কাদিয়ানীদের লিটারেচার হতে বাহাউল্লাহর মসীহ দাবীর প্রমাণ,

প্রশ্ন হল, বাহাউল্লাহ ইরানী সাহেব মসীহ মওউদ দাবী করেছিলেন, এর প্রমাণ কী?
উত্তর, আজকের এই লিখাটি লিখার উদ্দেশ্য হল, কাদিয়ানী তথা মির্যায়ী লিটারেচার সমূহে একটি তথাকথিত মূলনীতি খুব জোরেশোরে উচ্চারিত হতে দেখি, তা হল, রাসূল (সা.)-এর মোট নবুওয়তের ২৩ বছর জীবন-জিন্দেগি অতিক্রম করা কোনো মিথ্যা নবুওয়তের দাবীদারের জন্য সম্ভব নয়, যদি কখনো কোনো দাবীদার তা অতিক্রম করতে সক্ষম হয় তাহলে সে সত্যবাদী বলেই সাব্যস্ত হবে। তাদের দাবী হল, সূরা আল হাক্কাহ আয়াত নং ৪৪-৪৬ অনুসারে কোনো মিথ্যা দাবীদারকে আল্লাহ কখনো ছাড় দেননা, পাকড়াও করে থাকেন। এমন ব্যক্তিকে আল্লাহ কোনোভাবেই ন্যূনতম ২৩ বছরের দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অবকাশ দেননা। এই নির্বোধরা তারপর বলে থাকে, মির্যা কাদিয়ানী আপনা দাবীতে প্রায় ২৩ বছরেরও অধিক সময় অতিক্রম করেছিলেন, আল্লাহ তাকে সেই দীর্ঘ সময়ব্যাপী পাকড়াও করেননি। সুতরাং মির্যা কাদিয়ানী মিথ্যাবাদী নন, বরং সত্য। (এই হচ্ছে তাদের মূলনীতি)।
আমি আজকে এখানে তাদের সেই মনগড়া মূলনীতির গঠনমূলক দাঁতভাঙা উত্তর দেব, ইনশাআল্লাহ। প্রথমত, কাদিয়ানীদের উল্লিখিত মূলনীতি ঠিক নয়, বরং আগাগোড়াই গলদ। এই সম্পর্কিত আলোচনায় একটু পরেই আসছি। দ্বিতীয়ত, সূরা আল হাক্কাহ, আয়াত নং ৪৪-৪৬ কোনো ভাবেই সেরকম কোনো মূলনীতির জন্য সাপোর্টিং এভিডিয়েন্স নয় যেভাবে কাদিয়ানীরা বিশ্বাস করে।
- সূরা আল-হাক্কাহ আয়াত ৪৪-৪৬, আল্লাহতালা বলেন, وَ لَوۡ تَقَوَّلَ عَلَیۡنَا بَعۡضَ الۡاَقَاوِیۡلِ অর্থ, সে যদি আমার নামে কিছু রচনা করে চালাতে চেষ্টা করত।’ لَاَخَذۡنَا مِنۡہُ بِالۡیَمِیۡنِ অর্থ, তবে অবশ্যই আমি তার ডান হাত ধরে ফেলতাম’। ثُمَّ لَقَطَعۡنَا مِنۡہُ الۡوَتِیۡنَ অর্থ, এবং কেটে দিতাম তার জীবন-ধমনী।‘ বলে রাখা জরুরি যে, এই শাস্তি কেবলমাত্র সত্যনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ব্যাপারে বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে। এ থেকে উদ্দেশ্য তাঁর সত্যতার বিকাশ। এতে কোনো মূলনীতির কথা বর্ণনা করা হয়নি যে, যে ব্যক্তিই নবী হওয়ার মিথ্যা দাবী করবে, তাকেই সত্বর শাস্তি প্রদান করব। কাজেই নবুওয়তের কোনো মিথ্যা দাবীদারকে এই ভিত্তিতে সত্য সাব্যস্ত করা যাবে না যে, দুনিয়াতে সে আল্লাহর পাকড়াও থেকে যেহেতু রেহাই পেয়েছে সেহেতু সে সত্য। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাবলী থেকেও প্রমাণিত যে, নবুওয়তের অনেক মিথ্যা দাবীদারকে আল্লাহ ঢিল দিয়েছেন এবং তারা দুনিয়াতে তাঁর পাকড়াও থেকে নিরাপত্তা লাভ করেছে। যেজন্য আল্লাহর ঐ শাস্তির ধমককে মূলনীতি মনে করে নিলে তখন নবুওয়তের বহু মিথ্যা দাবীদারদেরকে সত্য নবী বলে মেনে নিতে হবে। বাহায়ী জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মির্যা হোসাইন আলী নূরী ওরফে বাহাউল্লাহ তন্মধ্যে অন্যতম। কারণ বাহাউল্লাহ (১৮১৭-১৮৯২) সাহেবও নবী রাসূল এবং মসীহ মওউদ দাবী করার পর আরও প্রায় চল্লিশ বছর বেঁচে ছিলেন। (দৈনিক আল হিকাম, নভেম্বর ১৯০৪ ইং পৃ. ১৯)।
বাহাউল্লাহ’র নবুওয়তে ওহী এবং মসীহ মওউদ দাবী :
(১) বাহায়ী জামাতের প্রতিষ্ঠাতা জনাব বাহাউল্লাহ সাহেব ১২৬৯ হিজরীতে নিজেকে ‘প্রতিশ্রুত মসীহ‘ বলে দাবী করেছিলেন। আর তিনি পরবর্তীতে ১৩০৯ হিজরী পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। (দৈনিক আল-হিকাম (الحكم)। উল্লেখ্য, আল-হিকাম একটি উর্দূ পত্রিকা। এটি কাদিয়ানী জামাতের নিজেস্ব একটি অফিসিয়াল পত্রিকা, গুরুদাসপুর জেলার (পাঞ্জাব, হিন্দুস্তান) কাদিয়ান দারুল আমান থেকে ১৮৯৭ সাল থেকে সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়ে আসলেও পরবর্তীতে এটি ১৯০৬ সাল থেকে ‘দৈনিক‘ পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। পত্রিকাটির ডাউনলোড লিংক।
(২) বাহাউল্লাহ ইরানী সাহেব দাবী করেছিলেন যে, আমার প্রতি খোদার ওহী প্রকাশিত হয়েছে। (রেফারেন্স, দৈনিক আল হিকাম, ভলিউম ৮, নম্বর ৯, তারিখ ১৭ নভেম্বর ১৯০৪, পৃ. ১৯)।
(৩) বাহাউল্লাহ ইরানী সাহেব প্রতিশ্রুত মসীহ দাবীর পর আরও প্রায় চল্লিশ বছর বেঁচেও ছিলেন এবং তিনি শেষ পর্যন্ত তার দাবিতে অবিচল ছিলেন। (দৈনিক আল হিকাম, নভেম্বর ১৯০৪ ইং পৃ. ১৯)। (২ এবং ৩ নং এর জন্য স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য)।


পরিশেষ :
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! এবার নিজেরাই চিন্তা করুন, এই কাদিয়ানী সম্প্রদায় মির্যা কাদিয়ানীর নবুওয়ত দাবী হালাল করার জন্য কতটা নিচে নামতে পারে! কিভাবে জঘন্য ব্যাখ্যা আর অযথা যুক্তিতর্কেও জড়াতে পারে! এদের উক্ত যুক্তি সত্য হলে তখন বাহায়ী জামাতের প্রধান বাহাউল্লাহ আর তার জামাতও সত্য সাব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে কিনা? এমতাবস্থায় মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী আপনা প্রতিশ্রুত মসীহ দাবীতে কিভাবে সত্য হন?
বলে রাখা জরুরি, বাহায়ীদের প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যান অনুসারে ১৯৮৬ সালে বিশ্বে বাহাই ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা ছিলো ৪০ লক্ষ ৭৪ হাজার, এবং বৃদ্ধির হার ছিল ৪.৪%। বাহায়ী সূত্রমতে ১৯৯১ পর্যন্ত সারা বিশ্বে বাহায়ী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫০ লক্ষেরও বেশি। ওয়ার্ল্ড ক্রিশ্চিয়ান এনসাইক্লোপিডিয়া, ২০০১ সালের এক জরিপে (পৃ. ৪) প্রকাশ করে যে, ২০০০ সালে বিশ্বে বাহাই অনুসারীর ছিলো সংখ্যা প্রায় ৭০ লক্ষ ১০ হাজার, এবং ২১৮টি দেশে এদের অনুসারী রয়েছে। এদের কেবলা আক্কা (বর্তমান ইসরাইলের হাইফা শহর), নামায তিন ওয়াক্ত, নারী পুরুষের মাঝে পর্দার বিধান নেই। এদের হিসেবে ১৯ দিনে এক মাস, ১৯ মাসে ১ বছর। তাদের রোজাও মাত্র ১৯টি। এদের মধ্যে নামায মাত্র তিন ক্যাটাগরির মানুষের জন্য। বৃদ্ধদের জন্য কোনো নামায নেই। আর পানি পাওয়া না গেলে তখন তিনবার ‘বিসমিল্লাহিল আত্বহার’ বলে শরীরে ফুঁ দিয়েও নামায পড়া জায়েজ। এদের উপাসনালয় সমূহ সব ধর্মের অনুসারীদের জন্য উন্মুক্ত। বাহাউল্লাহ ইরানী একই সাথে একজন নবী ও রাসূল দাবীদারও। ইলাহিয়তের দাবীও ছিল। তার সুস্পষ্ট বক্তব্য, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়ত ও রেসালতের ক্রমধারা তথা ইসলাম বারো শত বছর পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল, তারপর থেকে ইসলাম রহিত ও বাতিল। এখন থেকে শুধুই বাহাউল্লাহর নবুওয়ত ও রেসালত চলবে। বাহাউল্লাহর পুত্র আব্দুল বাহা’র রচনা মতে, বাহায়ীরা তাঁদের বর্তমান দূত বাহাউল্লাহ’র আবির্ভাবের ১০০০ বছরের মধ্যে ঈশ্বরের আর কোনো দূতের আবির্ভাবে বিশ্বাস করে না। বাহাউল্লাহর মৃত্যুর পর তার পুত্র আব্বাস এফেন্দী ওরফে আব্দুলবাহা তারপর শোঘি এফেন্দী বাহায়ী জামাতের হাল ধরেন। তারপর ১৯৬৩ সালের পর থেকে নেতৃত্বের চরম দ্বন্দ্ব দেখা দেয়ায় বাহায়ী জামাত সিট অফ দ্য ইউনিভার্সাল হাউস অফ জাস্টিস, (বাহায়ীদের পরিচালনা পর্ষদ) দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে প্রধানকেন্দ্র হাইফা (ইসরাইল) থেকে। প্রধানতম ধর্মগ্রন্থ কিতাবুল আক্বদাস, আল বয়ান এবং কিতাবুল ইতক্বান। মুসলিম উম্মাহার সকল স্কলারের সর্বসম্মত ফতুয়ায় বাহায়ী জামাত ইসলামের গণ্ডি থেকে বহিষ্কৃত ও একটি স্বতন্ত্র ধর্মমত। তবে বর্তমানে বাহাউল্লাহ’র গুরু আলী মুহাম্মদ বাব এর অনুসারীরা ছোটখাটো অনেক ভাগে বিভক্ত। তন্মধ্যে বাবী সুবহে আযলী, বাবী বাহাউল্লাহ, বাহায়ী-আব্বাস এফেন্দী, বাহায়ী-মির্যা মুহাম্মদ আলী অন্যতম। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন! আমীন।
লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী