ঈসা (আ.) সম্পর্কে ইসলামের প্রথম দুই খলীফার দৃষ্টিভঙ্গি ও সংশয় নিরসন,
সাধারণ কাদিয়ানীবন্ধুদের সম্পর্কে যখনি আলাপে যাই তখনি দুইচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। আহা! এরা কতই না প্রতারণার শিকার! হায়, যদি ওরা বুঝতো!! সাধারণ কাদিয়ানীবন্ধুদের দুর্বলতা হচ্ছে, পড়াশোনা ছেড়ে তাদের মু’আল্লিম কিবা মুরুব্বী সিলসিলার কাল্টদের যাইচ্ছেতাই অপব্যাখ্যাগুলো তোতাপাখির মত গিলতে থাকা, তাহকিক না করা। ফলে তারা তাদের সূক্ষ্ম জালিয়াতিগুলোও বুঝতে পারে না। যেমন, প্রত্যেক কাদিয়ানীই হযরত উমর (রা.) সম্পর্কে বয়ান দিয়ে থাকে যে, তিনি বলেছিলেন, ‘যে বলবে মুহাম্মদ (সা.) মৃত্যুবরণ করেছেন আমি তাকে আমার এই তলোবারি দ্বারা হত্যা করব।’ কিন্তু হযরত উমরের একই বক্তব্যের পরের অংশটুকু কোনো কাদিয়ানী বলেনা। কেননা, তারা তাদের মুরুব্বী সিলসিলার কাল্টদের কাছ থেকেও এটুকুই শুনে আসছে। অথচ হযরত উমরের ঐ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে হযরত আবুবকর (রা.) যে আয়াতটি তেলাওয়াত করেছিলেন তা হতে কাদিয়ানীরা ঈসা (আ.) বিষয়ে যে কনসেপ্ট দাঁড় করে সেটি হযরত উমরের একই বক্তব্যের পরের অংশটি দ্বারা পুরোপুরি বাতিল হয়ে যায়। মূলত তারা তাদের অপব্যাখ্যামূলক উক্ত জালিয়াতি টিকানোর উদ্দেশ্যেই উমর (রা.)-এর সম্পূর্ণ বক্তব্যটি পেশ করার সাহস রাখেনা।
এবার হযরত উমর (রা.)-এর একই বক্তব্যের পরের অংশটি দেখুন, তিনি আরও বলেছিলেন, ((و انما رفع الى السماء كما رفع عيسى ابن مريم عليه السلام)) এর মানে হল, “নিশ্চয়ই মুহাম্মদ (সা.)-কে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে যেমনিভাবে ঈসা (আ.)-কে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল।” (আল মিলাল ওয়ান নিহাল ১/২৪; ইমাম শাহরাস্তানী)। মির্যা কাদিয়ানী হযরত উমরের বক্তব্যের শেষের অংশটি নিজেও তার বইতে লিখে গেছেন। এজন্য মির্যা কাদিয়ানীর রচনাসমগ্র ‘রূহানী খাযায়েন’ এর খণ্ড নং ১৫ এবং পৃষ্ঠা নং ৫৮১ দেখা যেতে পারে। আফসোস! এত নিকৃষ্ট জালিয়াতি করার চরিত্র যাদের তাদের অনুসারীরা তোতাপাখির মত নির্বিঘ্নে সব বিশ্বাস করে থাকে, তাহকিক করার প্রয়োজনও বোধ করছেনা।
বলাবাহুল্য, হযরত উমর (রা.)-এর উক্ত সম্পূর্ণ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই হযরত আবুবকর (রা.) সূরা আলে ইমরানের ১৪৪ নং আয়াতটি উপস্থিত সকলের সামনে তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেন, ((من كان يعبد محمدا فان محمدا قد مات و من كان يعبد اله محمد فانه حى لا يموت و قرأ هذه الاية و ما محمد الا رسول قد خلت من قبله الرسل الخ)) এর অর্থ হল, “যে মুহাম্মদ (সা.)-এর ইবাদত করে থাকে (সে যেন জেনে নেয়) মুহাম্মদ (সা.) মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যে মুহাম্মদ (সা.) এর প্রভুর ইবাদত করে থাকে (তার জেনে রাখা উচিত) নিশ্চয়ই তিনি জীবিত, মৃত্যুবরণ করেননি। (তারপর) আবুবকর এই আয়াত তেলাওয়াত করেন, ((وما محمد الا رسول قد خلت من قبله الرسل الخ)) অর্থ-মুহাম্মদ একজন রাসূল মাত্র তাহার পূর্বে রাসূলগণই গত হইয়া গিয়াছেন”। মজার ব্যাপার হল, হযরত আবুবকর (রা.)-এর উক্ত আয়াত পেশ করার ভেতরে প্রচ্ছন্ন একটি উদ্দেশ্য ছিল। সেটি হচ্ছে, মুহাম্মদ (সা.) কোনো প্রভূ বা খোদা ছিলেন না যে, তাঁর মৃত্যু হতে পারেনা। তিনি শুধুই একজন রাসূল মাত্র। তাঁর পূর্বেও গত হয়ে যাওয়া প্রত্যেকেই ছিলেন রাসূল। তিনিও সেসব রাসূলের মতই গত হয়ে গিয়েছেন। কাজেই তাঁর মৃত্যুতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। হযরত আবুবকর (রা.) মূলত এ ম্যাসেজটাই দিতে চেয়েছিলেন। এখন হযরত আবুবকর (রা.)-এর উক্ত আয়াতে কারীমাহ’র তেলাওয়াত হতে ঈসা (আ.)-কেও ‘মৃত’ সাব্যস্ত করতে হলে নিচের প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর থাকেনা।
১. হযরত উমর (রা.)-এর যে বক্তব্যের প্রেক্ষিতে হযরত আবুবকর (রা.) و ما محمد الا رسول…الخ আয়াতটির দীর্ঘ আলোকপাত করলেন তিনি উমরের বক্তব্যের শেষের অংশের উপর কিজন্য দ্বিমত করলেন না? তিনি তো পরিষ্কার বলে দিতে পারতেন যে, হে উমর! ঈসা নবীও মরে গেছেন! তাই তোমার এ কথাও ঠিক না। কিন্তু আবুবকর (রা.) তো এভাবে তখন বলেননি!
বলে রাখা দরকার, উল্লিখিত প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে না পেরে হয়ত ওরা বলতে পারে, “ঈসা নবীকেও সমস্ত নবীর মতই আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে।” কিন্তু ওরা জানে না যে, ঈসা নবীর মত অন্য সমস্ত নবীর ‘রাফা’ (উঠিয়ে নেওয়া) হযরত জিবরাইল ফেতেশতার মাধ্যমে হয়নি, বরং আজরাইল ফেরেশতার মাধ্যমে হয়েছিল। সুতরাং সব ধরণের ‘রাফা’ মুক্ত অর্থে উদ্দেশ্য হবেনা। সাধারণ কাদিয়ানীদের গোলকধাঁধাটা-ই এখানে। যথা- রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন ((لَمَّا اِجْتَمَعَ الْيَهُوْدُ عَلَى عِيْسَى عَلَيْهِ السَّلَامُ لِيَقْتُلُوْهُ وَ أَتَاهُ جِبْرَائِيْلُ … فاَوْحَى اللهُ اِلَى جِبْرَائِيْلَ اَنِ ارْفَعْ اِلَيَّ عَبْدِيْ)) “যখন ইহুদীরা ঈসা (আ.)-কে হত্যার উদ্দেশ্যে সমবেত হলো তখন জিবরাইল (আ.) তাঁর নিকট আগমন করেন…আল্লাহতালা তাঁকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, তুমি আমার বান্দা (ঈসা)-কে আমার নিকট উঠিয়ে নিয়ে এসো।” (তারীখে দামেস্ক ৪৭/৪৭২; তারীখে বাগদাদ ১১/৩৭৯, সনদ সহীহ – তাহকীক শায়খ আলবানী রহ.)।
তারপর বাকি থাকল, كما رفع (কামা রুফি’আ) অর্থ ‘যেমনিভাবে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে’- এখানে হযরত উমর “কামা” শব্দে রাসূল (সা.)-কে ঈসার সাথে ‘মৃত্যুবরণ না করা’-এর দিক থেকে তাশবীহ (তুলনা) করেছেন, এটুকু পরিষ্কার। আর ঈসা (আ.)-এর মতই রাসূল (সা.)-কেও ‘আকাশে’ উঠিয়ে নেয়ার তাশবীহ’র কারণ, হযরত উমর (রা.) যখন রাসূলের মৃত্যু সংবাদ শুনতে পান তখন তিনি নিকটে ছিলেন না। অন্যথা তিনি রাসূল (সা.)-এর মৃত্যু শোকে যতই হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হন না কেন, তিনি রাসূল (সা.) সম্পর্কেও ‘আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে’ বলে উক্তি করতেন না। কারণ ঐ মুহূর্তে রাসূল (সা.)-এর শরীর মোবারক আয়েশা (রা.)-এর হুজরাতে-ই বিদ্যমান ছিল! সংক্ষেপে।
২. যদি و ما محمد الا رسول…الخ আয়াতটি দ্বারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ‘সমস্ত রাসূল মৃত্যুবরণ করেছেন’ বলেই বুঝাতে চাইতেন তাহলে তিনি আয়াতটিতে قد خلت ধরণের ‘মুশতারিক’ (ব্যপকার্থবোধক) শব্দ রাখতেন না। তিনি মওত বা قد ماتت ধরণের খাস তথা দ্ব্যর্থবোধক শব্দ-ই রাখতেন। এখন তাঁর এ ‘মুশতারিক’ শব্দ নেয়ার হিকমত কী? জেনে রাখা জরুরি যে, উক্ত আয়াতটির ‘গত হইয়া গিয়াছে’ বলতে রূপক অর্থে মৃত্যুবরণ করার মাধ্যমে এবং সশরীরে জীবিত উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে (উভয় পদ্ধতিতে) ইহজগত থেকে স্থানান্তরিত হওয়া-ই বুঝানো উদ্দেশ্য। এটাই আল্লাহ’র উক্ত ‘মুশতারিক’ শব্দ গ্রহণের হিকমত বা রহস্য।
৩. রাসূল (সা.)-এর চেয়ে পবিত্র কুরআনের মর্মার্থ দ্বিতীয় কেউই ভালো বুঝার দাবী করতে পারেনা। তিনিই কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। তাঁরপর কুরআনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম। ফলে সহজেই প্রশ্ন আসবে যে, যদি و ما محمد الا رسول…الخ আয়াতটি দ্বারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ‘সমস্ত রাসূল মৃত্যুবরণ করেছেন’ বলেই বুঝাতে চাইতেন তাহলে রাসূল এবং তাঁর সকল সাহাবী কিভাবে হযরত ঈসা (আ.)-এর পুনঃ আগমনে বিশ্বাস রাখতে পারেন?
৪. এখন হয়ত কোনো কাদিয়ানী কাল্ট বলতে পারে যে, আয়াতটির পুরাতন কোনো অর্থ বা ব্যাখ্যা সে মানবেনা। সে মির্যা কাদিয়ানী আর তার খলীফাদের কৃত অর্থই মানবে। তার জন্য তাদের প্রথম খলীফা হেকিম নূরুউদ্দীনের কৃত অনুবাদটি এখানে তুলে ধরা হল। হেকিম নূরউদ্দীনের বইতে আয়াতটির অর্থ উর্দূতে উল্লেখ আছে এভাবে যে, ((اور محمد تو ایک رسول ہے پہلے اس سے بہت رسول ہو چکے پھر کیا اگر وہ مر جائے یا قتل کیا جاوے تو پھر جاؤ گے الٹے پاؤں پر (فصل الخطاب لمقدمة اہل الکتاب))) অর্থ-মুহাম্মদ তো একজন রাসূল মাত্র; তাহার পূর্বে ‘বহু রাসূল’ হইয়েছিল। যদি তিনি মারা যান অথবা হত্যা হইয়া যান, তাহলে কি তোমরা পেছনে (বাপ-দাদার ধর্মে) ফিরিয়া যাইবে? (ফাছলুল খিতাব লি-মুকাদ্দিমাতি আহলিল কিতাব [উর্দূ] পৃষ্ঠা ২৮; রচনাকাল ১৮৮৭-৮৮ইং দ্রষ্টব্য)। প্রিয় কাদিয়ানীবন্ধু! হেকিম নূরউদ্দীন থেকে و ما محمد الا رسول…الخ আয়াতটির অর্থ- (پہلے اس سے بہت رسول ہو چکے-উচ্চারণ : পহেলে উস চে বহুত রাসূল হো চুকে) তথা “তাহার পূর্বে ‘বহু রাসূল’ হইয়াছিলো”। এবার পারলে এ অর্থ হতে ‘ঈসা (আ.)-কে মৃত’ সাব্যস্ত করে দেখান!
৫. তাফসীরে ইবনে কাসীর থেকে ঈসা (আ.) সম্পর্কে উম্মতে মুহাম্মদীয়ার তাওয়াতূর স্তরীয় আকীদা কেমন তা পেশ করা হল, ইমাম ইবনু কাসীর (রহ.) সূরা যুখরুফ-এর ৬১ নং আয়াতের বিশ্লেষণে মুসলমানদের ধারাবাহিক (ইজমায়ী) আকীদা সম্পর্কে লিখেছেন ((وقد تواترت الأحاديث عن رسول الله صلى الله عليه وسلم، أنه أخبر بنزول عيسى عليه السلام قبل يوم القيامة إماما عادلا، وحَكَما مقسطا)) অর্থাৎ রাসূল (সা.) থেকে বর্ণিত তাওয়াতূর স্তরীয় হাদীসসমূহ সংবাদ দিচ্ছে যে, ঈসা আলাইহিস সালাম কিয়ামতের আগে একজন ন্যায়পরায়ণ ইমাম এবং ন্যায়নিষ্ঠ শাসকরূপে অবতরণ করবেন। ইবনে কাসীর, ১২/৩২৩, সূরা যুখরুফ ৬১ দ্রষ্টব্য। এখন প্রশ্ন হল, উম্মতে মুহাম্মদীয়ার ধারাবাহিক আকীদা পরিপন্থী و ما محمد الا رسول…الخ আয়াতের সেই অর্থ কিভাবে সঠিক হতে পারে যেটি উম্মতে মুহাম্মদীয়ার ধারাবাহিক আকীদার বিরুদ্ধে!?
লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী
অ্যাডমিন- রদ্দে কাদিয়ানী (গুগল অ্যাপ)