প্রশ্নকর্তা : আগের সেই ঈসা (আ.) পৃথিবীতে আবার যদি আসেন তাহলে তো তাঁকে আধুনিক যুগের সব নিয়ম-কানুন নতুন করে শিখতে হবে, তিনি হিব্রু ভাষায় কথা বলতেন, আর এখন সেই ভাষা প্রায় বিলুপ্ত; তাহলে তিনি আবার এলে নতুন কোনো ভাষা শিখবেন কার কাছ থেকে? ইত্যাদি ইত্যাদি!
উত্তর : প্রথমত, প্রশ্নকারীর প্রশ্নটাই সঠিক নয়। কেননা কোনো ধার্মিক বা বিশ্বাসীর পক্ষে এমন ধরণের চিন্তা করাই অসম্ভব, বরং এধরণের প্রশ্ন শুধুই নাস্তিক কিবা ধর্মদ্রোহী অবিশ্বাসীদের পক্ষেই মানায়। জনৈক প্রশ্নকর্তা কাদিয়ানী মতবাদের অনুসারী হয়ে এধরণের প্রশ্ন যখন করেন তখন তিনি কিজন্য নিজেদের ঐ বিশ্বাসটিও ভুলে যান যে, ঈসা (আ.) জেরুজালেম ছেড়ে ভারতের কাশ্মীরের শ্রীনগরেও গিয়েছিলেন এবং আমৃত্যু সেখানেই ছিলেন। এমতাবস্থায় তাদের উদ্দেশ্যে একই প্রশ্ন তো আমাদেরও যে, হিব্রুভাষী হযরত ঈসা (আ.) কাশ্মীরে গিয়ে কোন ভাষায় কথা বলেছিলেন? অবশ্যই হিব্রু ভাষায় নয় বরং কাশ্মীরীদের ভাষায় কথা বলেছিলেন! তো কাশ্মীরী ভাষা তিনি কার কাছ থেকে শিখলেন?
- প্রসঙ্গত, ১৯২২ সালে হিব্রু ব্রিটিশ প্যালেস্টাইনের সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়। ইসরায়েলে প্রায় ৫০ লক্ষের বেশি লোক হিব্রু ভাষায় কথা বলেন। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রায় কয়েক লক্ষ লোক হিব্রুতে কথা বলেন। বর্তমানে আরবির পাশাপাশি হিব্রু ইসরায়েলের সরকারি ভাষা। সুতরাং হিব্রু ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে এমন দাবী কাদিয়ানীদের হয়ত অজ্ঞতা আর নয় কাঁচা মিথ্যাচার! (ফেইসবুক থেকে)।
আসুন, প্রশ্নকারীর যুক্তির প্রতিউত্তরে এবার দুই-এক্কান কথা বলি! আল্লাহতালা এক রাত্রিতেই প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদীকে নেতৃত্বের যোগ্য করে পাঠানোর কথা সহীহ হাদীসে (ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৩৩১৬) (يُصْلِحُهُ اللَّهُ فِي لَيْلَةٍ) বর্ণিত থাকাই কি ইংগিত করেনা যে, তিনি হযরত ঈসা (আ.)-কেও যুগের দাবী মোতাবেক যোগ্য করে যথাসময়ে আকাশ থেকে ফেরেশতাদ্বয়ের মাধ্যমে দুনিয়ায় পাঠাবেন! জ্ঞানীদের জন্য নবীকরীম (সা.)-এর ইংগিতপূর্ণ বাণীসমূহের আলোকে শিক্ষা লাভ করা যথেষ্ট নয় কি? আহা! নির্বোধরা আল্লাহর কুদরতেরও পরীক্ষা নিতে চায়! নাউযুবিল্লাহ।
তর্কের খাতিরে মানলাম যে, ঈসা (আ.) আধুনিক এই যান্ত্রিক যুগে আগমন করলে তিনি এগুলা শিখবেন কার কাছ থেকে? প্রশ্নকারীর উদ্দেশ্য হল, এইধরণের যুক্তি দিয়ে বনী ইসরাইলের প্রতি প্রেরিত ঈসা (আ.)-কে মৃত বলে সাব্যস্ত করা ও তদস্থলে মির্যা কাদিয়ানীকে রূপক ঈসা বলে প্রতিষ্ঠিত করা। মনে হচ্ছে যুক্তিতে তিনি অক্করে শিরোপা জিত্তা ফেলাইছেন!
এবার আপনাকে আমার প্রশ্ন, হযরত ঈসা (আ.)-এর আগমন যে আধুনিক এই যান্ত্রিক যুগেই হবে, আপনি এই সংবাদটা আমদানি করলেন কোত্থেকে? আধুনিক এই যান্ত্রিক সভ্যতার যে কখনো বিলুপ্তি হবেনা এবং এই যুগটা যে তীর ধনুক আর বর্শার যুগে উপনীত হবেনা; আপনারে এমন গ্যারান্টি কে দিল?
ঈসা (আ.) তীর ধনুক আর বর্শার সভ্যতার যুগেই দুনিয়ায় ফিরে আসবেন বলে হাদীস শরীফে পরিষ্কার ইংগিত দেয়া হয়েছে। যেমন, হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর সূত্রে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, فعند ذلك ينزل أخي عيسى ابن مريم من السماء على جبل أفيق، إماماً هادياً، وحكماً عادلاً، عليه برنس له بيده حربة يقتل الدجال فإذا قتل الدجال تضع الحرب أوزارها অর্থাৎ এমন সময় হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) আকাশ থেকে একজন সুপথপ্রাপ্ত ইমাম আর ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে (দামেস্কের পূর্বপ্রান্তে শ্বেত মিনারার নিকটে) সমতল একটি পাহাড়ের উপর অবতরণ করবেন। যার পরণে থাকবে লৌহবর্ম এবং হাতে থাকবে (বর্শা বা বল্লম ধরনের) যুদ্ধাস্ত্র। তিনি দাজ্জালকে হত্যা করবেন। তিনি যখন দাজ্জালকে হত্যা করবেন তখন যুদ্ধ তার সমস্ত সরঞ্জাম গুটিয়ে নেবে। (তারীখে দামেস্ক ৪৭/৫০৫ ইবনে আসাকীর, কাঞ্জুল উম্মাল ১৪/৪১৯)। এখন আমরা কি আপনার যুক্তি মেনে রাসূল (সা.)-এর উক্ত তীর ধনুক আর বর্শার সভ্যতার যুগেই (عليه برنس له) ঈসার আগমনী কনসেপ্ট বা ভবিষ্যৎবাণীকে মিথ্যা আখ্যা দেব? নাউযুবিল্লাহ। স্ক্রিনশট :-
জাবালে আফিক বা সমতল পাহাড় প্রসঙ্গ :
উল্লিখিত হাদীসে ‘জাবালে আফিক’ একখানা উপবাক্য রয়েছে। আসুন জেনে নিই এটির ভৌগোলিক অবস্থান কোথায়? উম্মুল মুমিনীন হযরত সাফিয়্যাহ (রা.) এর বর্ণনা হতে এর পরিষ্কার একটা ধারণা পাওয়া যায়। সেখানে বর্ণিত আছে যে, এটি এমন একটি সমতল পাহাড় যেখান থেকে আল্লাহতালা ঈসা (আ.)-কে আকাশে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। অনুবাদসহ হাদীসটি এই যে,
عن صفية أم المؤمنين رضي الله عنها أنها كانت إذا زارت بيت المقدس، وفرغت من الصلاة في المسجد الأقصى: صعدت على جبل زيتا فصلت عليه وقالت: هذا الجبل هو الذي رفع منه عيسى عليه السلام إلى السماء، وكانت النصارى يعظمون ذلك الجبل، وكذلك اليوم يعظمونه. {التصريح بما تواتر في نزول المسيح (ص: 258) للهندي}
অর্থাৎ একদা উম্মুল মুমিনীন হযরত সাফিয়্যাহ (রা.) বায়তুল মোকাদ্দাস পরিদর্শনে যান। মসজিদে আকসায় সালাত শেষে তিনি সুদূর দিগন্তে অবস্থিত একটি সমতল পাহাড়ে আরোহন করে সেখানেও সালাত আদায় করেন। তিনি (সাক্ষ্য দিয়ে) বলেন, এটি সেই পাহাড় যেখান থেকে ঈসা (আ.)-কে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল। খ্রিস্টান জাতি এই পাহাড়টির খুবই সম্মান করেন এবং বর্তমানেও তারা পাহাড়টিকে সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন। {আত তাসরীহ বিমা তাওয়াতারা ফী নুযূলিল মাসীহ, পৃষ্ঠা নং ২৫৮ (সাইয়েদ আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. আল-হিন্দী)}।
উম্মুল মুমিনীন (রা.)-এর উল্লিখিত সাক্ষ্য হতেও সুস্পষ্ট হয় যে, ঈসা (আ.)-এর অবতরণ স্থল দামেস্কের ভূখণ্ডেই ও বায়তুল মোকাদ্দাস এলাকার সুদূর দিগন্তে অবস্থিত একখানা সমতল পর্বতমালা। সত্যান্বেষণকারীদের জন্য সত্য উপলব্ধি করতে এটুকুই যথেষ্ট নয় কি?
সহীহ বুখারীর কিতাবুল আম্বিয়া পর্বে এসেছে, আল্লাহর রাসূল (সা.) শপথ বাক্য সহ (والذى نفسي بيده) ঈসা (আ.) এর আগমন সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী দিয়েছেন। এখন আপনি কি বলতে চান যে, তিনি (সা.) ঐ ভবিষ্যৎবাণী দ্বারা দুনিয়াকে মিথ্যা বার্তা দিয়ে গেছেন? নাউযুবিল্লাহ। গত দুই হাজার বছরধরে পৃথিবীর প্রায় সবাই নবীগণের কবর সম্পর্কে তথ্য দিয়ে গেলেও সবাই ঈসা (আ.)-এর কবর না থাকা সম্পর্কে একমত। এতে কী বুঝা যায়? এখন দুনিয়ার এই শেষ সময় এসে এমন কোনো মতবাদ দাঁড় করতে চাওয়া কতটুকু যুক্তিসঙ্গত যা পূর্বেকার প্রতিটি যুগের মানুষের সর্বসম্মত বিশ্বাসের বিরোধী! আছে কি কেউ এই কথাগুলোর যৌক্তিক জবাব দেবেন?
কিন্তু এরপরেও যারা বুঝতে চায় না, বুঝার ইচ্ছেও নেই যাদের; আমি তাদেরকে আল্লাহর নিকট সোপর্দ করছি।
লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী