- মির্যা কাদিয়ানীর স্ববিরোধী কথাবার্তার বদনাম ঘোচাতে রাসূল (সাঃ) এর হাদীসের উপর কাদিয়ানীদের আপত্তি ও তার খন্ডন!
কাদিয়ানীদের আপত্তিমূলক প্রশ্নটি হল, হাদীসে এসেছে, রাসূল (সা:) বলেছেন, যে আমাকে ইউনুছ ইবনে মাত্তা অপেক্ষা উত্তম বলবে সে মিথ্যা বলল । (তিরমিযী হা/৩২৪৫)। অথচ তিনি (সা:) আরেক হাদীসে ইরশাদ করেছেন, আমি সমস্ত বনী আদমের সর্দার কিন্তু তাতে আমার নিজের কোনো গৌরব নেই… (তিরমিযী হা/৩৬১৫)। বাহ্যিকভাবে তিনি (সা:) স্ববিরোধী উক্তি করলেন কিনা? এমতাবস্থায় মির্যা কাদিয়ানীর ক্ষেত্রে কিজন্য স্ববিরোধী উক্তির আপত্তি করা হবে??
জবাব ও খন্ডনঃ উপরের বক্তব্য দু’টির জবাব বিশিষ্ট যুগ ইমাম ও মুহাদ্দিস মোল্লা আলী ক্বারী (রহ:) এর কিতাব “মেরকাত শরহে মেশকাত” থেকে নিচে অনুবাদ আকারে তুলে ধরছি।
(مَنْ قَالَ: أَنَا خَيْرٌ) أَيْ: فِي النُّبُوَّةِ (مِنْ يُونُسَ بْنِ مَتَّى لَقَدْ كَذَبَ) : لِأَنَّ الْأَنْبِيَاءَ كُلَّهُمْ مُتَسَاوُونَ فِي مَرْتَبَةِ النُّبُوَّةِ، وَإِنَّمَا التَّفَاضُلُ بِاعْتِبَارِ الدَّرَجَاتِ، وَخُصَّ يُونُسُ بِالذِّكْرِ لِأَنَّ اللَّهَ تَعَالَى وَصَفَهُ بِأَوْصَافٍ تُوهِمُ انْحِطَاطَ رُتْبَتِهِ حَيْثُ قَالَ: (فَظَنَّ أَنْ لَنْ نَقْدِرَ عَلَيْهِ)
অর্থাৎ, রাসূল (সা:) এর বাণী “যে বলবে আমি ইউনুছ ইবনে মাত্তা অপেক্ষা উত্তম…”—এই কথাটি মূলত শুধুই নবুওয়তের ক্ষেত্রে ধর্তব্য হবে। ফলে তার অর্থ দাঁড়ায়, যে ব্যক্তি বলবে আমি ইউনুছ ইবনে মাত্তা অপেক্ষা নবুওয়তের ক্ষেত্রেও উত্তম তবে সেই ব্যক্তি মিথ্যা বলল। কেননা নবীগণের সকলে নবুওয়তের মর্যাদায় এক ও অভিন্ন। তবে কতিপয় সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিকোণ থেকে বিশেষত্ব নিশ্চয়ই রয়েছে। এক্ষেত্রে ইউনুছ (আ:) এর বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ হল, আল্লাহতালা পবিত্র কুরআনে তাঁকে নানা বিশেষণ দ্বারা বিশেষিত করে তাঁর মর্যাদা বর্ণনা করেছেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: فَظَنَّ أَنْ لَنْ نَقْدِرَ عَلَيْهِ অর্থাৎ সে (ইউনুছ) মনে করেছিল আমি তাঁর উপর (পৃথিবীটা) কখনোই সংকীর্ণ করব না। (মেরকাত শরহে মেশকাত : ৯/৩৬৪৫)।
- মহাগ্রন্থ আল কুরআন থেকেও রাসূল (সা:) এর উল্লিখিত হাদীস দুইখানার পক্ষে সমর্থন পাওয়া যায়। যেমন যথাক্রমে ২টি আয়াত :
আল্লাহতালা বলেন: لا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّن رُّسُلِهِ অর্থঃ তাহারা বলে, আমরা তাহার রাসূলগণের মধ্যে কোনো পার্থক্য করিনা (সূরা বাক্বারা ২৮৫)। অন্য জায়গায় এসেছে, আল্লাহ বলেন: تلك الرسل فضلنا بعضهم على بعض অর্থঃ এই রাসূলগণ, তাহাদের মধ্যে কাহাকেও কাহারও উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়াছি (সূরা বাকারা ২৫৩)।
খুব খেয়াল করুন, সূরা বাক্বারার ২৮৫ নং আয়াতে নবীদের মাঝে পার্থক্য নিরূপণ না করা সম্পর্কে উল্লেখ আছে। তারপর অন্য আয়াতে নবীগণের মাঝে পরস্পর অপেক্ষা বিশেষভাবে মর্যাদাবান বলেও উল্লেখ রয়েছে। তাই মোল্লা আলী কারী (রহ:) একজন যুগ ইমাম হিসেবে যেই ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন সেটি পবিত্র কুরআনের আলোকেই দিয়ে গেছেন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। কেননা স্বয়ং মির্যা কাদিয়ানী নিজেও লিখেছে, মুজাদ্দিদ ব্যক্তি কুরআনের বুঝপ্রাপ্ত হন এবং ঐশী নিদর্শনসহ আগমন করে থাকেন। (রূহানী খাযায়েন ১৪/২৮৮) সুতরাং আপনাদের উত্থাপিত আপত্তি পুরোপুরি অসার সাব্যস্ত হল। বিশিষ্ট মুফাসসীর, ইমাম কুরতুবী (রহ:) এর বক্তব্য হতেও হুবহু এমন ব্যাখ্যাই পাওয়া যায়। নিচে দেখুন!
ইমাম কুরতুবী (রহ:) লিখেছেন: ‘আন্নাল মান’আ মিনাত তাফদ্বীল। ইন্নামা হুয়া মিন জিহাতিন নাবুওয়্যাতি আল্লাতি হিয়া খাছলাতুন ওয়াহিদাতুন। লা তাফাদ্বালা ফীহা। ওয়াত তাফদ্বীলু ফী যিয়াদাতিল আহওয়াল ওয়াল খুছূছ ওয়াল কারামাত ওয়াল আল-ত্বাফ।’ অর্থাৎ অবশ্যই নবীগণের এককে অন্যের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিতে নিষেধ রয়েছে। আর তা নিশ্চিতভাবে ও শুধু কেবল নবুওয়তের ক্ষেত্রে। যেহেতু নবুওতের ক্ষেত্রে সবার মান সমান। তাতে কেউ অন্যের উপর শেষ্ঠত্ব রাখেনা। অধিকন্তু শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে, কতেক বিশেষত্ব, সম্মান আর দয়ার আধিক্যতার ক্ষেত্রে। (আল মুয়াসসাসাতুল ফিকহিয়্যাহ : ৪০/৪৯)। আশাকরি যুগ ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী আর ইমাম কুরতুবী রাহিমাহুমাল্লাহু দুইজনের জ্ঞানগর্ভ সামঞ্জস্যতার বিধান ও বিশ্লেষণ দ্বারা সমাধান পেলেন।
জ্ঞানীদের নিকট পরিস্কার যে, মূলত হাদীস দুটির ভেতরে কোনো স্ববিরোধিতা নেই। কাজেই মির্যা কাদিয়ানীর স্ববিরোধী কথাবার্তা হালাল করতে হাদীসের উপর আক্রমণ করার চেষ্টা পুরোপুরি বৃথা গেল! সংক্ষেপে উত্তর দিলাম।
লিখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী।