শায়খ আলবানী সাহেবের একটি গলদ ইজতিহাদ ও তার পর্যালোচনা
প্রশ্ন : শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী ইমাম আবূ হানীফাহ (রহ.)-এর দুর্বল হওয়ার পক্ষে ‘তাকরীবুত তাহযীব’ গ্রন্থের রেফারেন্স উল্লেখ করে বলেছেন, হাফেয ইবনে হাজার ‘তাকরীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে ইমাম আবূ হানীফাহ’র ব্যাপারে শুধু বলেছেন ‘তিনি একজন সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ’ আর কিছু উল্লেখ করেনি! (এটা তাঁর দুর্বল হবার প্রমাণ) [সিলসিলাহ য‘ঈফাহ: ৫৭২]। এর কী জবাব?
জবাব : এমন কথা সেই বলতে পারে যে ‘তাকরীবুত তাহযীব’ গ্রন্থটি রচিত হওয়ার কারণ ও এ গ্রন্থটির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আদৌ জানে না!
হাফেজ ইবনে হাজার (রহ.) রচিত ‘তাকরীবুত তাহযীব’ গ্রন্থটি হল তাঁরই রচিত আরেকটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘তাহযীবুত তাহযীব’ গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত রূপ! এই ‘তাহযীবুত তাহযীব’ গ্রন্থটি হল আবার হাফেজ মিযযী রচিত ‘তাহযীবুল কামাল’ গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত রূপ। আর হাফেয মিযযী রচিত ‘তাহযীবুল কামাল’ গ্রন্থটি হল হাফেজ মাকদীসী রচিত ‘আল-কামাল ফী আসমাইর রিজাল’ গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত রূপ। আর ‘আল-কামাল ফী আসমাইর রিজাল’ গ্রন্থটি হলো, সুপ্রসিদ্ধ ছয়টি গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সংকলিত রূপ এবং বুখারী রচিত ‘তারীখ’ ও ইবনে আবী হাতিমের ‘আল-জারহু ওয়াত-তা’দীল’ এবং ইবনে মা‘ঈন ও তার সাথি-সঙ্গী এবং তাঁর মত অন্যান্য ইমামদের রচিত কিতাবসমূহের সারনির্যাস।
অর্থাৎ তাকরীবুত তাহযীব গ্রন্থটি হলো, সংক্ষিপ্ত এর সংক্ষিপ্ত এর সংক্ষিপ্ত এর সংক্ষিপ্ত রূপ; তথা এক্সট্রিম কম্প্রেসড ফাইল— যা কয়েক ধাপে সংকুচিত হয়েছে।
এই গ্রন্থটি রচনার ব্যাপারে ইবনে হাজার নিজেই বলেন, “বিশেষজ্ঞ ছাত্রদের কাছে তাহযীবুত তাহযীব কিতাবটি ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে, কিন্তু এটি মূল কিতাবের এক তৃতীয়াংশ ছাড়িয়ে যাওয়ায় দীর্ঘ হয়ে গেছে। তাই আমার কিছু ভাই আমাকে শুধু রাবীদের নামগুলো আলাদা করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু আমি এটি পছন্দ করিনি। কারণ, এই শাস্ত্রের ছাত্রদের জন্য শুধু রাবীদের নাম আলাদা করার উপকারিতা কম। পরে আমি তাদের ইচ্ছা পূরণ করতে মনস্থ করি এবং গ্ৰন্থটিকে এমনভাবে সংক্ষিপ্ত করি যাতে তাদের উদ্দেশ্যও অর্জিত হয় এবং কাঙ্খিত উপকারিতাও আরো বেশি বৃদ্ধি পায়। আর তা হলো, আমি প্রত্যেক রাবী সম্পর্কে সংক্ষিপ্ততম বাক্যে এবং স্পষ্টতম ইঙ্গিতে (সবচেয়ে সুপরিচিত পদবী কিংবা গুণ উল্লেখ করে) এমন একটি (পূর্ণাঙ্গ) রায় দিয়েছি, যা তাদের সম্পর্কে বলা সবচেয়ে সঠিক কথা এবং তাদের সম্পর্কে করা সবচেয়ে ন্যায়সঙ্গত উক্তি। (আর খেয়াল রেখেছি) যাতে প্রতিটি রাবীর আলোচনা সাধারণত এক লাইনের বেশি না হয়।” [ভূমিকা: তাকরীবুত তাহযীব]
প্রিয় পাঠক, উপরের আলোচনা থেকে জানা গেল, মূলত এই গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য রাবীদের সুবিস্তৃত ইতিহাস জানানো নয় বরং রাবীদেরকে অতি সংক্ষেপে সঠিকভাবে চিহ্নিত করাই এই গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য। যার কারণে ইবনে হাজার গ্রন্থটি রচনা করার সময়ই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, সাধারণভাবে তিনি প্রতিটি রাবীর আলোচনা এক লাইনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবেন। আর রাবী সম্পর্কে সে কথাটাই তিনি উল্লেখ করবেন যা তার সম্পর্কে বলা সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ ও ন্যায়সঙ্গত হবে। বিশেষ করে হাদীসের ছাত্ররা যেন এই এক লাইনের সুসংক্ষিপ্ত মন্তব্যের মাধ্যমেই তাকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়।
ফলে এই সুসংক্ষিপ্ত গ্রন্থ ‘তাকরীবুত তাহযীব’ এর মধ্যে ইমাম আবূ হানীফাহ’র সম্পর্কে শুধু এ কথা বলাটাই সবচেয়ে সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত ছিল যে, ‘তিনি একজন সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ’! কারণ, ‘আবূ হানীফাহ’ নামে একাধিক রাবী আছে! এই কারণে তিনি তাঁর নামের সাথে ‘সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ’ যুক্ত করে দিয়েছেন যাতে করে এক কথাতেই তার পরিচিতি জানা যায়! তাছাড়া ইমাম আবূ হানীফাহ’র পরিচিতির জন্য এর চেয়ে বড় পরিচয় এর কোনো প্রয়োজনও নেই। মূলত ‘সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ’ বাক্যটাই তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়! এ কারণেই তিনি এই বাক্যটিকেই বেছে নিয়েছেন।
সুতরাং আলবানীর মত লোকেরা যদি বলে যে, হাফেয ইবনে হাজার ’তাকরীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে ইমাম আবূ হানীফাহ’র ব্যাপারে ‘সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ’ বলেই ক্ষান্ত ছিলেন, যা তার দুর্বল হওয়ার প্রমাণ! তাহলে এটা তার অল্পবিদ্যার বহিঃপ্রকাশই মাত্র!
অথচ ইবনে হাজার রহ. তাঁর অন্যান্য গ্রন্থে ইমাম আবূ হানীফাহ’র ভরপুর প্রশংসা করেছেন এবং সুবিস্তৃত আলোচনা করেছেন! এবং তিনি তার ভালো বিষয় ছাড়া অন্য কোন বিষয় মোটেই উল্লেখ করেননি।
যেমন তিনি তাঁর ‘তাহযীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে পৃষ্ঠাব্যাপী ইমাম আবূ হানীফাহ’র সুবিস্তৃত আলোচনা ও গুণাবলী উল্লেখ করার পর নিজস্ব বক্তব্য প্রদান করেন যে,
مناقب الإمام أبي حنيفة كثيرة جدًّا؛ فرضِيَ الله تعالى عنه، وأسكنه الفردوسَ، آمين
আবূ হানীফাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর গুণাবলী ‘কাছীরাতুন জিদ্দান’! তথা তিনি অগণিত গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হোন। তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউছে স্থান দিন। আমীন। [তাহযীবুত তাহযীব: ৫/৬৩১]
শুধু এই না, ইবনু হাজার আসকালানীর দৃষ্টিতে ইমাম আবূ হানীফাহ (রহ.) এর ব্যাপারে অন্যদের জারহ গ্রহণযোগ্যও নয়। এ কারণেই যখন তাঁকে তাঁর ছাত্র হাফিয সাখাবী (রহ.) জিজ্ঞেস করলেন, “নাসাঈ ইমাম আবূ হানীফাহ’র ব্যাপারে বলেছেন যে, তিনি হাদীসে শক্তিশালী নন”। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী, তা কি আদৌ সঠিক?
উত্তরে ইবনু হাজার (রহ.) বললেন, “নাসাঈ যা বলেছেন, তা তাঁর বাহ্যিক জ্ঞান ও নিজস্ব ইজতিহাদ অনুযায়ী বলেছেন। মনে রেখো, প্রত্যেক ব্যক্তির প্রত্যেক কথাই মেনে নেওয়া হবে ব্যাপারটা এমন নয় (অর্থাৎ ইমাম আবূ হানীফাহ-কে নাসাঈর দুর্বল বলাটা গ্রহণযোগ্য নয়)।
এরপর তিনি আরো বলেন, “প্রথমে তাঁর ব্যাপারে এমনটা বলা হলেও পরবর্তীতে নাসাঈ ও পরবর্তীকালের ইমামগণ ঐসব কথা থেকে ফিরেও এসেছেন। কারণ, তাঁরা দেখলেন যে, ইমাম আবূ হানীফাহ (রহ.) শ্রবণের পর থেকে হুবহু মুখস্থ রাখা ব্যতীত কোনো হাদীস বর্ণনা করতেন না।” [আল-জাওহার ওয়াদ দুরার ফী তারজামাতি ইবনু হাজার: ২/৯৪৭]
তিনি এখানেই ক্ষান্ত নন, বরং ইমাম আবূ হানীফাহ সম্পর্কে তথাকথিত জারহ-চর্চা করা যাবে কিনা- এ সম্পর্কেও তিনি সুন্দর উপদেশ দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে তিনি তাঁর ছাত্রের উদ্দেশ্যে বলেন-
وفي الجملة، تَرْكُ الخَوْضِ في مثل هذا أولى، فإنَّ الإمامَ وأمثالَه ممَّن قفزوا القَنْطَرَة، فما صار يُؤَثِّرُ في أحد منهم قولُ أحدٍ، بل هم في الدرجة التي رفعهم اللَّه تعالى إليها مِنْ كونهم متبوعين مقتدى بهم، فليُعتَمَدْ هذا، واللَّه ولي التوفيق
অর্থ: সারকথা হলো, এমন ধরনের বিষয়ে (ইমাম আ’যমের জারহ/সমালোচনায়) ডুবে থাকা ও অনর্থক কথাবার্তা ত্যাগ করাই উত্তম। কারণ, ইমাম আবূ হানীফাহ ও তাঁর মতো ইমামগণ সেতু পার করে ফেলেছেন। অতএব তাদের ব্যাপারে কারোরই কোনো সমালোচনা (জারহ) প্রভাব ফেলবে না। বরং, তারা তো সেই উঁচু স্তরে রয়েছেন যে স্তরে সর্বশক্তিমান আল্লাহই তাদের উঠিয়েছেন। ফলে তাঁরা মানুষের অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হয়েছেন! অতএব সকলকে এটিতেই বিশ্বাসী থাকতে হবে। আর আল্লাহই একমাত্র সফলতা দানকারী। [আল-জাওহার ওয়াদ দুরার ফী তারজামাতি ইবনু হাজার: ২/৯৪৭]

যাইহোক, ইবনে হাজার (রহ.) ইমাম আবূ হানীফাহ (রহ.) এর ব্যাপারে এত এত প্রশংসা ও দিফা‘ করলেও আলবানীর সেসব চোখে পড়েনি! আলবানী শুধু তাঁর ‘তাকরীব’ গ্রন্থটাই দেখেছেন, যেখানে তিনি সংক্ষিপ্ততার লক্ষ্যে শুধুমাত্র একটি বাক্যে তাঁর পরিচয় দিয়েছেন!
লিখেছেন, লুবাব হাসান সাফওয়ান (হাফিঃ)