Home সাধারণ আকাশে মৃতদের সাথে জীবিত ব্যক্তিও থাকতে পারা

আকাশে মৃতদের সাথে জীবিত ব্যক্তিও থাকতে পারা

0
আকাশে মৃতদের সাথে জীবিত ব্যক্তিও থাকতে পারা

প্রশ্নকর্তা : ঈসা (আঃ) দ্বিতীয় আসমানে জীবিত আছেন, এর দলিল দিন! তারপর একটি প্রশ্নের উত্তর দিন, ঈসা (আঃ) যদি দ্বিতীয় আসমানে জীবিত থেকে থাকেন তাহলে তো মানতে হবে যে, আসমানে অন্যান্য মৃতদের সাথেই জীবিত রয়েছেন! অথচ মৃত আর জীবিত একত্রে থাকতে পারেনা! এর কী জবাব?

উত্তর : আপনার প্রশ্নের উত্তরে একটু পরে আসছি। তার আগে আমাকে দুটি প্রশ্নের উত্তর দিন! (১) মৃত আর জীবিত একত্রে থাকতে পারেনা, এই কথার দলিল কী? কুরান হাদীসে কি এমন কোনো কথা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেও এসেছে? (২) তর্কের খাতিরে মানলাম যে, আকাশে মৃতদের সাথে জীবিতরা একত্র হওয়া সম্ভব না! এমতাবস্থায় মেরাজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও কি মৃত ছিলেন যে, ফলে তাঁর পক্ষে সাত আসমানে মৃত নবীগণের সাথে সাক্ষাৎ করা সম্ভব হয়েছিল!?

এবার প্রাসঙ্গিক আলোচনায় চলুন! হযরত ঈসা (আঃ) দ্বিতীয় আসমানে থাকা মর্মে সহীহ বুখারীতে এসেছে “ছুম্মা ছ’য়িদা হাত্তা আতাস সামায়াছ ছানিয়াহ” অর্থাৎ অতপর (জিবরাইল আমাকে নিয়ে) দ্বিতীয় আকাশে এসে পৌঁছলেন। (রাসূল সাঃ আরো বলেন) “ফালাম্মা খালাছতু ফা ইযা ইয়াহইয়া ওয়া ঈসা ওয়া হুমা ইবনা খা-লাতিন।” অর্থাৎ এরপর আমরা যখন সেখানে পৌঁছলাম তখন সেখানে ইয়াহইয়া এবং ঈসা আলাইহিমাস সালাম-কে দেখলাম। তাঁরা উভয়ই খালাত ভাই। দেখুন, সহীহ বুখারী কিতাবু আ-হাদীসিল আম্বিয়া, অধ্যায় ৫০; হা/৩১৮৯ (ইফা)।

প্রাপ্ত শিক্ষা ও কাদিয়ানী যুক্তির খন্ডন : উপরের হাদীস আমাদের বলছে, ঈসা আঃ বর্তমানে দ্বিতীয় আকাশে স্বশরীরে জীবিত। কিন্তু প্রশ্ন হল, তবে কি অন্যান্য নবীগণও আকাশে স্বশরীরে জীবিত?

উত্তরে বলব, না, বরং শুধুমাত্র ঈসা (আঃ)-ই দ্বিতীয় আকাশে স্বশরীরে জীবিত! তার কারণ প্রথমত বহু সহীহ হাদীসে এসেছে আল্লাহতালা ঈসা (আঃ)-কে স্বশরীরে আকাশে জীবিত উঠিয়ে নিয়েছেন এবং তিনি শীঘ্রই পৃথিবীতে ফিরে আসবেন (আত-ত্ববকাতুল কোবরা লি-ইবনে সা’আদ ১/৩৬-৩৭ দ্রষ্টব্য)। কিন্তু এইভাবে কোনো কথাই অন্যান্য নবীগণ সম্পর্কে কোনো হাদীসে পাওয়া যায়না। দ্বিতীয়ত, মেরাজের আরেকটি হাদীসে পরিষ্কার উল্লেখ আছে যে, হযরত ঈসা (আঃ) বলেছেন, আল্লাহ তাঁর কাছ থেকে দুনিয়াতে পুনরায় ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন। একথা সুনানু ইবনে মাজাহ’র হাদীসেও এসেছে। হাদীসের ভাষ্য : “ফা-রুদ্দাল হাদীসু ইলা ঈসা ইবনে মরিয়ম ফা-ক্বলা ক্বদ ও’হিদা ইলাইয়্যা ফী-মা দূনা ওয়াজবাতিহা ফা-আম্মা ওয়াজবাতুহা ফা-লা ই’য়ালামুহা ইল্লাল্লাহু”। অর্থাৎ অতপর (কেয়ামতের) বিষয়টি ঈসা বিন মরিয়ম (আঃ)-এর নিকট পেশ করা হলে তিনি বলেন, আমার থেকে কেয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে দুনিয়াতে প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি নেয়া হয়েছে। কিন্তু কেয়ামতের সঠিক জ্ঞান আল্লাহ ব্যতীত কারো কাছে নেই। (ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৪০৮১)। কিন্তু অন্য আর কোনো নবী-ই এইধরনের কোনো কথা বলেননি। এই সমস্ত কারণে কাদিয়ানীদের উক্ত প্রশ্ন – তবে কি অন্যান্য নবীগণও স্বশরীরে জীবিত, এটি সম্পূর্ণরূপে বাতিল। সংক্ষেপে।

তাদের আরেকটি যুক্তি হল, মৃত আর জীবিত একত্রে থাকতে পারেনা। তাই ইয়াহইয়া (আঃ) আর সাথে অবস্থানকারী ঈসা (আঃ) তিনিও মৃত প্রমাণিত! আমার জবাব, (১) পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে উল্লেখ আছে, মৃতরা কেয়ামতের আগে পুনরায় ফিরে আসবেনা। অথচ রাসূল (সাঃ) সহীহ বুখারীর কিতাবুল আম্বিয়া অংশে ঈসা (আঃ) সম্পর্কে শপথ করে ভবিষ্যৎবাণী দিয়ে বলেছেন, ঈসা (আঃ) অচিরেই নাযিল হবেন। সুনানে ইবনে মাজাহ’র উক্ত হাদীসেও আপনারা দেখেছেন, ঈসা (আঃ) নিজেই নিজের পুনরায় ফিরে আসা সম্পর্কে প্রতিশ্রুতির কথা জানান দিয়েছেন। এখন মির্যায়ী উক্ত যুক্তি বাতিল না হলে তখন কাদিয়ানীদের নিকট নিচের প্রশ্নটির আর কোনো জবাব থাকেনা! প্রশ্নটি হল, তবে কি প্রতিশ্রুত সেই ঈসা ইবনে মরিয়ম পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য আকাশে আবার জীবিত হবেন? (২) তর্কের খাতিরে মানলাম, দ্বিতীয় আকাশে ইয়াহইয়া (আঃ) আর ঈসা (আঃ) দুইজনই মৃত, কিন্তু সেই দুই মৃত ব্যক্তির সাথে নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাক্ষাৎ কিভাবে সম্ভব হল? নাকি এবার মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাক্ষাতকেও অস্বীকার করে বসবেন? দয়া করে ধূর্ত মির্যায়ী উগরানো বমি অন্ধের মতো না ছেঁটে নিজের মগজটা এবার একটু খাটাবেন! সত্য বলতে, মৃত আর জীবিত একত্রে থাকতে পারেনা, মির্যায়ী এই অপযুক্তি মূলত রাসূল (সাঃ) এর হাদীসকে অমান্য করার বড় চালাকি বৈ কিছুই না!

সেযাইহোক, আপনাদের উল্লিখিত যুক্তির খন্ডনে আমি শুধু একটি প্রশ্ন করব।

আপনাদের যুক্তি হল, মৃত আর জীবিত একত্রে থাকতে পারেনা! তাই আমার পাল্টা প্রশ্ন, আপনাদের উক্ত যুক্তি যদি সঠিক হয় তাহলে বায়তুল মুকাদ্দাসে আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ)-এর পক্ষে আপনা জীবিত অবস্থায় সেখানে মৃত্যুবরণকারী অন্যান্য নবীগণের সাথে একত্রিত হওয়া কিভাবে সম্ভব হল? তিনি (সাঃ) তো বায়তুল মুকাদ্দাসে আগত সমস্ত নবীর নামাযের ইমামতিও করেছিলেন। ফলে তিনি ‘ইমামুল আম্বিয়া’ উপাধিতে ভূষিত হন। কাজেই মৃত আর জীবিত একত্রে থাকতে পারেনা, এটি একটি বাতিল ও দুর্বল যুক্তি বৈ নয়।

এবার প্রাসঙ্গিক বিষয়ে একজন যুগ ইমামের উদ্ধৃতি তুলে ধরব। শায়খ ইবনুল কাইয়্যুম রহঃ লিখেছেন :

أُسْرِىَ برسول الله ـ صلى الله عليه وسلم ـ بجسده على الصحيح من المسجد الحرام إلى بيت المقدس، راكبًا على البُرَاق، صحبة جبريل ـ عليهما الصلاة والسلام ـ، فنزل هناك، وصلى بالأنبياء إمامًا، وربط البراق بحلقة باب المسجد‏، ثم عرج به تلك الليلة من بيت المقدس إلى السماء الدنيا

অর্থাৎ সহীহ হাদীস অনুসারে রাসূল সাঃ এর ইসরাহ (ঊর্ধ্ব জগত ভ্রমণ) হযরত জিবরাঈল আঃ এর সাহচর্যে থেকে স্বশরীরে ও মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্বসা পর্যন্ত বোরাক যোগে আরোহন অবস্থায় সংঘটিত হয়েছিল। অতপর তিনি বোরাক থেকে নিচে অবতারণ করেন এবং বোরাককে মসজিদুল আকসার এক কোণে বেধে (সেই বরকতময় রাতে সম্মিলিত) নবীগণকে নিয়ে ইমামতির মাধ্যমে তিনি সালাত আদায় করেন। অতপর তিনি জিবরাইলের সাথে বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে প্রথম আসমানের উদ্দেশ্যে ঊর্ধ্বাকাশে পাড়ি দেন। (রেফারেন্স : যাদুল মা’আদ পৃষ্ঠা নং ৪৭)। এবার হয়ত প্রসঙ্গ এড়িয়ে আপনা জান ছুটাতে আপনারা মেরাজ স্বশরীরে জাগ্রত অবস্থায় হওয়া-ও অস্বীকার করতে পারেন। তখন উত্তরে বলব, এই সম্পর্কে আপনাদের নিকটেও মুজাদ্দিদ ও যুগ ইমাম হিসেবে মাননীয় শায়খ ইবনুল কাইয়্যুম (রহঃ) এর উদ্ধৃতি দ্বারা একটু আগেই মেরাজ স্বশরীরে হওয়ার প্রমাণ দেখেছেন। এই পর্যায় আপনাদের মির্যা কাদিয়ানীর মেরাজ সংক্রান্ত একটি উদ্ধৃতি পেশ করে আজকের মত আলোচনা এখানেই শেষ করব, ইনশাআল্লাহ।

মেরাজ সম্পর্কে মির্যা কাদিয়ানী তার “মালফূযাত” বইতে লিখেছেন,

উর্দু উচ্চারণ : হামারা ইয়ে মাযহাব হারগেয নিহি কে উয়ো এক খাব থা ইয়া স্রেফ রূহ গী, বলকে হাম তু কাহাতে হেঁ কে রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কো আঈনে বিদারী মে মেরাজ হুয়া আওর এক লতিফ জিসিম বিহি সাথ থা। “অর্থাৎ মেরাজ স্বপ্নযোগে বা আধ্যাত্মিকভাবে হয়েছিল এটা আমাদের মতামত নয়, বরং আমরা তো বলে থাকি যে, মেরাজ জাগ্রত অবস্থায় হয়েছিল এবং সূক্ষ্মতর একটি শরীরও সাথে ছিল।” (মির্যা কাদিয়ানীর রচিত মালফূযাত [উর্দু] খন্ড ৫ পৃষ্ঠা ১৩৪; নতুন এডিশন)।

এখানে বলে রাখা দরকার, মির্যার উল্লিখিত বক্তব্যে মেরাজ যে, স্বপ্নযোগে ছিলনা, বরং জাগ্রত অবস্থায়ই ছিল; অন্তত এইটুকু তো পরিষ্কার হল। তারপর বাকি থাকল “সূক্ষ্ণতর শরীর” বিষয়টি। আমি বলি, সূক্ষ্মতর শরীর এর ব্যাখ্যা আর যাইহোক না কেন, অন্ততপক্ষে মেরাজ যে “জাগ্রত অবস্থায়”-তেও হয়েছিল তা কিন্তু কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারেন না! আল্লাহ আমাদেরকে সত্যটা যতই কঠিন হোক তা যেন সহজেই বুঝার এবং গ্রহণ করার তাওফিক দিন, আমীন।

লিখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here