উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর বিবাহের সঠিক বয়স সম্পর্কে,
প্রশ্ন : উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এর বিয়ে কত বছর বয়সে হয়েছিল?
উত্তর : হযরত আয়েশা (রা.) এর জন্ম হয়েছিল রাসূল (সা.) নবুওয়ত লাভ করার ৫ বছর পূর্বে ও ৬০৪ খ্রিস্টাব্দে এবং বিয়ে হয় দ্বিতীয় হিজরী সনে বদর যুদ্ধের পর শাওয়াল মাসে অর্থাৎ ৬২৩-৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে। হয়ত কেউ কেউ বলতে পারেন যে, এটি শুধু আমিই দাবী করছি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বহু গবেষকেরও এ বিষয়ে অভিন্ন বয়ান রয়েছে। আরবী ভাষার প্রসিদ্ধ পত্রিকা ‘আশ্ শিরকুল আওসাত’ তারিখ ৬ই সেপ্টেম্বর ২০০৮ দেখুন। আরও দেখুন, মিসরীয় আরবি সাহিত্যিক أحمد شوقي عبد السلام ضيف এর রচনা محمد خاتم المرسلين পৃষ্ঠা নং ১৭১।
- উল্লেখ্য, ইমাম যুরকানী, ইমাম ইবনে হাজার লিখেছেন, আম্মাজান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা জন্ম গ্রহণ করেছিলেন নবুওয়তের চতুর্থ বা পঞ্চমতম বর্ষে ৬১৩ খ্রিস্টাব্দে। (শরহে যুরকানী ৪/৩৯২)। কিন্তু ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর মতে নবুওয়তের পঞ্চমতম বর্ষে সূরা আল ক্বমর অবতীর্ণ হয় আর আম্মাজানের ভাষ্যমতে, তা অবতীর্ণ হওয়ার সময় তিনি জারিয়াহ বা কিশোরী ছিলেন। ফলে স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে যে, আম্মাজানের সুনির্দিষ্ট জন্মসন নিয়ে গবেষকদের জন্য মতভেদে জড়ানো খুবই স্বাভাবিক।
সহীহ বুখারীতে এসেছে, আল কোরআনের ৫৪ তম অধ্যায় নাযিলকালে আয়েশা (রা.) একজন কিশোরী (جارية) ছিলেন। যেমন হযরত আয়েশা (রা.) বলেন,
بَلِ ٱلسَّاعَةُ مَوْعِدُهُمْ وَٱلسَّاعَةُ أَدْهَىٰ وَأَمَرُّ
অর্থাৎ বরং কিয়ামত তাদের শাস্তির নির্ধারিত সময়। আর কিয়ামত হবে কঠিনতর ও তিক্তকর।
আয়াতটি যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি মক্কায় নাযিল হয়েছিল তখন আমি কিশোরী ছিলাম, খেলা-ধুলা করতাম।
সহীহ বুখারী, কিতাবুত তাফসীর অধ্যায় নং ৫২, হাদীস নং ৪৫১২ (ইফা)।
এখন জানবো যে, কত বছরে উপনীত হলে একজন কিশোরী কে ‘মহিলা’ বলা হবে?
এ সম্পর্কে আম্মাজান আয়েশা (রা.) নিজেই বলেছেন,
إِذَا بَلَغَتِ الْجَارِيَةُ تِسْعَ سِنِينَ فَهِيَ امْرَأَةٌ
অর্থাৎ কোনো কিশোরী যখন নয় বছর বয়সে উপনীত হয়, সে তখন (কিশোরীর স্ট্যান্ডার্ড বয়সসীমা পেরিয়ে) ‘মহিলা’ হয়। (জামে তিরমিযি হাদীস ১১০৯)।
এবার দেখা যাবে যে,
সর্বসম্মত মুসলিম স্কলারদের মতে ৫৪তম উক্ত অধ্যায় (সূরা আল-ক্বমর) নাযিল হয় মক্কায় মুশরিকদের একটি প্রশ্নের জবাবে (সহীহ মুসলিম)। আনুমানিক ৬১৫ খৃষ্টাব্দের দিকে (তাফসিরে কুরতুবী, সূরা ক্বমার আয়াত নং ২৪ দ্রষ্টব্য)। অর্থাৎ সূরা আত-ত্বরিক আর সূরা ছোয়াদ নাযিলের পর নবুওয়তের পঞ্চমবর্ষে। রঈসুল মুফাসসিরীন হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) নিজেও বলেছেন,
قال ابن عباس: كان بين نزول هذه الآية وبين بدر سبع سنين؛ فالآية على هذا مكية. وفي البخاري عن عائشة أم المؤمنين رضى الله عنها قالت: لقد أنزل على محمد صلى الله عليه وسلم بمكة وإني لجارية ألعب
অর্থাৎ বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হওয়া আর এই সূরাটি নাযিল হওয়া উভয়ের মধ্যখানে সাত (৭) বছরের তফাৎ রয়েছে। আর এই ক্ষেত্রে আয়াতটি মক্কায় নাযিল হয়। এবং বুখারীতে এসেছে যে, উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত আছে, আয়াতটি যখন মক্কায় নাযিল হয় তখন আমি কিশোরী ছিলাম, খেলা করতাম।
শেষকথা– দীর্ঘ তথ্য উপাত্ত হতে পরিষ্কার সাব্যস্ত হচ্ছে যে, হযরত আয়েশা (রা.) ৬১৫ খ্রিস্টাব্দেও ৯ বছর বয়সের একজন কিশোরী ছিলেন। আর যখন ৬২৩ বা ৬২৪ সালে উনার বিবাহ হয় তখন উনি ১৭-১৮ বছরের তরুণী ছিলেন বলা যায়। কাজেই ৬ বছর বয়সে বিবাহ সংক্রান্ত বর্ণনাটি শাজ ও মারজূ।
শাজ হাদীস সম্পর্কে হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ্ বলেছেন,
“مخالفة المقبول لمن هو أولى منه” (النزهة:صـ٩٨ )
অর্থাৎ মাকবুল রাবীর তার চেয়ে উত্তম রাবীর বিরোধিতা করা শাজ”। এখানে মাকবুল দ্বারা উদ্দেশ্য সহীহ ও হাসান হাদীসের রাবী আর উত্তম দ্বারা উদ্দেশ্য এক বা একাধিক সেকাহ রাবী। অর্থাৎ মাকবুল রাবী একাধিক মাকবুল কিংবা অধিক সেকাহ রাবীর বিরোধিতা করলে তার হাদীস শাজ। (আন-নুযহাহ পৃ. ৯৮)।
- বলে রাখা জরুরি, উপরের সম্পূর্ণ গবেষণাটি আমার একার নয়। তবে এ গবেষণা অবশ্যই উম্মাহ’র সংখ্যাগরিষ্ঠ ইমামগণের বুঝের পরিপন্থী। আর আমি বলিনা যে, আমার এ গবেষণা সবাইকে মানতে হবে। আমি বিশ্বাস করি যে, সালফে সালেহীনের গবেষণা ও বুঝের বিপরীতে নতুন যে কোনো গবেষণাই অনিরাপদ। তাই সকলের উচিত, বিচ্ছিন্ন মতগুলো এড়িয়ে চলা। উম্মাহার সর্বসম্মত ও প্রতিষ্ঠিত মতকেই গ্রহণ করা। হ্যাঁ, শুধুমাত্র সাহিত্য চর্চার উদ্দেশ্যেই নতুন কোনো গবেষণার দিকে ধাবিত হওয়া যেতে পারে। আর তখন সেটি অবশ্যই দালিলিক এবং সততার সাথেই হতে হবে।
সর্বশেষ সংশোধন ও পরিমার্জন ২০-০৫-২০২৫ ইং, বাংলাদেশ সময় রোজ মঙ্গলবার।
লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক