বর্তমানে ক্বওমী মাদরাসাগুলো জনগণের সাহায্য সহযোগিতায় চলার যে পদ্ধতিটা দেখা যাচ্ছে এটা মূলত আমাদের আকাবিরদের তরীকার বিপরীত। দেওবন্দে কালেকশনের জন্য আলাদা মুহাসসিল আছে। এটা উস্তাদ ছাত্রের কাজ নয়।
আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে উস্তাদ ছাত্ররা এটা আঞ্জাম দেয়। কোরবানির সময় ছাত্রদের দিয়ে চামড়া কালেকশন করার বিষয়টা সব সময় আমাদের বিবেকে বাঁধে, আমাদেরকে পীড়া দেয়। একই বাড়ির সামনে ছাত্র-উস্তাদ দাঁড়িয়ে আছেন চামড়ার জন্য, ভিক্ষুক দাঁড়িয়ে আছে গোশতের জন্য। বাড়িওয়ালা ভিক্ষুকদেরও ধমকাচ্ছে, ছাত্র-শিক্ষকদেরও ধমকাচ্ছে। বাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়ার ঘটনাও তো আমাদের সামনেই ঘটেছে। এমন দৃশ্যগুলো আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। এছাড়াও আরও কত লাঞ্ছনাকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। তা তো আমরা নিজ চোখেই দেখেছি। আবার অল্প সময়ে ভালো পরিমাণ অর্থ আয় হওয়াতে কমিটির লোকেরা এটা কোনোভাবেই বন্ধ করতে সম্মত হয় না। তাছাড়া রমজান মাসে কালেকশনের জন্য শিক্ষকদের বাধ্য করাও আমাদের মাদরাসাগুলোতে বিচিত্র নয়। সে কালেকশন করতে গিয়ে তাদের মান-মর্যাদা ঠিক থাকবে কিনা তা দেখার যেন কেউ নেই।
হযরত থানবী (রহ.) এর বক্তব্য ছিল, কোনো ছাত্র তো নয়; কোনো শিক্ষকও কালেকশন করতে যাবে না। এমনকি যদি এর জন্য মাদরাসার সংখ্যা কমে যায়, তাও দীনের জন্য ভালো। তাই আমরা আমাদের এখানে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি যেন ছাত্র-শিক্ষক সকলেরই ইজ্জত সুরক্ষিত থাকে। কালেকশনের জন্য তারা মানুষের বাড়ি-বাড়ি যাবে না। চামড়ার কালেকশন করবে না। এমনিভাবে উস্তাদরাও রমজানে যাকাত কালেকশনের জন্য রশিদ বই নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করবে না।
হ্যাঁ, নিজের ইজ্জত রক্ষা করে যতটুকু করা যায় তা করবে। পারলে করবে, না পারলে না করবে। কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। অর্থনৈতিক বিষয়টা আমরা সামনে রেখে তা’লীম গ্রহণে আসলাফ ও আকাবিরের যে চেতনা ও পদ্ধতি ছিল তা আবার ফিরিয়ে আনার চিন্তা করেছি। অর্থাৎ ইলম হাসিলের পথে ছাত্র তার সাধ্যমত খরচ করবে। যেমন সালাফের যামানায় ইলম হাসিলের যাবতীয় খরচ শিক্ষার্থী নিজে বহন করত। কারও কারও জীবনীতে পাওয়া যায়, বাবার রেখে যাওয়া বিপুল সম্পদের পুরোটাই ইলমের পথে ব্যয় করে দিয়েছেন।
তাই আমাদের চিন্তা হল প্রতিষ্ঠান নয়; শিক্ষার্থী নিজেই নিজের খরচ বহন করবে। সাধারণত আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ম হল, নির্ধারিত নম্বর পেলে মাসিক প্রদেয় মওকুফ হয়ে যায়। কিন্তু এই ফিকির সামনে রেখে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, মাসিক প্রদেয় ফ্রি হওয়ার সম্পর্ক থাকবে সামর্থ্যের সাথে, নম্বরের সাথে নয়। নম্বর বিবেচ্য হবে কেবল ভর্তির ক্ষেত্রে। নম্বর পেলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবে, না হয় না।
এর অর্থ এই নয় যে, এখানে কেবল ধনীরাই সুযোগ পাবে। ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবার জন্য অবারিত সুযোগ থাকবে। তবে প্রত্যেকেই সাধ্য অনুযায়ী ব্যয় করবে; স্বচ্ছলতা নেই বলে সে কিছুই দিবে না- এমন যেন না হয়। যে যতটুকু পারে ততটুকুই দিবে, বাকিটুকু প্রতিষ্ঠান বহন করবে। খরচ করতে অভ্যস্ত হওয়া ইলমের জন্য যেমন দরকার তেমনি দরকার নিজের ব্যক্তিত্ব গঠনের জন্য। এই অভ্যাস না থাকলে ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। একজন লোক যত বড়ই হোক যদি অন্যকে দেওয়ার অভ্যাস তার মাঝে গড়ে না উঠে, কেবল গ্রহণ করেই সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে কোনদিন তার মানসিকতা বড় হয় না। তার প্রতি মানুষের ভক্তি-শ্রদ্ধা জন্মায় না। মানুষ তাকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে না। তাই সমাজে সে কোনো প্রভাবও রাখতে পারেনা, সে গলে যায় অর্থবিত্তের সামনে। এজন্য কেবল যোগ্যতাই যথেষ্ট নয়, যোগ্যতার ব্যবহারের জন্য এই ব্যক্তিত্বকেও ধরে রাখা অত্যন্ত জরুরি।
- আল্লামা আবুল বাশার সাইফুল ইসলাম হাফিজাহুল্লাহ।
- শাইখুল হাদীস : জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া৷
- মুহাম্মাদপুর, ঢাকা৷