Home নবীদের ঘটনা সোলাইমান নবী (আ.) এর স্ত্রীদের প্রকৃত সংখ্যাটি কেমন?

সোলাইমান নবী (আ.) এর স্ত্রীদের প্রকৃত সংখ্যাটি কেমন?

0

প্রশ্ন : হযরত সোলাইমান (আ.)-এর স্ত্রীদের প্রকৃত সংখ্যাটি নিয়ে আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছি। আপনি কি আমাকে এর বিহিত একটা সমাধান দিতে পারবেন?

উত্তর : হযরত সোলাইমান (আ.)-এর স্ত্রীদের সংখ্যার ব্যাপারে সহীহ গ্রন্থের হাদীস সমূহে নানা অংক উল্লেখ রয়েছে। যেমন এক জায়গায় উল্লেখ আছে,

لأَطُوفَنَّ اللَّيلَةَ بِمِائَةِ امرَأَةٍ

অর্থাৎ “আজ রাতে আমি নিশ্চয়ই একশত স্ত্রীর নিকট পরিভ্রমণ (সহবাস) করব।” আপনি যদি সহীহ গ্রন্থগুলো সহ হাদীসের অপরাপর সোর্সগুলোও দেখেন তবে দেখবেন যে, সেখানে হযরত সোলাইমান (আ.) কোনো এক রাত্রিতে নিজ স্ত্রীদের মধ্য থেকে ৬০, ৭০, ৯০, ৯৯ বা ১০০ জন স্ত্রীর নিকট গমনের ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ আছে। (বুখারী হা/২৮১৯, ৩৪২৪, ৫২৪২, ৬৬৩৯, ৭৪৬৯; মুসলিম হা/১৬৫৪; মিশকাত হা/৫৭২০)।

ইমাম বুখারী ঐতিহাসিক অসঙ্গতিপূর্ণ বিবরণগুলো তাহলে কিজন্য গ্রন্থবদ্ধ করলেন?

উত্তরে বলা হবে যে, ইমাম বুখারী (রহ.) বিভিন্ন সনদে ঐতিহাসিক বিবরণটি নিজ সহীহ গ্রন্থে শুধুমাত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই এনেছেন, স্ত্রীদের সংখ্যা জানান দেয়ার জন্য আনেননি। কারণ এধরণের ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখের মধ্যে মানুষের তেমন কোনো ফায়দা নেই।

ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) ফাতহুল বারী গ্রন্থে এ সম্পর্কে লিখেছেন যে, বর্ণনাগুলোতে সোলাইমান (আ.)-এর স্ত্রীদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা বর্ণনা মূখ্য নয়, বরং ইন-জেনারেল ঘটনার অবতারণা করাই উদ্দেশ্য।

শারেহে মুসলিম ইমাম নববী (রহ.) আরও সুন্দর কথা বলেছেন, তিনি বলেছেন,

ولا نرى داعياً إلى استقصاء نسائه وحصرها إذ لا يَنْبَنِي على ذلك أمر ديني أو دنيوي

অর্থাৎ আমরা তার স্ত্রীদের (প্রকৃত সংখ্যার) তদন্ত এবং (নির্দিষ্ট সংখ্যায়) সীমাবদ্ধ করার কোনো কারণ দেখি না, কারণ এটি কোনো ধর্মীয় বা পার্থিব বিষয়ের উপর ভিত্তি রাখে না।

যারা ইতিহাসের ছাত্র তাদের জানা থাকার কথা যে, সাধারণত ঐতিহাসিক যে কোনো ঘটনার বর্ণনাকারীদের জন্য সেটিকে স্পেসিফিকভাবে (প্রকৃত সংখ্যা) তুলে ধরা সম্ভব হয়না, মতভেদ থাকে। কারণ হচ্ছে, ঘটনাগুলো একাধিক চেইনে বর্ণিত থাকে, ফলে চেইনগুলোর প্রথমদিকের কোনো রাবী যদি ভুল করেন তাহলে পুরো ব্যাপারটাই উলোটপালোট হয়ে যেতে বাধ্য।

উল্লেখ্য, হযরত সোলাইমান (আ.) এর মৃত্যু আনুমানিক ৯৩১ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। এতে সাহাবায়ে কেরাম এবং তাঁর (আ.) যুগের মাঝখানে প্রায় দেড় হাজার বছরের ব্যবধান। যার ফলে সাহাবায়ে কেরামগণ উক্ত ঘটনার প্রকৃত সনদ বা চেইনের শেষাংশের রাবী হওয়ায় তাঁদের কাউকে উক্ত ঘটনার জন্য অভিযুক্ত করা ঠিক হবেনা। কাজেই ইমাম বুখারী (রহ.) কর্তৃক সহীহ গ্রন্থে এ সকল মতভেদপূর্ণ সংখ্যা উল্লেখ করা নিয়ে চিন্তিত হবার কারণ নেই। বলাবাহুল্য, ইমাম বুখারী (রহ.) নিজ গবেষণার বিচারে ৯০ জনের হাদীসটিকে অধিক বিশুদ্ধ বলেছেন। সে যাইহোক, ফিলিস্তিন বংশোদ্ভূত হযরত সোলাইমান (আ.)-এর স্ত্রীর সংখ্যার ব্যাপারে ইস্রাঈলী সোর্স কিতাবুল মুকাদ্দাসের ভাষ্য হচ্ছে,

أن سليمان “كَانَتْ لَهُ سَبْعُ مِئَةٍ مِنَ ٱلنِّسَاءِ ٱلسَّيِّدَاتِ، وَثَلَاثُ مِئَةٍ مِنَ ٱلسَّرَارِيّ

“সোলাইমান (আ.) এর সাতশত স্ত্রী ও তিনশত উপপত্নী ছিল।” এরই উদ্ধৃতি টেনেছেন প্রখ্যাত মুফাসসির ইমাম ইবনু কাসীর (রহ.) তাঁর ঐতিহাসিক রচনা ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ এর মধ্যেও। বিখ্যাত ইসলামী ডিবেটার ও দাঈ ডক্টর আহমেদ দীদাত (রহ.) তার একটি লেকচারেও সোলাইমান (আ.) এর স্ত্রীর সংখ্যা কত, এমন একটি প্রশ্নের জবাবে ইস্রাঈলীদের সোর্স থেকে অনুরূপ তথ্য দিয়েছেন।

বলে রাখতে চাই যে, আসলে যারা ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যক রেওয়ায়েতগুলোর উপর আঙ্গুল উঁচিয়ে সাহাবীদের দিকে অভিযোগের তীর নিক্ষেপ করতে চাচ্ছেন তাদের বুঝা উচিত যে, ধরুন আজকের এ দিনে কোনো ডাকাতদলের হাতে আপনার গ্রামে এক সাথে ১৫/২০ জন মানুষ খুন হল। এমতাবস্থায় আগামী একশত বছর পরেও কি এ হিসেব একই থাকবে নাকি বদলেও যেতে পারে? অবশ্যই বদলে যেতে পারে। কেননা ঘটনার বর্ণনাকারীদের দুর্বলতা হেতু সময়ের ব্যবধানে হিসেব বদলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তার অর্থ এই নয় যে, এ জন্য মূল ঘটনাটিই ভিত্তিহীন হয়ে যাবে। হযরত সোলাইমান (আ.) এর স্ত্রীগণের প্রকৃত হিসেবটিকেও একই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে হবে। যেহেতু এখানে স্ত্রীদের প্রকৃত সংখ্যা কত, তা জানান দেয়া মূখ্য নয়, বরং ঘটনাটির মাধ্যমে নবীদের শক্তি ও ক্ষমতার বিশেষত্ব বর্ণনা দেয়াই মূখ্য। একই রাতে এত জন স্ত্রীর সাথে সহবাস করার শক্তি ও সামর্থ্য কেবল নবীরই বৈশিষ্ট্য হতে পারে। তাছাড়া স্ত্রীদের সংখ্যা বর্ণনার বাহ্যিক এই ভিন্নতা জামহূর উসূলবিদগণের দৃষ্টিতে পরস্পর সাংঘর্ষিক নয়। কারণ ছোট সংখ্যা উল্লেখের দ্বারা বড় সংখ্যা নাকচ হয়ে যাবেনা।

ঐতিহাসিক ঘটনার বৃত্তান্তে ইন-জেনারেল উপস্থাপনা এবং স্পেসিফিক সংখ্যা বর্ণনায় বিভিন্নরকম হওয়ার দৃষ্টান্ত স্বয়ং পবিত্র কুরআনেও বিদ্যমান। যেমন, সূরা কাহাফ এর ২২ নং আয়াতের মধ্যে আসহাবে কাহাফের (গুহাবাসীদের) ঐতিহাসিক ঘটনার অবতারণা করতে গিয়ে আল্লাহ তালা বলছেন, “অচিরেই তারা বলবে, ‘তারা ছিল তিনজন; তাদের চতুর্থটি ছিল তাদের কুকুর।’ কেউ কেউ বলবে, ‘তারা ছিল পাঁচজন; তাদের ষষ্ঠটি ছিল তাদের কুকুর।’ ওরা অজানা বিষয়ে অনুমান (তীর) চালায়। আর কেউ কেউ বলবে, ‘তারা ছিল সাতজন; তাদের অষ্টমটি ছিল তাদের কুকুর।’ বল, ‘তাদের সংখ্যা আমার প্রতিপালকই ভাল জানেন; তাদের সংখ্যা অল্প কয়েকজনই জানে।’ সুতরাং সাধারণ আলোচনা ব্যতীত তুমি তাদের বিষয়ে বিতর্ক করো না এবং তাদের কাউকেও তাদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করো না।” (কাহাফ)।

খেয়াল করুন, আল্লাহ চাইলে সঠিক সংখ্যাটি বলে দিতে পারতেন, কিন্তু বলেননি। কেননা এটি নিছক একটি ঐতিহাসিক ব্যাপার। এখানে ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণই মূখ্য, স্পেসিফিক সংখ্যা বলে দেয়াতে উম্মাহ’র কোনো উপকারিতা নেই।

দীর্ঘ আলোচনার সামারী হচ্ছে, এ সকল ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতি হ’ল,

إذَا حَدَّثَكُمْ أَهْلُ الْكِتَابِ فلَا تُصَدِّقُوهُمْ وَلَا تُكَذِّبُوهُمْ ، وَقُولُوا: آمَنَّا بِاللهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ ، فَإِنْ كَانَ حَقًّا لَمْ تُكَذِّبُوهُمْ ، وَإِنْ كَانَ بَاطِلًا لَمْ تُصَدِّقُوهُمْ

অর্থাৎ আহলে কিতাবী তথা ইসরাঈলীরা তোমাদেরকে যখন কোনো কথা বর্ণনা করবে তখন তাদের কথাকে সত্যায়ন করবেনা এবং মিথ্যাও বলবেনা। তোমরা বরং বলবে, আমরা আল্লাহ এবং তাঁর কিতাব সমূহ এবং সকল রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছি। কেননা যদি তা সত্য হয়ে থাকে তাহলে তোমরা তাকে মিথ্যা বলতে পারো না, আর যদি বাতিল (মিথ্যা) হয়ে থাকে তাহলে তোমরা তা সত্যায়ন করতে পারো না। (মুসনাদে আহমদ)।

এতে বুঝা গেল, ইস্রাঈলী বর্ণনা সমূহ ইসলামের আকায়েদ ও মৌলনীতির বিরোধী না হলে তার ব্যাপারে সত্য বা মিথ্যা কোনো মন্তব্য করা যাবেনা। (আবুদাউদ হা/৩৬৪৪; আহমাদ হা/১৭২৬৪; সহীহাহ হা/২৮০০)। যেজন্য, ইমাম বুখারী (রহ.) এর উল্লিখিত ঐতিহাসিক ঘটনাটিই যেহেতু ওহী নয়, বড়জোর ইসরাঈলীদের বিভিন্ন চেইন থেকে প্রাপ্ত সংবাদ, সাহাবায়ে কেরামগণও কোনোদিন প্রশ্ন তুলেননি; রাসূল (সা.) থেকেও এগুলোর সত্য বা মিথ্যা হওয়ার স্পেসিফিক কোনো দৃঢ় ফরমান নেই, সেহেতু উম্মাহ’র দায়িত্ব হচ্ছে, এ ব্যাপার গুলোকে ঐতিহাসিক জায়গা থেকে মূল্যায়ন করা, সত্য বা মিথ্যা কোনটাই মন্তব্য না করা। পবিত্র কুরআনের শিক্ষামতে, এ ধরনের প্রেক্ষিতে (Situation) নিশ্চিত জ্ঞান ব্যতীত যারা বিতর্ক করতে চায় তাদের কারও সাথে তর্কে না জড়ানো (কাহাফ ২২)। আল্লাহ আমাদেরকে হাদীস অস্বীকারকারী নির্বোধবন্ধুদের বাড়াবাড়ি থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী – শিক্ষাবিদ ও গবেষক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here