সালাতে রাফউল ইয়াদাইনের চমৎকার বয়ান – আল্লামা ডক্টর ইসরার আহমদ রাহিমাহুল্লাহ, পাকিস্তান
ডক্টর ইসরার আহমদ। একজন মু’তাদিল ইসলামিক স্কলার। তিনি ইসলামের এবং ধর্মীয় বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কিত ৬০টি গ্রন্থ রচনা করেন, যার মধ্যে ৯টি বই ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়। এর পূর্বে তিনি একজন টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং পিস টিভিতে একটি প্রতিদিনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতেন। তিনি নির্দিষ্ট কোনো মাসলাকের সাথে পরিচিত ছিলেন না, উনার দালিলিক আলোচনা হতে লক্ষ লক্ষ দর্শক শ্রোতা পরিতৃপ্তির সাথে দ্বীনের ফিকহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে থাকেন। তিনি আজ আর দুনিয়ায় নেই, কিন্তু তাঁর অডিও ভিডিও স্যোসাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মজার ব্যাপার হল, দেওবন্দী, বেরেলি, আহলে হাদীস ও সালাফী প্রত্যেকে তাঁকে নিজ নিজ মাসলাকের বলে দাবী করে থাকেন। কিন্তু সত্য হল, তিনি একজন ন্যাপরায়ণ ও মধ্যপন্থী ছিলেন। তিনি তারাবী সালাত বিশ রাকাতের প্রবক্তা যেমন, তেমনি সালাতে কখনো কখনো রাফউল ইয়াদাইনও করতেন আবার ছেড়েও দিতেন। আজকে উনার একটা আলোচনা এখানে তুলে ধরছি,
ডক্টর ইসরার আহমদ (রহ.) | ভিডিও – তিনি বলেছেন,
রাফউল ইয়াদাইন তথা সালাতে তাকবীরে তাহরিমাহ ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে দু হাত উঠানামা করার দলিল বুখারী মুসলিম সহ বহু হাদীসের কিতাবে এসেছে। আর এ সংক্রান্ত হাদীসগুলো ব্যাপক। কোনো কোনো হাদীসে রাসূল (সা.) এর উক্ত আমল সম্পর্কে সাহাবীদের কাছ থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি সালাতে রূকুর সময় রাফউল ইয়াদাইন করেছেন, কোনো কোনো হাদীসে রূকু হতে উঠার সময়ও করার কথা রয়েছে। আবার কোনো কোনো হাদীসে এসেছে, প্রত্যেক সেজদার সময় (নাসায়ী ১/১৬৫) এবং সেজদা থেকে উঠার সময়ও রাফউল ইয়াদাইন করেছেন (আবূ দাউদ ১/১০৮, নাসায়ী ১/১৭২)। সেজদা থেকে উঠে দাঁড়ানোর সময়ও রাফউল ইয়াদাইন করার কথা রয়েছে (আবূ দাউদ ১/১০৫)। তৃতীয় রাকাতের শুরুতেও (সহীহ বুখারী ১/১০২)। সালাতে প্রতিটি উঁচুনিচু হওয়ার ক্ষেত্রে (ইবনে মাজাহ ৬২)। মানে প্রায় পুরো সালাতজুড়ে প্রায় ৭ জায়গায় রাফউল ইয়াদাইন করার দলিল রয়েছে হাদীসে। আহলে হাদীস ভাইয়েরা তো বুখারী মুসলিম এর হাদীসের কথাই বেশি বলেন, অথচ হাদীসের আরও তো অনেক সংকলন রয়েছে। যেমন মুসান্নাফ ইবনে আব্দির রাজ্জাক ইত্যাদি । কিতাবটি বুখারী মুসলিম-এরও অনেক পূর্বেকার সংকলন। সেখানে ঐ সমস্ত বর্ণনা ভূরি ভূরি নজরে পড়বে। কিন্তু আমাদের হানাফী ভাইয়েরা রাফউল ইয়াদাইন এর হাদীসগুলোর উপর আমল করেন না। কেননা রাসূল (সা.) থেকে রাফউল ইয়াদাইন এর যত হাদীস বর্ণিত আছে সেগুলো একেক সাহাবীর একেক সময়ের রাসূল (সা.)-এর সালাতের অবস্থার উপর তাৎক্ষণিক মূল্যায়ন মাত্র, যা নিয়মিত কোনো অবস্থাকে নির্দেশ করেনা। আর রাসূল (সা.) তো জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে শুধুমাত্র তাকবীরে তাহরিমাহ এর রাফউল ইয়াদাইন ব্যতীত অন্য সব ধরণের রাফউল ইয়াদাইন পরিত্যাগ করেছেন। হানাফী মালেকী মাযহাবের বিশিষ্ট দুই ইমাম যারা অন্য দুই ইমামের-ও পূর্বেকার ও অধিক গ্রহণযোগ্য তারা রাফউল ইয়াদাইন এর হাদীসের আমল গ্রহণ করেননি, হোক তা সহীহ হাদীস। (কেননা সহীহ হাদীসের আমল যদি “মানসূখ” সাব্যস্ত হয় তখন আর সেটির উপর আমল করা হবেনা, যতই সহীহ হোক)।
ইমাম শাফেয়ী অনেক গুলো রাফউল ইয়াদাইন এর মধ্য থেকে মাত্র দু জায়গার আমল গ্রহণ করেছেন। রূকুতে যেতে এবং উঠতে। আর ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলও শাফেয়ীর অনুরূপ বলেছেন।
হানাফী আর মালেকী মাযহাবের যুক্তি হচ্ছে, রাসূল (সা.)-এর জীবনের সর্বশেষ আমলই উম্মাহার জন্য চূড়ান্ত হিসেবে গণ্য হবে। তাদের এ কথার দলিলও তারা দিয়ে থাকে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এর বর্ণনায় আছে, فصلى فلم يرفع يديه الا فى اول مرة অর্থাৎ রাসূল (সা.) সালাত পড়েছেন এবং শুধু প্রথমবার তাকবীরে তাহরিমায় দু হাত উঠিয়েছেন। (তিরমিজি ১/৩৫, হা/২৫৭, আবূ দাউদ হা/৭৪৮)। ইমাম তিরমিজি বলেছেন, هذا حديث حسن অর্থাৎ এ হাদীসের সনদ হাসান। ইবনে হাযম (রহ.) বলেছেন, এর সনদ সহীহ। (আল মুহাল্লা ৪/৮৮)।
সাহাবীরা ছিলেন রাসূল (সা.)-এর পূর্ণ আনুগত্যের একেকজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। তারা রাসূল (সা.)-কে যখন যে অবস্থায় দেখেছেন সে অবস্থার কথা উল্লেখ করে দিয়েছেন। এগুলোকে অসঙ্গতি মনে করা পুরোপুরি মূর্খতা। এ সমস্ত বৈপরীত্য আমলগুলোর ডিসাইড করতে মুজতাহিদদেরকে গবেষণা করতে হয়েছে। আমাদেরকে তাদের সেই গবেষণার ফসল ফিকহকে গ্রহণ করতে হবে। আর প্রত্যেক মুজতাহিদের ছিল নিজেস্ব কিছু উসূল (নীতিমালা)। গবেষণার ফলাফল তাদের একেকজনকে একেক মতামতের দিকে নিয়ে যায়। নতুবা মাযহাব কখনো একাধিক হত না। সুতরাং যিনি যেই মুজতাহিদকে ফলো করবেন তিনি সেই মুজতাহিদের ইজতিহাদের উপরই চলবেন।
সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সা.)-কে যখন যে অবস্থায় পেয়েছেন তারা শুধু সেটিকে বর্ণনা করে রেখে গেছেন। আমরা যেসব ক্ষেত্রে গবেষণার দাবী রাখে সেসব ক্ষেত্রে মুজতাহিদের ইজতিহাদের আলোকে সিদ্ধান্তে উপনীত হবো…!
(সম্পূর্ণ ভিডিও এর সার নির্যাস)।
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক
মুহাম্মদ নূরুন্নবী এম.এ