কাদিয়ানীর লেখিত বিভিন্ন বই পুস্তক থেকে হুবহু অনুবাদ সহ তার উত্থানের ঐতিহাসিক বিবরণ,
উনিশ শতকে যখন ব্রিটিশ শক্তি ভারত দখল করে নেয়, তখন স্বাধীনতা সংগ্রামের ইমাম হযরত শাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী ফতোয়া দিয়েছিলেন, ভারত দারুল হরব এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ ফরজ। যার ফলশ্রুতিতে পুরো ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের লেলিহান শিখা জ্বলে ওঠে। এ জাতির আলেমসমাজ এবং স্বদেশের মুজাহিদগণ জীবন মুঠোয় নিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রতিটি মোড়ে প্রতিটি রণক্ষেত্রে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী ভল্লুকদের সাহসিকতার সঙ্গে তারা রুখে দাঁড়ান। এটা সত্য, ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুসলমান মুজাহিদগণ হেরে গেছেন। এ কারণে তারাই সাম্রাজ্যবাদী অমানবিক পৈশাচিক নির্যাতনের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। তবে তাঁদের জিহাদি প্রেরণা কমে যায়নি কখনো। ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলেছে অহর্নিশ।
ইংরেজদের বাজদৃষ্টি মুজাহিদগণের আত্মায় পোষিত এই অগ্নিবিপ্লবের কথা সচেতনভাবেই জানতো। মুসলমান বিপ্লবীদের হৃদয় মৃত্তিকায় চাপাপড়া জিহাদের লেলিহানের কথা তারা জানত। এও জানত, যেকোনো সময় তা অগ্নিলাভার রূপ নিতে পারে এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সাজানো মঞ্চকে খাক করে দিতে পারে। এ ভয় থেকেই তারা ‘দলাদলি সৃষ্টি করো এবং শাসন করো’- এর ফর্মুলা জন্ম দেয়। মুসলিম জাতির জিহাদি জোশ, বিশ্বাসিক শক্তি, ঈমানি পূর্ণতা, কুরআন ও সুন্নতের প্রতি আকুল ভালবাসাকে চিরতরে ধ্বংস করে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদকে চির প্রতিষ্ঠিত করার তাগিদে একজন ‘সরকারী নবী’ সৃষ্টির প্রকল্প হাতে নেয়। বিষয়টি পরে ব্রিটিশ কমিশনের একটি প্রতিবেদন থেকে প্রতিভাত হয়ে ওঠে।
১৮৬৯ সালে স্যার উইলিয়াম হান্টারের নেতৃত্বে ইংরেজগোষ্ঠী ভারতবর্ষে একটি কমিশন দল প্রেরণ করেন। ইংরেজদের সম্পর্কে মুসলমানদের মনোভাব যাচাই এবং ভবিষ্যতে মুসলমানদের কিভাবে শেষ করে দেয়া যায়, তার একটা বাস্তব পরিকল্পনা তৈরিই ছিল এই কমিশনের লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে তারা এক বছর ধরে এখানে থেকে মুসলমানদের বিভিন্ন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। ১৮৭০ সালে লন্ডনের ভয়েন্ট হাউজে একটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। তাতে কমিশনের প্রতিনিধিগণ ছাড়াও বিশেষভাবে ভারতবর্ষে নিযুক্ত মিশনারী পাদ্রিগণও অংশগ্রহণ করেন। উভয় দল ভিন্ন ভিন্নভাবে রিপোর্ট পেশ করেন। এ রিপোর্টটি পরে ‘দি এরাইভল অফ ব্রিটিশ অ্যাম্পায়ার ইন ইন্ডিয়া’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। স্যার উইলিয়াম হান্টার তার প্রতিবেদনে লিখেছেন, “মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস হলো, কোনো বিদেশি শাসনের অধীনে বেঁচে থাকার সুযোগ নেই। তাই বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে জিহাদ করা অত্যাবশ্যক। জিহাদের এই মর্মবাণীর প্রতি তাদের অন্তরে রয়েছে উত্তাল আকুলতা। তারা জিহাদের জন্য সদা প্রস্তুত থাকে। তাদের এই মনোভাব যে কোনো সময় তাদেরকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে।”
এ দিকে পাদ্রী সম্প্রদায় তাদের রিপোর্টে বলছে,
- Report of missionary fathers.
- majority of the population of the country blindly follow their press their Spritual leaders at this stage. we succeed in finding out would be ready to daclare himself a Zilli Nabi (apostolic prophet). then the large number of people will relly round him. but for this puopose, it is very difficult to persuade someone from the Muslim masses. if this problems solved, the prophethood of such a pesson can flourish under the patronage of the government. we have already over powered the native government mainly persuing policy of seeking help from the traitors. that is a deffitary point of view, now when we have sway over every nook of the country and there is peace and order everywhere, we ought to undertake measure which might create internal unrest among the country. [Extact from the printed report India office library, London]
- “রাষ্ট্রের অধিবাসীদের অধিকাংশই ধর্মীয় নেতাদের অন্ধ অনুসরণ করে। এক্ষেত্রে যদি আমরা এমন কাউকে খুঁজে বের করতে পারি, যে এই কাজের জন্য প্রস্তুত হবে; নিজেকে ‘ছায়ানবী‘ হিসেবে ঘোষণা করবে। তাহলে একটি বিরাট জনগোষ্ঠী তার পাশে জড়ো হবে। কিন্তু এই লক্ষ্য সাধনের জন্য সাধারণ মুসলমানদের কাউকে উৎসাহিত করা কঠিন। যদি এই সমস্যা সমাধান হয়, তাহলে এই ব্যক্তির নবুওয়াতের বিষয়টিকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এগিয়ে নেয়া যায়। আমরা ইতিপূর্বে গাদ্দারদের সহযোগিতায় ভারতের শাসকদের প্রজা বানিয়েছি। কিন্তু সে ছিল ভিন্ন বিষয়। তখন সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে গাদ্দারদের প্রয়োজন ছিল। এখন যখন রাষ্ট্রের সকল প্রান্তে আমাদের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বহমান; তখন আমাদের এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যাতে রাষ্ট্রে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সৃষ্টি হয়।” [প্রিন্টেড রিপোর্ট, ইন্ডিয়া অফিস লাইবেরি, লন্ডন ]
এই রিপোর্টের আলোকে আমরা ব্রিটিশ পরিকল্পনাটি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি। মূলত এই পরিকল্পনার অধীনেই ব্রিটিশ প্রশাসন শীয়াদের মধ্য থেকে মির্যা হুসাইন আলী নূরীকে (যিনি বাহাউল্লাহ নামে প্রসিদ্ধ) আর সুন্নীদের মধ্য থেকে মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে স্বপ্রণীত নবুয়তের স্টেজে দাঁড় করিয়ে দেয়। মির্যা কাদিয়ানীর তৎপরতাগুলো সামান্য খুঁটিয়ে দেখলেই আমরা সহজে এই বিশ্বাসে উপনীত হতে পারব যে, কাদিয়ানীর নবুওয়াত ব্রিটিশদের তৈরি, তাদের হাতেই লালিত হয়েছে এবং বেড়ে উঠেছে তাদেরই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। আর এ কথা স্বয়ং কাদিয়ানীও তার বিভিন্ন রচনায় স্বীকার করেছে। যেমন, লক্ষ করুন!
বৃটিশ রাণী ভিক্টোরিয়াকে এক চিঠিতে লিখেছেন,
“হে মহামহিম ভারত সম্রাজ্ঞী! আপনার মহিমা এবং সুনাম মুবারক হোক! খোদার দৃষ্টি (তথা করুণা) সে দেশের উপরই রয়েছে, যে দেশের উপর রয়েছে আপনার দৃষ্টি, খোদার রহমত (তথা সাহায্য) সে জনতার উপরই রয়েছে যে জনতার উপর রয়েছে আপনার হাত (তথা হুকুমত)। আপনার পবিত্র নিয়ত (আকাঙ্খা) এর ফলশ্রুতিতেই আল্লাহ আমাকে (রূপক ‘মসীহ’ বানিয়ে) প্রেরণ করেছেন।” (সেতারায়ে কায়সারিয়া, রূহানী খাযায়েন ১৫/১২০, মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী)।
কাদিয়ানী তার এ লিখায় অকপটে বলেই দিয়েছে যে, আল্লাহ নাকি তাকে বৃটিশ রাণীর পবিত্র নিয়ত (আকাঙ্খা) এর ফলশ্রুতিতেই দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন।” প্রামাণ্য স্ক্যানকপি দ্রষ্টব্য।
পাঞ্জাবের লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে এক আর্জিতে লিখেছেন,
“নিজেদের হাতে রোপিত এই চারাগাছটির ব্যাপারে খুব সতর্কতা ও অনুসন্ধানের সাথে অগ্রসর হবেন এবং আপনার অধীনস্তদের বলবেন তারা যেন এই পরিবারের ত্যাগ ও নিষ্ঠার কথা মনে করে আমার দলের প্রতি সদয় দৃষ্টি জ্ঞাপন করেন। আমাদের পরিবার ইংরেজ সরকারের কল্যাণে নিজেদের খুন বইয়ে দিতে ও জীবন দিতেও দ্বিধা করেনি আর না এখনো দ্বিধা করছে।” (মাজমু’আয়ে ইশতিহারাত ৩/২১-২২; নতুন এডিশন)।
আরেকটি রচনায় লিখেছেন,
“আমার (ধর্ম)মত এটাই যা আমি প্রতিবার প্রকাশ করে থাকি তা হল, ইসলামের দুটি অংশ। একটি হল খোদাতালার আনুগত্য করা আর দ্বিতীয়টি হল, এই (ব্রিটিশ) সরকারের আনুগত্য করা যে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করেছে এবং জালেমদের হাত থেকে আপনা ছায়ার নিচে আশ্রয় দিয়েছে। সেটি হল ব্রিটিশ সরকার।” (রূহানী খাযায়েন ৬/৩৮০)।
আরেক জায়গায় লিখেছেন,
“আমার জীবনের অধিকাংশই এই ইংরেজ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা আর সহযোগিতার মধ্যেই অতিবাহিত হয়েছে। আমি জিহাদ নিষিদ্ধ করে ইংরেজ সরকারের আনুগত্যের উপর এই পরিমাণ কিতাব (পুস্তক) রচনা করেছি এবং (এত অধিক পরিমাণ) প্রচারপত্র প্রকাশ করেছি যদি ঐ পত্রাবলী এবং পুস্তকগুলি একত্রিত করা হয় তাহলে তা দ্বারা ৫০টি আলমারি ভর্তি হয়ে যাবে। আমি এই সমস্ত কিতাব তামাম আরব, মিশর, সিরিয়া, কাবুল এবং রোম (ইউরোপ-ইতালি) দেশেও পৌঁছে দিয়েছি। আমার সদাসর্বদা প্রচেষ্টা এটাই থাকে যে, মুসলমানরা যেন এই (ইংরেজ) সরকারের প্রকৃত খয়েরখাঁ হয়ে যায় এবং খুনি মাহদী এবং খুনি মসীহ সংক্রান্ত ভিত্তিহীন বর্ণনাসমূহ এবং জিহাদের প্রতি উদ্বুদ্ধকারী সমস্ত মাসয়ালা তাদের অন্তরসমূহ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় যেগুলো আহাম্মকদের অন্তরসমূহ খারাপ করে দিয়েছে।” (রূহানী খাযায়েন ১৫/১৫৫-৫৬)।
তিনি অন্য একটি রচনায় লিখেছেন,
“আমি বিশ বছর পর্যন্ত ইংরেজ সরকারের প্রতি আনুগত্যের শিক্ষাই দিয়ে যাচ্ছি। আমি আমার মুরিদদের মাঝে এই হিদায়াতই (নির্দেশনা) জারি রেখেছি। তাহলে কিভাবে সম্ভব হতে পারে যে, আমি এই সমস্ত হিদায়াতের বিপরীতে কোনো প্রকারের সরকার-দ্রোহী অভিসন্ধির শিক্ষা দিচ্ছি! অথচ আমি জানি যে, আল্লাহতালা স্বীয় খাস অনুগ্রহে এই সরকারকেই আমার এবং আমার জামাতের আশ্রয়স্থল বানিয়েছেন। এই সরকারের ছায়াতলে আমাদের জন্য যে নিরাপত্তা অর্জিত সেটি না মক্কা শরীফে রয়েছে আর না মদীনায় আর না রোম সম্রাটের কনস্টানটিনোপলের সিংহাসনেও।” (রূহানী খাযায়েন ১৫/১৫৬)।
আরেকটি রচনায় লিখেছেন,
“আমি ইংরেজ সরকারের যে সেবা করেছি তা হলো, এ দেশে এবং অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রে প্রায় পঞ্চাশ হাজার বই পুস্তক এবং প্রচারপত্র ছাপিয়ে বিতরণ করেছি। এ সব রচনায় আমি বলেছি, ইংরেজ সরকার আমাদের মুসলমানদের কল্যাণকামী বন্ধু। তাই ইংরেজ সরকারের নিষ্ঠাপূর্ণ আনুগত্য প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজ।” (সেতারায়ে কায়সারিয়া-৪, রূহানী খাযায়েন ১৫/১১৪, মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী)।
সুতরাং নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে, কাদিয়ানীর কথিত নবুওয়ত ব্রিটিশ সরকারেরই একটি পরিকল্পিত প্রজেক্ট। ব্রিটিশরাই নিজেদের ক্ষমতা টিকানোর উদ্দেশ্যে তাকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে দাঁড় করিয়েছিল। একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিকের পক্ষেও কখনো সম্ভব নয় যে, দখলদার বিদেশীদের দখলদারিত্বের পক্ষে জীবন উৎসর্গ করা, পঞ্চাশটি আলমারি ভর্তি লিখনী দিয়ে সাহায্য করা। কাজেই তার মাহদী, মসীহ কিংবা ‘ছায়ানবী’ ইত্যাদি দাবীসমূহ বাতুলতা আর ভেল্কিবাজি ছাড়া আর কিছুই না।
- বিশিষ্ট লিখক- মুহাম্মাদ যাইনুল আবিদীন
- সম্পাদনা- মুহাম্মদ নূরুন্নবী এম.এ