ঈমান কি বাড়ে কমে?
ইমাম আবু হানিফা (রহিমাহুল্লাহ)-এর সময় খারিজিদের খুব উৎপাত ছিল। তারা কবিরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তিদের কাফের মনে করতো এবং তাদের সাথে যুদ্ধ করা এবং তাদের জান মালকে হালাল মনে করত। কারণ, তাদের মতে ঈমান আমলের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং আমল পরিত্যাগ করা মানে ঈমান পরিত্যাগ করা। এজন্য আমল যে ঈমানের মূল বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত নয় এবং আমল ত্যাগের কারণে যে কেউ কাফের হয় না, তাকে হত্যা করা তার মাল ছিনিয়ে নেয়া যে বৈধ নয়, তা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া ওলামায়ে কেরামের উপর আবশ্যক হয়ে পড়ে। সে দায়িত্বই পালন করেছিলেন ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ)। তিনি ফাতাওয়া দিলেন, ঈমান আর আ’মল সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। আ’মল দ্বারা ঈমানে শক্তি বৃদ্ধি হয়, তবে সেটি ঈমানের অংশবিশেষ নয়। তিনি এ ফাতাওয়ার সমর্থনে দলিল এবং যুক্তি দুটোই পেশ করেন।
ঈমান শব্দের মূল অর্থ হলো বিশ্বাস করা, সত্যায়ন করা। খারেজিদের নিকট ঈমানের মূল রুকন বা ভিত্তি তিনটি। যথা-
১. ঈমানের বিষয়গুলোকে অন্তরে বিশ্বাস করা,
২. মুখে স্বীকার করা,
৩. শরীয়ত মোতাবেক আমল করা।
তাদের নিকট এগুলোর একটি বাদ গেলেও ঈমান থাকবে না, তাই কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি কাফের, যেহেতু সে আমল পরিত্যাগ করেছে আর আমল ঈমানের তিন রুকনের এক রুকন। উল্লেখ্য, প্রসিদ্ধ মাযহাব চতুষ্টয়ের তিনটি-ই আ’মলকে ঈমানের বাহিরের জিনিস বলে মত দিয়েছে।
বলাবাহুল্য, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের কতিপয় বিশেষজ্ঞ ঐ তিনটির সমষ্টিকে ঈমানের মূল রুকন বা ভিত্তি বললেও তাঁরা আমল পরিত্যাগকারীকে খারেজীদের মত ‘কাফের’ বলেন না। কিন্তু এটা তাঁদের এক ধরনের স্ববিরোধিতা বৈ নয়।
কারণ, বাকি দুই রুকনের মধ্যে সামান্য পরিমাণ ঘাটতি হলেও ঈমান বাতিল হয়, যেমন- কেউ বলল, আমি ফেরেশতায় বিশ্বাস করি না, তবে ঈমানের বাকি সব বিশ্বাস করি। এখানে ফেরেশতার প্রতি বিশ্বাসের কমতি হওয়ায় তার পুরো ঈমানই বাতিল হয়ে যাবে। তদ্রূপ কেউ বলল, আমি যাবুরকে আসমানী কিতাব হিসেবে স্বীকার করি না, কিন্তু ইসলামের বাকি সব মান্য করি। এ ব্যক্তি বাকি সব মানা সত্তেও কাফের বলে গণ্য হবে। তদ্রুপ কেউ যদি বলে, আমি পুরো কোরআন মানি তবে অমুক আয়াত মানি না। এই ব্যক্তি ও কাফের বলে গণ্য হবে। তদ্রূপ বাড়তি করলেও কাফের হবে। যেমন কেউ নিশ্চিতভাবে বলল শ্রীকৃষ্ণ নবী ছিল। অথচ এর স্বপক্ষে কোরআন হাদিসের কোন দলিল নেই। অথবা বলল বর্তমানে ও নবী আসা সম্ভব, তাহলে সে কাফের হবে। সুতরাং বুঝা গেল ঈমানের এই মৌলিক দুটি রুকনে বাড়তি কমতির কোনো সুযোগ নেই।
যেহেতু ঈমানের বিষয়বস্তুগুলোতে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বাড়তি কিংবা কমতির সুযোগ নেই এ দৃষ্টিকোণ থেকেই ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ঈমান বাড়েও না কমেও না। এ মাসআলাটিকে ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ “আল আলিমু ওয়াল মুতাআল্লিম”-এ অত্যন্ত সুন্দর ও চমকপ্রদভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আগ্রহীরা সেখানে দেখে নিতে পারেন।
যাইহোক, তাহলে মুহাদ্দিসদের কথা অনুযায়ী তৃতীয় রুকনে তথা আমলের ক্ষেত্রেও সামান্য পরিমাণ ছুটে গেলে পুরো ঈমান বাতিল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু খারেজীদের মতো সেটা তারা বলছেন না, সুতরাং এটা প্রকৃতপক্ষে ঈমানের রুকন নয়। হ্যাঁ, যদি এটাকে ঈমানের পূর্ণতাদানকারী রুকন বলি, ঈমানের অস্তিত্ব আনয়নকারী রুকন না বলে তাহলে অসুবিধা নেই।যেমন- হাসান নামক ব্যক্তির মাথার সুন্দর চুল না থাকলেও ব্যক্তি হাসান অস্তিত্বে থাকে। তদ্রুপ তার নাক, কান, চোখ, হাত ও পা না থাকলেও ব্যক্তি হাসান আছে বলে গণ্য হবে। কিন্তু এগুলো থাকলে ব্যক্তির দৈহিক সৌন্দর্যও গঠন পূর্ণতা লাভ করে।
তদ্রুপ ঈমানের বিষয়বস্তুগুলোর প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস এবং মৌখিক স্বীকৃতি থাকা অবস্থায় ব্যক্তি আমল পরিত্যাগ করলেও তার ঈমান বিদ্যমান থাকে কিন্তু ঈমানের সৌন্দর্যবর্ধক জিনিস বিদ্যমান থাকে না। আর যখনি ঈমানের বিষয়বস্তুগুলোর কোন একটিতে অবিশ্বাস করার মাধ্যমে কমতি সাব্যস্ত হবে, তখনি কুফর আবশ্যক হবে।
সুতরাং আমরা বুঝলাম ইমাম আবু হানিফা রহ. ঈমান বাড়েও না কমেও না বলে বুঝিয়ে থাকেন ঈমানের বিষয়বস্তুতে কমতি বাড়তি হয় না। আর কোরআন হাদিসের যত জায়গায় ঈমান বাড়া এবং কমার কথা বলা হয়েছে সেগুলো দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, ঈমানের সৌন্দর্য বাড়া, নূর বৃদ্ধি পাওয়া, ঈমানের বিষয়বস্তুতে বাড়তি কমতি উদ্দেশ্য নয়।
কারণ শত শত আমল থাকা সত্ত্বেও ঈমানের বিষয়বস্তুগুলোর কোন একটিতে সামান্য পরিমাণ অবিশ্বাস করলে সে কাফের বলে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে ঈমানের বিষয়বস্তুগুলোর প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস ও মৌখিক স্বীকৃতি থাকাবস্থায় সকল আমল বর্জন করলেও সে কাফের বলে গণ্য হবে না।
আবার কোন হালালকে হারাম মনে করলে কিংবা হারামকে হালাল মনে করলে সাথে সাথে কাফের হয়ে যাবে। অকাট্য দলিলে প্রমাণিত কোন গুনাহে লিপ্ত হওয়াকে হালাল মনে করলেও কাফের হয়ে যায়। এসকল বিষয়ে মুহাদ্দিসদের সাথে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মুতাকাল্লিমদের কোন বিরোধ নেই।
সুতরাং বোঝা গেল ঈমান হলো অন্তরের বিষয় আমল ঈমানের অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে ঈমান আনার কারণে আমল আবশ্যক হয়, আমলের কারণে ইমান আবশ্যক হয় না।
আমল যে মূল ঈমানের অন্তর্ভুক্ত নয় এ ব্যাপারে ইমাম আবু হানিফার বহু দলিল রয়েছে। ইনশাআল্লাহ ধীরে ধীরে আমরা সেগুলো আলোচনা করব।
লিখক, অ্যাডমিন ফিকহ মিডিয়া