Home আকীদা তাফসীরুল কুরআন থেকে ঈসা (আ.)-এর পুনঃ আগমন সংক্রান্ত সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণ

তাফসীরুল কুরআন থেকে ঈসা (আ.)-এর পুনঃ আগমন সংক্রান্ত সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণ

0

মুফাসসীরগণ সম্পর্কে মির্যা গোলাম আহমদ লিখেন, আল্লাহতালা পবিত্র কুরআনকে এমন সব ইমাম আর আকাবীরগণের মাধ্যমেও (সংরক্ষণ করেন) যাদেরকে প্রত্যেক শতাব্দীর শিরোভাগে কুরআনের সঠিক বুঝ দান করা হয়েছে, তারা কুরআন শরীফের অস্পষ্ট জায়গাগুলো নবীজির হাদীসসমূহ দ্বারা তাফসীর করে খোদার পবিত্র বাণীকে এবং পবিত্র শিক্ষাকে প্রত্যেক যুগে অর্থগত বিকৃতি হওয়া থেকে রক্ষা করেছেন।” (আইয়ামুছ ছুলহি, রূহানী খাযায়েন ১৪/২৮৮)। কাজেই এখন আর কোনো কাদিয়ানী মতাবলম্বীর পক্ষে কুরআনের সঠিক তাৎপর্য অনুধাবনের জন্য ‘তাফসীর’ গ্রন্থসমূহের প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করার সুযোগ থাকেনি।

তাফসীরুল কুরআন থেকে দলিল-প্রমাণ,

1 তাফসীরুল ওয়াসীত-শায়খ মুহাম্মদ সাইয়েদ আত-তানত্বাভী (الوسيط لطنطاوي), সূরা নিসা আয়াত নং ১৫৮ এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন ((وجمهور العلماء على أن الله تعالى رفع عيسى إليه بجسده وروحه لا بروحه فقط)) অর্থাৎ সর্বসম্মত ইসলামী বিশেষজ্ঞগণের মতে, নিশ্চয়ই আল্লাহতালা ঈসা (আ.)-কে শুধুই রূহ সহকারে নহে, বরং শরীর এবং রূহ উভয় সহকারে তাঁর নিকট উঠিয়ে নিয়েছেন।

2 তাফসীরে ইবনে কাসীর-ইমাম ইমাদুদ্দীন ইবনে কাসীর (ابن كثير), সূরা নিসা আয়াত নং ১৫৮ এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন ((قال ابن أبي حاتم : حدثنا أحمد بن سنان، حدثنا أبو معاوية، عن الأعمش، عن المنهال بن عمرو، عن سعيد بن جبير، عن ابن عباس قال : لما أراد الله أن يرفع عيسى إلى السماء، خرج على أصحابه – وفي البيت اثنا عشر رجلا من الحواريين ……. فألقي عليه شبه عيسى ورفع عيسى من روزنة في البيت إلى السماء. وهذا إسناد صحيح إلى ابن عباس)) অর্থাৎ ইবনে আব্বাস থেকে, তিনি বলেন, আল্লাহ যখন ঈসাকে আকাশে উঠিয়ে নিতে চাইলেন, তখন তিনি আপনা সাথীদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। তখন তাঁর বাড়ীতে বারোজন হাওয়ারী ছিলেন……..ইত্যবসরে জনৈক ইহুদীকে ঈসার সাদৃশ করে দেয়া হয় এবং ঈসাকে বাড়ীর বাতায়ন পথে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়। ইবনে আব্বাস পর্যন্ত এর সনদ তথা সূত্র সহীহ।

3 তাফসীরে কুরতুবী-ইমাম আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আল কুরতুবী (القرطبى), সূরা নিসা আয়াত নং ১৫৮ এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন ((بل رفعه الله إليه ابتداء كلام مستأنف؛ أي إلى السماء)) অর্থাৎ বরং আল্লাহ তাঁকে (ঈসাকে) আকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন।

ইমাম কুরতুবী (রহ.) আরও উল্লেখ করেন, ((وروي عن مجاهد أنه قال : ما من أحد من أهل الكتاب إلا يؤمن بعيسى قبل موته ؛ فقيل له : إن غرق أو احترق أو أكله السبع يؤمن بعيسى؟ فقال : نعم ! وقيل : إن الهاءين جميعا لعيسى عليه السلام ؛ والمعنى ليؤمنن به من كان حيا حين نزوله يوم القيامة ؛ قال قتادة وابن زيد وغيرهما واختاره الطبري)) অর্থাৎ মুজাহিদ থেকে বর্ণিত, আহলে কিতাবীদের প্রত্যেকে ঈসার মৃত্যুর আগেই তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে। প্রশ্ন করা হল, যদি সে ডুবে যায় বা জ্বালিয়ে দেয়া হয় অথবা চতুষ্পদ জন্তু খেয়ে ফেলে তখনও কি বিশ্বাস স্থাপন করবে? তিনি উত্তর দেন, হ্যাঁ। বলা হয়েছে যে, আয়াতে উল্লিখিত উভয় সর্বনাম পদ ঈসা (আ.)-এর প্রতিই প্রত্যাবর্তনকারী। এখন এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, প্রত্যেক ঐ আহলে কিতাবী অবশ্যই তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে, যিনি কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে তাঁর অবতরণকালে জীবিত থাকবে। ইমাম ক্বতাদাহ, ইবনু যায়েদ উভয়ই এরূপ বলেছেন। ইমাম তাবারী (রহ.) এ মতটি গ্রহণ করেছেন।

4 তাফসীরে তাবারী-ইমাম আবু জা’ফর মুহাম্মদ ইবনে জারীর আত তাবারী (الطبرى), সূরা নিসা আয়াত নং ১৫৮ এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন ((قال أبو جعفر: أما قوله جل ثناؤه : “بل رفعه الله إليه”، فإنه يعني: بل رفع الله المسيح إليه. يقول: لم يقتلوه ولم يصلبوه، ولكن الله رفعه إليه فطهَّره من الذين كفروا)) অর্থাৎ আল্লাহতালার ফরমান : بل رفعه الله إليه এর তাৎপর্য হল, বরং আল্লাহ মসীহ-কে তাঁর নিজের কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইহুদীরা না তাঁকে হত্যা করেছে, আর না তাঁকে শূলে চড়িয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে নিজের কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন। (এভাবেই) তিনি তাঁকে কাফিরদের থেকে রক্ষা করেছেন।

5 তাফসীরে মুইয়াসসার-ইমাম শায়খ সা’ঈদ ইবনে আহমদ আল কিন্দী (التفسير الميسر), সূরা নিসা আয়াত নং ১৫৯ এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন ((وإنه لا يبقى أحدٌ من أهل الكتاب بعد نزول عيسى آخر الزمان إلا آمن به قبل موته عليه السلام)) অর্থাৎ নিশ্চয়ই শেষ যামানায় হযরত ঈসার অবতরণের পর যত আহলে কিতাবী (জীবিত) থাকবে, তারা প্রত্যেকে তাঁর মৃত্যুর আগে আগেই তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে।

6 তাফসীরে বাগাভী-ইমাম আবূ মুহাম্মদ হুসাইন ইবনে মাসউদ আল-বাগাভী (البغوى), সূরা নিসা আয়াত নং ১৫৯ এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন ((قوله تعالى : ( وإن من أهل الكتاب إلا ليؤمنن به قبل موته) أي : وما من أهل الكتاب إلا ليؤمنن بعيسى عليه السلام، هذا قول أكثر المفسرين وأهل العلم)) অর্থাৎ আল্লাহতালার বাণী : وإن من أهل الكتاب إلا ليؤمنن به قبل موته এর তাৎপর্য হল, আহলে কিতাবীদের প্রত্যেকে ঈসা আলাইহিস সালামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে। এ বক্তব্য অধিকাংশ তাফসীরকারক এবং বিশেষজ্ঞগণের।

7 তাফসীরে সা’দী-শায়খ আব্দুর রহমান ইবনে নাসির আস-সা’দী (السعدى), সূরা নিসা আয়াত নং ১৫৯ এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন ((أن الضمير في قوله: { قَبْلَ مَوْتِهِ } راجع إلى عيسى عليه السلام، فيكون المعنى: وما من أحد من أهل الكتاب إلا ليؤمنن بالمسيح عليه السلام قبل موت المسيح، وذلك يكون عند اقتراب الساعة وظهور علاماتها الكبار. فإنه تكاثرت الأحاديث الصحيحة في نزوله عليه السلام في آخر هذه الأمة)) অর্থাৎ আল্লাহর বাণী : قَبْلَ مَوْتِهِ এর মধ্যকার ‘হি’ সর্বনাম পদটি ঈসা আলাইহিস সালামের প্রতিই ফিরেছে। ফলে এর তাৎপর্য হল, আহলে কিতাবীদের প্রত্যেকে মসীহ আলাইহিস সালামের মৃত্যুর আগে আগেই তাঁর প্রতি অবশ্যই বিশ্বাস স্থাপন করবে। আর এ ঘটনা ঘটবে কেয়ামতের নিকটবর্তী সময় এবং কেয়ামতের বড় আলামতগুলো প্রকাশিত হতে থাকলে। এ উম্মতের শেষভাগে ঈসার অবতরকালে এটি সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি বহু সহীহ হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত।

8 তাফসীরে ইবনে কাসীর-ইমাম ইমাদুদ্দীন ইবনে কাসীর (ابن كثير), সূরা নিসা আয়াত নং ১৫৯ এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন ((وأولى هذه الأقوال بالصحة القول الأول، وهو أنه لا يبقى أحد من أهل الكتاب بعد نزول عيسى، عليه السلام، إلا آمن به قبل موته، أي قبل موت عيسى، عليه السلام، ولا شك أن هذا الذي قاله ابن جرير، رحمه [الله] هو الصحيح)) অর্থাৎ এ বক্তব্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সঠিক হল প্রথম উক্তি। সেটি এই যে, ঈসা (আ.)-এর অবতরণের পর আহলে কিতাবীদের মধ্য হতে যারাই অবশিষ্ট থাকবে প্রত্যেকে ঈসা (আ.)-এর মৃত্যুর আগেই তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবেই। আর নিঃসন্দেহে এটাই বিশুদ্ধ মত, ইবনে জারীর আত তাবারীও এমনটাই বলেছেন।

9 তাফসীরে কুরতুবী-ইমাম আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আল কুরতুবী (القرطبى), সূরা মায়েদা আয়াত নং ১১৭ এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন ((فلما توفيتني كنت أنت الرقيب عليهم قيل : هذا يدل على أن الله عز وجل توفاه قبل أن يرفعه; وليس بشيء; لأن الأخبار تظاهرت برفعه، وأنه في السماء حي، وأنه ينزل ويقتل الدجال)) অর্থাৎ আল্লাহর বাণী : فلما توفيتني كنت أنت الرقيب عليهم এর তাৎপর্য এই যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, নিশ্চয়ই আল্লাহতালা তাঁকে উঠিয়ে নেয়ার আগে নিদ্রা দিয়েছেন আর এটা কিছুই না। কেননা হাদীসসমূহ তাঁর উঠিয়ে নেয়ার বিষয়কে সাব্যস্ত করেছে যে, তিনি আকাশে জীবিত। তিনি নিশ্চয়ই নাযিল হবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করবেন।

10 তাফসীরে বাহরুল উলূম/সামরকন্দী-ইমাম আবুল লাইস আস-সামরকন্দী (بحر العلوم أو تفسير السمرقندي), সূরা মায়েদা আয়াত নং ১১৭ এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন ((مَّا دُمْتُ فِيهِمْ} يعني ما دمت مقيماً في الدنيا بين أظهرهم {فَلَمَّا تَوَفَّيْتَنِي} يعني رفعتني إلى السماء {كُنتُ أَنتَ الرَّقِيبَ عَلَيْهِمْ} يعني الحفيظ والشاهد عليهم)) অর্থাৎ আল্লাহর বাণী : “যতক্ষণ আমি তাদের মধ্যে ছিলাম” তথা যতক্ষণ আমি তাদের মাঝে এই পৃথিবীতে অবস্থান করছিলাম, “অত:পর যখন আপনি আমাকে তাওয়াফা করলেন” তথা আপনি আমাকে আকাশে উঠিয়ে নিলেন। আপনিই তাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক অর্থাৎ তাদের রক্ষণাবেক্ষণকারী এবং প্রত্যক্ষদর্শী।

শেষকথা– ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.)-এর পুনঃ আগমন সম্পর্কে ইসলামের গত চৌদ্দশত বছর ধরে মুসলিম উম্মাহার সর্বসম্মত বিশ্বাস সেটাই, যা সর্বকালে কুরআনের প্রধান প্রধান তাফসীরকারকগণ নিজ নিজ তাফসীরগ্রন্থে বিশুদ্ধ সনদে রেখে গেছেন। এর বিপরীতে সকল বিশ্বাস ও ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যাত ও বাতিল।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here