অজু ছাড়া পবিত্র কুরআন স্পর্শ করার শরয়ী হুকুম কী?
উত্তর : প্রশ্নোল্লিখিত জিজ্ঞাসার উত্তরে বলতে পারি যে, পবিত্র কুরআন থেকে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট করে কোনো সমাধান পাওয়া যায়না। তবে সহীহ হাদীস, আছারে সাহাবায়ে কেরাম, ইজমায়ে উম্মত এবং বরেণ্য ইমামগণের ফতুয়া হচ্ছে, অজু ছাড়া পবিত্র কুরআন স্পর্শ করা কোনো মুসলমানের জন্য জায়েজ নয়। বরং পবিত্র কুরআনকে অজু বা পবিত্রতার সাথে স্পর্শ করাই তার হক্ব এবং শিষ্টাচার ও আদব। যাতে দুনিয়ার এই কুরআন নামক কিতাব পৃথিবীর অন্য সব কিতাব অপেক্ষা ব্যতিক্রমী মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত থাকে। এ সম্পর্কে আধুনিক মুহাদ্দিসগণের মধ্যে শায়খ আব্দুল আজীজ বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রহ.) কী লিখে গেছেন দেখা যাক। তিনি লিখেছেন, (আরবী) لا يجوز للمسلم مس المصحف وهو على غير وضوء عند جمهور أهل العلم وهو الذي عليه الأئمة الأربعة অর্থাৎ সমস্ত আহলে ইলম তথা আয়েম্মায়ে কেরামের মতে কুরআন অজু ছাড়া স্পর্শ করা জায়েজ নেই। আর এর উপরই চার মাযহাবের ইমামগণের ঐক্যমত। (মাজমু’ ফাতাওয়ায়ে ইবনে বাজ খণ্ড ৪ পৃষ্ঠা ৩৮৩)। এখান থেকে দেখুন (ক্লিক)! একজন নগন্য মুসলমান হিসেবে তার প্রত্যাশাও ঠিক তেমনি। তবে মুনাফিক হলে কথা ভিন্ন।
প্রকৃতি থেকেও আমরা এর দৃষ্টান্ত পাই। মনে করুন, মাহফীলে বক্তাদের জন্য স্টেজে আপনারা যে চেয়ারটি সুন্দর করে সাজিয়ে রাখেন সেটি কিন্তু আশপাশের অন্যগুলো থেকে মানে ও গুণে ব্যতিক্রমই থাকে। এটা কী জন্য? বলবেন যে, বক্তাদের বিশেষভাবে সম্মানিত করার জন্য। যদি তাই হয়, তাহলে আপনি কুরআনকেও দুনিয়ার সাধারণ কিতাবের ন্যায় ভাবতে পারলেন কিভাবে? ঐ বক্তাদের চেয়ারটা যদি ব্যতিক্রমী হতে পারে তাহলে পবিত্র কুরআনের ক্ষেত্রে কিজন্য এমন বে-ইনসাফ? অথচ পবিত্র কুরআন নিজেই নিজের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিচ্ছে যে, (আল্লাহতালার বাণী) رَسُولٌ مِنَ اللَّهِ يَتْلُو صُحُفاً مُطَهَّرَةً অর্থাৎ আল্লাহ’র পক্ষ থেকে (প্রেরিত) রাসূল; যিনি পুতঃপবিত্র সহীফা তেলাওয়াত করেন। (সূরা বায়্যিনাহ ২)। অন্যত্র এসেছে, (আল্লাহতালার বাণী) فِي صُحُفٍ مُكَرَّمَةٍ مَرْفُوعَةٍ مُطَهَّرَةٍ অর্থাৎ সমুচ্চ এবং পুতঃপবিত্র যা রয়েছে সম্মানিত সহীফায়। (আবাসা-১৩-১৪)। নিশ্চিত করে বলতে পারি, পবিত্র কুরআনের শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই হযরত ওমর (রা.) যখন কাফের থাকা অবস্থায় বোনকে কুরআন দেখাতে বলেছিলেন, তখন তার বোন ফাতেমা বিনতে খাত্তাব (রা.) উত্তরে বলেছিলেন, তুমি নাপাক! আর এ গ্রন্থ পাকপবিত্র ছাড়া কেউ ধরতে পারে না। (মুসনাদুল বাজ্জার-১/৪০১, মুস্তাদরাকে হাকেম-৪/৬৬, সুনানে দারা কুতনী-১/১২১, তাবাকাতুল কুবরা লি-ইবনে সাদ-৩/২৬৭, সুনানুল কোবরা লিল-বায়হাকী-১/৮৭)।
ইসলামের প্রাচীন ও সহজ সরল শিক্ষার দিকে ফিরে গেলেও আমরা একই শিক্ষা পাচ্ছি। এবার চলুন, মতভেদপূর্ণ বিষয়টির সমাধানের জন্য আমরা একটি সহীহ হাদীসের দিকে ফিরে যাই। হাদীসে এসেছে, عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي بَكْرِ بْنِ حَزْمٍ أَنَّ فِي الْكِتَابِ الَّذِي كَتَبَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِعَمْرِو بْنِ حَزْمٍ أَنْ لَا يَمَسَّ الْقُرْآنَ إِلَّا طَاهِرٌ অর্থাৎ, হযরত আব্দুল্লাহ বিন আবু বকর বিন হাযম বলেন, রাসূল (সা.) আমর বিন হাযমের প্রতি (ইয়েমেনবাসীর জন্য) এই মর্মে চিঠি লিখেছিলেন যে, পবিত্র হওয়া ছাড়া কুরআন কেউ স্পর্শ করবে না। (মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং-৬৮০, কানযুল উম্মাল, হাদীস নং-২৮৩০, মারেফাতুস সুনান ওয়াল আসার, হাদীস নং-২০৯, আল মুজামুল কাবীর, হাদীস নং-১৩২১৭, আল মুজামুস সাগীর, হাদীস নং-১১৬২, মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীস নং-৪৬৫, সুনানে দারেমী, হাদীস নং-২২৬৬)। হাদীসটির সনদকে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) সহ আগেকার প্রায় সব হাদীস বিশারদ এবং আধুনিক মুহাদ্দিসগণের মধ্যে শায়খ আলবানী (রহ.)ও সহীহ বলেছেন। বিখ্যাত হাদীস বিশারদ ইমাম নূরুদ্দীন আল হাইসামী (রহ.) হাদীসটির সনদ সম্পর্কে লিখেছেন, رواه الطبراني في الكبير والصغير ورجاله موثقون অর্থাৎ (পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া কেউ কুরআন স্পর্শ করবে না, মর্মে) হাদীসটি ইমাম তাবারানী (রহ.) স্বীয় রচনা কাবীর ও সাগীর উভয় গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। আর তার সকল বর্ণনাকারী সিক্বাহ তথা গ্রহণযোগ্য। (মাযমাউজ যাওয়ায়েদ, হাদীস নং-১৫১২)। ডক্টর আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)-এর লেকচারেও ঐ তথ্যগুলো উঠে এসেছে এবং তিনি বলেছেন যে, উম্মতে মুসলিমার ইজমা রয়েছে যে, অজু ছাড়া পবিত্র কুরআন স্পর্শ করা জায়েজ নেই। তিনি ইমাম ইবনে কুদামাহ (রহ.) এর রচিত ‘আল-মুগনী’ কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, প্রায় ১২/১৩জন সাহাবী থেকে পরিষ্কার মত আছে যে, অজু বা পবিত্রতা ছাড়া কুরআনুল কারীম স্পর্শ করা জায়েজ নেই। আর তাঁদের উক্ত মতের বিপরীতে কোনো সাহাবীই ভিন্ন মত পোষণ করেননি। (ভিডিও লিংক এখানে, ক্লিক করুন)।
সহীহ মুসলিম কিতাবের আরবী ব্যাখ্যাকারক ইমাম নববী (রহ.), মালেকি মাযহাবের বিখ্যাত ফকিহ ও ইমাম ইবনে আব্দুল বার (রহ.), হাম্বলী মাযহাবের অপর আরেক বিখ্যাত ইমাম শায়খ ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.) সহ অনেকেই সুস্পষ্ট করে লিখে গেছেন যে, অজু ছাড়া পবিত্র কুরআন স্পর্শ করা জায়েজ নেই। ইমাম নববী (রহ.) সাহাবায়ে কেরামের ইজমা উল্লেখ করে লিখেছেন, إنه قول علي وسعد بن أبي وقاص وابن عمر رضي الله عنهم، ولم يعرف لهم مخالف من الصحابة অর্থাৎ পবিত্র হওয়া ছাড়া কুরআন স্পর্শ করা নিষেধ, কথাটি হযরত আলী (রা.), সা’আদ বিন আবী ওয়াক্কাস (রা.) এবং হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রা.) সকলের। তাদের মতের বিপরীতে কোনো মত সাহাবাগণ থেকে বর্ণিত নেই। (শরহুল মুহাজ্জাব ২/৮০)। এরপর ইমাম ইবনে আব্দুল বার (রহ.) উম্মাহার ইজমা উল্লেখ করে লিখেছেন, أجمع فقهاء الأمصار الذين تدور عليهم الفتوى وعلى أصحابهم بأن المصحف لا يمسه إلا طاهر অর্থাৎ সমগ্র পৃথিবীর সকল ফক্বীহ ও তাঁদের অনুসারীগণ একমত এবং এর উপরই সকলে ফাতওয়া প্রদান করে থাকেন যে, কুরআনে কারীম পবিত্র হওয়া ছাড়া স্পর্শ করা জায়েজ নেই। (আল ইস্তিযকার খণ্ড ১০ পৃষ্ঠা নং ৮)। এবার শায়খ ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.) কী লিখলেন দেখা যাক। তিনি লিখেছেন, وهو قول سلمان الفارسي، وعبد الله بن عمر، وغيرهما، ولا يعلم لهما من الصحابة مخالف অর্থাৎ পবিত্র হওয়া ছাড়া কুরআন স্পর্শ নিষেধ, কথাটির পক্ষে মত দিয়েছেন হযরত সালমান ফারসী (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রা.) এবং অন্যান্যরা। কোনো সাহাবী থেকে এর বিপরীত মত বর্ণিত নেই। (মাজমু’ ফাতাওয়া খণ্ড ২১ পৃষ্ঠা নং২৬৬)। ‘ফিকহুল হাফেয আহমদ ইবনে সিদ্দিক আল গুমারী’ কিতাবের স্ক্রিনশট থেকে,
কথা এ পর্যন্ত শেষ। পাঠকের উদ্দেশ্যে বলব, আপনি পবিত্র কুরআনের বিশেষ ও ব্যতিক্রমী সম্মান ও মর্যাদা স্বীকার করেন কিনা? যদি করে থাকেন তাহলে দুনিয়ার সাধারণ বইপুস্তকের ন্যায় পবিত্র কুরআনকেও আপনি যেভাবে এবং যে অবস্থায় খুশি স্পর্শ করার সাহস কিভাবে করেন? অন্তত নিজের বিচারবোধ বিসর্জন না দিয়ে থাকলে আপনি পবিত্র কুরআনের বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার ঘোর বিরোধী হতে পারেন না। তবে হ্যাঁ, যে সব বক্তা এর জন্য দলিল প্রমাণ শুধুই পবিত্র কুরআনেই খোঁজে, আর কুরআনে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকার বাহানায় কুরআনের হক্বের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেনা, তারা কি তাদের ইহকালীন অন্যান্য সমস্ত সমস্যার সমাধানগুলোও শুধুই কুরআন থেকে নেয়? হাদীস, ইজমা, ফিকহ ইত্যাদি এ সমস্ত অথেনটিক সোর্স কি তাহলে কোনো কাজেরই নয়? হায় আল্লাহ, এ কোন শেষ যামানায় তুমি আমাদের পাঠালে! এই কেমন ফেতনা আর ফেতনা!! আল্লাহ! তুমি আমাদের রক্ষা কর।
লিখক, প্রিন্সিপাল মুহাম্মদ নূরুন্নবী এম.এ