সম্মিলিত মুনাজাত, পর্যালোচনা ও সমাধান :
ফরজ সালাতের পরপর আল্লাহর রাসূল (সা.) সম্মিলিত মুনাজাত করেছিলেন মর্মে কোনো হাদীস বা রেওয়ায়েত সহীহ সনদে পাওয়া যায়না, একথা সঠিক। কিন্তু তিন শর্তে এধরণের সম্মিলিত মুনাজাত বড়জোর জায়েজ হতে পারে। তবে যেহেতু সুন্নাত নয় সেহেতু মাঝেমধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে মুনাজাত ছেড়ে দেয়া উত্তম। যাতে অন্যরা এটিকে জরুরি মনে না করে।
• তিনটি শর্ত হল :
১. ফরজ নামাযের পর সম্মিলিত মুনাজাতকে জরুরী মনে করা যাবেনা।
২. সম্মিলিত মুনাজাতকে নামাযের অংশ মনে করা যাবেনা।
৩. সম্মিলিত মুনাজাত ছাড়া নামায পূর্ণ হয় না, এরূপ আকিদা রাখা যাবেনা।
- সতর্কতা : ফরজ সালাতের পর মুনাজাতের শরয়ী বিধান থাকা প্রমাণ করতে কেউ কেউ ‘মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ’ {مصنف ابن أبى شيبة} থেকে একখানা হাদীস পেশ করে থাকেন। আসলে ইনসাফের দৃষ্টিতে তাকালে হাদীসটির কোনোই গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণিত নয়। কেননা হাদীসের মতনে مضطرب বা বিশৃঙ্খল সৃষ্টি হয়ে আছে। কারণ ইমাম ইবনে হাযম (রহ.) সংকলিত ‘আল মুহাল্লা‘ কিতাবে বর্ণনাটিতে ورفع يديه ودعا অংশটুকু নেই। এতদ্ব্যতীত ইমাম ইবনে আবী শাইবাহ (রহ.)-এর সংকলন ‘মুসান্নাফ‘ কিতাবে বর্ণনাটি বর্ণিত হয়েছে সনদ (সূত্র) বিহীন। ফলে বর্ণনার কথাটি আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর মুখনিঃসৃত হওয়া সুদৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয়না। অন্তত জঈফ বা দুর্বল পর্যায়ের হলেও কোনোমতে ফাজায়েল বা আমলের ক্ষেত্রে গ্রহণ করা যেত। এবার বর্ণনাটির মতন সহ অর্থ পড়ুন, হযরত আসওয়াদ আল আ’মেরী {الأسود العامري} (রা.) স্বীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, صليت مع النبي صلي الله عليه وسلم الفجر فلما سلم انحرف ورفع يديه و دعا অর্থাৎ আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ফজরের সালাত আদায় করেছি। রাসুলুল্লাহ (সা.) সালাম ফেরানোর পর পাশ ফেরালেন এবং দুই হাত তুলে দোয়া করলেন। (তিরমিজি শরীফের আরবী ব্যাখ্যাগ্রন্থ তুহফাতুল আহওয়াযী খণ্ড নং ২ পৃষ্ঠা নং ১৬৮, শায়খ আল্লামা আবদুর রহমান মুবারকপুরী (১৮৬৫-১৯৩৫ খ্রি.)।
তবে হ্যাঁ, সাধারণভাবে সম্মিলিত মুনাজাতকেও যারা নাজায়েজ বা বিদয়াত বলতে চান তারা নিঃসন্দেহে ভুলের মধ্যে রয়েছেন। কারণ, একাধিক সহীহ হাদীস দ্বারাই সাধারণভাবে সম্মিলিত মুনাজাত জায়েজ, প্রমাণিত। আর এটি এখন আমাদের আহলে হাদীসবন্ধুরাও কার্যত মেনে নিয়েছেন। কেননা আমরা দেখেছি, ১৬ ই অক্টোবর ২০২১ ইং মুতাবেক সাভারের বাইপাইলে জমঈয়তে আহলে হাদীস-এর দশম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল অধিবেশনে সংগঠনটির নতুন সভাপতি ড. আব্দুল্লাহ ফারুক এবং সাধারণ সম্পাদক ড. শহীদুল্লাহ খান মাদানী মনোনীত হন। অনুষ্ঠানে তখন সবাইকে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করতে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করতেও দেখা গিয়েছে। (দৈনিক ইনকিলাব, ১৭-১০-২০২১)। এবার তাহলে একজন সাহাবীর একটা ঘটনা বলি, শুনুন!
(১) আল্লাহর প্রিয় একজন সাহাবী ছিলেন, নাম আ’লা বিন হাযরামী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)। তিনি একজন ‘মুস্তাজাবুদ দাওয়া’ সাহাবী ছিলেন। একবারের ঘটনা, তিনি এবং তাঁর সহযোদ্ধারা বাহরাইনের জিহাদ থেকে মদীনা ফেরার পথে একস্থানে যাত্রাবিরতি করলেন। ইত্যবসরে তাঁদের একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল, তাঁদের উটগুলো তাদের রসদপত্রসহ হঠাৎ কোথাও পালিয়ে গেল। তখন গভীর রাত। তাদের দুশ্চিন্তার শেষ ছিলনা। ফজরের সময় হল। মুয়াজ্জিন আজান দিল। সবাই জামাতে সালাত আদায় করলো। সালাত শেষে নবীজী (সা.)-এর প্রিয় সাহাবী হযরত আ’লা বিন হাযরামী উপস্থিত সাথীদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে হাত তুলে মুনাজাত শুরু করলেন। আল্লাহর সমীপে কাকুতি মিনতি সহকারে এমন মুনাজাত করলেন সূর্য উদিত হয়ে গেল, সূর্যের কিরণ এসে গায়ে পড়ল, তাদের সম্মিলিত মুনাজাতটি এত দীর্ঘ ছিল। সাহাবীদের সম্মিলিত মুনাজাতের এই ঘটনাটি ইমাম ইবনে কাসীর (রহ.) বিশুদ্ধ সনদে তার সংকলন ‘আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া’ এর ষষ্ঠ খণ্ডের ৩২৮-৩২৯ নং পৃষ্ঠায় এনেছেন। হাদীসটির আরবী সংক্ষেপে – فلمَّا قَضَى الصَّلاة جَثَا عَلَى رُكْبَتَيْهِ وَجَثَا النَّاس، وَنَصِبَ فِي الدُّعاء وَرَفَعَ يَدَيْهِ وَفَعَلَ النَّاس مِثْلَهُ حَتَّى طَلَعَتِ الشَّمْسُ
(২) সম্মিলিত মুনাজাতের প্রচলিত আমলের জায়েজের পক্ষে একদম টাটকা বিশুদ্ধ সনদে আরেকটি বর্ণনা এরকম, নবীজী (সা.)-এর আরেকজন সাহাবী ছিলেন, হযরত হাবীব বিন মাসলামা আলফিহরী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, (আরবী) لَا يَجْتَمِعُ مَلَأٌ فَيَدْعُو بَعْضُهُمْ وَيُؤَمِّنُ سَائِرُهُمْ، إِلَّا أَجَابَهُمُ اللَّهُ অর্থাৎ “যখনি কোনো দল একত্র হয়, তারপর তাদের কেউ দোয়া করে, আর কেউ আমীন বলে, তখন আল্লাহতালা তাদের সে দোয়া কবুল করেন”। (রেফারেন্স, মুস্তাতাদরাক আলাস সহীহাইন, হাদীস নং-৫৪৭৮)। তাহকীক, ইমাম নূরুদ্দীন আল-হায়ছামী (রহ.) বলেন, (আরবী) وَرِجَالُهُ رِجَالُ الصَّحِيحِ غَيْرَ ابْنِ لَهِيعَةَ، وَهُوَ حَسَنُ الْحَدِيثِ অর্থ- উক্ত হাদীসের সূত্রের প্রতিটি রাবী সহীহ’র রাবী। ইবনে লাহিয়াহ ছাড়া। কিন্তু সেও হাসান পর্যায়ের রাবী। (মাযমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস নং ১৭৩৪৭)।
আপাদত এ পর্যন্ত। শেষ কথা হল, এ সমস্ত সাধারণ বিষয়ে মুসলমানদের ঝগড়াঝাটি করা এখন মোটেও সমুচিত নয়। এখন উম্মাহার সামনে অনেক বড় বড় বিপর্যয়। এখন আমল নিয়ে যতটা চিন্তার বিষয় তার চেয়ে কোটিগুণ বেশি ঈমান টিকিয়ে রাখার বিষয়। কাজেই আসুন, ঈমান আকীদার সংগ্রামে আমরা ঐক্যবদ্ধ হই, ছোটোখাটো বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে সময় নষ্ট না করি।
লিখক, প্রিন্সিপাল মুহাম্মদ নূরুন্নবী এম.এ