যে, و يجعلها تحت صدره و فوق سرته، هذا هو الصحيح المنصوص অর্থাৎ ‘উভয় হাত বুকের নিচে ও নাভীর উপরে বাঁধবে, শাফেয়ী মাযহাবের প্রকৃত ও সুস্পষ্ট মত এটাই।’ একথা লিখেছেন, ইমাম মহীউদ্দীন আন-নববী আশ-শাফেয়ী। আর ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের চূড়ান্ত ও অগ্রগণ্য মত কীরকম—সে সম্পর্কেও অনুসন্ধান করে পাওয়া যায় যে, ‘মুখতাসারে খিরাকি’ (مختصر الخرقى) কিতাবে পরিষ্কার লিখা আছে, و يجعلها تحت سرته অর্থাৎ দুই হাত নাভীর নিচে বাঁধবে। (লিখক, ইমাম আবুল কাশেম উমর ইবনুল হুসাইন ইবনু আব্দিল্লা ইবনে আহমদ আল খিরাকি)। কিতাবটির ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘আল মুগনী’-তে (১/৫১৪) হাম্বলী মাযহাবের পক্ষ হতে অবশ্য মোট তিনখানা মত উল্লেখ রয়েছে। তবে চূড়ান্ত মত ‘নাভীর নিচে বাঁধা’ই। আর ইমাম মালেকের মতে তো و ندب إرسالهما অর্থাৎ হাত ছেড়ে দাঁড়ানোই মুস্তাহাব। (দেখুন, আল্লামা দারদী আল-মালেকী কৃত শরহে সগীর)। আর ইমাম আবু হানীফা’র মত তো সবারই জানা, নাভীর নিচে এমনভাবে হাত বাঁধা যেন নাভী হাতের উপরের অংশে লেগে থাকে। এটাই উত্তম।
পক্ষান্তরে আহলে হাদীসবন্ধুদের মতে, হাত বাঁধতে হবে বুকের উপর। তাঁদের মতের পক্ষেও দলিল রয়েছে। তাদের সব চেয়ে শক্তিশালী দলিল হল, হযরত ওয়ায়েল ইবনে হুজর (রা.) বলেছেন, আমি রাসূল (সা.)-এর পেছনে নামায পড়েছি। (আমি দেখলাম) فوضع يده اليمنى على يده اليسرى على صدره অর্থাৎ তিনি তাঁর ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে বুকের উপর রেখেছেন। (সহীহ ইবনে খুযাইমা ৩/৩১৩)। তাহকীক, এর সনদে ‘মু’আম্মাল ইবনে ইসমাইল’ নামীয় রাবীকে ইমাম বুখারী (রহ.) ‘মুনকারুল হাদীস’ (منكر الحديث) বলেছেন, ইমাম আবু যুর’আ আর-রাজী বলেছেন, في حديثه خطأ كثير অর্থাৎ হাদীস বর্ণনায় সে খুব বেশি ভুল করত। (তাহযীবুল কামাল ১৮/৫২৬; তাযীবুত তাহযীব ১০/৩৪০; মীযানুল ইতিদাল ৮৯৪৯ দ্রষ্টব্য)। কিন্তু শায়খ ইবনুল কাইয়ুম (রহ.)-এর ‘ইলামুল মুয়াক্কিয়ীন’ গ্রন্থে লিখা আছে, উক্ত রেওয়ায়েতে على صدره (বুকের উপর) এই অংশটি ঐ রাবীরই নিজেস্ব বৃদ্ধি, যার অন্যতম প্রমাণ সহীহ মুসলিমেও বর্ণনাটি ওয়ায়েল ইবনে হুজর থেকে ভিন্ন সহীহ সনদে এসেছে, কিন্তু সেখানে على صدره (বুকের উপর) এই অংশটি নেই। যাইহোক, সনদ যেমনই হোক; বুকের উপর হাত বাঁধা’র একাধিক বর্ণনাও যে রয়েছে তা কিন্তু ঠিক। মোটকথা, ইমাম চতুষ্টয় আর আহলে হাদীস দু’দিকেই দলিল-প্রমাণ থাকা সাব্যস্ত।
এবার হানাফীদের মতের সমর্থনে শুধু একখানা টাটকা সহীহ হাদীস পেশ করা হবে, ‘সাইয়্যেদুল হুফফাজ’ (سيد الحفاظ) উপাধিখ্যাত ও ইমাম বুখারী, মুসলিম সহ সিয়াহ সিত্তা’র চারজন মুহাদ্দিসের উস্তাদ, ইমাম আবুবকর আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবী শায়বাহ (১৫৯-২৩৫ হিজরী) সংকলিত হাদীসগ্রন্থ ‘মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ’ থেকে। সনদ নিম্নরূপ,
শায়খ ইবনে আবী শায়বাহ, ওয়াকী ইবনুল জাররাহ, মূসা ইবনে উমায়ের, আ’লক্বামাহ ইবনে ওয়ায়েল, সাহাবী হযরত ওয়ায়েল ইবনে হুজর (রা.)। (রাবীদের সবাই ছিকাহ)। এবার হাদীসের অনুবাদ,
(হাদীস) সাহাবী ওয়ায়েল ইবনে হুজর (রা.) বলেছেন, رأيت النبي صلى الله عليه وسلم يَضَعُ يَمِينَهُ على شِمَالِهِ تَحْتَ السُّرَّةِ অর্থাৎ ‘আমি নবী করীম (সা.)-কে দেখেছি, তিনি তাঁর ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে নাভীর নিচে রেখেছেন।‘ (হাদীসের মান, সহীহ; রাবীদের সবাই বুখারীর রাবী)। এবার কয়েকজন হাদীস বিশারদের উক্তি পেশ করছি,
(১) মিশর বংশোদ্ভূত ইমাম আবুল ফিদা যায়নুদ্দীন কাশেম ইবনে কুতলুবুগা (الْحَافِظُ الْقَاسِمُ بن قُطْلُوبُغَا) (৪০২-৪৭৯ হিজরী) তার تَخْرِيجِ أَحَادِيثِ الِاخْتِيَارِ شَرْحِ الْمُخْتَارِ নামীয় গ্রন্থে লিখেছেন, هذا سَنَدٌ جَيِّدٌ অর্থাৎ এই সনদটি খুবই ভালো।
(২) শায়খ শামসুদ্দীন আবু তাইয়েব আল মাদানী আল মালেকী (মৃত. ৯৬৩ হিজরী) (أبو الطَّيِّبِ الْمَدَنِيُّ) তার شَرْحِ التِّرْمِذِيِّ নামীয় গ্রন্থে লিখেছেন, هذا حَدِيثٌ قَوِيٌّ من حَيْثُ السَّنَدِ অর্থাৎ এই হাদীস সনদের দিক থেকে খুবই শক্তিশালী।
(৩) শায়খ মুহাম্মদ আবেদ আস সিন্দী আল আনসারী (১১৯০-১২৫৭) (عَابِدٌ السِّنْدِيُّ) তার طَوَالِعِ الْأَنْوَارِ নামীয় গ্রন্থে লিখেছেন, رِجَالُهُ ثِقَاتٌ অর্থাৎ এর সমস্ত রাবী সিকাহ বা বিশ্বস্থ।
- তবে এর সনদের উপরেও আপত্তি তোলার চেষ্টা করা হয়। শায়খ মুহাম্মদ হায়াত আস সিন্দী তার ‘ফাতহুল গাফূর’ পুস্তকে লিখেছেন, যদিও এর সনদ সহীহ কিন্তু বর্ণনায় تَحْتَ السُّرَّةِ অংশটুকু মুসনাদে আহমদ গ্রন্থের বর্ণনায় নেই। অথচ একই রাবী থেকে বর্ণিত। হতে পারে ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে উল্লিখিত ইমাম ইবরাহীম নাখয়ী (রহ.) কৃত একটি আছার (বর্ণনা)-এর মধ্যে تَحْتَ السُّرَّةِ অংশটুকু থাকায় কাতেব ভুল করে ঐ রেওয়ায়েতেও লিখে ফেলেন!
উত্তরে বলা হবে যে, (ক) ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিজরী) ছিলেন মুসান্নাফ-এর সংকলকের একজন ছাত্র। ‘মুসান্নাফ’ (المصنف) কিতাব যখন সংকলন হয় তখন আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) কলমও ধরেননি। এমতাবস্থায় আহমদ ইবনে হাম্বলের সংকলনে ঐ অংশটুকু উল্লেখ না থাকার দরুন একথা কিভাবে বলা যায় যে—’অতএব মুসান্নাফ কিতাবে অংশটুকু কাতেব ভুল করে লিখে ফেলেন’! এ সংক্রান্ত আরও যত উদ্দেশ্যমূলক ছিদ্রান্দ্বেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে তার জবাব দেয়া হয় আবুদাউদ শরীফের আরবী ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘বাজলুল মাজহূদ’-এর (২/২৩) মধ্যে।
(খ) সহীহ ইবনে খুযাইমা’র রেওয়ায়েতে على صدره উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও সহীহ মুসলিমের রেওয়ায়েতে على صدره অংশটুকু নেই। বরং সেখানে وضع يده اليمنى على اليسرى পর্যন্ত এসেই শেষ। অথচ একই রাবী থেকে বর্ণিত। এখন যারা উসূলে হাদীস (علم المصطلحات الاحاديث) না বুঝার দরুন এধরণের আপত্তি তুললেন তারা হুবহু ঐ একই যুক্তিতে على صدره অংশটুকুও সহীহ মুসলিমে না আসার কারণ কী ব্যাখ্যা দেবেন? তবে কি ‘ইবনে খুযাইমা’র রেওয়ায়েতেও কাতেবের ভুল হয়ে গিয়েছিল বলবেন? কোনো উত্তর থাকেনা।
(গ) ‘মুসান্নাফ’ কিতাব সংকলনের আগ থেকেই ইমাম চতুষ্টয় নাভির উপর বা নিচে হাত রাখা সুন্নাহ ও উত্তম বলে রায় দেয়াই প্রমাণ করে যে, “নাভির নিচে” শব্দটি মুসান্নাফের বর্তমান নুসখার ন্যায় মূল নুসখাতেও ছিল। যদি কোনো কোনো নুসখায় সত্যিই এই অংশটি না থাকার অভিযোগ সত্য-ও হয় তাতে ইমাম চতুষ্টয়ের সম্মিলিত ফতুয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বেনা। যেহেতু একই সাথে চার চারজন দুনিয়া বিখ্যাত ও সুপ্রসিদ্ধ ইমাম নামাযে হাত ‘নাভির নিচে’ রাখার মত ব্যক্ত করে ভ্রান্তির শিকার হয়েছেন, এটা বিবেক-বহির্ভূত কথা। একই সাথে চারজন ইমামের চোখ কখনো ফাঁকি দেয়া যায় না। এটাই যুক্তিযুক্ত।
শেষকথা, দু’দিকেরই যার যার মতের পক্ষে দলিল প্রমাণ থাকা সাব্যস্ত। কাজেই ‘শুধু একটাকে ধরো আর আরেকটা ছাড়ো’—নীতিটাই ঠিক না। বরং উভয়টাই রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহ মনে করে আঁকড়ে ধরতে হবে। রাসূল (সা.)-এর কোনো কোনো সুন্নাহর ন্যায় এই সুন্নাতেও বৈচিত্র্য আনতে হবে। যে যেটা ইচ্ছে আমলে নিবে, তবে অন্যটাকেও স্বীকার করতে হবে। নইলে রাসূল (সা.)-এর অনেকগুলো সুন্নাহর মধ্যে কোনো একটি সুন্নাহর প্রতি নিজেরই অজান্তে বিদ্বেষ রাখার দরুন বিচারদিবসে নিঃসন্দেহে আমাকে-আপনাকে পাকড়াও হতে হবে। মা’আজাল্লাহ। আল্লাহ আমাদের বুঝার তাওফিক দিন।
লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী এম.এ